মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ও সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের প্রণয় ও তার পরিণতি

মোস্তাক শরীফমোস্তাক শরীফ
Published : 3 Nov 2021, 05:11 AM
Updated : 3 Nov 2021, 05:11 AM


এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নুরুদ্দিন মুহম্মদ জাহাঙ্গীর। চতুর্থ মুঘল সম্রাট। বৈপরীত্যে ভরা এক চরিত্র। ছিলেন শিল্পকলার সমঝদার। ফুল, পাখি, বিচিত্র প্রাণী চমৎকৃত করত তাঁকে। প্রকৃতির রহস্যে বুঁদ হয়ে থাকতেন। লিখেছেন 'তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরি' নামে অসাধারণ এক আত্মজীবনীও। অন্যদিকে শত শত বিদ্রোহীকে শূলে চড়ানো ও জ্যান্ত মানুষকে চামড়া ছাড়িয়ে হত্যার নির্দেশ দেয়ার মতো অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতারও পরিচয় দিয়েছেন। স্ত্রী নূরজাহানের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল প্রবাদপ্রতিম। এক পর্যায়ে সাম্রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব পুরোপুরিই তুলে দেন নূরজাহানের হাতে। নিজে পিতা জালালুদ্দিন মুহম্মদ আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, কিন্তু পুত্র শাহজাহান যখন বিদ্রোহ করল কিছুতেই মানতে পারলেন না সেটি। সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন পুত্রের বিদ্রোহ দমনে। 'আলমপনাহ' কেবল জাহাঙ্গীর নামে বর্ণময় এক চরিত্রের উত্থান-পতনের উপাখ্যান নয়, সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকের ভারতবর্ষের সামগ্রিক চালচিত্রও। অসংখ্য চরিত্র, বিপুল ঘটনাপ্রবাহের সমাহারে ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা বর্ণময় এক উপাখ্যান। উপন্যাসটির প্রথম কয়েকটি অধ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে বিডিনিউজ আর্টস-এর পাতায়। আজ রইল প্রথম কিস্তি।

এক

আগ্রা।
ভোর হয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি। দিনের প্রথম রোদ আগ্রা দুর্গের বেলেপাথরের দেয়াল, গম্বুজ আর প্রকান্ড সব খিলানে মায়ার স্পর্শ বোলাচ্ছে। তবে সে স্পর্শ নির্মম হয়ে উঠতে সময় নেবে না। খানিক পরই চড়তে থাকবে রোদ, অতিষ্ঠ করে তুলবে সবাইকে। আগস্টের শুরু এখন। গেল বছরের চেয়ে বৃষ্টিটা বেশিই হয়েছে এবার, তাই বলে রোদের দাপট কমেনি। আরো মাসদুয়েক যাবে এভাবে, তারপর ধীরে ধীরে জাঁকিয়ে বসবে শীত। দিনমান কুয়াশায় ঢাকা মুঘল রাজধানীকে দেখে তখন বোঝার উপায় থাকবে না দু-মাস আগেই তাওয়ায় বসানো রুটির মতো সেদ্ধ হচ্ছিল শহরটি।
অন্য দিনের তুলনায় দুর্গের ভেতরটা আজ সুনসান। প্রগাঢ় এক নীরবতা যেন ভারি চাদরের মতো বিছিয়ে আছে সর্বত্র। পা টিপে টিপে হাঁটছে সবাই, কথা বলছে ফিসফিসিয়ে, গলা সামান্য উঁচু করলেও যেন বড় কোনো অপরাধ হয়ে যাবে।
সূর্য যখন পূবের রাজপাট ছেড়ে বেয়াড়া কোনো ঘোড়সওয়ারের মতো মধ্যাকাশমুখী যাত্রা করেছে আর রোদের তাপও অসহনীয় উঠতে শুরু করেছে, তখনই প্রাসাদের প্রবেশদ্বারে এসে হাজির হলেন অমাত্যদের একটি দল। সবার সামনে আছেন মির্জা আজিজ কোকা। সম্রাটের দুধ-মা জিজি আনগার সন্তান মির্জা আজিজ কেবল সম্রাটের ছোটবেলার খেলার সাথী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুই নন, দরবারের অন্যতম প্রভাবশালী অমাত্যও। থমথম করছে তাঁর মুখ, কপালে চিন্তার ভাঁজ। প্রহরীদের কুর্নিশ যেন দেখেও দেখলেন না, সদলবলে প্রবেশ করলেন প্রাসাদে।

দশটা বাজে প্রায়। সাধারণত সম্রাটের দিন শুরু হয় খুব ভোরে, চারটার কিছু পর। ন'টার মধ্যেই তিনি প্রাসাদের পূবপাশের ঝুলবারান্দায় সাধারণ মানুষকে দর্শন দিতে যান। দীর্ঘদিনের মধ্যে এ নিয়মের ব্যত্যয় দেখেননি তিনি। কিন্তু গত দু'দিন তাই ঘটেছে। ঝরোখা দর্শনে যাননি সম্রাট। শুধু তাই নয়, একবারের জন্যও যাননি দরবার-ই-আম অথবা দরবার-ই-খাসে। তাঁর মুখদর্শন করারই সৌভাগ্য হয়নি অমাত্যদের কারো। আজ ভোরে ডেকে পাঠিয়েছেন মির্জা আজিজকে। মির্জা আজিজের সহচরদের সঙ্গে আছেন আসাদ বেগ, সম্রাট বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁকে নিয়ে আসার জন্য। ইরানের কাজভিন থেকে আসা এই অমাত্য হিন্দুস্তানে এসেছেন বহু বছর আগে, তবে সম্রাটের নজরে পড়েছেন অল্প ক'দিন হলো। আসাদ বেগ দীর্ঘদেহী, ঘন ভ্রুর নিচে চোখদুটোয় সংকল্পের ছাপ। দেখলেই মনে হয়, নির্ভর করা যায় এর ওপর।
সম্রাটের খাসমহলের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন সবাই। খাসমহলে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন খোজা প্রহরী। তীরের ফলার মতো টানটান শরীর নিয়ে ভাবলেশহীন চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে দরজার দু'পাশে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। দশটার কিছু পরই বেরিয়ে এলেন সম্রাট আকবর। ছোটবেলা থেকেই সখ্য, তবু যতবারই দেখেন চমৎকৃত হন মির্জা আজিজ। মাঝারি উচ্চতা, আপাতদৃষ্টিতে বৈশিষ্ট্যহীন চেহারা; তবু তারই আড়ালে কী এক অদৃশ্য শক্তি যেন আছে মানুষটির, গত ছেচল্লিশ বছর ধরে যে শক্তি হিন্দুস্তানের সিংহাসনে টিকিয়ে রেখেছে তাঁকে। কেবল টিকিয়েই রাখেনি, কাবুল থেকে বাংলা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এক অঞ্চলের অবিসংবাদিত শাসকে পরিণত করেছে।
সম্রাটকে আজ খুব ভালো অবস্থায় দেখবেন না অনুমান করতে পেরেছিলেন মির্জা আজিজ, কিন্তু এতটা বিপর্যস্ত দেখবেন ভাবেননি। দৃষ্টিতে ক্লান্তি, চেহারায় রাত্রি জাগরণের ছাপ। বাম নাসারন্ধ্রের পাশে ঠোঁটের ঠিক উপরে একটি আঁচিল আছে সম্রাটের, আরো বড় দেখাচ্ছে ওটাকে এখন। দু চোখ কোঁচকানো, যেন জটিল কোনো হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে নিজের ওপরই বিরক্ত হয়ে আছেন।
মির্জা আজিজ ও তাঁর সহচরেরা মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করলেন সম্রাটকে। মাথা নিচের দিকে নোয়ানো সবার, সসম্ভ্রমে দু হাত ভাঁজ করে রেখেছেন তলপেটে।
এক এক করে সবার দিকে চাইলেন আকবর। আসাদ বেগের ওপর কিছুক্ষণ আটকে থেকে সবশেষে দৃষ্টি নিবন্ধ হলো মির্জা আজিজের ওপর। 'আসাদ বেগকে সব জানিয়েছ আশা করি?' থমথমে কণ্ঠস্বর সম্রাটের।
কুর্নিশ করলেন মির্জা আজিজ। 'জানিয়েছি জাঁহাপনা।'
আসাদ বেগের দিকে তাকালেন আকবর। 'আসাদ বেগ,' থমথমে গলা তাঁর, 'আমার পিতা বাদশাহ হুমায়ুন তোমাকে স্নেহ করতেন। আর আবুল ফজল ইবনে মুবারক তোমাকে স্নেহ করতেন নিজের সন্তানের মতো। যে নরাধম তোমার পিতৃসম আবুল ফজলের মৃত্যুর জন্য দায়ী তাকে ধরে নিয়ে আসবে তুমি। নিজের হাতে তাকে শাস্তি দেব আমি।'
মাথাটা অনেকটা নুইয়ে কুর্নিশ করলেন আসাদ বেগ। 'আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব আমি আলমপনাহ,' কণ্ঠস্বর নিচু তাঁর, তবে সংকল্পে দৃঢ়।
মির্জা আজিজের দিকে তাকালেন সম্রাট, 'আসাদ বেগের যা যা প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করো। আমি চাই যত দ্রুত সম্ভব যাত্রা শুরু করবে সে।'
মাথা নোয়ালেন মির্জা আজিজ। ঘুরে দাঁড়ালেন সম্রাট, অদৃশ্য হয়ে গেলেন খাসমহলের অভ্যন্তরে। তাঁর গমনপথের দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই ভ্রু দুটো কুঁচকে উঠল মির্জা আজিজের। জীবনে এই প্রথম কি কিছুটা শিথিলতা লক্ষ করলেন জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবরের শরীরী ভঙ্গিতে? সামান্য হলেও একটু দুর্বলতা?
সহচরদের নিয়ে যখন বেরিয়ে আসছেন কোঁচকানো ভ্রু তখনও সমান হয়নি। আসন্ন এক ঝড়ের অশুভ পদধ্বনি কানে বাজছে অভিজ্ঞ অমাত্যের।

আগ্রা দুর্গের একবারেই বিপরীত দৃশ্য তিনশো মাইল দূরে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থলে ইলাহাবাদ শহরে। যমুনার তীরে আকবরের নিজের গড়া দুর্গে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র সেলিমের দরবারে এখন খুশির আমেজ।
সকাল সকাল দরবারে হাজির হয়েছে সেলিমের বিশ্বস্ত সহচর ও ছোটবেলার বন্ধু খুবু ওরফে কুতুবুদ্দিন কোকা। সঙ্গে আছে আবদুল্লাহ খান, শেখ কবির ও মহব্বত খান-যার নাম তখনও জামানা বেগ।
সাদার মধ্যে সোনালী কাজ করা ফিনফিনে একটি আলখেল্লা পরেছেন শাহজাদা সেলিম, মাথায় সোনালী জরির কাজ করা পাগড়ি। দরবারে প্রবেশ করেই সেলিমকে কুর্নিশ করলেন চার সহচর। কুতুবুদ্দিন বললেন, 'আপনার মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে। এখন আমাদের উৎসবের সময়।'
স্মিত হাসলেন সেলিম। চেহারায় পিতার সাথে তেমন কোনো মিল নেই তাঁর। পিতার চেয়ে উচ্চতা খানিকটা বেশি, উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ। আকবরের মতো গোলাকৃতি নয়, কিছুটা চৌকোণা চেহারা। সুন্দর করে ছাঁটা গোঁফ দু ঠোঁটের পাশ দিয়ে সামান্য বেঁকে নিচে নেমে গেছে। দৃষ্টিতে এক ধরনের অন্যমনস্কতা মেশানো নিরাসক্তি, যেন এখানে থেকেও বহুদূরে কোথাও মন পড়ে আছে তাঁর।
'বুন্দেলারাজ বীর সিং দেওকে নিজের হাতে পুরস্কৃত করতে পারলে খুশি হতাম,' সেলিমের কণ্ঠস্বর নিচু, অনেকটাই যেন আত্মগত, 'কে অস্বীকার করবে, নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে এনেছে আবুল ফজল?' খানিক ইতস্তত করলেন সেলিম, তারপর বললেন, 'আগ্রার খবর কিছু জানো?'
মুখ খুললেন মহব্বত খান, সেলিমের সহচরদের মধ্যে সবচেয়ে ঠাণ্ডা মাথার এবং সাহসী বলে সুনাম আছে যার। 'শুনলাম জাঁহাপনা খুব মুষড়ে পড়েছেন, কাউকে দর্শন দিচ্ছেন না। বীর সিং দেওকে যেভাবে হোক ধরে আনার নির্দেশ দিয়েছেন বলেও শুনেছি।'
'দায়িত্বটা কাকে দিয়েছেন?'
'নিশ্চিত করে জানি না। তবে শুনেছি বীর সিং দেও বুন্দেলখণ্ডের পাহাড়ি এলাকার দিকে পালিয়ে গেছে।'
সেলিমের চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ল। 'আল্লাহ তাকে হেফাজত করুন। তোমাদের কী মনে হয়, শাহেনশাহর রাগ নিশ্চয়ই বেশিদিন থাকবে না? যা ঘটার তো ঘটেই গিয়েছে, হিন্দুস্তানের শাহেনশাহ নিশ্চয়ই সামান্য এক ঘটনার পেছনে এত সময় নষ্ট করবেন না?'
সেলিমের মুখভঙ্গী আর প্রশ্ন করার ধরন দেখে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝেও হাসি পেল মহব্বত খানের। মনে হচ্ছে এক শিশু যেন ভুল করে মায়ের প্রিয় কোনো পেয়ালা বা ফুলদানি ভেঙে ফেলে নিজের মনকে বুঝ দিচ্ছে এখন। উপস্থিত বাকি সবার মতো মহব্বত খানও জানে, আবুল ফজলের হত্যাকাণ্ড কোনো সামান্য ঘটনা নয়। সম্রাট আকবরের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠদের মধ্যে তিনি একজন। সেলিমের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আবুল ফজল যদি আগ্রায় পৌঁছুতে পারে তাহলে নতুন করে কান ভারি করবে সম্রাটের, ফলে ইতোমধ্যে পুত্রের ওপর বিষিয়ে থাকা সম্রাটের মন তিক্ত হয়ে উঠবে আরো। কথাটার মধ্যে সত্যতা আছে, জানেন মহব্বত খান।
বস্তুত সম্রাটের ওপর আবুল ফজলের বাড়াবাড়ি প্রভাব তাকেও বিস্মিত করে মাঝে মাঝে। অবশ্য ষাটোর্ধ্ব সম্রাটের বিচারবুদ্ধিও যে আগের মতো তীক্ষè নেই সেটিই বা কার অজানা আছে!
সহচরদের বিদায় দিয়ে দরবার ছেড়ে হেরেমের দিকে পা বাড়ান শাহজাদা। নিজের মনকে যতই বুঝ দিন, আবুল ফজলের মৃত্যুতে সম্রাটের প্রতিক্রিয়া ঠিক কেমন হবে তা ভেবে ঠিকই শঙ্কায় দুরুদুরু করছে বুক। তবে যতই শঙ্কিত হোন, চিরশত্রু আবুল ফজলকে হত্যা করা ছাড়া যে উপায় ছিল না সে উপলব্ধি এক ধরনের শক্তিও জোগাচ্ছে মনে। নিজের খাসমহলে পৌঁছে আরামকেদারায় শরীর এলিয়ে দিলেন সেলিম। খোলা জানালা দিয়ে যমুনার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে হঠাৎ শরাব পানের ইচ্ছেটা চাগিয়ে উঠল, চেষ্টা করে নিজেকে নিবৃত্ত করলেন সেলিম। সন্ধ্যা বাদে দিনের অন্যসময় শরাব পান বন্ধ করেছেস বেশ কিছুদিন হলো। সর্বনাশা নেশাটাকে বাগ মানাতে কষ্ট হয়েছে বেশ, মুহূর্তের খেয়ালে সেটাকে নষ্ট করতে সায় দিল না মন। মনকে অন্যদিকে ফেরানোর জন্য তালেব আমোলির লেখা প্রিয় একটা শের বিড়বিড় করে আওড়ালেন তিনি:

"দু লাব দারাম ইয়েকি দার মিপারসাতি
ইয়েকি দার উজর খোয়াহি হ্যায় মাস্তি"

দুটো ঠোঁট আমার-
একটি ক্রমাগত পান করে শরাব,
আর অন্যটি শরাবপানের জন্য চায় মাফ!

প্রথম যেদিন শরাবের নেশা শুরু হল চোখ বন্ধ করলে সেদিনটিকে স্পষ্ট দেখতে পান সেলিম।
বয়স তার তখন আঠারো। পাঞ্জাবে, নীলাব নদীর তীরে আটোক-এ ইউসুফজাই আফগানদের এক দুর্গ অধিকার করতে গিয়েছিলেন আকবর, সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন সেলিমকে। মুঘল সৈন্যরা সম্রাটের নেতৃত্বে দুর্গ অবরোধ করে বসে আছে, এ ফাঁকে চাচা মির্জা মুহম্মদ হাকিম-এর সাবেক সহচর ওস্তাদ শাহ কুলীকে নিয়ে শিকারে গিয়েছিলেন সেলিম। শিকার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে একটু দম নিচ্ছিলেন, শাহ কুলী বুদ্ধি দিল, শরাবে দুটো চুমুক দিলে ক্লান্তি কাটতে পারে শাহজাদার।
কিন্তু শরাব পাওয়া যাবে কোথায়? মাথায় এলো হাকিম আলীর কথা। রাজকীয় হেকিমের বাড়িটি কাছেই। পরিচারক মাহমুদকে তক্ষুনি পাঠানো হলো হেকিমের বাড়িতে, ছোট্ট বোতলে হলদেটে রঙের মিষ্টি একটু পানীয় নিয়ে মাহমুদ ফিরে এল চটজলদিই। সেই শুরু। দু' চুমুক দিয়ে শুরু করে পরের নয় বছরে পরিমাণটি পৌঁছাল প্রতিদিন প্রায় ছয় সেরে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে শাহজাদার অতিরিক্ত মদ্যপানের কথা আগ্রায় আর কারো জানতে বাকি থাকল না।
সেলিম একা নন, তার বৈমাত্রেয় দুই ভাই মুরাদ ও দানিয়ালও ততদিনে একই পথের যাত্রী। মুরাদ বয়সে সেলিমের এক বছরের ছোট, দানিয়াল তিন বছরের। দানিয়ালের প্রতি এক ধরনের স্নেহবোধ থাকলেও মুরাদকে কখনোই পছন্দ করেননি সেলিম। দুর্বিনীত মনে হতো তাকে বরাবরই। ছোটবেলায় আকবরের দরবারের পর্তুগিজ পাদ্রিদের হাতে মুরাদের পড়াশোনার ভার ছিল, পাদ্রিরা তাকে নিয়ে বেশ মাতামাতি করত। সে নাকি একদিন বিরাট কিছু একটা হবে। কিন্তু বয়স বিশের কোঠা না পেরোতেই পাঁড় মদ্যপে পরিণত হয় মুরাদ, আকবরের ধমক-ধামক, অনুরোধ কিছুতেই কোনো কাজ হয়নি। মাত্র আটাশ বছর বয়সেই প্রাণ হারিয়েছে। দানিয়ালের অবস্থাও যে খুব একটা ভালো তা বলা যাবে না। ছোট ছেলেকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন আকবর। দেখতে শুনতে বড় দুই ভাইয়ের চেয়ে ভালো, আচরণও চমৎকার। সত্যি বলতে কী, ছোট ভাইয়ের জন্য বেশ একটু মায়াই অনুভব করেন সেলিম। দানিয়ালের দুটো শখ-গানবাজনা আর বন্দুকবাজি। ভালোবাসে হিন্দি গান শুনতে। কবিতাও লেখে মন্দ না। কোন ফাঁকে যে তিন নম্বর শখটা যুক্ত হলো কে জানে। বড় দুই ভাইয়ের মতো শরাবের নেশায় পেয়ে বসল। মুরাদের মৃত্যুর পর দানিয়ালকে দাক্ষিণাত্যে পাঠিয়েছিলেন সম্রাট, কাজের কাজ কিছু হয়নি। মদ খাওয়া আর বাইজির নাচ দেখা-এর বাইরে সারাদিন কিছুই করে না দানিয়াল। এভাবে চলতে থাকলে মুরাদের ভাগ্য বরণ করতে তারও খুব একটা দেরি হবে না।
তা নিয়ে খুব যে দুঃখবোধ করেন সেলিম তা নয়। ছোটভাইয়ের প্রতি যেটুকু স্নেহবোধ ছিল এখন তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাঁর শয়নে স্বপনে এখন একটাই চিন্তা-আগ্রার মসনদ।
ছেচল্লিশ বছর!
এতগুলো বছর মসনদে বসে থাকা তার পিতার পক্ষে নেহাতই অন্যায্য হচ্ছে বলে মনে করে তিনি। প্রপিতামহ বাবুর আর পিতামহ হুমায়ুন তো বয়স পঞ্চাশ হবার আগে মারাই গিয়েছিলেন, সেখানে আকবরের বয়স ইতোমধ্যেই ষাট পেরিয়ে গেছে, শারীরিকভাবে এখনও যথেষ্ট শক্তসমর্থ। ফলে সিংহাসনের বসার জন্য সেলিমের দীর্ঘ অপেক্ষা সহসা শেষ হবে এমন আশা দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে আগ্রা থেকে যেসব খবর আসছে সেগুলোও খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। বিশেষ করে সেলিমের বদলে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র খসরুকে মসনদে বসানোর ষড়যন্ত্রের খবর যেন বুকের মধ্যে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে সেলিমের। গুপ্তচরদের খবর সত্যি হলে এ ষড়যন্ত্রের পেছনে আছেন খসরুর মামা রাজা মানসিং আর শ্বশুর মির্জা আজিজ কোকা। খসরুর বয়স মাত্র তেরো, এসব কিছু বোঝার বয়স এখনও হয়নি, তবে আকবরের মৃত্যুর পর সেলিমের পরিবর্তে তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় এমন মানুষের সংখ্যা নাকি নেহাত কম নয়।
শান্ত ভঙ্গিতে বয়ে যাওয়া যমুনার ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষেন সেলিম। সময় আসুক, মান সিং আর মির্জা আজিজ কোকার দিবাস্বপ্নকে চুরমার করে দেবেন তিনি।

দুই

আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ান সেলিম। পেছনে দু'হাত বেঁধে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকেন। অপেক্ষা, অপেক্ষা, অপেক্ষা। জীবনটা কি এভাবেই যাবে!
শাহেনশাহ আকবরের চেহারাটি চোখে ভাসে তার। একথা সত্যি যে, এই তেত্রিশ বছর বয়সেও পিতার সামনাসামনি হলে বুকটা কেঁপে ওঠে। অনেক বড় বড় আমিরকে সম্রাটে সামনে বেতপাতার মতো কাঁপতে দেখেছেন সেলিম। এটা যদিও ঠিক যে ছোটবেলা থেকে পিতার অঢেল স্নেহ ও প্রশ্রয় সবই পেয়েছে তারা তিন ভাই, বিশেষ করে তিনি নিজে। জ্ঞান হবার পর থেকে তাঁকে কখনো সেলিম বলে সম্বোধন করেননি আকবর। শেখ সেলিম চিশতীর দোয়ার ফজিলতে তার জন্ম, এজন্য পিতার কাছে সেলিম সবসময়ই শেখু বাবা, কখনো কখনো শেখুজি। কিন্তু যতই সময় গেছে পিতাপুত্রের মধ্যে কেমন যেন একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। হতে পারে সেলিমের মধ্যে নিজের যে প্রতিচ্ছবি দেখবেন বলে আশা করেছিলেন সেটি হয়নি বলেই আকবরের হতাশা। তাঁর চণ্ডাল রাগও এর একটা কারণ। ছোটবেলা থেকেই তুচ্ছ কারণে পিতার বকুনি, মাঝেমাঝে চড়থাপ্পড়ও খেয়েছে তিন ভাই। অনেক সময় সামান্য কারণে ক্ষোভে রীতিমতো উন্মাদ হয়ে যান আকবর, তাঁর সেই ভয়ঙ্কর মূর্তি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
বছর পনের আগে কাশ্মীরের সেই ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল সেলিমের।
পরিবারের সবাইকে নিয়ে কাশ্মীরের সৌন্দর্য উপভোগের ইচ্ছে হলো সম্রাটের। কাশ্মীরে তখন প্রচণ্ড শীত। কিন্তু সম্রাটের ইচ্ছেপূরণ নিয়ে কথা। পাঁচ হাজার কর্মীকে পাঠানো হলো বরফ সরিয়ে রাস্তাকে চলার উপযোগী করতে। তারপরও, তাঁরা যখন ভিম্বর গিরিপথে পৌঁছালেন, পরিস্থিতি এমনই সঙ্গীন ছিল যে মুরাদের জিম্মায় নারীদের রেখে সেলিম আর বাকি অমাত্যদের নিয়ে সামনের দিকে যাত্রা করলেন আকবর। খানিক যেতেই বোঝা গেল, রাস্তার যে অবস্থা, পেছনে ফেলে আসাদের সবাইকে আনা যাবে না। সেলিমের পুত্র খসরুসহ নারীদের কয়েকজনকে নিয়ে আসার জন্য সেলিমকে ভিম্বরে ফেরত পাঠালেন সম্রাট। বাকিদের নিয়ে এগিয়ে চললেন তিনি। প্রচুর কষ্টস্বীকার করে একসময় পৌঁছালে কাশ্মীর উপত্যকায়, যেখানকার ফুলে ভরা বাগান আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য মুগ্ধ করল তাঁকে।
ওদিকে ভিম্বরে পৌঁছে নারীদের নিয়ে রওনা ঠিকই দিয়েছিলেন সেলিম, কিন্তু পথের অবস্থা এমন দাঁড়াল যে শেষে আর এগোনো সমীচীন মনে করলেন না। ভিম্বরের অদূরে নওশেরায় তাদের রেখেই এগিয়ে চললেন কাশ্মীরের উদ্দেশে। প্রচুর পথশ্রম সহ্য করে কাশ্মীর পৌঁছে যখন পিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, খালি হাতে তাকে ফিরতে দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন আকবর।

সারা শরীর রাগে কাঁপছিল সম্রাটের, চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে।
'কমবখ্ত!' চিৎকার করে উঠলেন তিনি, 'কোন সাহসে আমার হুকুম অমান্য করেছ তুমি?'
তাঁর অবস্থা দেখে সেলিমের সহযাত্রী আব্দুর রহিম খান-ই-খানান কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিলেন, আকবর তাঁকে থামিয়ে দিয়ে গর্জে উঠলেন, 'মেরুদণ্ডহীন শাহজাদা এমন বেত্তমিজি করতেই পারে, কিন্তু তুমি কীভাবে প্রশ্রয় দিলে এটাকে?'
ক্রোধান্ধ আকবর নিজেই রওনা দিয়েছিলেন মহিলাদের নিয়ে আসতে, আবুল ফজলসহ বাকিরা বহু চেষ্টা করেও থামাতে পারেনি। কিছুদূর গিয়ে অবশ্য মত বদলেছিলেন সম্রাট, দায়িত্বটা আব্দুর রহিমকে দিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন কাশ্মীরে।
সেলিমের মনে আছে দুঃখে, অপমানে সারাদিন তাঁবু থেকে বের হননি তিনি। খাওয়া-ঘুম সব উধাও হয়ে গিয়েছিল, কেবল চোখ দিয়ে দরদর করে ঝরে পড়ছিল অশ্রু।

আকবরের সেদিনের ভয়ঙ্কর চেহারা স্মরণ করে আজ এতদিন পরও শরীর শিউরে ওঠে তার।
কিন্তু পিতার দুর্ব্যবহার, অন্য সন্তানদের-এমনকি সেলিমকে বাদ দিয়ে তার পুত্রের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, আবুল ফজলসহ কয়েকজন অমাত্যের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত দুর্বলতা এসব সত্তে¡ও তাঁর প্রতি সমীহের কমতি নেই সেলিমের। যদিও সেই সমীহ কতদিন ধরে রাখতে পারবেন তা নিয়ে ইদানিং নিজের মনেই সন্দেহ মাথাচাড়া দিচ্ছে। মাঝে মাঝে নিজের ভাগ্যকেই অভিসম্পাত দেন তিনি।
তেত্রিশ বছর!
এতদিন মসনদে বসার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় যে যুবরাজকে সে দুর্ভাগা ছাড়া আর কী! প্রপিতামহ বাবুর ফারগানার মসনদে বসেছিলেন এগারো বছর বয়সে, পিতামহ হুমায়ুন মুঘল সিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন বাইশ বছর বয়সে, আর সম্রাট হওয়ার সময় পিতা আকবরের বয়স ছিল মাত্র চৌদ্দ। অথচ তেত্রিশ বছর বয়সেও সিংহাসনে আসীন হওয়ার আপাতত কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। দানিয়াল তো আছেই, এর মধ্যে নিজের ঔরসজাত পুত্রও যদি প্রতিদ্বন্দ্বীর কাতারে সামিল হয় তার চেয়ে দুঃখের আর লজ্জার কি কিছু আছে!
অক্ষম ক্রোধে দাঁতে দাঁত পিষেন শাহজাদা।
শাহেনশাহ আকবর যেন প্রখর এক সূর্য, যাঁর আলোয় তার সামান্য যা কিছু দীপ্তি সেটিও যেন ম্লান হয়ে গেছে। তাই যেন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতোই এলাহাবাদে এসে সম্রাট সেজে বসেছেন তিনি। এত দুঃখের মধ্যেও ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি খেলে যায় সেলিমের।

মনে পড়ে এলাহাবাদে ঘাঁটি গেড়ে বসার সেই প্রথম দিনগুলোর কথা।
মুরাদের মৃত্যুর পর ক'দিন শোকে ডুবে ছিলেন আকবর, তারপরই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাক্ষিণাত্য অভিযানে মুরাদের শূন্যস্থান পূরণ করার নির্দেশ দিলেন সেলিমকে, বললেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রওনা হতে। কিন্তু আগ্রা থেকে অত দূরে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না সেলিমের। গা ঢাকা দিয়ে রইলেন তিনি, কয়েকদিন চেহারাই দেখালেন না দরবারে। বাধ্য হয়ে দানিয়ালের ঘাড়েই এ দায়িত্ব চাপালেন সম্রাট। নেহাত অনিচ্ছাসত্ত্বেই দাক্ষিণাত্যের উদ্দেশে যাত্রা করল দানিয়াল, কিন্তু বাপের চোখের আড়াল হতেই এদিক সেদিক ঘুরে সময় নষ্ট করতে লাগল। তিন মাস পরও যখন সে দাক্ষিণাত্যে গেল না রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে আকবর নিজেই রওনা হলেন পুত্রকে দাক্ষিণাত্যে দিয়ে আসার জন্য। তবে রাজধানীর দায়িত্ব সেলিমের ওপর ছাড়লেন না, তাকে পাঠালেন মেওয়ারে রাণা প্রতাপের রাজ্য দখলের জন্য। আগ্রা দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন কিলিচ খানকে। একই দিনে আকবর দাক্ষিণাত্য আর সেলিম রওনা হলেন মেওয়ারের উদ্দেশে। সেলিম যাতে দায়িত্বপালনে বেগড়বাই না করে সেজন্য উপদেষ্টা হিসেবে মান সিংকে তার সঙ্গে পাঠালেন সম্রাট।

মেওয়ারে অভিযান পরিচালনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না সেলিমের। আজমিরে গিয়ে তাঁবু ফেললেন তিনি। শিকার আর আমোদপ্রমোদে সেখানে কাটালেন ক'দিন, পরে মান সিংয়ের পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে রওনা হলেন মেওয়ারের দিকে, তবে উদয়পুর পর্যন্ত পৌঁছেই ফের গ্যাঁট হয়ে বসলেন। এরই মধ্যে বাংলায় বিদ্রোহের কথা শুনে তাড়াহুড়ো করে সেদিকে রওনা দিলেন মান সিং, ফলে মেওয়ার অভিযানের ন্যূনতম কোনো আগ্রহও আর থাকল না সেলিমের।
এমন সময়ই বাল্যবন্ধু কুতুবুদ্দিন কোকা, শেখ কবির, আবদুল্লাহ খান আর মহব্বত খান দিলেন ভয়ঙ্কর এক বুদ্ধি। আকবর আর দানিয়াল দাক্ষিণাত্যে, মান সিং বাংলায়, রাজধানীর দায়িত্বে আছে অথর্ব বুড়ো কিলিচ খান। এক ঝটকায় গিয়ে আগ্রা দখল করে মসনদে বসে পড়লে কে ঠেকাচ্ছে সেলিমকে।
আকবরের চেহারাটা চোখে ভেসে উঠতে বুকটা দুরুদুরু করে উঠলেও সহচরদের বুদ্ধিটা পছন্দ হলো সেলিমের। আবার কবে এমন সুযোগ পাওয়া যাবে কে জানে! সৈন্যসামন্ত নিয়ে আগ্রার উদ্দেশে রওনা হলেন তিনি। রাজধানী যতই কাছে আসতে লাগল সাহসও ক্রমশ বাড়তে লাগল।

আগ্রায় পৌঁছে দুর্গের বাইরে কয়েকজন অমাত্যকে নিয়ে কিলিচ খানকে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন সেলিম।
বুড়ো, অথর্ব বলে তাকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামাননি সেলিম, কিন্তু সৌম্য আর আত্মবিশ্বাসী চেহারার বয়োবৃদ্ধ আমিরকে দেখে নিজের আত্মবিশ্বাস হঠাৎ একটু যেন চুপসে গেল তার।
'আমি দুর্গে প্রবেশ করতে চাই,' আর কোনো কথা না পেয়ে বললেন সেলিম। নিজের গলা নিজের কানেই দুর্বল শোনাল।
'শাহজাদার নগণ্য এক খাদেম আমি,' কুর্নিশ করে বললেন কিলিচ খান। 'কিন্তু শাহেনশাহর হুকুম ছাড়া কাউকে দুর্গে প্রবেশ করতে দেয়ার অনুমতি নেই।'
'আমি সুলতান সেলিম,' গলায় ক্ষোভ ফোটানোর চেষ্টা করলেন সেলিম, 'নিজের দুর্গে প্রবেশের অনুমতি নিতে হবে আপনার কাছে?'
পুনরায় কুর্নিশ করলেন কিলিচ খান। 'আমার কাছে নয়, হিন্দুস্তানের শাহেনশাহর কাছে।'
কী বলবেন ভেবে পেলেন না সেলিম, ওদিকে কুতুবুদ্দিন কোকা আর আবদুল্লাহ খান তার কানের কাছে ফিসফিস করে পরামর্শ দিচ্ছেন বেয়াদব কিলিচ খানের মাথাটা ধড় থেকে নামিয়ে দেয়ার জন্য।
তরবারির কাছে হাতটা নিয়েও কেন যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না সেলিম, তাকে বাঁচিয়ে দিলেন মহব্বত খান। শাহজাদার কানের কাছে মাথা নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, 'মরিয়ম মাখানি আসছেন বিরাট এক হাতির পিঠে চড়ে।'
'মরিয়ম মাখানি' শব্দটাই যেন বরফের মতো জমিয়ে দিল সেলিমকে।
ষাট বছর আগে সম্রাট হুমায়ুনের স্ত্রী হয়ে মুঘল রাজপরিবারের সদস্য হয়েছিলেন পারস্য বংশোদ্ভুত শিয়া পণ্ডিত আলী আকবর জামির চৌদ্দ বছর বয়সী কিশোরী কন্যা হামিদা। অল্পবয়সে বিধবা হয়েছেন, তারপর কাছ থেকে দেখেছেন পুত্র আকবরের বালক সম্রাট থেকে মহামতি আকবর হয়ে ওঠা। সবাই জানেন সম্রাট আকবরের ওপর মায়ের প্রভাব কতটা। এ কারণে 'মরিয়ম মাখানি' তথা হামিদা বানু বেগমের কথা অমান্য করার সাহস রাজপরিবারে কারো নেই।
রীতিমতো আতঙ্ক অনুভব করলেন সেলিম।

ছোটবেলা থেকেই দাদির ন্যাওটা তিনি। হামিদা বানুও হৃদয়ের সবটুকু স্নেহ ঢেলে দিয়েছেন এই নাতিটার জন্য। আকবরের ভর্ৎসনা আর কড়া শাসন থেকে কতবার যে নাতিকে বাঁচিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। সেলিম বুঝতে পারলেন, মরিয়ম মাখানি একবার এসে পৌঁছালে আর কিছুই করার ক্ষমতা থাকবে না। সঙ্গীদের উদ্দেশে ইশারা করলেন তিনি, তারপর দ্রুত ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিলেন উল্টো দিকে।
মরিয়ম মাখানি এসে হতবিহ্বল চেহারায় একা কিলিচ খানকেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। সেলিম বা তার সঙ্গীদের টিকির দেখাও পাওয়া গেল না কোথাও।
এর দু'হপ্তা পর সঙ্গীসাথী নিয়ে এলাহাবাদে পৌঁছালেন সেলিম। আগ্রার মতো কোনো সমস্যা এখানে হলো না। বিনা বাধায় এলাহাবাদ দুর্গ আর ধনাগার দখল করলেন, তারপর জাঁকিয়ে বসলেন ওখানে। দ্রুতই পার্শ্ববর্তী বিহারকে করতলগত করলেন, সেখানে শাসক হিসেবে বসালেন কুতুবুদ্দিন কোকাকে। আর নিজেকে ঘোষণা করলেন বাদশাহ হিসেবে।
হোক না এলাহাবাদ, একটা বাদশাহী মসনদ তো পাওয়া গেল!

বছরদুয়েক আগের কথা সেটি। তারপর যমুনার বুক দিয়ে বহু জল গড়িয়েছে।
প্রথমে সেলিমের ছোটবেলার বন্ধু শরীফ খানকে এলাহাবাদ পাঠিয়েছিলেন সম্রাট সেলিমকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে 'ছেলেমানুষি' থেকে নিবৃত্ত করার জন্য। তাতে খুব একটা লাভ হয়নি, উল্টো উজিরে আজম বানিয়ে শরীফ খানকে এলাহাবাদেই রেখে দিলেন সেলিম। উজিরে আজম হবার কয়েকদিন পর এক সকালবেলা এসে হাজির হলেন শরীফ খান। লম্বা কুর্নিশ করে বলল, 'আপনি অনুমতি দিলে একটা প্রস্তাব দিতে চাই।'
কয়েকদিন আগে শেখ কবির দুটো কোকিল পাখি উপহার দিয়েছিল, একটা পুরুষ একটা নারী। গভীর মনোযোগে সেগুলোকেই নিরীক্ষণ করছিলেন সেলিম। কোকিলের নাম শুনলেও আগে কখনো দেখেননি। কাকের মতো দেখতে, তবে কাকের চোখ কালো হলেও কোকিলের লাল। মজার ব্যাপার হচ্ছে পুরুষ পাখিটার কণ্ঠস্বর সুন্দর হলেও নারী পাখিরটা বেশ কর্কশ। শেখ কবির বলেছে, ডিম পাড়ার সময় হলে কোকিল নাকি একটা কাকের বাসা খুঁজে বের করে। তারপর কাকের ডিমগুলো ফেলে দিয়ে সেখানে ডিম পাড়ে। এ জিনিসটা দেখার ইচ্ছে সেলিমের, তবে সেটা কীভাবে করা যায় তার কোনো উপায় এখনও বের করতে পারেনি।
কোকিল-দর্শনে বিঘ্ন ঘটায় বিরক্তিভরে শরীফ খানের দিকে তাকালেন সেলিম। 'বলো কী প্রস্তাব।'
'সম্রাটকে একটা চিঠি লিখুন। বলুন তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আপনি আগ্রা যেতে চান।'
'কী ফায়দা হবে তাতে?'
'হয়তো অনুমতি দেবেন না, কিন্তু সম্রাটের সঙ্গে কোনো না কোনোরকম যোগাযোগ করা দরকার বলে মনে হচ্ছে।'
অনিচ্ছাসত্তে¡ও রাজি হলেন সেলিম। সেদিনই চিঠি পাঠানো হলো আগ্রায়। শরীফ খান যা ভেবেছিলেন তাই হলো, সপ্তাহ না ঘুরতেই সম্রাটের জবাব এসে গেল, সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন, আগ্রায় যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে না। শরীফ খানের ওপর মেজাজ বিগড়ে গেলেও সেলিম হয়ত চুপচাপ সহ্য করে যেতেন এ অপমান, কিন্তু বাদ সাধলেন কুতুবুদ্দিন কোকা।
'আপনিও এখন বাদশাহ। এবং মুঘল মসনদের আইনগত উত্তরাধিকারী,' সক্ষোভে বললেন তিনি। 'আবুল ফজল আর আজিজ কোকা সারাদিন কানভারি করে চলেছে শাহেনশাহর। তাছাড়া বয়সও হয়ে গেছে, ফলে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা হারিয়েছেন।'
'তাহলে কী করা উচিত আমার?' সেলিম জিজ্ঞেস করলেন।
'একটাই কাজ করার আছে। সৈন্যসামন্ত নিয়ে চলুন রওনা হই আগ্রার দিকে। এমন সুযোগ বারবার আসবে না। এবার প্রমাণ হবে আবুল ফজল, মান সিং আর আজিজ কোকার শক্তি বেশি নাকি বাদশাহ সেলিমের!'
অভাবনীয় এই প্রস্তাব শুনে কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন সেলিম। তার দ্বিধান্বিত চেহারা দেখে মহব্বত খান বললেন, 'সমস্যা কী? আগে পরে একদিন যুদ্ধ করতে হতই। শুভস্য শীঘ্রম। তাছাড়া আমার ধারণা এসময় পুরোপুরি অপ্রস্তুত পাওয়া যাবে সম্রাটের বাহিনীকে।'

শরীফ খানের দ্বিমত সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন সেলিম। সপ্তাহ না ঘুরতেই হাজার ত্রিশেক সৈন্য নিয়ে আগ্রার উদ্দেশে রওনা দিলেন। যেতে যেতে অবশ্য মাথাটা অনেকটাই ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে তার। আগ্রার শ-খানেক মাইল তফাতে এসে পৌঁছে দামি একটা চুনিপাথর পাঠালেন সম্রাটের কাছে। অনুমতি চাইলেন দেখা করার। জবাবও এল তুরন্ত। সম্রাটের দুই লাইনের বার্তার সারকথা হচ্ছে: যদি আসতেই হয় একা আসবে তুমি। সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে নিয়ে এলে নিজ দায়িত্বে আসবে।
সেই আকবর! কী চান সেটি বোঝাতে ছলাকলার আশ্রয় নেন না, যা বলার বলেন রাখঢাক না করে। মহব্বত খান, কুতুবুদ্দিন কোকা আর আবদুল্লাহ খান যথারীতি পরামর্শ দিলেন সম্রাটের চিঠিকে কোনো গুরুত্ব না দিতে, কিন্তু সম্রাটের ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়ার ইচ্ছে আর হলো না সেলিমের। সৈন্যবাহিনীকে হুকুম দিলেন ফিরতি পথ ধরতে। এলাহাবাদে পৌঁছুতে না পৌঁছুতে সম্রাটের দ্বিতীয় চিঠি এল, যাতে বাংলা আর উড়িষ্যার শাসনভার ন্যস্ত করলেন সেলিমের হাতে।
'আজিজ কোকাদের আরেক শয়তানি,' ক্ষোভের সঙ্গে বললেন কুতুবুদ্দিন। 'আপনাকে হাজার মাইল দূরে বাংলায় পাঠিয়ে খসরুকে মসনদে বসানোর ষড়যন্ত্র!'
তারপর কিছুদিন সব চুপচাপ।
তারপরই গোপন খবর এল। আগ্রায় ফেরার সময় আবুল ফজলকে দাক্ষিণাত্যেই রেখে গিয়েছিলেন আকবর, এখন সম্রাট জরুরি খবর পাঠিয়েছেন আবুল ফজল যেন অবিলম্বে আগ্রায় রাজকীয় দরবারে যোগ দেন।
খবরটার মধ্যে অশুভ ইঙ্গিত পেলেন সেলিম।
আবুল ফজলকে হঠাৎ এই জরুরি এত্তেলা কেন?
কী ষড়যন্ত্র ঘনিয়ে উঠছে ওখানে?
সে ষড়যন্ত্রে ধূর্ত আবুল ফজলের ভূমিকা কী হবে?
হঠাৎ উপলব্ধি করলেন তিনি, তার অন্যতম শত্রু আবুল ফজলকে আগ্রায় পৌঁছাতে দেয়া যাবে না। থামিয়ে দিতে হবে পথেই। কী করা যায়?
ভেবে যখন কুলকিনারা পাচ্ছিলেন না তখনই মনে পড়ল বহুদিনের পুরনো সহচর বুন্দেলার রাজা বীর সিং দেওয়ের কথা। আগ্রায় ফিরতে হলে বুন্দেলখণ্ডের ভেতর দিয়েই যেতে হবে আবুল ফজলকে। বীর সিং দেওকে একটা চিঠি লিখলেন সেলিম-
'আমার একান্ত অনুগত ও স্নেহভাজন বুন্দেলরাজ বীর সিং দেও,
আশা করি খোদার অনুগ্রহে কুশলেই আছ।
আমার চিরশত্রু, দুরাচার ও হীন ষড়যন্ত্রকারী আবুল ফজল ইবনে মুবারক কিছুদিনের মধ্যেই বুন্দেলখণ্ডের মধ্য দিয়ে আগ্রায় ফিরবে। তুমি যদি তার অস্তিত্ব বিনাশ করতে পারো তাহলে আমি অত্যন্ত খুশি হব এবং তোমাকে যথাযথ ইনাম দিয়ে পুরস্কৃত করব।
আল্লাহ তোমার সহায় হোন।
মির্জা নুরুদ্দিন বেগ মুহাম্মদ খান সেলিম।'
যথাসময়েই সে চিঠি গিয়ে পৌঁছাল বীর সিং দেওয়ের হাতে এবং এক মুহূর্তও দেরি না করে আবুল ফজলকে নিকেশ করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল সে।

তিন

আবুল ফজলের মৃত্যুর পর সম্রাটের প্রতিক্রিয়া কী হয় তা নিয়ে ভয়ে ভয়ে ছিলেন সেলিম, তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে বুঝলেন, তার ওপর ক্ষোভ ঝাড়ার কোনো ইচ্ছে অন্তত এ মুহূর্তে সম্রাটের নেই। তবে আসাদ বেগের নেতৃত্বে মুঘল সৈন্য আর গুপ্তচরেরা যে বুন্দেলখণ্ড ও তার আশেপাশের এলাকা চষে বেড়াচ্ছে বীর সিং দেও-র খোঁজে সে খবর সেলিমের কাছে যথাসময়েই পৌঁছাল। আবুল ফজলের মুণ্ডু কেটে নেয়ায় যেমন, গা ঢাকা দিয়ে থাকার ব্যাপারেও বীর সিং দেওয়ের প্রতিভা চমৎকৃত করল সেলিমকে।
এদিকে আগ্রা থেকে চরেরা প্রায়ই নানা রকমের খবর নিয়ে আসে, যার বেশির ভাগই গুজব। সম্রাট বিরাট একটা বাহিনী প্রস্তুত করছেন সেলিমকে শাস্তি দেয়ার জন্য, খসরুকে মুঘল মসনদে বসানোর জন্য মান সিং আর আজিজ কোকা নানারকম ষড়যন্ত্র করছে-কত কিছু। খুব বেশি বিচলিত হননি সেলিম। জীবনে এই প্রথম স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনার স্বাদ উপভোগ করছেন, তা সে যত ছোট রাজ্যই হোক না কেন। প্রতিদিন দরবারে বসছেন, ঘনিষ্ঠজনদের নানা খেতাব দিচ্ছেন আর উপহার বিলাচ্ছেন, বিচার-আচার করছেন। আর একটা কান পেতে রাখছেন আগ্রার দিকে।
জ্ঞান হবার পর থেকেই সেলিম জানেন, আমির তৈমুরের বংশধর হিসেবে ভারতবর্ষে মুঘল রাজদণ্ডকে বহন করার ভার একদিন তার ওপর অর্পিত হবে। সেলিম চিশতির দোয়া আছে তার ওপর। তাছাড়া যতই অসন্তুষ্ট হোন, জ্যেষ্ঠ পুত্রকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসানোর সিদ্ধান্ত কিছুতেই নেবেন না শাহেনশাহ আকবর, এ বিশ্বাসও তার আছে। যেটুকু অনিশ্চয়তা আর আশঙ্কা তার মনে দানা বেঁধেছে তার পেছনে মসনদের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা আর তার শত্রুদের ষড়যন্ত্রই দায়ী, যদিও শেষমেষ আগ্রার মসনদ যে তার কাছেই আসবে এ বিশ্বাসে এখনও অটল সেলিম। দাক্ষিণাত্য থেকে যে খবর আসছে তাতে মুরাদের মতো দানিয়ালেরও একই পরিণতি সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাকি থাকে কেবল খসরু। নিজের তেরো বছর বয়সী পুত্রকে সিংহাসনের প্রতিদ্ব›দ্বী ভাবতে হাসিই পায় সেলিমের, যদিও জানেন, আজিজ কোকা আর মান সিংহের মতো প্রভাবশালী আমিরদের সক্রিয় সমর্থনের কারণে সেটি এখন আর হাসিতামাশার পর্যায়ে নেই। তারপরও খসরুকে নিজের প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে বিবেচনা করাটাকে অপমানজনকই মনে হয় তার কাছে।
সন্ধ্যার পর হেরেমে মান বাইয়ের কাছে গেলেন সেলিম।

তার প্রথম স্ত্রী মান বাই, খসরুর মা। ষোল বছর বয়সে আম্বেরের রাজা ভগবান দাসের পঞ্চদশবর্ষীয়া এ কন্যাটিকে বিয়ে করে এনেছিলেন সেলিম, বিয়ের পর তার নাম দিয়েছিলেন শাহ বেগম। পরে আরো কয়েকবার বিয়ে করেছেন শাহজাদা কিন্তু হয়তো প্রথম স্ত্রী বলেই মান বাইয়ের প্রতি বিশেষ একটা দুর্বলতা রয়েছে তার। বিয়ের দু'বছর পর যখন লাহোরে খসরুর জন্ম হলো সেদিনটির কথা ভুলতে পারেন না সেলিম। প্রথম পুত্র সন্তান জন্মের আনন্দে দু'হাতে উপহার বিলিয়েছিলেন, কল্পনাও করেননি সেই ছেলে একদিন সিংহাসনের জন্য তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হবে।
সেলিম জানেন, সন্তান ও স্বামীর এই দ্বন্দ্বে মান বাইয়ের সমর্থন পুরোপুরিই স্বামীর প্রতি। খসরু এবং ভাই মান সিংকে অনেকবার বুঝিয়েছেন তিনি, লাভ হয়নি। এ কারণে ছেলের প্রতি প্রগাঢ় একটা অভিমান জন্মেছে তার। হতাশা থেকে আফিমের নেশায় আসক্ত হয়েছেন মান বাই, এটাও জানেন সেলিম। স্ত্রীর বাড়াবাড়ি রকমের আফিম আসক্তি কমানোর জন্য চেষ্টাও করেছেন, লাভ হয়নি খুব একটা।
জানালার ধারে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিললেনমান বাই। দূরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ স্ত্রীকে পর্যবেক্ষণ করলেন সেলিম, তারপর মৃদু গলায় বললেন, 'শাহ বেগম।'
ধীরে ধীরে ফিরে তাকালেন মান বাই। তারপর তসলিম জানিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। কাছে গিয়ে তার হাত ধরলেন সেলিম। 'তোমাকে আরো শক্ত হতে হবে।'
'আমি শক্তই আছি,' যন্ত্রের মতো গলা মান বাইয়ের। 'আপনি ভালো আছেন তো?'
মান বাইয়ের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে ফিরে আসার সময় মনটা বিষন্ন হয়ে থাকল সেলিমের। স্ত্রীর বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থা কাঁটার মতো খোঁচাচ্ছে তাকে।

পরদিন। সন্ধ্যা নেমেছে খানিক আগে। পূবের আকাশে একরাশ লাল রঙ ঢেলে দিয়ে অস্তমিত হয়েছে সূর্য, যদিও যমুনার জল থেকে এখনও বিদায় নেয়নি লালিমা। সেলিমের মনটা উদাস হয়ে যায় সেদিকে তাকিয়ে। রাজ্যশাসনের আনন্দটা দিনদিন ফিকে হয়ে আসছে। গোটা হিন্দুস্তান শাসনের রোমাঞ্চের সঙ্গে কি তুলনা চলে পুঁচকে এই রাজ্য শাসনের?
'কতদিন, আর কতদিন?' যেন যমুনার অবিশ্রান্ত ঢেউয়ের উদ্দেশেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন সেলিম।
'জাঁহাপনা।'
ঘাড় ফিরিয়ে তাকান সেলিম। সসম্ভ্রমে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে আবুল হাসান মাশহাদি। মুরাদের কোষাধ্যক্ষ আর ব্যক্তিগত সচিব ছিল সে, মুরাদের মৃত্যুর পর সেলিমের দরবারে এসে যোগ দিয়েছে। প্রশাসনিক দক্ষতার কারণে অল্পদিনেই পরিণত হয়েছে সেলিমের ঘনিষ্ঠদের একজনে।
'আকা রেজাসহ কয়েকজন দেখা করতে এসেছে।'
'বসতে বলো তাদের। বলো কিছুক্ষণের আসছি।'
মিনিটদশেকের মধ্যেই দিওয়ান-ই-খাসে গিয়ে হাজির হন সেলিম। লম্বা কুর্নিশ করে তাকে অভিবাদন জানায় অভ্যাগতেরা। মোট তিনজন তারা, সঙ্গে বারো তেরো বছরের এক বালক। আকা রেজা হেরাতির ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় সেলিমের। দীর্ঘদেহী, অভিজাত চেহারার মানুষটি সম্প্রতি হেরাত শহর থেকে এসেছেন। প্রতিচ্ছবি আঁকায় তাঁর সুনাম শুনে সেলিমই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন হেরাতিকে। অল্পদিনের মধ্যেই চমৎকার কয়েকটি ছবি এঁকে সেলিমের মন জয় করেছেন তিনি।
'বিষাণ দাস আর মীর্জা গোলামকে নিয়ে এসেছি জাঁহাপনা,' দুই সঙ্গীর দিকে ইশারা করে আকা রেজা বললেন। তারপর বালকটির মাথায় হাত রেখে বললেন, 'আমার ছেলে আবুল হাসান। বাদশাহ সেলিমকে দেখার খুব ইচ্ছে তার।'
স্মিত হাসলেন সেলিম। বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে বালক আবুল হাসান, দৃষ্টিতে প্রগাঢ় কৌতূহল।
'তুমিও কি বাবার মতো ছবি আঁকতে পারো?' ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
মাথা নাড়ল আবুল হাসান, 'এখনও শিখছি, একদিন হয়তো পারব বাবার মতো আঁকতে।'
ছেলেটির জড়তাহীন স্পষ্ট উচ্চারণে চমৎকৃত হলেন সেলিম। আকা রেজার দিকে ফিরে বললেন, 'মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকা শেখান ওকে। আমার মন বলছে একদিন বড় শিল্পী হবে।'
আকা রেজা হাসলেন। 'ছবি আঁকায় ওর যে আগ্রহ, আমার মনোযোগ দেয়ার দরকার হয় না। বরং তার এত বেশি মনোযোগে আমিই মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে উঠি।'
খানিকক্ষণ তিন শিল্পীর সঙ্গে বাতচিত করলেন সেলিম। চিত্রকলায় প্রবল আগ্রহ তার, বিশেষ করে মানুষ আর বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতিতে। আকা রেজাকে দিয়ে কয়েকটি পাখির ছবি আঁকিয়েছেন, নিজেরও আঁকিয়েছেন একটা। তুলির আঁচড়ে কারো চেহারাকে হুবহু ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার ব্যাপারটাকে রীতিমতো অলৌকিক একটা ব্যাপার মনে হয় তার কাছে। সেলিমের স্বপ্ন, আগ্রার মসনদে বসার পর বিশাল একটি চিত্রশালা তৈরি করবেন, যেখানে দিনরাত ছবি আঁকবে শত শত শিল্পী।
তিন চিত্রকর বিদায় নেয়ার পর পুনরায় হেরেমের উদ্দেশে রওনা দেন সেলিম। কে জানে কেন, বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে মনটা। আরেকটু শরাব পান করবেন? নাকি গান শুনবেন? নাকি স্ত্রীদের কারো সাথে সময় কাটাবেন?
মনস্থির করতে পারেন না সেলিম। খাসকামরায় ফিরে আরামকেদারায় শরীর এলিয়ে দেন আবার। অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকেন বাইরের অন্ধকারে। তাঁর জানা নেই, তিনশো মাইল দূরে আগ্রা দুর্গে তাঁকে নিয়েই তখন গভীর আলোচনায় ব্যস্ত তিন নারী।

গুলবদন বেগমের বয়স এখন ঊনআশি।
ভাই হুমায়ুনের মৃত্যুর বছরদুয়েক পর ভ্রাতুষ্পুত্র আকবর তাকে আগ্রা নিয়ে আসেন, সেই থেকে আছেন কখনো আগ্রা নয়তো লাহোরে। বছর পনেরর ছোট বোনটিকে খুব স্নেহ করতেন হুমায়ুন, যদিও ভাইয়ের সাহচর্যে খুব বেশিদিন কাটানোর সুযোগ হয়নি গুলবদনের। মরিয়ম মাখানি হামিদা বানু বেগম তাঁর এই ননদকে ভালোবাসেন নিজের বোনের চেয়েও বেশি।
নিজের বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছেন হামিদা বানু বেগম। তাঁর পাশ ঘেঁষে বসেছেন গুলবদন। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না ইদানিং। খুব ক্লান্ত লাগে সবসময়। শ্বাস নিতে কষ্ট হয় মাঝে মাঝে। গুলবদনের কেন যেন মনে হয় খুব বেশিদিন আর আয়ু নেই তাঁর।
তাঁদের দুজনের কাছ থেকে খানিক তফাতে দাঁড়িয়ে আছেন সেলিমা সুলতান বেগম, আদতে যিনি ছিলেন আকবরের ফুফাত বোন এবং আকবরের অভিভাবক বৈরাম খানের স্ত্রী। বৈরাম খানের মৃত্যুর পর আকবর বিয়ে করেন তাঁকে এবং সেলিমা অচিরেই হয়ে ওঠেন স্ত্রীদের মধ্যে আকবরের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। ব্যক্তিত্ব ও প্রখর বুদ্ধিমত্তার কারণে রাজপরিবারের সদস্যদের তো বটেই, প্রভাবশালী আমিরদেরও সমীহ অর্জন করেছেন সেলিমা।
হামিদা ও গুলবদন দুজনেই স্নেহ করেন সেলিমাকে, সেলিমাও মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করেন দুজনকে। আরেকটি ব্যাপারেও মিল আছে তিনজনের মধ্যে। তাঁরা তিনজনই একমত, আকবরের মৃত্যুর পর মসনদের যোগ্যতম দাবিদার সেলিম।
'তোমার কথায় যুক্তি আছে, মানি,' সেলিমার উদ্দেশে বললেন হামিদা বানু। 'কিন্তু আকবর কি শুনবে? একবার মনস্থির করলে তো আর সিদ্ধান্ত পাল্টায় না সে।'
'শোনাতে হবে,' সেলিমার গলায় সংকল্প। 'নাহলে মুঘল সাম্রাজ্য বলে আর কিছু থাকবে না।'
'আর সেলিম? সে কি শুনবে? গোঁয়ার্তুমিতে সেওতো কম যায় না।'
'আপনার কথা বলব তাকে। পরিস্থিতি বোঝাব।'
'আমার মনে হয় সেলিমা ঠিকই বলেছে,' মুখ খুললেন গুলবদন বেগম। 'যাও তুমি, শাহেনশাহকে বোঝাও। এছাড়া আর কোনো পথ নেই।'
তসলিম জানিয়ে চলে গেলেন সেলিমা সুলতান বেগম। ননদের দিকে তাকালেন হামিদা বানু। 'ওর মা গুলরুখের মতোই হয়েছে সেলিমা। ঘাড়ের ওপর বসানো মাথাটা যথেষ্ট পরিপক্ব।'
ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাসলেন গুলবদন। 'দেখা যাক আকবর কী বলে।'
আকবরকে মানানো অবশ্য খুব একটা কঠিন হলো না সেলিমার জন্য। প্রথমেই ছেলের উদ্দেশে কড়া কড়া অনেক কথাই বললেও খানিক পরই শান্ত হলেন সম্রাট।
'আমি জানি, বড় ছেলে হিসেবে তার ওপর অনেক আশা ছিল আপনার। কিন্তু চাইলেই কি সব হয় জাঁহাপনা? তাছাড়া বাস্তবতাওতো বুঝতে হবে। মুরাদ নেই। দানিয়েলকে নিয়েও আর কোনো আশা করা যায় না।'
'তারপরও ঐ মদ্যপ আর কুঁড়ের বাদশার ওপর ভরসা রাখতে হবে? কোন কাজটার যোগ্য সে শুনি? সে ছাড়া মসনদের আর কোনো উত্তরাধিকারী নেই নাকি? আমার নাতিরা কম কিসে?'
'ওকথা ভুলেও মুখে আনবেন না জাঁহাপনা,' সেলিমার গলায় কর্তৃত্বের সুর। 'পিতা বেঁচে থাকতে তাকে বাদ দিয়ে নাবালক পুত্র হবে সম্রাট? কেউ কখনও শুনেছে এমন কথা?'
'বাপ যদি যোগ্য না হয় তাহলে ছেলেকেই তার স্থান নিতে হয়। তাছাড়া দুনিয়াতে প্রথম বলেও একটা ব্যাপার আছে।'
'আপনার সঙ্গে তর্ক করার দুঃসাহস নেই আমার, জাঁহাপনা,' সেলিমার কণ্ঠস্বর নিচু কিন্তু দৃঢ়। 'আশা করি আমার বিচারবুদ্ধির ওপর আস্থা আছে আপনার। মরিয়ম মাখানি আর খালাআম্মার মতও আমার মতোই।'
সকৌতুকে হাসলেন আকবর। 'মাঝে মাঝে আমার মনে হয় সেলিম বোধহয় জাদু করেছে তোমাদের তিনজনকে। নইলে ওর কোনো দোষ দেখতে পাও না কেন তোমরা? তার মধ্যে এমন কী দেখতে পাও যা আমি পাই না?'
'যাই বলুন জাঁহাপনা, সেলিমের ব্যাপারে আপনি একটু বেশি কঠিন। হয়ত আপনার মতো পরিশ্রমী হয়নি, একটু খেয়ালিপনাও আছে। মসনদে বসলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া, জালালুদ্দিন মুহম্মদ আকবর তো আর শত শত জন্মান না!'
কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না সম্রাট। অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দেয়ালের দিকে।
'তাহলে আপনার কোনো আপত্তি নেই জাঁহাপনা?'
মাথা নাড়লেন সম্রাট।
মৃদু হাসি ফুটে উঠেছে সেলিমার ঠোঁটের কোণে। মাথা নুইয়ে বেরিয়ে গেলেন কক্ষ থেকে।

চার

এলাহাবাদ শহরের প্রবেশমুখে গিয়ে সেলিমা সুলতান বেগমকে স্বাগত জানালেন সেলিম। উপহার হিসেবে সম্রাটের হাতিশাল থেকে বিশাল একটি হাতি নিয়ে এসেছেন তিনি, যার নাম ফতেহ লস্কর, আর একটা আরবি ঘোড়া এবং দামি একটি রাজকীয় পোশাক।
ভ্রাতুষ্পুত্রকে আলিঙ্গন করলেন সেলিমা, তাঁর দু চোখে অশ্রু। 'আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি শাহজাদা সেলিম,' আবেগে ভারি শোনাল তাঁর কণ্ঠস্বর। সঙ্গে সঙ্গে কোনো জবাব দিলেন না সেলিম। সমাদর করে শহর অভিমুখে নিয়ে চললেন ফুফুআম্মাকে।
দুর্গে পৌঁছেই কাজের কথায় এলেন সেলিমা। মরিয়ম মাখানি ও গুলবদন বেগমের সঙ্গে নিজের আলাপচারিতার বিবরণ দিয়ে জানালেন, সম্রাটের অনুমতি নিয়ে সেলিমকে ফিরিয়ে নিতে এসেছেন তিনি।
মনের মধ্যে এক ধরনের উচ্ছ্বাস অনুভব করলেও কিছুক্ষণের জন্য বাক্যহারা হয়ে রইলেন সেলিম। আবুল ফজলকে হত্যার উদ্দেশ্যটা আপাতত পূরণ হয়েছে, সম্রাট তাকে আগ্রায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু তারপরও মনের মধ্যে কেমন একটা দ্বিধা অনুভব করলেন। এমন যদি হয় যে এটি সম্রাটের একটি ছল? দেখা করার কথা বলে তাকে বন্দি করতে চান? আবুল ফজলকে হত্যা করার জন্য কঠিন শাস্তি দিতে চান?
তাঁর দ্বিধা টের পেয়ে অভয়ের হাসি হাসলেন সেলিমা। 'নিজের পিতাকে চেন না তুমি? আমার কথা বাদ দাও। মরিয়ম মাখানি আর গুলবদন বেগমের কাছে দেয়া কথার খেলাপ করবেন তিনি এটা তুমি ভাবলে কীভাবে?'
মাথা ঝাঁকালেন সেলিম। মনস্থির করে ফেলেছেন তিনি। 'ঠিক আছে, আগ্রায় যাব আমি।'
সেলিমা আগ্রায় ফিরে যাবার পর অমাত্যদের নিজের সিদ্ধান্ত জানালেন সেলিম। কুতুবুদ্দিন ছাড়া সবাই সমর্থন দিলেন তাঁকে। কেবল কুতুবুদ্দিনকেই অসন্তুষ্ট মনে হলো। 'হতে পারে আপনার জন্য একটা ফাঁদ এটা,' মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন তিনি।
'ফাঁদ আর যাই হোক, আমি যাব।' গম্ভীর মুখে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন সেলিম।

সুখবর নিয়ে সেলিমা এলাহাবাদ থেকে ফেরার পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়লেন গুলবদন বেগম। তাঁকে দেখে এসে গম্ভীর হয়ে গেলেন আকবর। নিজের প্রধান হেকিম হুমাম ও হাকিম আব্দুল মুলক্কে ডেকে পাঠালেন তিনি।
'অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না আমার কাছে। এক্ষুনি চিকিৎসায় লেগে যাও তোমরা।'
ঘণ্টাখানেক পর একসঙ্গে ফিরে এল দুই চিকিৎসক। দুজনের চেহারাই ভারি। 'মনে হচ্ছে আর বেশিদিন নেই তিনি,' বিষন্ন গলায় বলল হুমাম।
'তোমার কী মনে হচ্ছে সেটা জানতে চাইনি,' ধমকে উঠলেন আকবর। 'যত হেকিম লাগে নিয়ে এসো। তাঁকে সুস্থ করে তুলতে হবে।'
মাথা নাড়াতে নাড়াতে চলে গেল দুই চিকিৎসক। আকবর ছুটে গেলেন গুলবদনের শয্যাপাশে। চোখ বন্ধ করে নির্জীব হয়ে শুয়ে আছেন তিনি, একপাশে মরিয়ম মাখানি, অন্যপাশে সেলিমা আর রুকাইয়া। ছোট চাচা হিন্দালের মেয়ে রুকাইয়াও আকবরের স্ত্রী, স্বামীকে দেখে উঠে দাঁড়াল সেলিমা ও রুকাইয়া দুজনেই। ছেলের দিকে তাকিয়ে ধীরে মাথা নাড়লেন মরিয়ম মাখানি। তাঁর দুচোখে প্রগাঢ় বিষন্নতা। নিজের অজান্তেই চোখ আর্দ্র হয়ে উঠল আকবরের। গুলবদনের কপালে হাত রাখলেন তিনি। বেশ জ্বর। কিছুক্ষণ ওভাবেই থাকলেন আকবর, তারপর বেরিয়ে গেলেন কারো সাথে কোনো কথা না বলে।
পরদিন সন্ধ্যা। গুলবদনের শয্যাপাশে বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনি এসে গিয়েছিল হামিদা বানু বেগমের। হঠাৎ গুলবদনকে ছটফট করে উঠতে দেখে বলে উঠলেন, 'গুলবদন!'
ঘোলাটে দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন গুলবদন।
'বেগম!' ব্যাকুল গলায় বলে উঠলেন হামিদা, 'বেঁচে থাকো, বেঁচে থাকো!'
গুলবদনের দৃষ্টিটা কেঁপে উঠল। লম্বা করে শ্বাস টানলেন তিনি। তারপর মাথাটা ঢলে পড়ল একপাশে।
সমস্ত শহরে খবরটা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না।

গুলবদনের মৃত্যুর দু'মাস পর আগ্রায় পা রাখলেন সেলিম। শহরের প্রবেশদ্বার থেকে তাকে নিজ প্রাসাদে নিয়ে এলেন মরিয়ম মাখানি। দু'বছরে এই প্রথম দাদি আর নাতির দেখা। আবেগ চেপে রাখতে না পেরে নাতিকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলেন দাদি। সেলিমের চোখও অশ্রুসজল। শিশুকাল থেকে এ পর্যন্ত পিতামহীর উদার প্রশ্রয় আর স্নেহের নানা স্মৃতি ভেসে উঠছে তাঁর চোখে। অন্য সব ভাইবোনের তুলনায় তাঁর জন্য মরিয়ম মাখানির টানটা যে অনেক বেশি সেটি বিলক্ষণ জানেন তিনি।
'শাহেনশাহর মুখে মুখে কথা বলবে না,' নাতিকে বললেন হামিদা বানু। 'যাই বলুক, চুপ করে থাকবে। তারপর ক্ষমা চাইবে তোমার ভুলের জন্য। মনে থাকবে তো?'
উপর নিচে মাথা নাড়লেন সেলিম। সে রাতে অনেকক্ষণ ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করে আর গল্প করে দাদির সঙ্গে কাটালেন। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় টের পেলেন, বুকটা ঢিপঢিপ করছে। নিজেকেই ধমক দিলেন সেলিম। চৌত্রিশ বছর বয়স তার, ছয় সন্তানের বাবা। অথচ এখনও নিজের বাবার সামনাসামনি হওয়ার আগে ভয়ে বুক কাঁপে। কী ধরনের মানুষ তিনি!
পরদিন দরবারে সম্রাটের মুখোমুখি হওয়ার পর ধুকপুকুনিটা অবশ্য আর থাকল না। সবার সামনে নিজের পাগড়ি খুলে ছেলেকে পরিয়ে দিলেন আকবর, তারপর বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন সেলিম। এ যাত্রা ফাঁড়াটা মনে হয় কাটল!

পরদিন খুররমকে দেখতে গেলেন সেলিম।
তিন পুত্রের মধ্যে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় খুররম। খুররমের মা মারওয়াড়ের রাজা উদয় সিংয়ের কন্যা জগৎ গোসাই, মান বাইকে বিয়ে করার পরের বছরই তাকে বিয়ে করেন সেলিম। খুররমের জন্মের পরপরই সম্রাট আকবরের নিঃসন্তান স্ত্রী রুকাইয়া সুলতান বেগম সম্রাটকে অনুরোধ করেন খুররমকে তাঁকে দিয়ে দেয়ার জন্য। আকবরের নির্দেশে সন্তানকে রুকাইয়ার হাতে তুলে দিতে হয় জগৎ গোসাইকে। সে থেকে এখনও রুকাইয়ার কাছেই আছে খুররম। খুররমকে রুকাইয়া যেভাবে বড় করেছে নিজের গর্ভজাত সন্তানকেও কেউ সেভাবে করে না। সেলিম জানেন, সমস্ত নাতির মধ্যে খুররমই সম্রাটের সবচেয়ে প্রিয়। নাতির নাম নিজে রেখেছেন আকবর, যার অর্থ 'খুশি'। মিষ্টি চেহারার খুররমকে যখনই দেখে সেলিমের নিজের মনেও খুশির হিল্লোল বয়ে যায়।
রুকাইয়ার মহলে ঢুকেই সেলিম দেখেন খুররমকে পেয়ালা থেকে কিছু একটা খাওয়ানোর চেষ্টা করছে রুকাইয়া, আর মাথা নেড়ে অনিচ্ছা জানাচ্ছে খুররম। এগারো বছর বয়সেই বেশ লম্বা হয়ে উঠেছে খুররম। মায়ের বড় বড় চোখ আর চেহারার কমনীয়তা পেয়েছে, চোয়াল আর থুতনির কাছটায় বাবার ছাপও স্পষ্ট। মনটা খুশি হয়ে উঠল সেলিমের। হেসে উঠলেন তিনি। একসঙ্গে তার দিকে তাকাল খুররম আর রুকাইয়া।
'শাহজাদা তুমি?' আনন্দিত চেহারায় বললেন রুকাইয়া। মরিয়ম মাখানি আর সেলিমার মতো সেলিমকে পছন্দ করেন তিনিও।
'কী খাওয়ার ব্যাপারে এমন আপত্তি তার?' খুররমের দিকে ইশারা করে লঘুকণ্ঠে জানতে চাইলেন সেলিম।
'পায়েস। যত দিন যাচ্ছে বেয়াড়া হচ্ছে ছেলেটা,' কপট রাগ রুকাইয়ার কণ্ঠে।
বাবাকে তসলিম জানাল খুররম। জন্মের পর থেকে সেভাবে বাবার সঙ্গে থাকা না হলেও সেলিমের চেহারাটা ভালোই চেনা আছে তার।
কাছে গিয়ে খুররমের মাথায় হাত বোলালেন সেলিম।
'তুমি এসেছ আমরা খুব খুশি হয়েছি,' রুকাইয়া বললেন। 'আগ্রাতেই থাকা জন্য ভালো হবে তোমার জন্য।'
মাথা নাড়লেন সেলিম। রুকাইয়ার কথার নিহিত অর্থ বুঝতে পেরেছেন, যদিও কতদিন আগ্রায় থাকা হবে তা নিয়ে তার নিজের মনেই সন্দেহ আছে।
'দেখা যাক। আর সব খবর ভালো তো এদিকে?'
'তুমি তো সবই জানো,' রুকাইয়ার কণ্ঠস্বর গম্ভীর। 'সম্রাটের শরীর আর আগের মতো নেই। মনটাও নরম হয়ে গেছে। তাই বলে বাকিরা তো আর বসে নেই। যে যার মতো কাজ করছে।'
সেলিম বুঝলেন, নাম উচ্চারণ না করে মির্জা আজিজ কোকা আর মান সিংয়ের কথা বলছেন রুকাইয়া।
'আপনারা আর মরিয়ম মাখানি আমার জন্য যা করেছেন তাতে আমি কৃতজ্ঞ।'
'শাহেনশাহ বাবুরের রক্ত আর ঘামে গড়া এ সাম্রাজ্য ধুলোয় মিশে যাক তা আমরা চাই না।'
চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল সেলিমের। 'আমি বেঁচে থাকতে তা হতে দেব না,' নিচু কিন্তু দৃঢ় সংকল্পে ভরা গলায় বললেন তিনি।

ছয় মাস পর এলাহাবাদে ফিরলেন সেলিম।
না ফিরে উপায় ছিল না। আগ্রায় মাসতিনেক কাটানোর পরই ফের মেওয়ার অভিযানের জন্য তাকে তাড়া দিতে শুরু করেন আকবর। যাচ্ছি-যাব করে দু-এক মাস কাটানোর পর যখন বুঝলেন কিছুতেই আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না, বিরাট এক বাহিনী নিয়ে রওনা হলেন সেলিম। তবে মাইলচল্লিশেক দূরে ফতেপুর সিক্রিতে গিয়েই ঘাঁটি গেড়ে বসলেন। আগ্রায় দূত পাঠিয়ে জানালেন, এত কম সৈন্য নিয়ে রাণার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা ঠিক হবে না, আরো সৈন্য আর রসদ লাগবে। আকবরের ফিরতি বার্তা আসতেও দেরি হলো না। বরাবরের মতোই সংক্ষিপ্ত সে বার্তা: 'বরং এলাহাবাদেই ফিরে যাও তুমি। আমার ঝামেলা আমিই সামলাব।'
এলাহাবাদে ফিরেই সম্রাটের সঙ্গে পুনর্মিলনকে উদযাপন করার জন্য আনন্দ উৎসবের আয়োজন করলেন সেলিম। পেটপুরে খাওয়ালেন অমাত্য থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাইকে, আকাশ আলো করে বাজি ফুটল, ঘনিষ্ঠ অমাত্যদের নিয়ে সুরা আর নাচগানে মেতে থাকলেন অনেক রাত পর্যন্ত।
এমনকি চরম সন্দেহবাতিকগ্রস্ত কুতুবুদ্দিন কোকা পর্যন্ত স্বীকার করলেন, আগ্রা সফরটা বৃথা যায়নি।
তবে মাসতিনেকের মধ্যেই এমন একটা ঘটনা ঘটল, সেলিমের সব আনন্দ এক ফুঁৎকারে নিভে গেল।
আত্মহত্যা করলেন মান বাই।
হতে পারে স্বামী আর সন্তানের অন্তহীন দ্ব›দ্ব সহ্যের শেষ সীমায় নিয়ে গিয়েছিল তাকে। গোটা এক বোতল আফিম গলায় ঢেলে যন্ত্রণামুক্তির সহজ পথটিই বেছে নিলেন।
স্ত্রীর মৃতদেহের সামনে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন সেলিম।
উনিশ বছর আগে লাহোরের সেই আনন্দ উৎসবে ভরা রাতের কথা মনে পড়ল তার, যে রাতে শাহ বেগম হয়ে তার ঘরে এসেছিল কিশোরী মান বাই। সেলিমের মনে হলো তাঁর হৃদয়ের সব আলো নিভে আসছে, প্রগাঢ় এক অন্ধকার ভারি চাদরের মতো ঢেকে দিচ্ছে তাঁর সত্তাকে।
অঝোরে কাঁদলেন সেলিম। মান বাইয়ের জন্য এতটা ভালোবাসা তার হৃদয়ে ছিল তিনি নিজেও জানতেন না।

আলামপনাহ নামক প্রকাশিতব্য উপন্যাসের অংশবিশেষ