ডেনিস ডাটনের বক্তৃতাসৌন্দর্য ও ডারউইনের থিওরি

luna_rushdi
Published : 28 Jan 2011, 06:53 PM
Updated : 28 Jan 2011, 06:53 PM


…………
ডেনিস ডাটন (৯.২.১৯৪৪ – ২৮.১২.২০১০)
…………









[গত এক শতাব্দী ধরে শিল্প সমালোচকেরা বলে এসেছেন সামাজিক পরিবেশ শিল্পের রুচি গড়ে তোলে। ডাটন ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি মনে করেন, শিল্প বিষয়ক রুচি, সেটা যে কোন শিল্প মাধ্যমই হোক না কেন, গঠিত হয়েছে বিবর্তনের মাধ্যমে, ডারউইনের থিওরি দিয়ে যার ব্যাখ্যা করা যায়। সৌন্দর্যের প্রতি আমাদের ভালোবাসা সহজাত। নান্দনিক অনেক ভালোলাগা সংস্কৃতি নির্ভর হয় না। যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে ডাটন দেখিয়েছেন ভাববাচক বা বিমূর্ত কোনো তত্ত্ব নয়, বরং বিবর্তন বিষয়ক উপলব্ধিই শিল্প সমালোচনার ভিত্তি। তাঁর মতে সৌন্দর্য, যে কোনো রকম আনন্দ ও দক্ষতা শিল্পমূল্যের অর্ন্তগত।—বি.স.]

অনুবাদ: লুনা রুশদী

আজ আমার প্রিয় একটা বিষয় নিয়ে কথা বলবো। নন্দনতত্ত্ব আমার পেশা। দার্শনিক, বৌদ্ধিক ও মনস্তাত্ত্বিক আঙ্গিক থেকে আমি সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতাকে বুঝতে চেষ্টা করি। এ বিষয়ে যুক্তিগতভাবে কী বলা যায়? বিষয়টা জটিল। তার একটা কারণ হলো এর পরিধি, ভেবে দেখেন, কত বিচিত্র কিছুকে আমরা সুন্দর বলি—একটা শিশুর মুখ, বার্লিওজের 'হ্যারল্ড এন ইতালি', উইজার্ড অফ ওজ-এর মতো সিনেমা, চেখভের নাটক, ক্যালিফোর্নিয়ার প্রাকৃতিক দৃশ্য, হকুসাইয়ের আঁকা 'মাউন্ট ফুজি', ওর্য়াল্ড কাপ ফুটবলে একটা দারুণ গোল, ভ্যান গগের 'স্টারি নাইট', জেন অস্টেনের উপন্যাস অথবা পর্দায় ফ্রেড এস্টেয়ারের নাচ। এই সংক্ষিপ্ত তালিকায় আছে মানুষ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, শিল্প ও অন্যান্য মানবিক দক্ষতা। তালিকাভুক্ত সমস্ত কিছুর সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করা সহজ কাজ হবে না।

……
ডেনিস ডাটনের বই: দি আর্ট ইনস্টিংক্ট–বিউটি, প্লেজার অ্যান্ড হিউম্যান ইভ্যুলুশন
…….
তবে আমি, আমার জানা মতে আজ সৌন্দর্য বিষয়ক সবচেয়ে শক্তিশালী থিওরির সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিতে পারি। এবং এ থিওরি কোন দার্শনিক বা পোস্টমডার্ন শিল্পের নামকরা কোন সমালোচকের কাছ থেকে আসেনি, এসেছে এক জাহাজীর কাছ থেকে, যিনি কেঁচো আর কবুতর পালতেন। এতক্ষণে নিশ্চয়ই আপনারা বুঝে গেছেন যে আমি চার্লস ডারউইনের কথা বলছি।

'সৌন্দর্য' কী? অনেকেই মনে করেন তাঁরা এই প্রশ্নের উত্তর জানেন। যেমন, 'সৌন্দর্য থাকে যে দেখে তার দৃষ্টিতে' অথবা 'যা কিছুই আমাদের ব্যক্তিগতভাবে নাড়া দেয়, তাই সুন্দর।' অথবা কেউ কেউ, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীরা বলে থাকেন 'সৌন্দর্য থাকে যে দেখে তার সংস্কৃতি-নিয়ন্ত্রিত দৃষ্টিতে।' কোনো চিত্রকর্ম, ছায়াছবি বা সঙ্গীত আমাদের সুন্দর লাগে কারণ সাংস্কৃতিক সমরূপতা নির্ধারণ করে আমাদের রুচি; এই বিষয়ে একমত সবাই। প্রাকৃতিক ও শৈল্পিক সৌন্দর্যের রুচিবোধ আসলে কিন্তু এক দেশ থেকে আরেক দেশে সহজেই ঘোরাফেরা করে। জাপানের মানুষ বিটোভেন ভালোবাসে, পেরুতে জাপানের ব্লক প্রিন্টের কদর আছে, বৃটিশ যাদুঘরে যত্নে রাখা আছে ইনকা ভাস্কর্য আর শেক্সপিয়ার তো অনূদিত হয়েছেন পৃথিবীর প্রায় সব ভাষায়। অথবা মার্কিন জ্যাজ বা ছায়াছবির কথা ভাবেন, সর্বত্রই যাতায়াত তাদের।


ডেনিস ডাটনের বক্তৃতার ভিডিও

বিভিন্ন শিল্পে পার্থক্য অনেক কিন্তু আবার এমন কিছু তাৎপর্য ও ভালো লাগা আছে যা সংস্কৃতিকে অতিক্রম করে যায়। এই সমরূপতা কীভাবে আমরা ব্যাখ্যা করবো? সবচেয়ে ভালো উত্তর পাওয়া যাবে যদি আমরা শিল্প ও সৌন্দর্যের বিকাশ বিষয়ে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের পুনঃনির্মাণ করি। তা করতে গেলে প্রথম থেকে শুরু করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতে হবে—কী করে প্রাগৈতিহাসিক পরিবেশ আর আমাদের বিকাশকালের বিভিন্ন পরিস্থিতিই ঠিক করে দিয়েছে বর্তমান শৈল্পিক রুচি বা পছন্দ। এ ক্ষেত্রে আমরা প্রাগৈতিহাসিক সময়ের সংরক্ষিত ফসিল, গুহাচিত্র ইত্যাদি বিভিন্ন তথ্যের সাহায্য নিতে পারি। আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি যে ১৯ অথবা ২০ শতকের বিচ্ছিন্ন হান্টার (শিকারী) ও গ্যাদারার (সংগ্রাহক) সমাজ সেই প্রাচীন সৌন্দর্যবোধ কতটুকু ধরে রেখেছিল।

সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা, তার অনুভূতির তীব্রতা ও আনন্দসহ, যে আমাদের বিকশিত মননের অংশ—এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। এই অভিজ্ঞতা ডারউইনীয় অভিযোজনের একটা সিরিজের অংশ। সৌন্দর্য একটা অভিযোজিত পরিণতি যা আমরা প্রসারিত বা তীব্র করি সৃষ্টি, কাজ, শিল্প ও বিনোদনের মাধ্যমে। অনেকেই জানেন বিবর্তনের দুইটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে।

প্রথম অংশ হলো 'ন্যাচারাল সিলেকশান' বা 'প্রাকৃতিক নির্বাচন'। প্রাকৃতিক কারণেই প্রাচীনকাল থেকে নানা ভাবে রূপান্তরিত হতে হতে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছি আমরা। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমেই আমাদের চুল, চোখ কিংবা হাতের নখ বিবর্তিত হয়েছে। আমাদের বিভিন্ন বিতৃষ্ণা বা ভীতি, যেমন পচে যাওয়া মাংসের দুর্গন্ধ, সাপের ভয় কিংবা কোনো খাঁড়াইয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ভয়—সবই প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় । বিভিন্ন আনন্দ বা পরিতৃপ্তি যেমন মিষ্টি, চর্বি ও প্রোটিনযুক্ত খাবারের প্রতি আকর্ষণ অথবা যৌনতাও ব্যাখ্যা করে প্রাকৃতিক নির্বাচন।


গুগল অফিসে বক্তৃতা দিচ্ছেন ডেনিস ডাটন

বিবর্তনের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো 'সেক্সুয়াল সিলেকশান', এর কার্যক্রম আবার একদম অন্যরকম। এর সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হলো ময়ূরের পেখম। এর বিকাশ প্রাকৃতিকভাবে টিকে থাকার জন্য ঘটে নাই, বরং প্রাকৃতিক নিয়মের উল্টোদিকেই যায় এই পেখম। এটা এসেছে ময়ূরীদের সঙ্গী নির্বাচনের ফলাফলস্বরূপ। আর কে না জানে যে মেয়েরাই ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে চলে! এ প্রসঙ্গে বলে রাখি যে, ময়ূরের পেখম যে ময়ূরীর চোখে সুন্দর ছিল এই বিষয়ে ডারউইন নিঃসন্দেহ ছিলেন।

এখন এই বিষয়গুলি মনে রেখে বলতে পারি যে, সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা এসেছে আমাদের আকর্ষণ, মুগ্ধতা বা আচ্ছন্নতা জাগিয়ে তোলা এবং ধরে রাখার জন্য বিবর্তনের একটা উপায় হিসাবে, যাতে আমরা টিকে থাকা ও প্রযোজনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারি। বলা যায়, সৌন্দর্য হলো দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রাকৃতিক উপায়। আমরা নিশ্চয়ই আমাদের শিশু, প্রেমিক অথবা কোন একটা সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য খেয়ে ফেলি না! বিবর্তনের কৌশল হলো আমাদের চোখে তাদের এরকম আকর্ষণীয় করে তোলা, যাতে তাকিয়ে থাকতেই ভালো লাগে।

আসুন কিছুক্ষণের জন্য নান্দনিক আনন্দের একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎসের কথা ভাবি—সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের আকর্ষণী ক্ষমতা। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষেরা একটি বিশেষ ধরনের প্রাকৃতিক দৃশ্য পছন্দ করে। যা দেখতে সেই বিবর্তনকালের সাভানার মতন। সেই একই দৃশ্য এখনও আমরা দেখি ক্যালেন্ডারের পাতায়, পোস্টকার্ডে, গলফ খেলার মাঠের নকশায়, ফ্রেমে বাঁধানো ছবিতে যা নিউইয়র্ক থেকে নিউজিল্যান্ডের বসার ঘরে শোভা পায়। এই দৃশ্যে থাকে খোলা প্রান্তর, ঘাসের জমি আর মাঝে মাঝে গাছের সারি। গাছগুলির আবার প্রায়ই নিচের দিকে ডালপালা থাকে, তার মানে, বিপদ আপদে গাছে উঠতে চাইলে পারা যাবে এরকম। এইসব দৃশ্যে পানি থাকে কাছেপিঠেই অথবা অন্তত খানিকটা দূরে নীল রঙ দিয়ে পানির অস্তিত্ব দেখানো হয়। পশু ও পাখির অস্তিত্বের প্রমাণ থাকে আর থাকে নদীতীরে, সমুদ্রতীরে বা গাছের সারির ভেতর আঁকাবাঁকা পথ যা দিগন্তের দিকে চলে গিয়েছে, যেন আপনাকে সেই পথ ধরে চলার আহ্বান করছে। এমনকি যে সব দেশে এরকম প্রাকৃতিক দৃশ্য নেই, সেই দেশের মানুষের কাছেও এটা সুন্দর। পৃথিবীর সর্বত্রই যে মানুষ একই ধরনের ভিশ্যুয়াল অভিজ্ঞতায় সৌন্দর্য খুজেঁ পায়, তার খুব ভালো একটা উদাহরণ হলো এই আদর্শ সাভানা দৃশ্য।

……
ফ্রান্সের ল্যাসকু গুহাগাত্রে অঙ্কিত ছবি
……..
কিন্তু এ তো গেল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। শৈল্পিক সৌন্দর্য কি পুরোপুরিভাবেই সাংস্কৃতিক নয়? না, আমি তা মনে করি না। আবার আমি প্রাগৈতিহাসিক সময়ের দিকে ফিরে এর ব্যাখ্যা দিতে চাই। অনেকেই অনুমান করেন যে ল্যাসকু (Lascaux) এবং শাওভে (Chauvet)-এর অসম্ভবরকম দক্ষ গুহাচিত্রগুলিই মানুষের সৃষ্টি করা প্রথম আর্ট। শাওভের গুহাগুলি প্রায় বত্রিশ হাজার বছর পুরানো, কেভ পেইন্টিং ছাড়াও একই সময়ের তৈরি কিছু নারীমূর্তি ও পশুপাখির আকৃতি পাওয়া গেছে গুহাগুলিতে। তবে শৈল্পিক অলঙ্করণের চর্চা কিন্তু এই সময়েরও অনেক আগের। ঝিনুক বা শামুকের মালা যা এখন আমরা প্রায়ই আর্ট ও ক্রাফট-এর মেলাগুলিতে দেখি এবং বডি পেইন্টের নিদর্শন পাওয়া গেছে প্রায় এক লক্ষ বছরেরও আগে থেকে। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত প্রাচীন শিল্পকর্ম

পূর্ব আফ্রিকার উত্তর তানজানিয়ায় ওল্ডুভাই গর্জ। ৪৮ কিমি দীর্ঘ।

আসলে সেই সময়েরও অনেক আগেকার। আমি একুলিয়ান হ্যান্ড অ্যাক্স (acheulian hand axe) এর কথা বলছি। মানুষের তৈরি সবচেয়ে আদিম পাথরের হাতিয়ার হলো কাটারি, যা পাওয়া গিয়েছিল আফ্রিকার ওল্ডুভাই গর্জ (Olduvai Gorge)-এ, প্রায় আড়াই মিলিওন বছর আগে। এই কাটারিগুলি ছিল বেশ স্থুল ধরনেরর হাতিয়ার।

……
আফ্রিকার ওল্ডুভাই গর্জ-এ পাওয়া একুলিয়ান হ্যান্ড অ্যাক্স, ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত।
……
প্রায় দেড় মিলিয়ন বছর আগে হোমো ইরেক্টাসরা শুরু করেছিল পাতলা পাথরের ব্লেড বানানো। কখনো ডিম্বাকৃতির কিন্তু কখনো আবার এরা ছিল আকষর্ণীয় ত্রিভুজাকৃতির পাতার মতোন দেখতে বা 'টিয়ার ড্রপে'র আকারের। পৃথিবীর যেখানেই (এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকা) হোমো ইরেক্টাস আর হোমো ইরগাস্টারদের যাতায়াত ছিল, সেখানেই পাওয়া গেছে হাজার হাজার একুলিয়ান হ্যান্ড এ্যাক্স।

শুধু শিকার করার জন্য এত বেশী সংখ্যক অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল না। রহস্য আরো ঘনীভুত হয় যখন বোঝা যায় যে অন্যান্য প্রাগৈতিহাসিক অস্ত্রের মতোন এই হ্যান্ড এ্যাক্সগুলিতে তেমন ক্ষয়ের চিহ্ন নেই, আর এর মধ্যে কিছু ছিল বড় আকৃতির এবং ব্যবহার অনুপযোগী। এদের সামঞ্জস্য, গঠন প্রণালী ও খুঁটিনাটি এখনো আমাদের চোখে সুন্দর।
এই প্রাচীন হাতিয়ারগুলি তবে কিসের নিদর্শন? উত্তর হলো এরাই সবচেয়ে পুরানো শিল্প। ব্যবহারিক অস্ত্রের এই বিমুগ্ধকর নান্দনিক রূপান্তর প্রাগৈতিহাসিক মানুষের কারিগরী দক্ষতা প্রতীয়মান করে। ডারউইনীয় ইতিহাসে 'হ্যান্ড এ্যাক্স' সভ্যতার নতুন এক ধাপের চিহৃস্বরূপ। এই হাতিয়ার তৈরিই হয়েছে ডারউইনীয়দের ভাষায় 'ফিটনেস সিগন্যাল' এর জন্য। অর্থাৎ এও ময়ূরের পেখমের মতোনই এক বস্তু, পার্থক্য শুধু এই যে—প্রকৃতি নয়, এর স্রষ্টা মানুষ। হ্যান্ড এ্যাক্স-এর একজন দক্ষ কারিগর ছিল কাঙ্খিত পুরুষ। এই দক্ষতা প্রমাণ করতো যে নির্মাতার রয়েছে বুদ্ধি, কর্মনিপুণতা, সচেতনতা ও দূরদর্শিতা।

হাজার হাজার প্রজন্ম ধরে এ ধরণের দক্ষতাসম্পন্ন মানুষ সামাজিক অবস্থান, চাহিদা ও পুনর্জননের ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থেকেছে। আপনারা তো সবাই জানেন, সেই প্রথম পরিচয় বাক্য যা আজও সমান উপযোগী-'এসো আমার গুহায় এসো, তোমাকে আমার বানানো হ্যান্ড এ্যাক্স দেখাই!' অবশ্য মজার ব্যাপার হলো—আমরা জানি না, এই ভাবের আদান প্রদানের ধরণ ঠিক কী রকম ছিল তখন। কারণ হোমো ইরেক্টাসদের তখনো কোন ভাষা ছিল না। বিস্ময়কর হলেও সত্যি এটা। ভাষা ব্যবহার শুরু হওয়ার পঞ্চাশ থেকে এক'শ হাজার বছর আগেই এই হাতিয়ার বানাতো হোমো ইরেক্টাস আর হোমো এনগাস্টাররা।

এক মিলিয়ন বছরেরও পুরানো এই হ্যান্ড এ্র্যাক্স মানব ইতিহাসে শিল্পের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী সৃষ্টি। এই হ্যান্ড অ্যাক্স-এর মহাকাব্যের পর হোমো সেপিয়েন্সরা নিঃসন্দেহে নতুন নতুন উপায়ে একে অপরকে মুগ্ধ করেছে। যেমন: হাসি তামাশা, গল্প বলা, নাচ কিংবা চুল বাঁধা।

আধুনিক মানুষের ক্ষেত্রে গল্পে বা সিনেমায় তৈরি হয় কল্পনার জগৎ। আমরা অনুভূতির তীব্রতা প্রকাশ করি সঙ্গীত, চিত্রকলা অথবা নাচে। তবু আমাদের সৌন্দর্য চেতনায় এখনো সেই প্রাচীন পূর্বপুরুষের ছায়া রয়ে গেছে। যে কোন দক্ষতার প্রদর্শনীতে সৌন্দর্য খুঁজে পাই আমরা। ল্যাসকু থেকে লুভর বা কার্নেগি হল সর্বত্রই আমাদের সহজাত রুচিতে এর প্রমাণ রয়েছে।

দক্ষতার সাথে সম্পন্ন যে কোনো কাজ আমাদের চোখে সুন্দর হয়ে ওঠে। কোন গয়নার দোকানে টিয়ার ড্রপ আকারের কোনো পাথর দেখলে মনে করার কারণ নেই যে আমাদের সংস্কৃতিই শিখিয়েছে তাকে সুন্দর বলতে। বরং আমাদের সুদুর পূর্বপুরুষও ভালোবাসতো এই আকৃতি, আর কদর করতো এর নির্মাণের পেছনের দক্ষতাকে। সেই সময় থেকে, যখন ভালোবাসা প্রকাশের ভাষাও ছিল না তাদের কাছে।

সত্যি কি সৌন্দর্য নির্ভর করে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর? না। বরং এই বোধ আমাদের মস্তিষ্কের অংশ, যা আমরা উপহারস্বরূপ পেয়েছি প্রাচীন পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। কোন সুন্দর প্রতিকৃতি, আবেগ-এর প্রকাশ, শিল্প বা সংঙ্গীতের সৌন্দর্য অথবা রাতের আকাশ দেখে মুগ্ধতা বহন করবে আমাদের উত্তরপুরুষরাও, যতদিন পর্যন্ত মানুষের অস্তিত্ব থাকবে।

ডেনিস ডাটন সম্পর্কে

[ডেনিস ডাটনের জন্ম ৯ ফেব্রুয়ারী ১৯৪৪, ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ফারনান্দো ভ্যালি তে, সেখানে তাঁর বাবা-মা একটা বইয়ের দোকানের মালিক ছিলেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন সানটা বারবারায়, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়াতে, ১৯৭৫ সালে এখান থেকেই ফিলোজফিতে পি.এইচ.ডি করেন। এখানে শিক্ষকতাও করেছেন কিছুদিন। ১৯৭৬ সালে মিসিগান ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতার সময় তিনি 'ফিলজফি এ্যান্ড লিটারেচার' নামে ষান্মাসিক সাময়িকী বের করা শুরু করেন। এই সাময়িকী ১৯৮৩ সালে তাঁর কাছ থেকে কিনে নিয়েছিল জন-হপকিন্স ইউনিভার্সিটি, তবে তিনি সম্পাদক হিসাবে থেকে গিয়েছিলেন।

পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য নিউজিল্যান্ড চলে আসেন এবং ১৯৮৪ সাল থেকে ক্রাইস্টচার্চের ক্যান্টারবেরী ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা আরম্ভ করেন।

তিনি 'নিউজিল্যান্ড স্কেপটিক'দের স্থাপয়িতা ছিলেন এবং প্রথম চেয়ারম্যান। এই দল নিউজিল্যান্ডের বেশ কয়েকজন শিক্ষক, বৈজ্ঞানিক, যাদুকর, ডাক্তার এবং অন্যান্য অনেক পেশার মানুষ নিয়ে একটি নেটওয়ার্ক। এরা বিজ্ঞান এবং পরাবিজ্ঞানের (যেমন সাইকিক শক্তি) মধ্যে কোন যোগসূত্র আছে কিনা তা নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করেন।

১৯৯৫ সালে তিনি রেডিও নিউজিল্যান্ডের বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের একজন ছিলেন এবং এখানে সাত বছর কাজ করেছেন। তবে পরবর্তীতে সংবাদ ও বিভিন্ন ঘটনা বিষয়ে রেডিও নিউজিল্যান্ডের পক্ষপাতদুষ্টতা নিয়ে এক রিপোর্ট লিখেছিলেন।

'আর্টস এ্যান্ড লেটার্স ডেইলি' (http://www.aldaily.com/ ) নামে একটা ওয়েবসাইট শুরু করেছিলেন ১৯৯৮ সালে। অনেকেই বলেন এটি তাঁর সবচেয়ে প্রভাবশালী অর্জন। তাঁর মৃত্যুর পর ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে তাকেঁ নিয়ে একটি লেখায় এই ওয়েবসাইটের কথা বিস্তারিত ভাবে বলা হয়েছে। আগ্রহীরা লেখাটি অনলাইনে পড়তে পারেন এখান থেকে: http://online.wsj.com/article/SB10001424052748704405704576064540563199586.html?KEYWORDS=denis+dutton। এই ওয়েবসাইটে প্রতিদিন তিন/চারটা লিঙ্ক পোস্ট করা হয় সাহিত্য ও শিল্প বিষয়ক বিভিন্ন লেখার যা সারা পৃথিবীর অনলাইন লেখা থেকে সংগৃহীত। বর্তমানে প্রতিমাসে এই সাইট ভিজিট করেন তিন মিলিয়নেরও বেশী পাঠক। এই ওয়েবসাইটের তিন মাস বয়সেই লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা বলেছিল এটা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ওয়েবসাইট। ১৯৯৯ সালে ক্রনিকল অফ হাইয়ার এডুকেশনের কাছে $২৫০,০০০ দামে ওয়েবসাইটটি বিক্রি করেন তিনি।

২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে Bloomsbury Press থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর বই 'The Art Instinct – Beauty, Pleasure & Human Evolution'। এই বই সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য ও রিভিউ পাওয়া যাবে এখানে: http://theartinstinct.com/। আমার অনুবাদটিও এই বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে তাঁর দশ মিনিটের বক্তৃতার থেকে নেয়া। এছাড়াও এই বই বিষয়ে Google একটি এক ঘণ্টার সেমিনার করেছিল, সেটা দেখা যাবে এখান থেকে: http://www.youtube.com/watch?v=R-Di86RqDL4

২০১০ সালের ১৫ ডিসেম্বর তাঁকে কেন্টারবেরি ইউনিভার্সিটি রিসার্চ পদকে সম্মানিত করা হয়। এ সময়েও তাঁর শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল না। হুইল চেয়ারে করে অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। এর দুই সপ্তাহের মধ্যেই ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ, ২০১০ সালে প্রোস্টেট ক্যানসারে মারা যান ডেনিস ডাটন।–অনুবাদক]

লেখকের আর্টস প্রোফাইল: লুনা রুশদী
ইমেইল: lunarushdi@gmail.com

—-
ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts