রফিকুন নবীর ড্রইং প্রদর্শনী ২০১০

admin
Published : 1 Jan 2011, 02:47 AM
Updated : 1 Jan 2011, 02:47 AM


ড্রইং ৬, কাগজে চারকোল, ৫৪ x ৭৯ সেমি, ২০১০

ধানমণ্ডির গ্যালারী চিত্রক-এ ডিসেম্বরের ৩ থেকে ২০ পর্যন্ত শিল্পী রফিকুন নবীর ড্রইং প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন আনিসুজ্জামান। বিশেষ অতিথি ছিলেন মুস্তাফা মনোয়ার। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন কাইয়ুম চৌধুরী। এটি ছিল শিল্পীর নবম একক চিত্রপ্রদর্শনী।


ড্রইং ১৬, কাগজে জলরঙ, ৫৫ x ৩৯ সেমি

রফিকুন নবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ ফাইন আর্টস-এর ড্রইঙ ও পেইন্টিং বিভাগে প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন এই ইন্সটিটিউটের পরিচালক। বর্তমানে ফ্রিল্যান্স আর্টিস্ট হিসাবে কাজ করছেন। গ্যালারী চিত্রকের সৌজন্যে প্রদর্শনীর ২৭টি ছবি আর্টস-এর ওয়েব গ্যালারিতে উপস্থাপিত হলো।

প্রদর্শনী উপলক্ষে রফিকুন নবীর ভাষ্য:

গ্যালারী চিত্রকের তিন কর্ণধার শিল্পী মোঃ মনিরুজ্জামান, আহমেদ নাজির এবং মোঃ জহির উদ্দিন আমার প্রিয়ভাজন ছাত্র। তাদের ক্রমাগত অনুরোধকে উপেক্ষা করতে না পারার ফল এই একক প্রদর্শনী। অনুরোধ ছিল শুধু ড্রইং-এর। সেই অনুযায়ী কিছু ছবি নিয়ে এই আয়োজন।


রফিকুন নবী, জন্ম. চাপাই নওয়াব গঞ্জ ২৮ নভেম্বর ১৯৪৩

ছবি মানে বিষয়ভিত্তিক সাম্প্রতিক কতক ড্রইং। কথাটিকে উল্টেও বলা যায়। মানে ড্রইংভিত্তিক কিছূ বিষয়কে নিয়ে ছবি রচনা। প্রকৃতি, মানুষ, পশুপাখি ইত্যাদি চেনা জগৎকে ড্রইং উপযোগী কয়েকটি মাধ্যমে উপস্থাপন। মাধ্যম হিসেবে চারকোল, ড্রাই প্যাস্টেল, কালি-কলম, জলরংই মুখ্য। অনুষঙ্গ হিসেবে কখনো-কখনো রংও ব্যবহার করেছি প্রায়োজনে। আমি বলি পাঁচ মিশালী ধরনে আঁকা।

আসলে ড্রইংয়ের প্রতি আমার এক ধরনের মোহ আছে। টান অনুভব করি। তাতে পেইনটিংয়েও ড্রইং এসে যায়। ড্রইংয়ের প্রতি এই দুর্বলতার অন্যতম কারণ হয়তবা ষাট দশকের শুরু থেকে মাঝামাঝিতক আর্ট কলেজের লেখাপড়া। তখন নামী-দামী শিল্পীরা কলেজটিতে শিক্ষক ছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই ড্রইংয়ের প্রতি জোর দিতেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, আনোয়ারুল হক, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, আব্দুর রাজ্জাক, রশীদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, কাজী আব্দুল বাসেত, মোস্তাফা মনোয়ার প্রমুখকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম। এঁরা ড্রইং-এ অসাধারণ দক্ষ ছিলেন, শক্তিধর ছিলেন।

অতএব এ ব্যাপারে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। এই বরেণ্য শিল্পীবৃন্দের কাছে আমার শিল্পকলা শিক্ষার সব কিছুরই হাতেখড়ি। লক্ষণীয় যে, ক্লাসে অনুশীলনী পর্যায়ে তাঁরা খাঁটি অ্যাকাডেমিক পদ্ধতিকে প্রাধান্য দিতেন বটে কিন্তু নিজ চর্চায় যাঁর যাঁর আপন ধরনই রাখতেন। এই ঘটনাটি অবশ্য পৃথিবী জুড়েই রয়েছে। সত্তর দশকের শুরুতে গ্রিসে লেখাপড়া করতে গিয়েও একই নিয়ম দেখেছি।

এই যে আর্ট কলেজের পাঠক্রমে অ্যাকাডেমিক পদ্ধতি শেখাবার নিয়ম বেঁধে দেওয়া বা বাধ্যতামূলক করা তার কিছূ কারণ ছিল। বিদেশের অ্যাকাডেমিতে নিয়মটির ব্যাপারে বলা হয় 'বেইজ' তৈরি অবশ্যম্ভাবী, ভবিষ্যতে যে কোনো ধরনের চর্চার জন্য । তবে দেশে এর সাথে যুক্ত ছিল অন্য একটি উল্লেখযোগ্য দিক। তা হলো, লেখাপড়া শেষে জীবন অতিবাহন-সংক্রান্ত। যা হয়ত এখনকার শিল্পকলা চর্চায় নিয়োজিত শিল্পীদের সাথে তুলনীয় নয়।

তখন দিনকালের পরিপ্রেক্ষিতটিই ছিল ভিন্ন। ছুট-ছাট কিছু কমার্শিয়াল কাজ আর বইপত্রের ইলাস্ট্রেশন ছাড়া শিল্পীদের আয়ের কোনো ক্ষেত্র ছিল না। ছবি বিক্রি করে সহজ দিনাতিপাত সম্ভব হত না। তো যে সব কাজ করে মোটামুটি বাঁচার উপায় ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল তাতে ড্রইংয়ের প্রয়োজনীয়তা ছিল মুখ্য। তাই ড্রইংয়ে ছাত্রদের হাত পোক্ত করার দিকে নজর দেয়া হত বেশি।

এ সব কারণে শিল্পকলায় পাশ দেয়া অধিকাংশ শিল্পীর ঝোঁকটাও ড্রইংয়ের দিকে যেত বলে আমার ধারণা। ছবিও 'ড্রইং প্রধান' হয়ে পড়ত।

তবে নিখাদ অ্যাকাডেমিক যে ধরন তা থেকে আমার বর্তমান অবস্থানে অনেকটাই দূরত্ব বেড়েছে বলে উপলব্ধি করি। আবার এও হয়েছে যে, সেই ধরন আর বদলে যাওয়ায় ঈষৎ আধুনিকতা মিশে একটু ভিন্নতর ব্যাপার ঘটেছে। আমি অকপটে স্বীকার করি যে, এককালে চর্চায় রাখা ইলাস্ট্রেশন এবং কার্টুন-ড্রইংয়ে আমার অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে কিছূটা হলেও প্রচ্ছন্নে উপস্থিত থাকে। আমি সেসবকে অগ্রাহ্য করে দূরে ঠেলি না ।

প্রতিনিয়ত ড্রইং করি। করতে হয়। যেহেতু বিষয়ভিত্তিক চিত্র রচনার দিকে এখনো মন দেয়া আছে, সে কারণে পেইন্টিং অথবা ছাপচিত্র, যাই করি ড্রইংয়ের প্রশ্রয় থেকেই যায়। তো ড্রইং চর্চায় রাখি রেওয়াজের মতো করে। বলা চলে আঁকিবুকি করি। এতে অনেক খসড়া থেকে কখনো একটি পেইন্টংয়ের বিষয় বিন্যাস যেমন ঘটে তেমনি আবার উল্টোটাও ঘটে। অর্থাৎ একটি খসড়ার হরেক রেখার সমষ্টি থেকে অনেকগুলি ছবির খোরাক জুটে যায়। প্রাপ্তি ঘটে নতুন নতুন আকার আকৃতির, বিষয়ের। রেখার মধ্য থেকে অজান্তে কিছু খুঁটিনাটি, এলিমেন্টস্ উপস্থিত হয়।

যাই হোক, এই প্রদর্শনীর ড্রইংগুলি নিতান্তই আমার ভালোলাগাকে প্রাধান্য দিয়ে। তেমন কোনো অত্যাধুনিক নিরীক্ষাধর্মী নয়। যখন যা ভাবনায় এবং হাতে এসেছে তাই আঁকার চেষ্টা করেছি স্মৃতিকে অবলম্বন করে এবং মেমোরি ড্রইংকেই সহায়ক করে । এই পন্থার ড্রইংয়ে এক ধরনের সুবিধে হয় বলে আমার ধারণা। বাস্তবের অনেক অপ্রয়োজনীয় ডিটেলস মন থেকে মুছে থাকে। আবার এমনও হয় যে, স্মৃতিতে গেঁথে থাকলেও তা ইচ্ছেমাফিক পরিহার করা যায়। এভাবে বাস্তবের স্মৃতি ও স্মৃতির বাস্তবতা মিলেমিশে এক ধরনের নতুন ভাবলোক সৃষ্টি হয়। তাতে ছবিটি সব কিছূ মিলিয়ে এক ধরনের রূপকধর্মিতার চেহারা পেতে পারে বলে আমার মনে হয় । চেনা জগৎ ভিন্ন মাত্রা লাভ করুক, এই ইচ্ছা বা আশায় এ পথে যাওয়া। এই সাথে আর একটি বিশ্বাসকে আমি ধারণ করি। তা হল নিজের ভালো লাগাকে দর্শকদের ভালোলাগায় রূপান্তরের।

আসলে ছবি আঁকার জগতে ড্রইংই হল একমাত্র সার্বজনীন মাধ্যম। সব মানুষই ড্রইং করে। অতএব এই দিকটি শুধুই যে শিল্পীদেরই তা নয়। খাতার পাতায় , টুল-টেবিলের তক্তায় আঁকিবুকি, কাটাকুটি করার মধ্যে দিয়ে জেনে না জেনে বা কথা বলতে বলতে অন্যমনস্কতার মধ্যে কলম-পেন্সিলের দাগাদাগি করে না এমন কেউ আছে বলে মনে হয় না। এসবও ড্রইংয়েরই ব্যাপার। তবে শিল্পীরা সেজেগুজে বুঝে-শুনে যখন অর্থবহতা এনে এসব করেন তখন অন্য মাত্রা হয়। আমিও সেই গোত্রভুক্ত থাকার চেষ্টা করি।

এই প্রর্দশনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ।

রফিকুন নবী

প্রদর্শিত ছবি থেকে
(বড় আকারে দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন।)

—-
ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts