দিনহাটায় স্টুডেন্ট ফেডারেশনের উত্থান

নূরিতা নূসরাত খন্দকার
Published : 22 June 2020, 05:53 AM
Updated : 22 June 2020, 05:53 AM


১৯৬০ সালের কথা। অসিত তখনও কৈশোরত্ব ছাড়েনি । সরু গড়ন। ঝড়ো বাতাসের ধাক্কা সামলানোর মতো কায়িক শক্তি শরীরে তখনও জমেনি। বেশ নড়বড়ে। কলকাতার এক উকিলের ছেলে সে। তার পুরো নাম অসিতবরণ রায়। সবে তার স্কুল শেষ। মানে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। রেজাল্ট না হওয়া পর্যন্ত ইয়া লম্বা ছুটি। নিশ্চয়ই চুনসুরকির বস্তি কলকাতায় বসে ছুটির মতোন গুরুত্বপূর্ণ সময়টা নষ্ট করা চলে না! গ্রামের বাড়ি কোচবিহারের দিনহাটায়। কাকা, কাকাতো ভাই সহ নানা আত্মীয়তার ডালপালা সেখানে। এসব ছাড়াও বীরেনের মতো ডানপিটেদের প্রতি আকর্ষণও কম নয়। পরিবারের সাথে বাক্সপেট্রা সমেত ছুটি কাটাতে সোজা দিনহাটায় ছুটলো নড়বড়ে দেহ কাঠামোর কিশোর অসিতবরণ রায়।

মদনমোহন পাড়াটি তখনও গ্রামীন আঁচল বিছিয়ে প্রকৃতির নরম কোমল রূপ-লাবণ্যে ভরপুর। পাড়ার সব দুরন্ত ছেলেরাই অসিতের বন্ধু। তার উপর সে কমরেড অজিত রায় গুপ্তের কাকাতো ভাই। এবারের দিনহাটা যাপন অসিতের কাছে বেশ ব্যতিক্রম হতে চলেছে। পারিবারিকভাবে কমিউনিস্ট ঘরানায় বেড়ে উঠেছে। তারমধ্যে এবার এসে মদনমোহন পাড়া নতুন নতুন খবরে তোলপাড়। এরইমধ্যে বছর কয়েক আগে দিনহাটার কিছু পরিচিত ত্যাঁদোড় ছেলেপুলে এলাকার ত্রাস হয়ে গেছে। অসিতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বীরেনও ছিলো সেইসব ত্রাসের শীর্ষমুনি। সেসব গল্পের ভীড় ঠেলে ঠেলে অসিতের চোখে পড়লো সাদা বর্ণের এক বাল্যতরুণ নুরুজ্জামান খন্দকার।

কয়েক বছর আগে ১৯৫৩-৫৪ সালের কথা। দিনহাটার একদল কিশোর 'খাদ্য আন্দোলন' সংগঠিত করেছিলো । নুরুজ্জামান ও বীরেনের নেতৃত্বে শহীদবাগে বিপুল ছাত্র জমায়েত হয়। সরকার বিরোধী কঠোর আন্দোলন গড়ে তারা সফলও হয়েছিলো সেবার। যদিও পুলিশের ব্যাপক লাঠিলার্জ, গুলিবর্ষণে নুরুজ্জামান, বীরেন কেউই দমে যায়নি। তবে পুলিশের বুলেটে বকুল, বন্দনা দুইজন ছাত্রী এবং আরও তিনজন ছাত্র সহ মোট পাঁচজন আন্দোলনকারীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।

অনেকেই রাজবন্দী হলো। জেলের বদ্ধঘরে বারবার বন্দী হয়ে আসে বীরেন আর নুরুজ্জামান। কয়েক দফা জেল খাটতে হয় তাদের। পুলিশের কড়া চোখ এই দুইজনের দিকেই বিস্ফোরিত হয় বারবার। সহযোদ্ধাদের মৃত্যুশোক বুকে চেপে রাখতে জানে ওরা। কারণ ওরা দু'জনই শৈশব থেকে হারানোর বেদনার ভার কী, তা জেনে এসেছে। সংসারের কনিষ্ঠ পুত্র নুরুজ্জামানের জন্মের কয়েকমাস পরেই তার পিতা হাজী মোঃ ছকিউদ্দিনের মৃত্যু ঘটে। পিতাহীন সংসারে মাথার ছায়া বলতে তখন বড় তিনভাই আর তিনবোন এবং দুই মা। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পীর বংশীয় ঘরের ছেলে। অভাব নেই কোথাও। কিন্তু অনাদর তো থেকেই যায় পিতৃহীনতার। মনমরা মন বুকে চেপে রাখে। তাই পৃথিবীর প্রতি অভিমানও উগলে আসে কখনও কখনও। তবু নির্লিপ্ততাকেই বরণ করেছে সে তখন থেকেই। শিশুর বায়না বোঝার মতোন ভার কারও ওপর ছিলো না। পীর ঘরের মা বোনরা ছিলো অন্তঃপুরবাসিনী। ভাইয়ে ছিলো আবাদ নিয়ে ব্যস্ত। অনেকটা চলাচল শেখার পর একাকীই তাকে বড় হতে হয়েছে। বেড়ে উঠতে উঠতেই বড়বোন, মেঝো বোন, ছোট বুজান সবারই তখন নিজের সংসার। তাই ঘরেও নিভৃতচারী জীবন নুরুজ্জামানের। বন্ধুমহলেও খুব বেশি রসিক নয় সে। চুপচাপ থাকাই স্বভাব ছিলো তার।


বীরেন বাড়ির বড় ছেলে। তারও কিশোর বুকে ছোটে সেই ফুলকুমারি নদী। চোখে ছায়া দোলায় বাড়ির বড় আমলকী গাছটা। ধানি ক্ষেত ঘেরা সেই কুড়িগ্রামের বাড়ির আঙিনা হুহু করে ওঠে বুকের মাঝে। বাবা নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী। ঢাকামেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা ডাক্তার। কুড়িগ্রামেই রোগী দেখতেন। পূর্ববঙ্গের উত্তরে কুড়িগ্রাম একটি সাব ডিভিশন তখন। ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর নানারকম ভাগাভাগির চির তাদেরও পরিবারে লাগতে থাকে। খুব বেশিদিন আাগের কথা নয়। ১৯৫০ সাল। সবফেলে এক কাপড়েই একদিন ভোরবেলা কোচবিহারের দিনহাটায় গোটা পরিবারকে চলে আসতে হলো। শৈশবের সেই মিষ্টি গ্রামের বাড়িটা বীরেনের চোখ থেকে মলিন হয় না। হারানোর যন্ত্রণার ঢেউ পাড়ি দিতে বীরেনও শিখে ফেলেছিলো ততোদিনে। প্রায় সমবয়সী পাঁচজন সহযোদ্ধা হারানোর শোক বুকে চেপেই শুরু হয় নুরুজ্জামান এবং বীরেনের নতুন পদযাত্রা। নুরুজ্জামান তখন শনিদেবী হাইস্কুলের ক্লাস সেভেনের ছাত্র। বীরেন তখন নিগমানন্দ সারস্বত স্কুলের ক্লাস সিক্সের ছাত্র। সেবারই তারা জেল থেকে বেরিয়ে ছাত্র ফেডারেশনের ফর্ম সংগ্রহ করে সদস্য হয়ে যায়।

১৯৫৬ সাল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তখন বিধানচন্দ্র রায়। 'রি অর্গানাইজেশন অব স্টেট আইন' জারি হলো। বাংলা ও বিহারকে একত্র করে এক রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করা হলো। এর বিরোধীতা করে কমিউনিস্টদের সারা রাজ্য জুড়ে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। নুরুজ্জামান এবং বীরেন গোটা দিনহাটায় সরকারী আইন অমান্য করে তুমুল আন্দোলনে ব্যস্ত। প্রায় রোজই আইন অমান্য করতো আর জেল খাটতো। বের হলেও আবারও পুলিশ জেলেই পুরতো। তো রাজবন্দী এইসব ত্যাঁদোড় কিশোরদের পুলিশও ঠিক বাগে আনতে পারছিলো না। যা হোক সেবারও ছাত্র আন্দোলনকে তারা নেতৃত্ব দিয়ে জয়ের পথে এগিয়ে চলে। স্টেশন পড়ার ফকীর টাড়িতে নুরুজ্জামানের বাড়ি। তারই কাছাকাছি আজিমিয়া স্কুল। একটিমাত্র টিনের ঘর বিশিষ্ট ঐ স্কুলটিকেই বেছে নিলো নুরুজ্জামান ও তার সহযোদ্ধারা। সেখানে প্রথমবার ছাত্র ফেডারেশনের সম্মেলন করলো। দিনহাটারও ইতিহাসের মাঠে সেদিনই প্রথম সূর্য উদিত হলো ছাত্র ফেডারেশন সম্মেলনের। প্রায় দেড়শত ছেলেমেয়ের কিশোর-তরুণের বিশাল জনগমাগম। ভোটগ্রহণের মাধ্যমে সভাপতি পদে নির্বাচিত হলো সরোজ বর্মা। সেও আহামরি বয়সী কেউ নয়। স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি তখনও। সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হলো কমরেড নুরুজ্জামান। সহসম্পাদক পদে নির্বাচিত হলো কমরেড বীরেন। আবারও এই দুই জনের ওপর বর্তালো সুকঠোর ভার। প্রিয় থেকে জনপ্রিয় হয়ে গেলো তারা।

এরপর ১৯৫৯ সালের কথা। দিনহাটার ইতিহাসে প্রথম ছাত্রফেডারেশনের অফিস ঘর নেওয়া হলো মহা ধুমধামের সাথে। গোধূলি বাজারে কোনোরকম একটি টিনের চালা, টিনের বেড়া বিশিষ্ট টং ঘর। অবস্থা যে খুব সুবিধার নয় তা আর বলতে। সেইসালেই সারা বিশ্বে তোলপাড় করা একটা সংবাদ ছুটতে লাগলো। তোলপাড় করা সংবাদের উত্তেজনার ধূমকেতু কিশোর কমরেডে নুরুজ্জামানের বুকেও এসে দুম করে বিঁধল। সোভিয়েত রাশিয়া সেবার একটা রকেট মহাকাশে চাঁদের বুকে ক্ষেপণ করছে। পৃথিবীবাসীর কাছে মহাবিস্ময় ছিলো সেটি। একেতো রাশিয়া, তার উপর বিশ্বে প্রথম এই রকেট ক্ষেপণ করা হয়েছে মহাকাশে। এর জন্য তো একটা উৎসব উদযাপন করা ফরজ কাজ। নুরুজ্জামানের মাথায় এলো এবার ফেডারেশন যতই কমিউনিস্ট বিশ্বাসী হউক, সরস্বতী পূজা এবার করা চাই। হৈ হৈ করে প্রতিবাদের ঝড়।
-কমিউনিস্ট করবে পূজো!
-এ কেমন অবাক কথা!
-না না ওসব চলবে না।
-চাঁদে সরস্বতীকে পাঠিয়ে পড়াশুনা সব বিসর্জন দিবো নাকি।

এসব শুনে নুরুজ্জামান সকল প্রতিবাদীকে বুঝিয়ে বললো, এবার সরস্বতী চড়ে বসবে সোভিয়েত রাশিয়ার রকেটে। সেই রকেটের আদলেই সরস্বতী নেমে আসবে ধরিত্রীপুরে।

ব্যস ! চললো খিচুড়ি ভোগের আয়োজন, তিনদিন লাগাতার। কেউ আর সে কয়দিন পিটুনির ভয়ে বাড়ি ফিরলো না। একে তো পাড়া তোলপাড় করা একেকটা ত্যাঁদোড় ছেলেপুলে। তাতে আবার রাজবন্দী হয়ে বিশাল বিশাল নেতাও বনে গেছে। বাড়ির পথে পা পড়বেই বা কেন। পার্টি অফিসেই তক্তা বিছিয়ে মশার কামড় খেয়ে রাত কাটালো সবাই। কিন্তু বীরেন প্রথম রাতে মশার আক্রমণ আর সইতে না পেরে পাশেই টং দোকানের বেঞ্চে ঘুমালো সে কয়দিন।

২.
এসব যাবতীয় খবর অসিত বরণ রায় কলকাতা থেকে দিনহাটায় এসে সংগ্রহ করলো। নুরুজ্জামানদা আর বন্ধু বীরেনের পলিটিকাল একটা বিশাল টিমও তৈরি হয়েছে। দু'দিন বাদেই তারা 'গ্রামের দিকে মুখ ফেরাও' আন্দোলন নিয়ে এঁদো কাদা ঘাটা গ্রামের পথে গিয়ে মানুষকে একত্রিত করবে। সবাই মহাব্যস্ত। টিমে রয়েছে গণ জাগানিয়া এবং জনসমাগমের শিল্পী গুরুচরণ সরকার, কল্যাণ ঘোষ। এদের গান শুনে মনে হত যেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়েরই গান শুনছে। এরাও যে খুব বেশি দূর বয়সের ঘর টপকেছে তাও নয়। স্কুল ছেড়ে নেতারা কেউ তখন সদ্য কলেজ পড়ুয়া, কিম্বা মেট্রিকুলেশনের ছুটি কাটাচ্ছে। তো আন্দোলনের খবর পেয়ে তো অসিতেরও বসে থাকলে চলে না। অসিতও চলবে তাদের সাথে গ্রামে গ্রামে, গণ মানুষের মুক্তির পথে পথে। নুরুজ্জামান আর বীরেনের আদর্শ পথে রওনা দিবে সেও।

মাথা ভাঙা সাব ডিভিশনের গ্রামগুলোতে কাজ করার প্রধান প্রধান দায়িত্ব নুরুজ্জামান এবং বীরেনের ওপর আরোপ হলো। কেন্দ্রীয় পার্টির তরফ থেকে খরচও পাঠানো হয়েছে। গাড়ির খুব একটা সুদিন তখনকার দিনেও আসেনি। গাড়ির সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। কোনোমতে একটা সরকারি বাস ধরে মাথাভাঙা শহরে পৌঁছালো সবাই। সেখানে পার্টি সেক্রেটারি পদে একজন মারোওয়ারিকে দেখে নুরুজ্জামান ও বীরেন মারাত্ম থুবড়ে গেলো। অবাক হলো। মারোওয়ারি তো বুর্জোয়া বণিক শ্রেণির হয়! এ আবার কমিউনিস্ট পার্টিতে এলো কী করতে! পরিচয় জানার পর বাকিদেরও চোখ কপালে। যা হোক। মারোওয়ারির ব্যাপক সহযোগিতায় তরুণ আভার কিশোর দলটি অবশেষে একটা গ্রামেরবাড়ির গোয়াল ঘরে ঠাই পেলো।

চারিদিকে গোবরের গন্ধ। সেখানে পোয়ালের ওপর ছালা বিছানো। গোয়াল ঘরেই এইসব কমরেড মশার কামড় সমেত হাড় হাড্ডির নাসারন্ধ্র বুঁজে কোনমতে রাত কাটালো। খানা হিসেবে আউস ধানের মার্বেল সাইজ ভাত এলো। নুন মরিচ। ওতেই পেট পুরলো সবার। একদিকে থাকা খাওয়ার দুর্দশা। তো আরেকদিকে পুলিশি দুর্দান্ত টহল।

গ্রামের পথে যেখানেই পোয়ালের পুঁজ, সেখানেই পার্টির ব্যানার ঝুলিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা। আবার সেখানেই তেড়েমেরে ছুটে এসে ব্যানার ছেড়ে পোয়ালের মালিক। নয়তো পুলিশ বন্দুক উঁচিয়ে ভণ্ডুল করে দেয় গ্রামবাসীর গ্রামের দিকে মুখ ফেরাও কর্মসূচি। এরমধ্যে ঘটে গেলো আরেক মহাবিপদ। একদিকে পুলিশ তাদের খোঁজে এ গ্রামে সে গ্রামে। এতসব বিপদ মাথার ওপর ঝুলছিলো। তাতে আবার একরাতে কোন এক হতভাগা এসে সেই গোয়ালঘরেই গলায় দিলো দড়ি। ভোরে আলো ফোটার আগেই সবার কেমন কেমন যেন লাগছিলো। ঘুম ভাঙতেই ঝুলন্ত লাশ চোখের সামনে। নুরুজ্জামানের মাথায় এলো পুলিশকেস! বীরেন ভাবলো পুলিশ মানেই গোটা টিমকে রিমান্ডে নেওয়া হবে। বাকিরাও ভাবলো, পুলিশ তো তাদেরও খুঁজছে। আর কি সেখানে থাকা যায়! নিমিষেই সবাই টের পেলো দুষ্ট কিশোরের চেয়ে শূন্য গোয়ালঘর শ্রেয়। গোটা টিম ভদ্দরনোকের মতোন বেরিয়ে পড়লো চুপচাপ। বাড়ির কেউ টের পেলো না। সকালের আগেই অন্য গ্রামে ঢুকে গেলো তারা।

প্রায় একমাস ধরে নানান গ্রামে ঘুরে ঘুরে 'গ্রামের দিকে মুখ ফেরাও' কর্মসূচি কমরেড নেতা নুরুজ্জামান এবং বীরেনের নেতৃত্বে অদমনীয় রইলো। সারাদিন হাড়ভাঙা মিটিং,সমাবেশ, জ্বালাময়ী গান, বক্তৃতা চলতে লাগলো। ফুরসত মিললে নদীর বুকে তোলপাড় সাঁতার। অন্তক্ষরি গানের লড়াই আড্ডা। সবকাজ শেষে গ্রামের কোথাও খড়ের গাদা পেলেই সকলেই সেখানে ধপাস। মশার আক্রমণ তীব্র। তবুও সেসব ক্লান্ত তরুণ শরীর বুলিয়ে জোস্নার চাদরও নিথর হয়ে যেত।

মাথাভাঙায় ফেরার পালা। গ্রাম ছেড়ে শহরের পথ ধরে ফিরেও এলো। টিমটি সেবার দুর্দান্ত কাজ সেরে ফিরছে। এমনসময় সবাই খবর পেলো মনোহর আইচের শো হবে মাথাভাঙ্গা পার্টি অফিসের আসপাশেই কোথাও। এই বীরের মাসল প্রদর্শনী না দেখে তো দিনহাটায় ফেরা উচিতই হবে না কারোর। গভীর আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো তারা শো দেখে তারপরদিন ফিরবে। সেদিন রাতেই ঘটলো আর এক মহা বিপত্তি। অসিত কলকাতার ছেলে। একেই শরীরটা নড়বড়ে। তাতে গ্রামের ওইসব মার্বেল সাইজ ভাত আর উল্টোপাল্টা যাপনে তার শরীর বসলো বেঁকে। ডায়রিয়ার আক্রমণ মারাত্মক ভাবে কাবু হয়ে গেলো সে । যখনই পেট মোচড়ায় অসিতের গগনফাটা চিৎকার শুরু হয়। খানিক বাদে বাদে কান্নার বিলাপে বলে, 'ও নুরুজ্জামান দা গো…আমি মরে গেলাম গো। ও বীরেন আমি আর বাঁচবো না রে'। নুরুজ্জামান এবং বীরেনের মতো দুই বীর বাহাদুর নেতা থাকতে সামান্য পেট খারাপের দোহাই দিয়ে যম অসিতকে নিয়ে যাবে! যমের সে সাহস কোথায়! যমকে পেদানোর নকশাও তৈরি হলো দ্রুত। ডাক্তার ডাকতে ছুটলো ওরা। অবশেষে ডাক্তার এলো। ঔষধ অস্ত্রে যমকে পেদিয়ে সারিয়ে তোলা হলো অসিতকে।


পরদিন। মনোহর আইচের প্রদর্শনী দেখে রাতে সবাই মিলে একটা হিন্দু হোটেলে খেতে গেলো। নুরুজ্জামানের কী যেন মনে হলো। খাবার অর্ডারের আগেই সে গেলো ম্যানেজারের কাছে। বললো, আমি তো মুসলমান ঘরের। আপনারা কি আমাকে খেতে দিবেন?
-না! মানে…আমরা তো মুসলমানকে খেতে দিই না। আমাদের নিয়ম নেই।

নুরুজ্জামান চুপচাপ বাইরে বেরিয়ে গেলো কথা না বাড়িয়ে।
বীরেন দৃশ্যটি দেখলো। সেও বেরিয়ে গিয়ে নুরুজ্জামানকে বললো, কী হলো এটা? তুই কেন এত কথা বলতে গেলি। চুপচাপ খেয়ে নিলে সমস্যা কি?
নুরুজ্জামান একটি কথাও বলেনি। সে রাতে শুধু মুড়ি খেয়েই কাটালো। পরদিন দিনহাটায় ফিরলো সবাই। অসিত ফিরে গেলো কলকাতায়। নুরুজ্জামান ও বীরেন সম্পূর্ণরূপেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে থাকলো কোচবিহারের গ্রামে গ্রামে।

দিনহাটা কলেজের ইতিহাসে ছাত্র ফেডারেশন নির্বাচনে (১৯৬১- ৬২সাল) জিএস নুরুজ্জামান খন্দকার নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারপর ১৯৬২-৬৩ সালে একই কলেজে জিএস হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন কমরেড বীরেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী। দিনহাটা কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে প্রথম মঞ্চস্থ রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা। এদিক থেকেও দিনহাটার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নতুন চমক সৃষ্টি করেন তিনি। তখন কেউ চিত্রাঙ্গদার গান তেমন জানতো না। কমরেড নুরুজ্জামান নিজেই তার সংগ্রহ করা গ্রামোফোন রেকর্ড বাজিয়ে বাজিয়ে ছাত্র ফেডারেশনের মহিলা দলকে গান শেখানোর ব্যবস্থা করলেন। স্বপ্না ব্যানার্জী, ঝর্ণা বর্ধন প্রমূখেরা গানগুলো শিখে ফেলেন নবউদ্যমে। সেবার অর্জুনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তৎকালীন প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা রাজেন চ্যাটার্জীর কন্যা লক্মী চ্যাটার্জী। বীরেন্দ্রনারায়ণ চুরি করে নেতার বাড়ি ঢুকে তাদের লক্ষ্মীদিকে রিহার্সালে নিয়ে আসতেন এবং বাড়ি পৌঁছেও দিতেন। এভাবেই কমরেড নুরুজ্জামানের পরিচালনায় কলেজের মাঠে চিত্রাঙ্গদা মঞ্চস্থ হয়। এই নতুন চমকে সকলে নুরুজ্জামানের সৃজনশীল প্রতিভার সুনামও করেন। কলেজের প্রিন্সিপালও তাকে খুব ভালোবাসতেন। নুরুজ্জামান ও বীরেন ছিলেন প্রিন্সিপাল রামচরণ নাথের আদরনীয় ছাত্র। চীনপন্থী হিসেবে নুরুজ্জামান ও বীরেনের মাথার ওপর হুলিয়া জারি হলে এই প্রিন্সিপালই দু'জনকে কলেজের পিছনের গেট দিয়ে পালিয়ে যেতে করেছিলেন।

তারপর দু'জনেরই জীবনের অধ্যায়গুলো বিচিত্র ঘটনার ভিতর দিয়ে পরিবর্তিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিতেও দেশভাগের মতন বিভক্তি আসে। সে সময় কমরেড কমল গুহের সাথে তাঁদের কখনও মতাদর্শ বনতো, কখনও বনতো না। পরবর্তীতে দুইজনই সিপিএমের পক্ষে নেতৃত্ব দেন। একসময় উচ্চতর পড়াশোনার জন্য বীরেন চকে যান গৌহাটিতে। দুই বন্ধুর বিচ্ছেদের নির্ঘণ্ট যে তখনই বাজবে তা তাঁরা কেউই জানতেন না।

নানা ঘটনার এলোমেলো ঝড় পেরিয়েও ঘটে যায় আর এক কাকতালীয় ঘটনা। আজ কমরেড নুরুজ্জামান খন্দকার চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন বীরেনেরই ফেলে যাওয়া সেইকালের কুড়িগ্রামের সাবডিভিশনের থানা লালমনিহাটের মাটিতে। আর কমরেড বীরেন আজও রয়ে গেছেন নুরুজ্জামানেরই পিতৃভূমি দিনহাটার প্রাঙ্গনে। বর্তমানে তিনি মুম্বাইয়ে অবসর কাটাচ্ছেন, কন্যার বাড়িতে। বিভিন্ন দেশবিদেশ ভ্রমণ করেও অসিতবরণ রায় রয়েছেন কলকাতায়। তিনি আলিয়াস ফ্রসেসের একজন সম্মানিত ফরাসী ভাষা শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেছেন। বহু গ্রন্থ অনুবাদও করেছেন। এত ব্যস্ত জীবন পেরিয়েও কমরেড নুরুজ্জামান তাঁদের স্মৃতিতে আজও বেঁচে আছেন।

(কমরেড বীরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার অবলম্বনে)