সফিউদ্দীন আহমেদের ছাপচিত্র

কামরুল হাসানকামরুল হাসান
Published : 5 Dec 2010, 07:35 PM
Updated : 5 Dec 2010, 07:35 PM


মেলার পথে, উড এনগ্রেভিং, ১৯৪৭

বাংলাদেশের আধুনিক ছাপচিত্রের জনক শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার দ্বারা আমাদের ছাপচিত্র জগৎকে বিশ্বমানে উন্নীত করেছেন। ছাপচিত্রের অনেকগুলো মাধ্যমকে তিনি ব্যাপক ও গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সমৃদ্ধ করেছেন। এসব মাধ্যমের মধ্যে রয়েছে: উড এনগ্রেভিং, ড্রাই পয়েন্ট, এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, কপার এনগ্রেভিং প্রভৃতি।

………
সফিউদ্দীন আহমেদ; জন্ম. কলকাতা ১৯২২
……..
কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলে ১৯৩৬-৪২ কালপর্বে স্নাতক সমমানের ছ-বছরের শিক্ষা কোর্সে তিনি ছিলেন ফাইন আর্টসের ছাত্র; তারপর ১৯৪৪-৪৬ পর্বে শিক্ষকতার কোর্সে তিনি শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন ছাপচিত্র। মুকুল দে, রমেন চক্রবর্তী প্রমুখ শিল্পী ভারতের ছাপচিত্রকে বিশ শতকের ত্রিশের দশকে যে উন্নত শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেন তা সফিউদ্দীন আহমেদকে আকৃষ্ট করে। তিনিও এ-বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণসহ তাঁর শিক্ষকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভারতীয় ছাপচিত্রকে পৌঁছে দেন শিল্পের উন্নত মহিমায়। ফলে সমগ্র ভারতের আধুনিক ছাপচিত্রের অগ্রণী শিল্পীদের তালিকায় তাঁর নামও অনিবার্যভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে।

সফিউদ্দীন আহমেদের ছাপচিত্র
(বড় আকারে দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন।)

১৯৪৬-৪৭ পর্বে দু-দুটি পুরস্কার প্রাপ্তির ঘটনায় তার প্রমাণ মেলে। নয়াদিল্লিতে দি অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস সোসাইটির উদ্যোগে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সমকালীন চারুকলা প্রদর্শনীতে (১৯৪৬) উড এনগ্রেভিং মাধ্যমে আঁকা 'সাঁওতাল মেয়ে' (১৯৪৬) চিত্রটির জন্য পাশ্চাত্য ধারার সাদা-কালো বিভাগে প্রথম পুরস্কার এবং নয়াদিল্লিতে ওই একই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে আয়োজিত আন্তঃএশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে (১৯৪৭) অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে আঁকা 'পারাবত' (১৯৪৫) চিত্রটির জন্য সাদা-কালো বিভাগে (এচিং ও ড্রইং) প্রথম পুরস্কার লাভ করেন তিনি।

…….
দুমকার শালবন ও মোষ, ড্রাইপয়েন্ট, ১৯৪৪
…….
ছাত্রজীবনেই শুরু করেছিলেন উড এনগ্রেভিং মাধ্যমের চর্চা, সেটি ১৯৫৬ সালে লন্ডন যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কলকাতায় শিক্ষকতা কোর্সে অধ্যয়নকালে ড্রাই পয়েন্ট মাধ্যমে ছবি এঁকেছেন, তারপর আর আঁকেননি। ওই সময়েই কোর্সের প্রয়োজনে লিথোগ্রাফি ও ম্যুরাল পেইন্টিং মাধ্যমের চর্চা করেছিলেন, কিন্তু পরে আর এ-বিষয়ে আগ্রহ দেখাননি। ওই সময়েই তিনি অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে চিত্র রচনা করেছেন। ঢাকায় এসেও এ-মাধ্যমে ছবি এঁকেছেন এবং লন্ডন গিয়ে এচিং মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষা লাভের পর এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, সফটগ্রাউন্ড, লিফটগ্রাউন্ড, ডিপ এচ প্রভৃতি নানা মাধ্যমের মিশ্রণ ঘটিয়ে চিত্র রচনা করেছেন। লন্ডনে শিখেছেন আরেকটি নতুন মাধ্যম: কপার এনগ্রেভিং (তাম্রতক্ষণ)। তাঁর ছাপচিত্রের অনুশীলন শুরু হয়েছিল উড এনগ্রেভিং দিয়ে, শেষ হয়েছে কপার এনগ্রেভিং-এর মাধ্যমে।

লন্ডন যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সফিউদ্দীন আহমেদের চিত্রধারায় অবয়বধর্মী বাস্তবতাই ছিল মুখ্য। অবয়বকে তিনি ইতোমধ্যে ভাঙলেও তা নিজ পরিচিত রূপকে পুরোপুরিভাবে বিনাশ করেনি। কিন্তু লন্ডনে যাওয়ার পর অবয়বকে তিনি এতটাই ভাঙচুর করেন যে, তা তার পরিচিত রূপকে পুরোপুরিভাবে হারিয়ে ফেলে। এভাবেই তিনি বিশ শতকের মধ্যলগ্নে বিশ্বশিল্পে সংঘটিত আধুনিক ধারাকে অঙ্গীকার করেন। ফলে তাঁর চিত্রের জমিনে এসে ভিড় করে নানা অপরিচিত রূপকল্প (ইমেজ)। সেইসঙ্গে তিনি ব্রতী হন টেকনিকের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। সূক্ষ্ম রেখার পাশাপাশি ছাপচিত্রে স্থূল ও মোটা রেখা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিরীক্ষায় রত হন তিনি। ছাপচিত্রের প্রতি মাধ্যমেই সফিউদ্দীন আহমেদের রেখার একটা প্রবল গতি আছে। রেখার এই গতিধর্মের সঙ্গে যুক্ত তাঁর সূক্ষ্মতা এবং কখনো কখনো ঋজুতা। দীর্ঘকাল যাবৎ তাঁর ছাপচিত্রে এই সূক্ষ্ম ও সরু রেখারই ছিল আধিপত্য। এই সূক্ষ্ম রেখার স্থলে তিনি স্থূল বা মোটা রেখার অনুশীলন শুরু করেন ১৯৬২ সালে। লন্ডনের শিক্ষা তাঁর চিত্রের বিষয় ও কলাকৌশলে যে পরিবর্তনের সূচনা ঘটায় তাতে রূপক-প্রতীকের আশ্রয় গ্রহণ হয়ে ওঠে অনিবার্য। স্বাধীনতা-উত্তরকালেও অব্যাহত থাকে এই ধারা। এ কালে চোখ তাঁর ছবিতে বিশেষভাবে প্রতীকী ব্যঞ্জনার দ্যোতক হয়ে ওঠে। একথা ঠিক, ষাটের দশকে মাছের রূপাবয়ব ও নৌকার গলুই তাঁর চিত্রে চোখের আদল পেয়েছে। 'বিক্ষুব্ধ মাছ' (১৯৬৪) শীর্ষক চিত্রে মাছের চোখটি প্রকাশ করছে তার বদ্ধাবস্থাজনিত প্রতিবাদ। এসবই হয়ত বিক্ষিপ্ত চিত্র। কিন্তু আশির দশকে তিনি সরাসরি চোখের মোটিফ ব্যবহার করে আঁকেন 'কান্না', 'একুশে স্মরণে', 'একাত্তরের স্মৃতি' ও পরবর্তীকালে 'একাত্তরের স্মরণে' শীর্ষক তাম্রতক্ষণ মাধ্যমের একগুচ্ছ চিত্র যা চোখের এক নতুন রূপ বা অভিব্যক্তি প্রকাশ করে।

এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, মেটাল এনগ্রেভিং মাধ্যমে তিনি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করেন সার্থক সব চিত্রকর্ম। তাঁর এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার সবচেয়ে সার্থক দৃষ্টান্ত 'জলের নিনাদ' (১৯৮৫) শীর্ষক শিল্পকর্মটি। এটি করার জন্য তিনি ছাপচিত্রের প্রায় সবগুলো মাধ্যমকে এক সঙ্গে ব্যবহার করেন। এ আইডিয়াটা তিনি নেন অর্কেস্ট্রা থেকে। অর্কেস্ট্রায় একসঙ্গে শত লোক বাদ্যযন্ত্র বাজায়, কখনো তার সুর হয়ে যায় ভীষণ চড়া, আবার কখনো তা নামতে নামতে নেমে যায় একবারে সূক্ষ্ম খাদে, আচ্ছন্ন হয়ে যায় বিষাদে। এই যে চড়া সুর থেকে খাদে নামিয়ে আনা, সবগুলো যন্ত্রকে এক সঙ্গে বাজানো এবং তার মধ্যে এক অপূর্ব সমন্বয় সাধনের অসাধারণ দক্ষতা অর্কেস্ট্রায় আছে তা থেকেই তিনি পরিকল্পনা করেন ছাপচিত্রের সবগুলো মাধ্যমকে ব্যবহার করে একটি চিত্র সৃষ্টির। এভাবেই তিন বছরের সাধনার ফল হিসেবে সৃষ্টি হয় 'জলের নিনাদ' ছবিটি, যাতে এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, সুগার অ্যাকুয়াটিন্ট, মেজোটিন্ট, লিফটগ্রাউন্ড, এনগ্রেভিং, ডিপ এচ, ড্রাই পয়েন্ট প্রভৃতি মাধ্যমের আশ্রয় নেওয়া হয়।

উড-এনগ্রেভিং
কলকাতা আর্ট স্কুলে সে-সময়ে উডকাট ও উড-এনগ্রেভিং এ দুটি মাধ্যমের কাজই শেখানো হতো। কিন্তু সফিউদ্দীন আহমেদ উডকাটের পরিবর্তে উড-এনগ্রেভিং মাধ্যমের অনুশীলনেই আগ্রহী হন। কারণ, এ মাধ্যমে রয়েছে তুলনামূলকভাবে বেশি সূক্ষ্মতার কারুকাজ, অনুপুঙ্খতার খেলা এবং সর্বোপরি আলো-ছায়ার বর্ণবিভাগত মজা। সফিউদ্দীন আহমেদ ছাপচিত্রের যতগুলো মাধ্যমে কাজ করেছেন তার মধ্যে এটিই শুধু রিলিফ পদ্ধতির, বাকি সবগুলো ইন্টাগ্লিও (অন্তর্লীন) পদ্ধতির।

উড-এনগ্রেভিং মাধ্যমে সফিউদ্দীন আহমেদের প্রথম উল্লেখযোগ্য চিত্রের নাম: 'ঘরে ফেরা' বা 'বাড়ির পথে' (১৯৪৪)। চিত্রটিতে মোষসহ রাখালের বাড়ি ফেরার এ দৃশ্যে মোষগুলো চলছে যে মাটি ঘেঁষে তা প্রকৃতির বিশালত্বকেই অভিব্যক্ত করে তুলেছে।

উড-এনগ্রেভিং মাধ্যমে সফিউদ্দীন আহমেদের সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রটির নাম: 'সাঁওতাল মেয়ে' চিত্রটিতে দুই সাঁওতাল নারীর কলসিতে পানি ভরার একটি দৃশ্যকে মূর্ত করে তোলা হয়েছে। চিত্রের প্রধান আকর্ষণ হলো, ওই দুই নারীর একটি বিশেষ কর্মরত মুহূর্তের ভঙ্গিমা এবং চিত্রতলে যথার্থভাবে আলো ফেলার সৌকর্য। এরই পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য 'মেলার পথে' (১৯৪৭) শীর্ষক চিত্রকর্মটি। এই চিত্রে কড়া রোদের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে নরম রোদের কোমল আলো। চিত্রকর্মটি কত সূক্ষ্ম, গভীর ও তাৎপর্যবহ হতে পারে সেদিকেই ছিল শিল্পীর সজাগ দৃষ্টি। উড-এনগ্রেভিংয়ের সকল সম্ভাবনাকে এখানে ব্যবহার করা হয়েছে।

ড্রাই পয়েন্ট
ড্রাই পয়েন্ট মাধ্যমে আঁকা তাঁর প্রথম চিত্রকর্মটির বিষয় 'দুমকার শালবন ও মোষ' (১৯৪৪)। বিষয় ও শৈলী উভয় দিক থেকেই চিত্রকর্মটি সার্থক। চিত্রটির আবেদন অনেকটা কবিতার মতো।

এই মাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ চিত্রের বিষয় 'ময়ূরাক্ষী তীরে উপবিষ্ট দুই সাঁওতাল রমণী' (১৯৪৫)। চিত্রের মধ্যভূমিতে কিছুটা বাঁকা করে স্থাপন করা হয়েছে এই দুই অবয়বকে। এ চিত্রে ধারণ করা হয়েছে একটি বিশেষ মুহূর্তকে, কিন্তু তা প্রকাশ করছে সাঁওতাল নারীজীবনের এক বৃহৎ ও সর্বকালীন আখ্যান। এ মাধ্যমে আঁকা তাঁর সর্বশেষ চিত্রটির নাম: 'শান্তিনিকেতনের দৃশ্যপট' (১৯৪৫)। বীরভূমের রুক্ষ মাটির বুক চিরে দীর্ঘ তালবৃক্ষের সারি, তারই মধ্য দিয়ে গরুর গাড়িতে করে কিংবা পদব্রজে চলছে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর জীবনধারা। আলোছায়ার ব্যবহারে ও পরিপ্রেক্ষিতের সুচারুতায় চিত্রকর্মটি সার্থকতা লাভ করেছে।

এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট
অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে সফিউদ্দীন আহমেদ ১৯৪৫-৪৬ কালপর্বে মাত্র তিনটি চিত্রকর্ম সম্পাদন করেন। এর মধ্যে 'পারাবত' চিত্রটি আলো-ছায়ার ব্যবহারে হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ। চিত্রটির মূল সৌন্দর্য হলো, এর বিরচন-কৌশল। এখানে শিল্পীকে গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে পরিচয় দিতে হয়েছে অসাধারণ পরিমিতিবোধের । কলকাতায় থাকাকালেই তিনি এচিং-মাধ্যমের অনুশীলন শুরু করেন। ১৯৪৭এ ঢাকায় আসার পরও এর চর্চা অব্যাহত রাখেন। তবে তা আকাঙ্ক্ষিত গতি লাভ করে যখন তিনি এ-বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে লন্ডন যান।

১৯৫৬-৫৯ কালপর্বে সফিউদ্দীন আহমেদ লন্ডনে এচিং ও এনগ্রেভিং (মেটাল) মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা লাভ করলে তাঁর চিত্রচর্চায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা ঘটে। এক. সাদাকালোর পরিবর্তে তাঁর ছাপচিত্র হয়ে ওঠে রঙিন। দুই. দৃশ্যবস্তুকে হুবহু চিত্রায়িত করার পরিবর্তে তাঁর চিত্রতলে ঘটে অবয়বের ব্যাপক ভাঙচুর, এবং চিত্রতল ভরে ওঠে রূপকল্পের সূক্ষ্ম প্রতীকধর্মিতায়। ১৯৫৬-পরবর্তী তাঁর কাজে এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যম পরস্পর এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে, এর পর এই দুই রীতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে আর কম ছবিই তিনি এঁকেছেন।

লন্ডনে যাওয়ার পরপরই তিনি এচিং মাধ্যমে প্রথম যে-চিত্রটি আঁকেন সেটির নাম: 'মাছ ধরার সময়-১' (১৯৫৭)। লন্ডনের এই প্রথম চিত্রেই আমরা লক্ষ করি তাঁর শিল্পীসত্তার মৌলিক পরিবর্তনের দিকচিহ্ন: ছাপচিত্রে রঙের সমাবেশ। এর পরে লন্ডনে তাঁর প্রথম পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য চিত্র হলো সূর্যমুখী ফুল নিয়ে এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে সম্পাদিত 'জড়জীবন' (১৯৫৭)। এই চিত্রও তাঁর শিল্পীসত্তার আরেকটি মৌলিক পরিবর্তনের দিকচিহ্ন ধারণ করে আছে। তা হলো: অবয়বের অবিকল রূপের প্রস্থান। এই চিত্রে সূর্যমুখীর প্রকৃত রূপাবয়ব সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং একই সঙ্গে এর ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যকে ভেঙে দিয়ে ফ্ল্যাট সারফেসের দ্বিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একে ধারণ করা হয়েছে।

১৯৫৯ সালে তিনি এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে রচনা করেন তিনটি উল্লেখযোগ্য চিত্র 'নেমে যাওয়া বান', 'বন্যা-২' ও 'সেতু পারাপার'। এই তিনটি চিত্রকর্মেই রয়েছে শিল্পীর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে সম্পাদিত তাঁর সবচেয়ে সার্থক চিত্রটির নাম 'সেতু পারাপার'। সাদা-কালো এই চিত্রটিতে শিল্পী অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমের গুণগুলোকে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন।

লন্ডন থেকে ফেরার পর এ মাধ্যমের কাজে তিনি নিজেকে আরো কীভাবে অতিক্রম করা যায় সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রত হন। ১৯৬২ সালে এ মাধ্যমে 'মাছ ধরার সময়-২ ও ৩' শীর্ষক দুটি চিত্র রচনায় শিল্পী একটি নতুন বিষয়ের ওপর জোর দেন। তিনি রেখাকে মোটা বা স্থূল করার দিকে মনোযোগী হন। ১৯৬৪ সালে এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে তিনি আঁকেন দুটি চিত্র: 'নীল জল' ও 'বিক্ষুব্ধ মাছ'। 'নীল জল' চিত্রটিতে লক্ষণীয় সূক্ষ্ম ও স্থূল রেখার এক অপূর্ব সমন্বয়। 'বিক্ষুব্ধ মাছ' শীর্ষক চিত্রটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। জালে আবদ্ধ মাছটির চোখে যে বিক্ষোভের আগুন তা তৎকালীন পাকিস্তানী সেনাশাসকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের শৃঙ্খলিত মানুষের অন্তঃক্ষোভেরই প্রতীকী প্রকাশ। পুরো ষাটের দশক জুড়ে তাঁর এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধারা অব্যাহত থাকে।

এ ধারার সর্বশেষ চিত্রটিতে শুধু এই দুই মাধ্যম নয়, ছাপচিত্রের সবকটি মাধ্যমকে ব্যবহার করে এক গভীর নিরীক্ষার আশ্রয় নিয়েছেন শিল্পী। চিত্রটির নাম: 'জলের নিনাদ'। ছাপচিত্রের সকল মাধ্যমের সফল ব্যবহারে এবং শিল্পীর সারা জীবনের শিল্পসাধনার গভীর অভিজ্ঞতাঋদ্ধ চিন্তাভাবনার সমন্বিত প্রকাশে চিত্রটি সার্থকতা অর্জন করেছে।


জলের নিনাদ, এচিং একুয়াটিন্ট ও এনগ্রেভিং, ১৯৮৫

কপার এনগ্রেভিং
সফিউদ্দীন আহমদের শক্তির দিকটি তাম্রতক্ষণ মাধ্যমের চিত্রমালায় আরেকবার প্রমাণিত। ১৯৫৭-৫৮ কালপর্বে এ মাধ্যমে তিনি রচনা করেন : 'জেলের স্বপ্ন', 'হলুদ জাল', 'কম্পোজিশন' ও 'গুনটানা'। 'গুণটানা' চিত্রটিতে নৌকাকে স্রোতের বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে-শক্তি প্রয়োগ গুণ টানার মধ্য দিয়ে ঘটে, তার অন্তর্নিহিত বেগ ও আবেগ চিত্রিত হয়েছে রেখার সাহায্যে। অবয়ব যে বেঁকেচুরে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে তার মূলে রয়েছে ওই গতি ও টেনশন। এনগ্রেভিং কত সমৃদ্ধ হতে পারে এটি তার উত্তম উদাহরণ। সরু মোটা নানা তীক্ষ্ণ রেখার অসাধারণ স্বচ্ছন্দ ব্যবহার এখানে ঘটেছে।

এ চিত্র রচনায় হেটারের প্রভাব লক্ষ করে তা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন শিল্পী। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজন হয় দীর্ঘ সময়ের। ১৯৫৮ সালের পর এ মাধ্যমে তিনি আবার কাজ করেন ১৯৮০ সালে। এ ছবিটির নাম 'কান্না'। চিত্রটিতে শিল্পী মূলত এঁকেছেন 'ঝড়ের চোখ'। যে-ঝড়ের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে দুর্ভোগ-দুর্গতি ও কান্নার উৎসবিন্দু। 'কান্না' সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সফিউদ্দীন আহমেদের চিত্রভুবনে চোখ এক নতুন মাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। প্রথমে তা গতি ও শক্তির তীব্রতা অনুভবের প্রতীক রূপে উপস্থাপিত হলেও ক্রমে তার তাৎপর্য রূপান্তরিত হয়েছে। একই মাধ্যমে তিনি চোখের মোটিফ ব্যবহার করে পরে আরো তিনটি চিত্র আঁকেন যেখানে চোখ হয়ে উঠেছে জাতীয় চিন্তা-চেতনা ও মননের প্রতীক।

'একুশে স্মরণে'র (১৯৮৭) পুরো চিত্র জুড়ে পাশ থেকে দেখা একটি মুখাবয়ব—তাতে আছে নাক, মুখ, চোখ ও চোখের জল। চোখ ও চোখের জলের একাধিক ফর্ম মাথা ও মুখমণ্ডল জুড়ে বিন্যস্ত। বায়ান্নর একুশের সেই জাতীয় আবেগ, তার রক্তাক্ত অশ্রুপাতের স্মৃতি তা শুধু একক ব্যক্তির বিষয় না, তা সমগ্র দেশের সংবেদনশীল সকল মনের অনুভূতিতে বিস্তৃত। এই বিস্তারকেই তিনি চিত্রজুড়ে বিচিত্র ফর্মের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন। চিত্রের সাদা-কালো বিন্যাস, মুখের অভিব্যক্তিতে বিষাদের ব্যঞ্জনা, অশ্রুপাত প্রভৃতির মাধ্যমে একটি বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সকাতর বিক্ষোভের রূপকেই চিত্রিত করা হয়েছে। এর পরের বছরই তিনি আঁকেন 'একাত্তরের স্মৃতি'। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের দুই গৌরবময় প্রান্ত—বায়ান্ন ও একাত্তরকে শিল্পী এভাবে অক্ষয় করে তোলেন। এ চিত্রে শুধু চোখ আর চোখের জলের বিচিত্র ফর্ম। এ চিত্র রচনার পেছনে কাজ করেছে শিল্পীর একাত্তরের বিভীষিকাময় স্মৃতির এক গভীর তাড়না। তাম্রতক্ষণে সম্পন্ন শিল্পীর সর্বশেষ কাজটিও একাত্তরের স্মৃতিতে ভাস্বর।

—-
ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts