ব্রডওয়েতে যেভাবে অপেরার ভূত দেখতে পেলাম

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 16 Sept 2018, 09:45 AM
Updated : 16 Sept 2018, 09:45 AM

সত্যি বলতে কি, ন্যু ইয়র্কে গিয়ে নাটক দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার ছিল না। বহু বছর যাবৎ যে-কারণে সিনেমা দেখা হয় না, অনেকটা একই কারণে নাটক দেখা হয় না। আমার আগ্রহের কেন্দ্রে গুটেনবার্গ একটু বেশি জায়গা করে নিয়েছে। আর এখন এই বয়সে শিল্পের অন্য যেকোনা মাধ্যমের চেয়ে গ্রন্থধৃত শিল্পকর্মগুলোই আমাকে বেশি আকৃষ্ট করে। যদিও এরই মধ্যে নাটক না-দেখলেও সিনেমা আমি দেখেছি, এর কারণ নাটকের তুলনায়–অন্তত দেখার তৃপ্তি বেশি বলেই–সিনেমা দেখেছি। বাংলাদেশে আমার সর্বশেষ নাটক, মানে মঞ্চনাটক দেখার অভিজ্ঞতা জামিল আহমেদের বিষাদসিন্দু। ঠিক ওই কাছাকাছি সময়েই আরেকটি নাটক দেখেছিলাম–নামটা মনে নেই, তবে সেটি ছিল ইংরেজ কোনো অভিনেতার অভিনীত শেক্সপিয়রের কোন একটি নাটক, সম্ভবত ম্যাকবেথ –একক অভিনয়ে বহুচরিত্র। ভদ্রলোক–তার নামটা ভুলে গিছে–অসামান্য অভিনয় করেছিলেন। অামি অভিভূত হয়েছিলাম বিষাদসিন্দু ও ওই শেক্সপিয়রে। তার অল্প পরেই চলে গিয়েছিলাম দূর পৃথিবীর গন্ধে অন্য এক প্রান্তের টানে। সেখানেও নাটক দেখার দেদার সুযোগ ছিল কিন্তু ইচ্ছে করেই দেখিনি, প্রথমত নাটকের নাটুকেপনাকে অতিক্রম করে যদি তা মঞ্চায়িত হতে না পারে তাহলে সেটা আমার কাছে আবেদন তৈরি করে না। অভিনয়–শিল্পের কৃত্রিমতা যখন প্রাকৃতিকতা, অর্থাৎ সহজ স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন করতে পারে তখনই আমার কাছে তা উপভোগ্য হয়ে ওঠে। সেটা এদেশে কিংবা ওদেশেও কদাচিৎ ঘটে বলে আমি পারতপক্ষে মঞ্চ এড়িয়ে গেছি। সেই অাশংকা থেকেই আমি ব্রডওয়েতেও যেতে চাইনি। কিন্তু আমার বান্ধবী প্রাবন্ধিক, গবেষক ও অনুবাদক Maria Barrera-Agarwal–যিনি নজরুল ইসলামের কবিতা স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করেছেন– এতই বদ্ধপরিকর ছিল যে আমাকে সে ব্রডওয়েতে নাটক দেখিয়েই ছাড়বে।

আমি ন্যু ইয়র্ক যাবো জেনেই সে আমাকে না-জানিয়ে আগেভাবে টিকিট কেটে রেখেছিল। সেখানে পৌঁছামাত্রই আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি ব্রডওয়েতে নাটক দেখতে চাই কিনা। আমি সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিলাম, দেখ, নাটক দেখে আমি এই পরবাসে তিন ঘন্টা সময় নষ্ট করার চেয়ে তোমার সাথে আড্ডা দিতে পছন্দ করবো। সে বললো, সেটা তো হবেই, কিন্তু নাটকটা তোমার দেখা উচিৎ। নাটক নিয়ে আমার নিখিল নিরাবেগ ও নিরুৎসাহ তার জানা ছিল না বলে সে বোধহয় কিছুটা বিপাকেই পরে গিয়েছিল। কারণ, ধরেই নিয়েছিল, সাহিত্যের এত কিছুতে যার আগ্রহ, ব্রডওয়ের মতো অভিজাত জায়গায় নাটক দেখার আগ্রহ নিশ্চয়ই থাকবে। আর বাংলাদেশি মাত্রেই সেখানে যাওয়ার জন্য পাগল। এমন নয় যে নাটকে আমার আগ্রহ নেই, আছে, তবে তা কেবল পাঠোত্তীর্ণ নাটকের ক্ষেত্রে। আমি অবশ্য তাকে সেসব খোলসা করে বলিনি। ফলে আমার আগ্রহ থাকতে পারে বলেই আমার জন্য ২৫০ ডলার খরচ করে একটা টিকিট কিনে রেখেছে আগেভাগেই । আগেই কেনার কারণ নিউ ইয়র্কে আমার অবস্থানের সময়টা ধরাবাধা– সেটা সে আগেই জানতো। তাছাড়া ব্রডওয়ের টিকিট 'ওঠ ছেমড়ি তোর বিয়ে'র মতো নয় যে আপনি দিনের টিকেট দিনে দিনেই পেয়ে যাবেন। মারিয়া যে আমার জন্য আগেই এই প্রক্রিয়ায় টিকিট কিনে রেখেছে তা আমার একদমই জানা ছিল না। সে কারণেই আমি তাকে বললাম নাটক দেখার কোন আগ্রহ আমার নেই। তাছাড়া, নিজের দেশেই আমি ৫০০ টাকা দিয়ে নাটক দেখি না, সেখানে ২৫০ ডলার মানে বাংলাদেশি টাকায় ২০ হাজার টাকা দিয়ে নাটক দেখবো? যদিও টাকাটা আমি দিচ্ছি না, কিন্তু অামারই এক স্বজনের তো। আমার কাছে রীতিমত অর্থের অপচয় বলে মনে হয়। আমি মারিয়াকে বললামও সে কথা। মারিয়া আমার এই উত্তরে হতাশ হলেও হাল না ছেড়ে বললো, তুমি নাটকটা দেখ, তারপরে তুমি আমাকে বল।

এও বলেছিল Phantom of the opera ব্রডওয়েতে কেউ মিস করতে চায় না। ওর নাছোড় অভিলাষের কারণেই যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু সেই যাওয়া ছিল আরেক নাটকীয়তায় ভরা, কারণ টিকিটটা আমাকে সে ইমেইলে পাঠিয়ে বলেছিল, তুমি এটার একটা প্রিন্ট সঙ্গে নিয়ে যেও। ন্যু ইয়র্কে আমার( আমি যেহেতু ওই এলাকা সম্পর্কে অন্ধ) যষ্ঠি তাপস, তাই তাপসকে বললাম, ওস্তাদ, টিকিটের একটা প্রিন্ট করিয়ে নিন। তাপস বলবো, অসুবিধা নেই, ওখানে গিয়েই আমরা প্রিন্ট করিয়ে নেব। কিন্তু ঘটনা যা ঘটলো তাহলো, ওখানে গিয়ে প্রায় আধাঘন্টা যাবৎ এদিক সেদিক ঘুরেও এমন কোনো জায়গা পেলাম না যেখান থেকে ওই টিকিটের কোন প্রিন্ট করা যায়। ন্যু ইয়র্কবাসীর তো এসব দরকারও হয়না, কারণ সবতো মোবাইলেই এটে নিচ্ছে। আমরা একটু বুদ্ধি করে যদি ওই টিকিটটার একটা ছবি মোবাইলে তুলে নিয়ে আসতে পারতাম, তাহলেই হোত। কিন্তু যা হয়নি তা নিয়ে আর আহাজারি করে লাভ নেই। যাইহোক, এই প্রিন্টার না-পাওয়ায় আমি মনে মনে খুশীই হচ্ছিলাম। যাক, আমার ইচ্ছেরই জয় হচ্ছে। কিন্তু দায়িত্ব যেহেতু এখন তাপসের কাঁধে, সে তো আর এই দায়িত্বকে অচরিতার্থ রাখতে পারে না। প্রথমত দায়িত্ব বলে কথা, দ্বিতীয়ত আমি তার অতিথি, এতএব এখানে ব্যর্থতা নিদারুণ লজ্জার ব্যাপার। তাপস মরিয়া হয়ে সব রকম উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছে টাইম স্কয়ায়ের অলিগলিতে । সঙ্গে আছে তাপসের বন্ধু মনোজ সাহা। কিন্তু মনোজ এই অভিযানে যতটা না আগ্রহী, তারচেয়ে বেশি আগ্রহ চলমান শ্বেতাঙ্গিনীদের দেহের ভাঁজ আবিস্কারে। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত কোথায়ও কোনো সুরাহা না করতে পেরে তাপস ওর হাতের ফোনটিকে আমার হাতে সঁপে দিয়ে বললো, আপনার ইমেইল একাউন্টে ঢুকে টিকিটটা বের করুন। কিন্তু তাপস আমার মতোই মোবাইল ফোনে অজ্ঞ বলে, তার ইমেইল একাউন্ট থেকে সাইন আউট করতে পারছে না। কোথায় কোন জাগয়ায় গিয়ে সাইন আউট করতে হবে আমরা খুঁজে বের করতে পারছি না। ফেসবুকেও সেই একই অবস্থা। আর না পারা মানে আমার প্রবেশ রুদ্ধ। এদিকে নাটক শুরুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। তাপস অস্থির হয়ে উঠেছে তার দায়িত্ব ও প্রতিজ্ঞাকে বাস্তবায়িত করার জন্য। আমি মনে মনে মজা লুটছি তার এই অসহায়ত্বের, কারণ আমি তো দেখতে চাই না। আমার চাওয়ার সঙ্গে তাপসের ফোন সেটটিও যেন একাত্ব হয়ে বলতে চাচ্ছে নৈব নৈব চ। হলে ঢুকবার শেষ ঘন্টা বেজে উঠেছে । লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু টিকিট চেকারকে কী বলবো। অবশেষে পাশেই টিকিট কাউন্টারে গিয়ে তাপস বললো মারিয়ার নামে একটা টিকিট কাটা আছে, কিন্তু আমরা এটার কোন প্রিন্ট আনতে পারিনি। কাউন্টারের মেয়েটি বলবো, ঠিক আছে কোনো অসুবিধা নেই। তার পুরো নামটি বল। কিন্তু তাপস মারিয়ার পুরো নামটি বলতে না পারায় মেয়েটি সেটা খুঁজে পাচ্ছে না। মারিয়া বাররেরা নাকি মারিয়া এলেনা বাররেরা, নাকি মারিয়া এলেনা বাররেরা-আগারওয়াল—কে জানে কোন নামে সে টিকিট কিনেছে। বহুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর অবশ্য শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল।

হলে ঢুকে প্রথম দিকে আমার কাছে সত্যি সত্যি তেমন কিছু মনে হয়নি। খুব যে বড় কোনো হল—তা নয়, তবে সুন্দর, পরিপাটি এবং সুদৃশ্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই হল একেবারে কানায় কানায় ভরে গেল। আলো ক্রমে নিভে গেল, এ হল-মণ্ডল অন্ধকারে নিস্তব্ধ হলো। অনতিদূরে মঞ্চ, মঞ্চের উপরে কি যেন একটা, তা ধীরে ধীরে ছাদের দিকে উঠে গেল। যেন একটা মৌচাক ঝুলিয়ে রে্খেছে উপরে। সেটা থেকেই শুরু হলো ফ্যান্টম অব দ্য অপেরার নাট্যরস।


এই অপেরার সবাই যেন সেই শ্রমিক মৌমাছি যারা নাটকের মৌচাকে তাদের অভিনয়ের মধু জমা করছে। কী অদ্ভুদ তাদের অভিনয়-দক্ষতা। সংগীত, গানের কথা, পোষাক আশাক সবই ছিল নান্দনিকতায় উপচেপড়ার মতো। নাটক শুরুর আগে পর্যন্ত ভেবেছিলাম, হা ঈশ্বর, তুমি আমাকে কোন অপরাধে প্রায় তিন ঘন্টার জন্য এই নন্দিত কারাগারে নিক্ষেপ করলে। শুরু হওয়ার আগেই আমি বেরুবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। এত নাটকীয়তা আমি সহ্য করবো কীভাবে! ঈশ্বর বোধহয় আমার দুর্গতি বুঝে অভিনেতাদেরকে কানে কানে বলেছিলেন: একটি নাট্যবিমুখ বাঙাল এসেছে, ওকে ধরে রাখ যাতে করে তোমাদের বদনাম না হয়। ঈশ্বরের কথায় কাজ হলো।

ওহ হো, সে কি অভিনয়! ওরা যে-কেউ অভিনয়ে সেরার সেরা। আর নাটকে উপস্থাপন, দৃশ্য, সাজসজ্জা, শব্দ, প্রযুক্তি, দক্ষতা—যাই বলি না কেন, এক কথায় অভিভুত করার মতো। মনে হচ্ছিল, নাটক নয়, যেন সাসপেন্স ও থ্রিলারের—ঘটনা নয়, বরং অভিনয়ের পারম্পর্য ও ঘটনার বুননের কারণে– মুহুর্মুহু অভিঘাতে দর্শককে বশীভূত করে রেখেছে। প্রযুক্তির চোখধাঁধানো ব্যবহার যেন সিনেমাকেও হার মানায়। মঞ্চের উপর,নিচ, এমনকি মঞ্চ ফুঁড়ে যেভাবে দৃশ্য ও বস্তুর উদয় ও অস্ত ঘটছে তা অবিস্মরীয়। এমনকি চারিদিক থেকেও এসবের উৎসার এতটাই স্বাভাবিক ছিল যে মনে হবে এ যেন কোনো চেষ্টাকৃত বিষয় ছিল।


দ্য ফ্যান্টম অব দ্য অপেরা সম্পর্কে পাঠকরা হয়তো ইতিমধ্যেই জানেন যে এর কাহিনীটি আসলে ফরাসি লেখক গাস্তঁ লারোর উপন্যাস Le Fantôme de l'Opéra-এর অনুসরণে গড়ে উঠেছে, যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১০ সালে।
কাহিনীটা সুগায়ক ভূত, ক্রিস্টিন আর রোউল-এর মধ্যে ত্রিভুজ প্রেমের ভূতুরে ঘটনা নিয়ে গড়ে উঠৈছে। রোউলকে এই কাহিনীতে দেখা যায় ক্রিস্টিনের বাল্যবেলার প্রেমিক হিসেবে। তার এই প্রেমিক ধনাঢ্য এবং ক্রিস্টিনকে সব রকম নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত সে। অন্যদিকে, ভূতের সঙ্গে তার কোন পূর্ব-পরিচয় ছিল না। সে অমাময়, কুৎসিত, ভয়ংকর, অতএব সে এক নিষিদ্ধ প্রেমের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু তার মধ্যে রয়েছে অন্য এক শক্তি। ক্রিস্টিন তার প্রতি আকৃষ্ট হয তার গানের অপূর্ব শক্তির কারণে, কারণ সে সুদর্শনা সোপ্রানো, তাকে সে সংগীতের আশ্চর্য ফেরেশতা হিসেবে মান্য করে। রহস্যময় এই সংগীত প্রতিভার অবস্থান প্যারিসের অপেরা হাউজের নিচে এক গোলকধাঁধাময় জায়গায়। মূল কাহিনী এইটুকুই। সম্পর্ক, টানাপোড়েন এবং অবশেষে বাল্যপ্রেমের জয়। পুরো কাহিনীটি গীতিনাট্যের মাধ্যমে পল্লবিত হয়ে উঠেছে অভিনেতাদের গায়কী মাধুর্যে আর অভিনয়ের দুরন্ত শক্তিমত্তায়।
সার্বিক গুণের কারণে ব্রডওয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ব্যাপী প্রদর্শিত এক নাটক এটি। ইতিমধ্যে এর ১০ হাজারতম ব্রডওয়ে পার্ফমেন্স হয়ে গেছে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে। এরপর গত ছয় বছরের প্রদর্শনগুলোতো আছেই্। টাকা পয়সাও কম কামায়নি এই নাটক, ওই ২০১২ সাল পর্যন্ত এর মোট আয় ছিল ৫.৬ বিলিয়ন ডলার। লায়ন কিং-এর পর এটাই সর্বাধিক ব্যবসাসফল নাটক। ২৭ টি দেশের ১৪৫টি শহরে এ পর্যন্ত এর দর্শক সংখ্যা হচ্ছে ১৪০ মিলিয়ন। এবং এখনও চলছে।
তার মানে আকস্মিকভাবে আমি একটি ঐতিহাসিক( ইতিহাসভিত্তিক আর্থে নয়, ইতিহাসসৃষ্টিকারী হিসেবে) নাটক দেখার সুযোগ পেয়ে গেছি অনিচ্ছাসহত্বেও। প্রায় ভেলকির মতো মনে হচ্ছিল নাটকটিকে।

আমাদের থিয়েটার হল বা সিনেমা হলগুলোর মতোই ইন্টারভেল-এর সময় হাল্কা খাবার বিক্রি করার জন্য বেশ কয়েকজনকে ঢুকে পরতে দেখলাম। আমাদের হকারদের মতোই এরা। কিন্তু বিক্রি করছে বেশ চড়া দামে। আমি চড়া দাম এড়াবার জন্য বাইরে, হলের বাইরে কিন্তু মূল ভবনের ভেতরেই নানান ধরনের খাবার যেমন চিপস, পপকর্ন, সফট এবং হার্ড ডিংকস বিক্রি হচ্ছে, সেখানে খাবারের ক্ষুধা আমার ছিল না, তবে তৃঞ্ষা ছিল বলে একটা কোকাকোলার অর্ডার দিতেই সুন্দরী মেয়েটি দ্রুতই মেশিনের বাটন টিপে আমাকে গ্লাস ভর্তি একগাদা বরফযুক্ত কোকাকোলা এগিয়ে দিল। জিজ্ঞেস করলাম, দাম? দশ ডলার। আমি ভুল শুনছি কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবারও জিজ্ঞেস করলাম। এবার সে মুখটা অামার কাছাকাছি এনে আগের চেয়েও উচ্চস্বরে কিন্তু মুখটাকে চুইংগামের মতো খানিকটা নরমভাবে বাঁকিয়ে 'দশ ডলার' কথাটা এমন খড়গকন্ঠে উচ্চারণ করলো যেন ওই দুটি শব্দের অন্তরালে আমাকে ভর্সৎনার স্বরে বলতে চাচ্ছে, তুমি কি এখানে নতুন নাকি যে জিসিনপত্রের দাম জান না। আমি ওর এই অভিব্যক্তিতে ভয় পেয়ে সসম্মানে দ্রুত দশ ডলার বের করে ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। গ্লাসে যে-পরিমাণ কোকাকোলা দিয়েছে তা এক ডলার মূল্যেরও নয়, অথচ দশ ডলার খসিয়ে নিল আমার কাছ থেকে।
ফ্যান্টম অব দা অপেরা তার প্রদর্শনীর ৩০তম বর্ষে পা দিয়েছে। ইতিমধ্যে অর্জন করেছে ৭০টি প্রধান নাট্য পুরস্কার। আরও একটি বড় পুরস্কার সে অর্জন করেছে প্রাচ্য থেকে, সে হলো আমি, আমার মতো নাট্যবিমুখ মানুষকেও সে জয় করেছে।


দেখতে দেখতে মনে মনে অবশ্যই আমাদের দেশের নাটকের বক্তব্যের ঐশ্বর্য্য আর উপস্থাপনার দীনতাকে মিলিয়ে দেখছিলাম। ওদের কাছ থেকে কিছুই নেবো না কারণ ওরা পশ্চিমী, কারণ ওরা জনবিচ্ছিন্নতার চূড়ান্তে পৌঁছে গেছে, ওরা কেবল বিনোদনটাই বোঝে, ওদের মধ্যে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে জাগিয়ে তোলার প্রণোদনা নেই—এই অভিযোগে ওদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা যায়, কিন্তু সেটা শৈল্পিক সুবুদ্ধির পরিচয় হবে কিনা সেটাও ভেবে দেখার অবকাশ আছে। যে-কোনো শিল্প তখনই ব্যাপ্ত ও বড় হয়ে ওঠে যখন পারস্পরিক লেদদেন ঘটে। অতীতে এমন ঘটেছে। যাদের ক্ষেত্রে ঘটেছে তারা সর্বজনীনতার কন্ঠস্বর অর্জন করেছেন। পশ্চিমে নাটকের হলগুলোতে নাটক দেখা একটা বলার মতো ব্যাপার হয়ে উঠেছে, ওটা শুধু বুড়োবুড়িদের অভ্যাসের চর্চা হিসেবেই নয়, তরুণদেরও এক অকর্ষণীয় তীর্থতল। কিন্তু আমাদের হলগুলো এখনও কি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আকর্ষণ-বিন্দু হয়ে উঠতে পেরেছে?

আর্টস-এ প্রকাশিত রাজু আলাউদ্দিনের অন্যান্য প্রবন্ধ:
বোর্হেস সাহেব