লিন্ডেনকুঞ্জের অদ্ভুত পথিক

কুমার চক্রবর্তীকুমার চক্রবর্তী
Published : 22 April 2019, 06:28 AM
Updated : 22 April 2019, 06:28 AM


এই যে বিপ্রলব্ধ প্রকৃতি, যে কম্প্রমান দৃশ্যজগৎ–তার ভেতরে জন্ম, বৃদ্ধি ও বিনাশপ্রাপ্ত প্রতিটি মানুষ দেখে যায় এই প্রকৃতিবিদ্ধ পৃথিবীকে, দেখে প্রকৃতিলিপ্ত আত্মসত্তাকে। এই দেখা কখনও অনুসন্ধান, কখনও-বা স্বস্থিত বস্তুকে চিন্তাবস্তু বা অজানা স্বরূপে চেনার প্রচেষ্টা। প্রতিটি বস্তুই দার্শনিকের কাছে এক সংবেদনের আলখাল্লায় মুড়ে হাজির হয়। বস্তু অপরত্বে যেতে চায়। এভাবেই বস্তু তার স্বরূপ থেকে রূপান্তরিত বস্তুতে পরিণত হয়। নিজরূপ থেকে অপররূপে পরিণত হওয়াতেই যেন অবলোকনের মাত্রা স্থাপিত হয়। এ দুয়ের পার্থক্যটা, অর্থাৎ অবভাস আর স্বগতসত্তার মধ্যে যে দূরত্বটা রয়েছে, দার্শনিকজন তার সূত্রটি ধরিয়ে দেন প্রথমবারের মতো; বলেন, যে, সংবেদন থেকে বস্তুর এই স্বগতসত্তাকে জানা যায় না, যা যায় তা হলো বস্তুর অবভাস। দার্শনিকজনের কাছে তাই এ জগৎ এক অবভাসমাত্র। ভাব ছাড়া বস্তু হয় না। বস্তু আর ব্যক্তির মাঝে থাকে বৌদ্ধিকতা যার কারণে বস্তু তার স্বরূপে প্রতিভাত হয় না, কতকগুলো ইঙ্গিত উপস্থাপন করে শুধু। এই ডিং-আন-জিখ বা 'স্বগতসত্তা'কে জানা হয় না পুরোপুরি, তার অবভাসকেই শুধু জানা যায়। অবভাস হলো ইন্দ্রিয়গাহ্য প্রত্যক্ষতা, যার মাধ্যমে বস্তু ধরা দেয় ব্যক্তির কাছে, ব্যক্তির গ্রহণমাধুর্যে। বস্তুর স্বরূপকে তাই কখনোই জানা যায় না, তা অনেকটাই অজ্ঞেয় এবং অধরা।
দার্শনিকজন আরও বললেন, জ্ঞানের প্রধান সূত্রগুলো অভিজ্ঞতাপূর্বভাবেই পায় মানুষ যা অর্জিত হয় স্বজ্ঞার দ্বারা, তাই অধিবিদ্যা এক ভ্রান্ত ধারণা। বস্তু বা বাহ্যিক জগৎ নিয়ে তিনি সন্দেহপ্রকাশ করেননি, শুধু বলেছেন যে, বস্তু বা বাহ্যিক জগৎ-সম্পর্কে তাদের অস্তিত্বের বাইরে নিশ্চিত করে কিছু বলা কঠিন।
২.
সেই দার্শনিকজন, নিজেকে যিনি ঠিক করে ফেলেছিলেন গোড়াতেই–কেমন হবে তাঁর জীবন, কীভাবে চালাবেন তা, এবং কখন-বা সমাপ্তি ঘটবে তার। যাকে বলে, নিশ্ছিদ্র ও রক্ষণীয় এক অবস্থান, তিনি তা রক্ষা করেছেন আজীবন। যুক্তি, আবেগ, পথচলা, থেমে যাওয়া, এমনকি যাপনের কড়িবর্গা–সবকিছুই যেমনটি তিনি করতে চেয়েছিলেন, তা-ই হয়েছিল নিখুঁতভাবে। লক্ষ্য অর্জনের জন্য শৃঙ্খলের গাণিতিকতায় নিজেকে ঠেঁসে রেখেছিলেন তিনি আগাগোড়া, সারাজীবন। এজন্যই বাইশ বছর বয়সে প্রথম লেখা বইয়ের শুরুতে তিনি জানান দেন: 'লক্ষ্য-অনুযায়ী অগ্রসরমাণতাকে ঠিক করে ফেলেছি আমি। তাকে সার্থক করার পথেই এখন এগিয়ে যাব, কিছুতেই টলব না আমি তার থেকে।' এ-ই ছিল তাঁর অভিলক্ষ্য, এবং এই সংকল্পকে সত্যে পরিণত করেছিলেন তিনি সারা জীবন ধরে, বিন্দুমাত্রও বিচ্যুত হননি কখনও। এজন্যই দেখা যায়, একা জীবনে, দরিদ্রতার মধ্যে পনেরো বছর সময় নিয়ে তিনি লিখলেন সেই গ্রন্থটি যা নাড়িয়ে দিয়েছিল দর্শনের আগপাশতলাকে, সে-গ্রন্থেই তিনি বলেন: 'শুধু অভিজ্ঞতার বৃত্তে আমাদের বোধকে আটকে রাখা অযথার্থ। অভিজ্ঞতা কেবল যা-রয়েছে তাকেই জ্ঞাত করে, এর বাইরের নিশ্চিত কিছুকে তা জানায় না।' তিনি মনে করতেন, সত্যান্বেষণে বিয়ে বাধা হতে পারে, তাই সিদ্ধান্ত নিলেন তা না-করার। অনুষঙ্গ হিসেবে উল্লেখ্য, দু-দু-বার দুজন মহিলাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে দিতে সময়ক্ষেপণ এমনটাই করলেন যে, দু-নারীই ছিটকে পড়েন তাঁর কাছ থেকে: প্রথমজন অন্য-এক সাহসীকে বিয়ে করে নেন, আর অন্যজন অনুভূত অবজ্ঞায় দূরের এক শহরে চলে যান। ফরাসি রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, বিশপ, শার্ল-সরিস দ্য তালেরাঁ-পেরিগো নাকি বলতেন, অর্থের জন্য বিবাহিতরা সবকিছু করতে পারে।
৩.
এমনই ছিলেন ইমানুয়েল কান্ট, ঊনবিংশ শতাব্দের শ্রেষ্ঠ প্রভাবশালী দার্শনিক, যিনি ১৭৮১ সালে, জন্মের প্রায় সাতান্ন বছর পর, প্রকাশিত তাঁর ক্রিটিক অফ পিয়ুর রিজন লিখে অন্ধ বিশ্বাসের সুষুপ্তি থেকে জাগিয়ে তোলার বৌদ্ধিক ধাক্কাটি দেন সমকালকে। হিউম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন কান্ট; হিউম-পাঠ তাঁর জীবনকে বদলে দিয়েছিল। হিউমের সাথে দ্বিমত করার চেষ্টা করেন তিনি, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে হিউমকে অকাট্য বলে মেনে নেন। হিউম গুরুত্ব দেন যে, আমাদের মন অনেকগুলো মনোছাপ আর ধারণার সমষ্টিমাত্র, মনোছাপ সেটাই লক যাকে বলেছেন সংবেদনের ধারণা, বাহ্যিক জগৎ সম্বন্ধে আমাদের ইন্দ্রিয়োপলব্ধি; ধারণা হলো মনোছাপের প্রতিরূপমাত্র যা চিন্তা এবং যুক্তিশীলতায় জন্মলাভ করে। কান্ট হিউমের এই চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানবমনের নতুন বর্ণনা উপস্থাপন করেন এই বলে যে, মনের দুটো অংশ: একটি হলো তার চিন্তার অংশ অন্যটি তার বোধগম্যতার অংশ। জগতে আমরা যে শৃঙ্খলাকে খুঁজে পাই, তা জগতের নিজস্ব নয়, বরং সেই চিন্তারই শৃঙ্খলা যা জগৎকে বোঝে। যা-ই হোক, কবি হাইনরিশ হাইনে কান্ট সম্পর্কে বলেছেন: 'বাহ্যিক কান্ট আর তাঁর বিশ্ব-কাঁপানো ধ্বংসাত্মক চিন্তার কতই না বৈপরীত্য! ক্যোনিগ্সবার্গের জনসাধারণ তাঁর এ সমস্ত চিন্তার অভিঘাতকে অনুমান করতে পারলে জল্লাদের চেয়েও তাঁর সামনে পড়লে থর থর করে কাঁপতে থাকত অধিক, কারণ জল্লাদ শুধু জবাই-ই করে। কিন্তু সরলসিদে মানুষগুলো কান্টকে মনে করেছিল একজন দর্শনের অধ্যাপক। তিনি যখন বেড়াতে বের হতেন তখন তারা তাঁকে সমীহ-করা অভিবাদন জানিয়েই ক্ষান্ত হতো আর তাদের সময়টা মিলিয়ে নিত।' হাইনে তাঁকে তুলনা করেছেন ফরাসি কূটনীতিক রব্সপিয়েরের সাথে; তবে রব্সপিয়ের হত্যা করেছিলেন হাজার হাজার ফরাসিকে, আর কান্ট হত্যা করেছিলেন খোদ ঈশ্বরকে।
মনে করাই যেতে পারে শোপেনহাউয়ার ও নিটশেকে, যাঁরা এমনটিই মনে করতেন, যে, বিয়ে হলো জ্ঞানান্বেষণের পথে সমূহ বাধা। এজন্যই দেখি, তাঁরা দুজনই বিয়ে করা থেকে বিরত থেকে যান। বিয়ে-সংক্রান্ত বিবেচনাকে বাদ দিলেও আর্টুর শোপেনহাউয়ার প্রভাবিত হয়েছিলেন কান্টের দর্শন, শৃঙ্খলতা আর যাপনের দ্বারা। শোপেনহাউয়ার তাঁর মাগনুম ওপুস দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ উইল অ্যান্ড আইডিয়াতে 'ওয়ার্ল্ড অ্যাজ আইডিয়া' এবং 'দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ উইল'-এর যে দ্বিত্ব ধারণার কথা বলেন, তা কান্টেরই অপ্রাপঞ্চিক ও প্রাপঞ্চিক জগতের ধারণার ভাবতরঙ্গ। এছাড়াও শোপেনহাউয়ারের যে যাপনগল্প, তাও ঠিক কান্টের মতনই ছিল শৃঙ্খলায় আবর্তিত: পয়তাল্লিশ বছর থেকে পরবর্তী সাতাশ বছর শোপেনহাউয়ার বাস করেছিলেন ফ্রাঙ্কফুর্ট-আম-মাইন-এ, একা, একটি আবাসিক হোটেলের রুম ভাড়া করে, সাথে থাকত তাঁর কুকুরটি যার নাম তিনি দিয়েছিলেন 'আত্মা', যাকে পাড়ার ছেলেপিলেরা মশকরা করে বলত 'ছোটো শোপেনহাউয়ার'। এবং প্রতিদিনই একই সূচিতে চলত তাঁর জীবন: সকাল সাতটায় স্নান, কোনো প্রাতরাশ ছাড়াই এক পেয়ালা শক্ত কফি পান করে দুপুর-অব্দি লেখালেখি, মধ্যাহ্নের মধ্যে সমস্ত দিনের কাজ শেষ করে আধ ঘণ্টা বাঁশি বাজানো যাতে ছিল তাঁর বিশেষ দক্ষতা, তারপর মধ্যাহ্নভোজের জন্য এংলিশার হোফেতে গমন; তারপর ঘরে ফিরে চারটা অব্দি অধ্যয়ন, এরপর ঝড়বৃষ্টি যা-ই থাকুক না কেন দু-ঘণ্টার বিরতিহীন হাঁটা, ছ-টায় পাঠকক্ষে গমন এবং দ্য টাইমস পড়া, সন্ধ্যায় থিয়েটার বা কনসার্টে যাওয়া, এরপর রেস্তোরাঁয় বা হোটেলে নৈশভোজ সারা। জানা যায়, খাবারের আদেশ দিয়ে পকেট থেকে একটি সোনার মোহর বের করে টেবিলে রাখতেন, খাবার খাওয়া শেষ হলে তা আবার পকেটে পুরে রাখতেন। এই অদ্ভুত অভ্যাস দেখে দেখে টিকতে না পেরে একদিন ওয়েটার এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে তিনি বলেন যে, এটা তাঁর এক নিশ্চুপ বাজি, যে-সব ইংরেজ কর্মকর্তারা এখানে খেতে আসে, তারা যদি ঘোড়া, মহিলা আর কুকুর ছাড়া অন্য কোনোকিছুর আলাপ কোনোদিন করে তো সেদিন তিনি এই মোহরটি গরিবদের মাঝে দান করে দেবেন। খাবার সেরে ঘরে ফিরে ন-টা বা দশ-টার মধ্যে ঘুম। সাতাশ বছরে এর অন্যথা হতে পারত শুধু সাক্ষাৎপ্রার্থী এলে, তাছাড়া এই ছিল তাঁর কঠোরভাবে মেনে চলা দিনসূচি। কান্টের দিনসূচির সাথে মেলালে এটাই মনে হবে যে, কত মিল ছিল দুজনের স্বপ্ন ও যাপনের। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁর শিক্ষক জি. ই, শুলৎস তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি যেন প্লাতোন আর কান্টের মধ্যেই তাঁর পড়াশোনা সীমাবদ্ধ রাখেন, তিনি তা-ই করেছিলেন। এ দুজনই তাঁর দার্শনিক ভাষানির্মাণের মালমসলা সরবরাহকারী।
কান্টের পূর্বপুরুষ স্কটল্যান্ড থেকে এসেছিলেন প্রুশিয়ার ক্যোনিগ্সবার্গে। জীবনে কখনোই তিনি এই শহরের বাইরে কোথাও যাননি, যদিও দূর দেশের মানবজাতিবিজ্ঞান আর ভূগোল পড়াতেই অধিক পছন্দ করতেন তিনি। গৃহশিক্ষকতা আর অধ্যাপনা করেই পার করেছেন সারাটি জীবন। ১৭৫৫ সালে ক্যোনিগ্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেসরকারি প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন, আর এই পদেই রয়ে গিয়েছিলেন পনেরো বছর। অধ্যাপক পদে তাঁর পদোন্নতির আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ১৭৭০ সালে অবশেষে যুক্তিশাস্ত্র ও অধিবিদ্যার অধ্যাপক হন তিনি। পরবর্তী সময়ে অধিবিদ্যার নতুন নিয়ম লিখে তিনি বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন। ঠাট্টা করে বলেছিলেন: 'অধিবিদ্যার দয়িত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার, কিন্তু দয়িতা আমার প্রতি আজ অবধি খুশিই হলো না।' আরও বললেন: 'অধিবিদ্যা যেন কুলকিনারা আর দিগ্বিদিকহীন এক কৃষ্ণ মহাসাগর।'
মাঝারি উচ্চতার, মাথামোটা, উজ্জ্বল নীল চোখ, ডানকাঁধ বাম কাঁধের চেয়ে উঁচু, সরল, সাদাসিদে, অন্তর্মনা আর নিভৃতচারী মানুষ ছিলেন তিনি। এক চোখ অন্ধও হয়ে গিয়েছিল তাঁর। তাঁর এক জীবনীকার তাঁকে অভিহিত করেছেন শৃঙ্খলারও শৃঙ্খলাময় একজন বলে। আচরণের এই নিয়মানুবর্তিতার জন্যই তাঁকে বলা হতো 'ক্যোনিগ্সবার্গ ঘড়ি'। কোনোরকম ব্যত্যয় ছাড়াই এক নিয়মে চলত তাঁর জীবন। যেদিন ক্লাস থাকত, সেদিন ঘর থেকে বের হলেই পাড়াপ্রতিবেশীরা বুঝে নিত যে এখন ঘড়িতে ঠিক আটটা বাজল। দশটায় তিনি তাঁর টুপিটি পরে নিতেন, পাঁচটায় ছড়িটি হাতে; ঠিকঠিক আটটায় দরজার বাইরে পা ফেলতেন। সময়ানুসরণ ছিল তাঁর একক অবলম্বন যা থেকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন হতে চাইতেন না তিনি। নিট্শের মতোই, লেখা ও পড়ার বাইরে দুটো কাজ আনন্দের সাথে করতেন তিনি– হাঁটা আর খাবার খাওয়া। কিন্তু নিটশের সাথে তাঁর প্রকৃতিগত পার্থক্য ছিল। নিটশে ছিলেন অদম্য ও দীর্ঘ পথভ্রামণিক–ভ্রমণ থেকে, বিশেষত হাঁটার সময় লেখার উপাদান সৃষ্টি ও সংগ্রহ করতেন; খেতেন সামান্য, ঠিক ঋষির মতো পরিহার করতে চাইতেন খাবারদাবার, চাইতেন যেভাবে তাঁর পেট স্বস্তিতে থাকে, কেননা তাঁর ছিল মারাত্মক পেটপীড়ার সমস্যা।
অন্যদিকে কান্টের ছিল ভালো হজমশক্তি। তিনি পান করতেন আনন্দচিত্তে, যদিও তা ছিল অতি পরিমিত, নড়চড় হতো না এক তিল পরিমাণও। খাবার টেবিলে দীর্ঘ সময় কাটাতেন। সিগারও টানতেন যদিও বরাদ্দ ছিল দিনে একটা। কিন্তু তাঁর হাঁটা ছিল অতি সংক্ষিপ্ত, কখনও-বা ছিল নিছক দায়সারাগোছের। বলা যায়, অনেকটা অলস পায়চারি। পরিশ্রমসাধ্য হাঁটা তিনি পছন্দ করতেন না। সেজন্যই গ্রীষ্মকালে তিনি হাঁটতেন খুব ধীর গতিতে, তীব্র তাপে ছায়ায় দাড়িয়ে পড়তেন। মোজা পরার সময় মোজার বন্ধনীর প্রান্তটি প্যান্টের পকেটে স্পিংয়ের সাথে বেঁধে দিতেন, স্প্রিংগুলো আবার ছোটো বাক্সের মধ্যে পুরে রাখতেন। কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্য যে পরিপূর্ণ ভালো ছিল সেরকমটিও নয়। তিনি কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগতেন, আর নিটশের ছিল ক্ষুধামান্দ্য এবং বমিভাব। ভঙ্গুর মনোভাবের জন্যই কান্ট মনে করতেন, তাঁর দীর্ঘজীবনের রহস্য নিহিত তাঁর কঠোর জীবনপ্রণালির মধ্যে। সুস্বাস্থ্যকে তিনি মনে করতেন ব্যক্তিগত অর্জন রূপে যার ভিত্তি ছিল তাঁর শৃঙ্খলপরায়ণ জীবনযাত্রা। ওষুধ খেতেন না তিনি, দিনে একবেলা প্রধান খাবার খেতেন। পথ্যকেই সুস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্ব দিতেন যার উদ্দেশ্য ছিল–জীবনের উদযাপন নয়, দীর্ঘস্থায়ীকরণ। সত্তর বছর বয়সে লেখেন প্রবন্ধ 'সংকল্পের জোরে অসুস্থতার ভাবনা থেকে মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায়'। জীবনের শেষ দিনগুলোতে তাঁর মনে হয়েছিল, এক বাতাসজাত বৈদ্যুতিক রস তাঁর স্বাস্থ্যকে শেষ করে দিচ্ছে। একই সময়ে বাজেল শহরে এ জাতীয় প্রবাহের কারণে অকল্পনীয়-সংখ্যক বিড়াল মারা গিয়েছিল বলে মনে করতেন তিনি। ঋণ ছিল না তাঁর, এটা তিনি সদম্ভে বলতেনও। অগোছালো কোনো বিষয় বা কোনো ধরনের পরিবর্তনকে পছন্দ করতেন না তিনি। তাঁর এক ছাত্র, সবসময় জ্যাকেট পরে তাঁর ক্লাস করত, জ্যাকেটটিতে একটি বোতাম কম থাকত। একবার ছাত্রটি সেখানে একটি নতুন বোতাম লাগিয়ে ক্লাসে এল, আর তা দেখে কান্ট দারুণ ক্ষেপে গেলেন। তিনি নতুন বোতামটি থেকে তাঁর দৃষ্টি ফেরাতে পারছিলেন না। তিনি ছাত্রটিকে নির্দেশ দেন নতুন বোতামটি খুলে ফেলার জন্য। আরও বললেন, শ্রেণীবদ্ধকরণ অপেক্ষা কোনো কিছু সম্পর্কে শিক্ষাগ্রহণ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সারাজীবন একইরকম পোশাক পরতেন তিনি, তাঁর আচরণ ছিল সুভদ্র ও মার্জিত।
তাঁর জীবন ছিল ধ্রুপদ সংগীতের স্বরলিপির মতোই যথাযথ, গায়ক বা কন্ডাকটর হিসেবে তা তিনি বাজাতেন বা পরিচালন করতেন একফোঁটাও স্বাধীনতা না-নিয়েই। কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠতেন তিনি, তারপর কয়েক পেয়ালা চা বা কফি, তারপর একটা পাইপ টানতেন, একটাই ছিল সারাদিনে বরাদ্দ। যেদিন ক্লাস থাকত সেদিন সকালে বেরিয়ে যেতেন, ফিরে এসে গাউন পরে পৌনে একটা পর্যন্ত লিখতেন, তারপর আবারও পোশাক পালটিয়ে কতিপয় বন্ধুদের সাথে দর্শন, বিজ্ঞান আর আবহাওয়া নিয়ে সুখকর আড্ডা। তখন হয়তো প্লেটে থাকত কয়েকখণ্ড পনিরের টুকরো, বা ডেজার্ট, সাথে অতিথিদের সেবার জন্য ছোটো পাত্রে একটুআধটুু মদ। বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত চলত এই আড্ডা। তারপর হয়ে যেত তাঁর হাঁটার সময়। কী বৃষ্টি কী রৌদ্র, বিরাম ছিল না এর। একা হাঁটতেন মুখ বন্ধ করে নাক দিয়ে নিশ্বাস টেনে টেনে যা তিনি মনে করতেন স্বাস্থ্যসম্মত, আর তাঁর ভক্তরা সেই বদ্ধ মুখ খোলার জন্য হয়ে পড়তেন তৎপর। একই পথ ধরে হাঁটতেন তিনি, আর হাঁটার সেই পার্কটি, লিন্ডেনকুঞ্জটি, পরে বিখ্যাত হয়ে যায় 'দার্শনিকের হাঁটা'র পথের কারণে। শোনা যায়, জীবনে মাত্র দুবার তিনি পথ পরিবর্তন করেছিলেন–একবার রুশোর এমিল বইটির কপি দ্রুত পাওয়ার জন্য, আরেকবার ফরাসি বিপ্লবের ঘোষণার পর হন্তদন্ত হয়ে তাজা খবর শোনার জন্য। এমনটিও শোনা গেছে যে, এমিল তাড়াতাড়ি পড়ে শেষ করার জন্য তিনি হাঁটার সময়ও কমিয়ে দিয়েছিলেন। এমিল যে তাঁকে আলোড়িত করেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না, তিনি মনে করতেন, তাত্ত্বিক যুক্তির চাইতে অনুভূতির শ্রেষ্ঠত্বকে সাহসের সাথে উচ্চারণ করতে পেরেছেন রুশো। আমরা জানি, রুশো নিজেও ছিলেন অসাধারণ ভ্রামণিক। তো হেঁটে এসে কান্ট দশটা অব্দি পড়াশোনা করতেন, তারপর টানা ঘুম।
তাঁর এই যে স্বল্পমাত্রার হাঁটা, ধীরে, টেনেটুনে দিনে এক ঘণ্টা, অনিবার্যত প্রতিদিন, প্রয়োজনভিত্তিক, যার ছিল না কোনো প্রকৃতিশ্লিষ্টতা বা সংরাগ, ছিল না আনন্দজাত উপলব্ধি; যেন নিছক স্বাস্থ্যগত কারণেই তা করা, যেন তা ছিল এক ব্যক্তিপ্রতিস্বের পুনঃপৌনিকতা–এর পেছনে কিছু ভিত্তিকে বিবেচনা করা যেতে পারে যা বিষয়টি অনুধাবনে আগ্রহোদ্দীপক।
প্রথমত, হাঁটা একএকঘেয়েমির কাজ যদি না তাতে থাকে মনের অংশগ্রহণ, বা ঘটনার রোমাঞ্চ। স্বাস্থ্য রক্ষার্থে যারা হাঁটেন তারা ভোগেন এক মানসিক চাপ এবং প্রাত্যহিক একঘেয়েমিতে। হেঁটে হেঁটে যারা কাজ করেন বা বাজারে যান বা তীর্থযাত্রায়ও যান, তারা জানেন এই একঘেয়েমির বিষয়টি, কারণ তাতে থাকে না আনন্দজাত মনোপ্রাপ্তি। পেশাগত কাজে হাঁটা চরম একমাত্রার ব্যাপার, কোনো প্রীতি ছাড়াই তা চালাতে হয়। তীর্থযাত্রীরা পূণ্যের আশায় এই একমাত্রাকে অতিক্রম করেন কখনও কখনও। কিন্তু হাঁটা যত একঘেয়েমিপূর্ণই হোক না কেন, তা বিতৃষ্ণাকে জয় করে যায়। ক্লান্তি বা বিতৃষ্ণা হলো মানসিক বৈকল্য, মানসিক শূন্যতা, তার জন্ম হয় গতিহীনতা থেকে। নির্বেদ আর স্থবিরতা। ব্যক্তি নিপতিত হন চরম আশাহীনতার সলিলে, ব্যক্তি হয়ে পড়েন জড়বৎ। ব্যক্তি তখন কিছু একটা করতে চেয়েও পেরে ওঠেন না, এক নিশ্চলতায় আবদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। হাঁটা যেহেতু তীব্র এক শারীরিক ও মানসিক গতিশীলতা, তাই হাঁটার মাধ্যমে মানুষ তার এই বিতৃষ্ণাকে পেরিয়ে যেতে পারেন। কারণ হাঁটা শরীরের সাথে সাথে মনেও তরঙ্গ তোলে যা ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক জাড্যাবস্থার পরিবর্তন ঘটায়। নতুন ভাবনা ও পরিকল্পনায় মানুষ উদ্দীপিত হয় হাঁটার মুহূর্তে। গতিশীলতা স্থান নিতে দেয় না স্থিতিশীলতাকে, বরং দূরীভূত করে। ইচ্ছাশক্তি পুঞ্জীভূত হতে থাকে নিজের ইপ্সিত কাজ সম্পাদনের জন্য।
সুতরাং কান্টের হাঁটা যতই প্রাত্যহিকতার ছকবাঁধা আবর্তন হোক না কেন, তা তাঁকে সুস্থ রাখত, কারণ তা ছিল তাঁর জন্য এক মানসিক উদ্দীপক, তিনি মনে করতেন তা এক দাওয়াই। হাঁটা যে তাঁর চরম শৃঙ্খলপরায়ণতা এবং অভ্যাসের অংশই ছিল, তা নয়। হাঁটার সময় তিনি চিন্তাও করতেন, হয়তো রোমন্থন করতেন পুরোনো চিন্তার নির্যাসকে, কারণ তার পরপরই তিনি লিখতে বসতেন। সুতরাং হাঁটার সময় যে তিনি কিছু ভাবনার স্ফুলিঙ্গ পেতেন তা অমূলক নয়। শুধু তত্ত্বতালাশ দিয়ে যে তিনি লিখতেন তা-তো নয়, চিন্তার যে মৌলিকতা তাঁর ভেতর দানা বাঁধতে শুরু করেছিল, তার উদ্গিরণ নিশ্চয় হাঁটার সময়ও হতো। ফলে প্রতিদিন এক পৃষ্ঠা নতুন লেখা, চিন্তার উন্নমন, পূর্ণতার অন্বেষণ সম্ভব হতো সহজেই। আর এসব কিছুকে নিয়ে নতুন শিল্পরূপ, নতুন দর্শন-অভিযাত্রা, নতুন চিন্তাবেদের আত্মপ্রকাশ, বা বলা যায় অভুত্থান। তাঁর জীবনকে বলা যায়, পরিকল্পিত চিন্তার পিরামিড, যা রচিত হয়েছে কঠোর যাপন-শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার পাথর গেঁথে গেঁথে। শারীরিক হাঁটা ছিল তাঁর সীমাবদ্ধ কাঠামোয়, এর মধ্যেই বস্তুত তিনি তাঁর অর্নিদ্দেশ্য ভ্রমণ চালিয়েছিলেন জ্ঞানের রাজ্যে দীর্ঘ জীবনে, যা ছিল শত শত মাইল। গীতায় জ্ঞানমার্গ সম্বন্ধে বলা হয়েছে, এটি প্রাচীন তথা শাশ্বত পথ, সময়ান্তরে তা নবীকৃত হয় মাত্র। বলা হয়েছে, জ্ঞানের মতো পবিত্র কিছু আর হয় না, আত্মসংযম দ্বারা মানুষ এই বোধ প্রাপ্ত হয়।
আরেকটি বিবেচনা হলো, কান্টের হাঁটা ছিল তাঁর জন্য এক অপরিত্রাণণীয় অবস্থা, এক স্বখাতসলিলদশা। তিনি এর থেকে বের হতে চাননি, বরং এর মধ্যেই আটকে থাকতে চেয়েছেন। যেন এটাই ছিল তাঁর নিয়তিসমচক্র। তা না-হলে কেন তিনি, সমগ্র জীবন ধরে কোনো অন্যথা না করে, ঠিক পাঁচটায় হাঁটতে বের হয়ে যাবেন? তাঁর এই অভ্যাস ছিল অনেকটা প্রথার মতো, অপরিবর্তনীয় এবং অভীপ্সাতাড়িত। তিনি নিজেই যেন তাঁর এক আচার হয়ে উঠেছিলেন, হয়ে উঠেছিলেন উদ্দেশ্য এবং গন্তব্য। তাঁর ইচ্ছাশক্তি তাঁকে দিয়েছিল এক স্বাধীনতা যাকে তিনি এককভাবে অনুসরণ এবং উদযাপন করেছেন। হাঁটা বা বড়ো অর্থে ভ্রমণের নিয়তি হলো এরকম, একবার শুরু হলে চলতে থাকে আজীবন। যেন এক চিরন্তন চলা, যাকে ভারতীয় জ্ঞানীরা জীবনের সাপেক্ষে বলেছেন চরৈবেতি। কিন্তু হাঁটাকে ভ্রমণে পরিণত করতে পারেননি তিনি, না প্রকৃতিগত না মানসগত, কোনো অর্থেই। হাঁটা ভ্রমণ হয়ে উঠতে চাইলে তাতে যুক্ত হতে হয় প্রাত্যহিকতার বিচ্ছেদ, সমাজবিচ্ছেদ; ভ্রমণ হলো ব্যক্তির জীবনযাপনের মুক্তি যা তাকে যুক্ত করে মহাপ্রকৃতিমুখী অভিক্রমের সাথে, ভ্রামণিক মুখোমুখি হন নানা অভাবনীয়র সাথে, পান অন্য-এক অভিজ্ঞতা, অর্জন করেন ভিন্ন বোধ। কান্ট সম্ভবত এর প্রয়োজন বোধ করেননি, জীবনই যেন ছিল তাঁর জন্য এক সম্পূর্ণতা, মোটাদাগে হাঁটার জীবনের প্রয়োজন পড়েনি তাঁর, জীবনের জন্যই একটু নিয়মমাফিক হেঁটেছেন তিনি। কিন্তু নিরন্তর ভ্রমণ করেছেন, সাধারণ পথে নয়, জ্ঞানের পথে। সে-অর্থে তিনি জ্ঞানলোকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পথিক।