আভাটার: বর্ণ, সাম্রাজ্য ও টেকনলজির মাহাত্ম্য বর্ণনার রূপকথা

ফরহাদ মজহার
Published : 6 April 2010, 03:15 PM
Updated : 6 April 2010, 03:15 PM
[আভাটার জেমস ক্যামেরনের মহাকাব্যিক সায়েন্স ফিকশন ছবি। এর চিত্রনাট্যও তাঁরই লেখা। ছবিটি মুক্তি পায় ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। ছবির কাহিনী ২১৫৪ সালের এক ভবিষ্যৎ ভিনগ্রহের চাঁদ প্যানডোরার। ক্যামেরন ছবির চিত্রনাট্যের ৮০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত লিখে রেখে দিয়েছিলেন ১৯৯৪ সালেই। ১৯৯৬-এ ঠিক করেন তাঁর
……
জেমস ক্যামেরন (জন্ম. অনটারিও, কানাডা, ১৬/৮/১৯৫৪)
……….
নির্মীয়মান ছবি টাইটানিক (১৯৯৭)-এর পরেই তিনি এর কাজ ধরবেন। কিন্তু স্পেশাল ইফেক্টস বিশেষজ্ঞ ক্যামেরন ছবি বিষয়ে যেরকম ভাবনা ভেবেছিলেন তখনো তেমন তেমন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়নি। তাই অপেক্ষা করছিলেন তিনি। পরে সম্ভাবনা উন্মুক্ত হওয়ায় ২০০৬ সালে আবার তিনি চিত্রনাট্যে হাত দেন। ছবিটি প্রচলিত দ্বিমাত্রিক প্রজেক্টরের পাশাপাশি ত্রি-মাত্রিক প্রজেক্টরের জন্য তৈরি করা হয়েছে। আভাটারের জন্য ক্যামেরন উদ্ভাবন করেছেন নতুন এক ক্যামেরা। যার দ্বারা অভিনেতা-অভিনেত্রীর মুখভঙ্গির সঞ্চালন ডিজিটালি রেকর্ড করে অ্যানিমেটেড চরিত্রের উপর হুবহু আরোপ করা যায়। ছবিটি ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা করেছে। এবং এর সিক্যুয়েল করার ঘোষণাও দিয়েছেন জেমস ক্যামেরন।

আভাটার নিয়ে ফরহাদ মজহারের এ লেখাটি কয়েক কিস্তিতে প্রকাশিত হবে।—বি. স.]

———————————————————————————
কিস্তি ১
———————————————————————————

জেমস ক্যামেরনের টাইটানিক ছবিটি বাজারে এসেছিল ১৯৯৭ সালে। তখন দেখা হয় নি। ছবিটি আমি দেখেছি অনেক পরে। যখন দেখেছি তখন জেমস ক্যামেরন আভাটার ছবিটি বানাচ্ছিলেন বলে শুনেছি। তখনেই ভেবে রাখি আভাটার দেখব। আভাটার সিনেমা দেখার ইচ্ছা টাইটানিক ছবিটি দেখার পর পরই জেগেছিল নিছক আমোদের জন্য নয়। আরো নানান উদ্দেশ্য চরিতার্থ


আভাটারের দৃশ্য

করার বাসনা ছিল ঐ 'দেখা'-র আকাঙ্ক্ষার মধ্যে। টাইটানিকে বিনিয়োগ ছিল বিশাল, কিন্তু তারো চেয়ে বেশি বিনিয়োগ ছিল আভাটার-এর পেছনে। সিনেমার একটা অর্থশাস্ত্রীয় বিচার হতেই পারে তাহলে। কিন্তু তার জন্য যে তথ্য-উপাত্ত দরকার তার হদিস পাওয়া কঠিন। বাংলাদেশের গ্রামে গেলেই দেখি চৈত্রের হাহাকারে মাঠ পুড়ে যাচ্ছে, খাবার পানির অভাবে কারবালা হয়ে যাচ্ছে চতুর্দিক। তার মধ্যে মাটির তলার পানি তুলে উফশি ধানের আবাদ হচ্ছে; ওর ফলে আর্সেনিকের বিষে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ওর মধ্যেই চারিদিকে ডিজিটাল বিপ্লবের সুসমাচার! ইনফরমেশান টেকনলজির কথিত তথ্য বিপ্লবের চিৎকার সত্ত্বেও যে তথ্যগুলো আমাদের প্রাণে বেঁচে থাকার জন্য দরকার তারই খোঁজ নাই—যেমন, সার, বিষ ও মাটির তলার পানি না তুলেও ফলন বাড়ানো যায়, আর ফলন বাড়ানোর আসলেই এটাই একমাত্র টেকসই পদ্ধতি। কিন্তু বহুজাতিক কম্পানিগুলো সেটা শুনবে না। সার, বিষ ও মাটির তলার পানি তুলে চাষাবাদে লাভ হয় সার, বিষ, ট্রাক্টর, তেল ও হাইব্রিড ও জিএমও বীজ কম্পানির। কৃষকের নয়। দখল হয়ে যাচ্ছে প্রাণ ও পরিবেশ রক্ষার শর্ত।


ইউটিউবে আভাটারের টিজার

নিজেদের হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা প্রাণবৈচিত্র ভিত্তিক চাষাবাদ পদ্ধতি ধ্বংস করে আমরা প্রাণে বেঁচে থাকার শর্ত তিলে তিলে ধ্বংস করছি। এর পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য। প্রাণ ও পরিবেশ সংক্রান্ত এই সাধারণ তথ্যগুলো ভার্চুয়াল জগতে নয়, পাচ্ছি বাস্তবের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার কারণে। আমরা সহজে বুঝতে পারি না যে 'ইনফরমেশন' জ্ঞান নয়, ওটা বাইটস। বাইটসকে কমপিউটারের যান্ত্রিক বাক্সে প্রসেস করার পরেও সেটা বাইটসই থাকে, জ্ঞান নয়। তথ্যকে জ্ঞান হয়ে উঠতে হলে যেটা দরকার সেটা মানুষের চিন্তা ও বিচার ক্ষমতা। বিজ্ঞান, ইনফরমেশান কৃৎকৌশল হাতিয়ার তৈরির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে বলে ভাববার কোন কারণ নাই যে মানুষকে চিন্তায়, জ্ঞানে ও দূরদর্শিতায় আরো পরিণত করে তোলার ক্ষমতা তার আছে। বাংলায় 'বিজ্ঞান' কথাটার মানে কিন্তু বিকৃত জ্ঞান, যে জ্ঞান তার স্বভাব হারিয়ে ফেলেছে এবং জ্ঞান চর্চার উদ্দেশ্য খুইয়েছে। ঠিক। বাংলার বৌদ্ধ দর্শনের মধ্যে 'বিজ্ঞান' ধারণার এই ইঙ্গিত আছে। এই সজ্ঞান সচেতনতা বাংলার ভাবচর্চার মধ্যে আজও আমরা টের পাই। সেই প্রসঙ্গ এখন থাকুক।

……
আভাটারের সম্পাদনা চলছে; জেমস ক্যামেরনের সঙ্গে ছবির কুশলীরা
…….
আমরা জ্ঞানকে যেমন বিকৃত করে আনন্দিত, ঠিক তেমনি আমাদের মনুষ্যজীবনের উদ্দেশ্যকেও উড়নচণ্ডী করে উল্লসিত। ডিজিটাল বিপ্লবের মর্মবাণী হচ্ছে উড়নচণ্ডী জগত থেকে বাস্তবে প্রত্যাবর্তন নয়, বরং উড়নচণ্ডী জগত থেকে ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশ, ওর মধ্যে নীলাভ শিহরণ অনুভব করা—মানব সভ্যতা টেকনলজির গুণে টেকনলজির দাসানুদাস হয়ে সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছে। এই হর্ষে নিজের পায়ের তলার পাটাতনটুকুকেও বোমা মেরে উড়িয়ে দেবার দশা। এই কথাগুলো বলে রাখলাম এই কারণে যে আভাটার থ্রি ডিমেনশনাল প্রডাকশান প্রথমে দেখাতে চেয়েছে টেকনলজির শক্তি এবং আগামি দিনের সিনেমার সম্ভাবনা। একই সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছে টেকনলজির জগতই শেষাবধি আগামি ভবিষ্যৎ। আমি জানি যে সিনেমাশিল্পের অর্থশাস্ত্রীয় বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য জোগাড় করা কঠিন, কিন্তু দর্শকের জায়গা থেকে আভাটার সিনেমাকে কীভাবে বদলিয়ে দিয়েছে ও দেবে তার কিছুটা আন্দাজ অবশ্যই করা সম্ভব। একই সঙ্গে টেকনলজির পূজা বা নামাজ আদায় করাই যে মানুষের অবশ্যম্ভাবী নিয়তি সেই সত্যের উদযাপনও আছে এই ছবিটিতে। ঠিক যে আভাটার সিনেমার ভাষাকে বদলে দেবে, কিন্তু একই সঙ্গে মানুষকে টেকনলজির—ওপরে নয়—অধীনস্থ রাখার বয়ানটিকেও আরো মজবুত করবে।
—————————————————————–
আমাদের রাজনৈতিক বা আর্থ-সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজন নাই; চিৎকার উঠেছে 'ডিজিটাল' বিপ্লবের। ইনফরমেশান টেকনলজি আমাদের জগতকে বদলিয়ে দিয়েছে ও দিচ্ছে সন্দেহ নাই। কিন্তু তার ফল মাত্রই শুভ এই নির্বিচার সিদ্ধান্তের মধ্যে মুশকিল রয়েছে। কৃৎকৌশল আমাদের এখন কাজে আসতেই পারে, সেই তর্ক এখানে তুলছি না। কৃৎকৌশল মাত্রেরই অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক চরিত্র আছে। তার একটা বিচার তো দরকার।
—————————————————————-
জেমস ক্যামেরনের আভাটার সিনেমার অর্থশাস্ত্রীয় বিচারের জন্য তথ্য পাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তবু টেকনলজির একটা বিচার সম্ভব। আমাদের রাজনৈতিক বা আর্থ-সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজন নাই; চিৎকার উঠেছে 'ডিজিটাল' বিপ্লবের। ইনফরমেশান টেকনলজি আমাদের জগতকে বদলিয়ে দিয়েছে ও দিচ্ছে সন্দেহ নাই। কিন্তু তার ফল মাত্রই শুভ এই নির্বিচার সিদ্ধান্তের মধ্যে মুশকিল রয়েছে। কৃৎকৌশল আমাদের এখন কাজে আসতেই পারে, সেই তর্ক এখানে তুলছি না। কৃৎকৌশল মাত্রেরই অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক চরিত্র আছে। তার একটা বিচার তো দরকার। রাজনৈতিক বা আর্থ-সামাজিক রূপান্তর নয়, দরকার টেকনলজির—এই চিন্তার বিপদ ভয়ানক। একে রুখে দেওয়া দরকার।

মানবেতিহাস কি শেষাবধি শুধু টেকনলজির ইতিহাস ছাড়া আর কিছু হয়ে উঠতে পারবে না? ইনফরমেশান টেকনলজি নিয়ে যাঁরা বিস্তর লম্বা কথাবার্তা বলেন তাঁদের সম্পর্কেও আমাদের খানিক থমকে দাঁড়ানো দরকার। বাংলাদেশে হুজুগে চিৎকারের মধ্যে যে সত্যটা চাপা দেওয়া হয় সেটা হচ্ছে 'ইনফরমেশান' একটা পণ্য—দুনিয়ায় কোকাকোলা কেনটাকি ফ্রাইড চিকেনের মতো বোতলে পুরে বা জেনেটিকালি মডিফাইড সয়াবিন তেলে ভেজে বেচাবিক্রি হয়। দুনিয়ায় তথ্যের আদান প্রদান ঘটছে এটা বানোয়াট কাহিনী। সেই তথ্যেরই আদান-প্রদান চলে যাতে অল্প কয়েকজন মুনাফা কামাতে পারে এবং মুনাফা কামানোই মনুষ্য জীবনের পরমার্থ, কিম্বা মুনাফাই জগত সংসার সভ্যতার ভিত্তি; এই কাহিনীকেই জগতের প্রধান ও একমাত্র সত্য হিশাবে প্রতিষ্ঠা করবার বয়ান, গল্পগাঁথা, শিল্পসাহিত্য, নাটক থিয়েটার ডিজিটাইল বাইটস হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে তাদের কাছে যারা বাস্তব জগতে নয়, ভার্চুয়াল জগতে বাস করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। ওর মধ্যেও প্রতিরোধ আছে অবশ্যই। কিন্তু সেই দিকে আমি এখন যাচ্ছি না।

আভাটার-কে সামনে রেখে কিছু পর্যবেক্ষণ পেশ করাই আমার এখানে মতলব। ছবি দেখার ক্ষেত্রে আমার 'মিত্র' হচ্ছে কিশোর বা তরুণরা। ওরা কী ধরণের ছবি দেখে, কী তারা পছন্দ করে, কেন করে ইত্যাদি দিকগুলো বোঝার চেষ্টা করি আমি। বাংলাদেশে সিনেমা হলে ছবি দেখার সুযোগ বা সময় আমি পাই না। কিন্তু পাইরেটেড ডিভিডিগুলোর সুবিধাটুকু নিতে পারি। ভাবি যে সিনেমা হলে ছবি না দেখে নিজের কমপিউটারে একা একা ছবি দেখার পার্থক্যের যে সমাজতত্ত্ব সেটাও তো আলোচনার একটা বিষয় হতে পারে। টেকনলজি আমাদের পারস্পরিক সম্পক ও পারিপার্শ্বিক জগতে যে পরিবর্তন ঘটায় সে সম্পর্কে আমরা কতোটা সজাগ?

কিশোর ও তরুণ যাদের আমি চিনি তাদের মধ্যে জেমস ক্যামেরনের প্রতি আগ্রহ আমাকে আভাটার ছবিটি দেখতে তৎপর করে তুলেছে সন্দেহ নাই। তারাই আমাকে প্রথমে খবরটুকু দেয় যে জেমস ক্যামেরন একটি পরিবেশবাদী ফিল্ম বানিয়েছে, আমি যেহেতু প্রাণ ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করি অতএব এই ছবিটি আমার ভাল লাগবে। আমার ছবি সংগ্রহ ও ছবি দেখার বন্ধু হচ্ছে আমার বোনের ছেলে কাশিব আহসান ফারশাদ। ও আমাকে একটা কপি এনে দিল। খুব ভাল ছিল না। কিন্তু দেখলাম। ও ছবির মধ্যে প্রাণ ও পরিবেশের বয়ান আছে এটা ফারশাদ ধরতে পেরেছে দেখে আমি খুশি হই। একই সঙ্গে ওর মধ্যে ছবিটি সম্পর্কে একটি অস্বস্তিও লক্ষ করি। একই অস্বস্তি আমার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। আমি বুঝতে পারলাম ওর কাছে ছবিটি ভাল লেগেছে ঠিক। কিন্তু কোথাও যেন অবিশ্বাস আছে। ভাল কপি সংগ্রহ করে আরো ভালভাবে দেখার সাধ জাগল। এই অবিশ্বাস ও অস্বস্তির কারণটা খোঁজার আগ্রহ বাড়ল আমার। বলা বাহুল্য থ্রি-ডিমেনশনাল ছবি দেখার অভিজ্ঞতা হোল না। তবে কী দেখছি খানিক আন্দাজ করতে পারলাম। তরুণ ও কিশোর—যারা কিছুটা ভাবুক এবং রাজনীতি সচেতন তাদের কাছে ছবিটি যে কারণে ভাল লেগেছে—প্রাণ, পরিবেশ ও 'আদিবাসী' জনগোষ্ঠির লড়াকু স্বভাব ও জয়ী হবার কাহিনী–সেই কারণকে উপেক্ষা করা যাবে না। প্রথম দেখাতে ছবিটি ভাল লাগবার কথা। আমি খানিক হকচকিয়ে গেলাম। কারণ ছবিটি দেখার পর পরই আমার মনে বহু প্রশ্ন জেগেছিলো। যার মধ্যে ভার্চুয়াল জগত আর বাস্তবতার যে ফারাকটা আমরা এই ছবিতে দেখছি তাকে নিছকই কল্পনা আর বাস্তবতার ফারাক বলা যাচ্ছে না। 'ভার্চুয়াল' কথাটার আরেকটি মানে পেয়ে যাচ্ছিলাম ছবিটাতে। সেটা ব্যাখ্যা করার দরকার বোধ করতে শুরু করলাম। সেই ব্যাখ্যাটা যে প্রশ্ন দিয়ে শুরু হতে পারে সেটা হোল 'ভার্চুয়াল' জগত কি কল্পনার জগত? নাকি অন্য কিছু। প্রতীকী? কী আসলে? এই প্রশ্নে আমি ফিরে আসব।


পলিফেমাস গ্রহের চাঁদ প্যানডোরা, পৃথিবীর সঙ্গে কিছু মিল আছে এর; আভাটারের দৃশ্য

আমরা একটা পাঠচক্রে একত্রিত হই প্রতি বৃহস্পতিবার। ভাবলাম চিন্তা পাঠচক্রে দলেবলে ছবিটি দেখা দরকার এবং দর্শকদের প্রতিক্রিয়া শোনা দরকার আমার। ছবির কৃৎকৌশলগত বিচারের চেয়েও যে কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে সেই কাহিনী কে কীভাবে বিচার করে সেটা শোনা দরকার। ছবিটির রাজনৈতিক মর্ম সম্পর্কে পরিচালক ক্যামেরন বলছেন:

'খুব তীব্র ভাবে রাজনীতিকরণ অনেকে যেমন করেন, তেমন করে নয় তবে প্রকৃতির সঙ্গে আমরা কীভাবে আচরণ করি তারই একটা প্রতীক এটা (অর্থাৎ ছবিটি—ফ. ম.)।'

'ওর মধ্যে একধরণের দখলী ভাব আছে।—'আমরা এই তো হাজির, হাতে বন্দুক, টেকনলজি আছে আমাদের, আমাদের মগজও পাক্কা, অতএব এই গ্রহের সবকিছুর ওপর দখলদারি কায়েমের দাবি আছে আমাদের।'

'কিন্তু ব্যাপারটা তো এই ভাবে কাজ করে না, আমরা যদি সজ্ঞান না হই এবং সেই জীবন যদি না খুঁজি যেখানে জীবন পৃথিবীর প্রাকৃতিক চক্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে টিকে থাকে তাহলে অনেক মূল্য দেবার পর আমরা তা বুঝব।'

'(ছবিটি) ইতিহাসের ছিঁড়ে যাওয়া জায়গাটিকে সুতা দিয়ে বাঁধার চেষ্টা। আমি সেই সুতাটা আরো অনেক পেছনে ১৬ ও ১৭ শতাব্দিতে নিয়ে গিয়েছি যখন ইউরোপীয়রা দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায় নিজেদের দখলদারি কায়েম করে এবং সেখানকার আদিবাসীদের উৎখাত করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠিতে রূপান্তরিত করে। রক্ত দিয়ে লেখা মনুষ্য জাতির এই এক দীর্ঘ ও অনবদ্য ইতিহাস আমাদের স্মৃতি যতোদূর যায় ততোটাই পেছনে খোদিত- আমাদের তো সেই প্রবণতা রয়েছে যে আমরা যা চাই তা জিজ্ঞাসা না করেই দখল করে নিয়ে থাকি।'

"I see it as a broader metaphor, not so intensely politicised as some would make it, but rather that's how we treat the natural world as well.
"There's a sense of entitlement – 'We're here, we're big, we've got the guns, we've got the technology, we've got the brains, we therefore are entitled to every damn thing on this planet.'

"That's not how it works and we're going to find out the hard way if we don't wise up and start seeking a life that's in balance with the natural cycles of life on earth."

"It's a way of connecting a thread through history. I take that thread further back to the 16th and 17th centuries and to how the Europeans pretty much took over South and Central America and displaced and marginalised the indigenous peoples there.

"There's just this long, wonderful history of the human race written in blood going back as far as we can remember, where we have this tendency to just take what we want without asking."

আমি ইচ্ছা করেই বড় উদ্ধৃতি দিলাম। যাঁরা রাজনীতি সচেতন তাঁরা ছবিটিকে বিচার করবার সময় পরিচালকের উদ্দেশ্য মনে রেখে যেন বিচার করেন তার জন্যই এতো লম্বা টুকলাম।
—————————————————————–
সদিচ্ছাকে সন্দেহ করা আমাদের কর্তব্য নয়। আমরা বরং বিচার করে দেখব জেমস ক্যামেরন এবং দর্শক হিশাবে আমাদের সদিচ্ছাগুলো দাবিয়ে দিয়ে কীভাবে বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ জনপ্রিয় বয়ানগুলোকে আমাদেরই অজান্তে অধিকার করে নেয়। অথচ আমাদের নজর এড়িয়ে চলে যায়। ধরতে পারি না। তীব্র রাজনীতিকরণের পথ পরিহার করে প্রাণ, পরিবেশ ও আদিবাসীদের পক্ষে তিনি যে মসৃণ গল্পটি পেশ করেন আমরা দেখি তার মধ্যে কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী বয়ান ও বর্ণবাদ হাত ধরাধরি করে চলে।
—————————————————————-
দুনিয়ার আবহাওয়ার দুর্দশা, প্যালেস্টাইন, ইরাক, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দখল করে নেওয়া, খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ ও এলাকাগুলোতে বহুজাতিক কম্পানিগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রের চুক্তি এবং তার বিরুদ্ধে মাওবাদীদের নেতৃত্বে গণযুদ্ধ—ইত্যাদি বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে জেমস ক্যামেরনের এই কথাগুলো ভাল লাগবার কথা। সত্যি যে দর্শকদের সেটা ভাল লাগে। এক ধরণের আরামের উপলব্ধি হয়। তাঁরা উজ্জীবিত বোধ করেন। সদিচ্ছাকে সন্দেহ করা আমাদের কর্তব্য নয়। আমরা বরং বিচার করে দেখব জেমস ক্যামেরন এবং দর্শক হিশাবে আমাদের সদিচ্ছাগুলো দাবিয়ে দিয়ে কীভাবে বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ জনপ্রিয় বয়ানগুলোকে আমাদেরই অজান্তে অধিকার করে নেয়। অথচ আমাদের নজর এড়িয়ে চলে যায়। ধরতে পারি না। তীব্র রাজনীতিকরণের পথ পরিহার করে প্রাণ, পরিবেশ ও আদিবাসীদের পক্ষে তিনি যে মসৃণ গল্পটি পেশ করেন আমরা দেখি তার মধ্যে কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী বয়ান ও বর্ণবাদ হাত ধরাধরি করে চলে। সেই দিকটা নিয়েই আমরা আগামি কিস্তিগুলোতে আলোচনা করব।

(চলবে)