রোয়াল্ড ডাল-এর গল্প: স্বর্গে যাওয়ার পথ

নাবিলা ওরিয়ানা
Published : 6 Nov 2021, 03:01 PM
Updated : 6 Nov 2021, 03:01 PM


রোয়াল্ড ডাল একজন ওয়েল্‌সীয় লেখক এবং ঔপন্যাসিক। তাঁর জন্ম ১৯১৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যের কার্ডিফে। তাঁর বইয়ের কপি সারা বিশ্বজুড়ে ২৫০ মিলিয়নেরও বেশি বিক্রি হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি রয়্যাল এয়ারফোর্সে কাজ করেছেন। চল্লিশের দশকে তিনি প্রথম ছোটদের এবং বড়দের জন্য লেখার জন্যে খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় বইগুলো হলো 'চার্লি অ্যান্ড দ্যা চকলেট ফ্যাক্টরি', 'মাটিল্ডা' এবং 'দ্যা বিজিএফ'। ১৯৯০ সালের ২৩ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মুল: রোয়াল্ড ডাল
বাংলা অনুবাদ: নাবিলা ওরিয়ানা

মিসেস ফস্টারের মধ্যে সারা জীবন ধরেই ট্রেন, প্লেন, লঞ্চ, এমনকি থিয়েটারের শো ধরতে দেরী হয়ে যাওয়া নিয়ে একটা অসুন্থতাজনিত ভয় কাজ করে। অন্য সব ব্যাপারে তিনি কখনোই তেমন নার্ভাস না হলেও কোন বিশেষ জায়গায় যেতে দেরী হয়ে যাবার চিন্তা পর্যন্ত মাথায় এলেও তিনি খুবই নার্ভাস হয়ে পড়তেন। মাঝে মাঝে সেটা এমন পর্যায়ে চলে যেতো, যে তার বাম চোখের একটা ছোট্ট মাংসপেশী লাফানো শুরু করতো। তার চোখের সেই লাফালাফি ফ্লাইট বা ট্রেন ঠিক সময়ে ধরার পরেও প্রায় এক ঘন্টা পরও চলতে থাকতো। এর আগে যেন থামতেই চাইতো না কোনভাবে। এটাই ছিলো সব থেকে বিরক্তিকর ব্যাপার।

ট্রেন ধরার মতো একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে উদ্বেগ যে কারো কারো মধ্যে একেবারে অবসেশনের পর্যায়ে চলে যেতে পারে, ব্যাপারটা সত্যিই খুব অদ্ভুত। কখনো কোন কারণে স্টেশনে যাওয়ার দরকার পড়লে, বের হবার নির্দিষ্ট সময়ের কমপক্ষে আধা ঘণ্টা আগে তিনি হ্যাট, কোট আর হাতমোজা পরে একবারে প্রস্তুত হয়ে লিফটের বাইরে পা রাখতেন। আর তারপর এ রুম থেকে ও রুম শুধু অস্থিরভাবে পায়চারি করে বেড়াতেন। তার স্বামী তার নিজের রুম থেকে বের হওয়া পর্যন্ত তিনি এভাবেই ছটফট করতে থাকতেন। মিস্টার ফস্টার বেশ ভালোভাবেই তার স্ত্রীর এই অবস্থার কথা জানতেন। রুম থেকে বেরিয়ে এসে একেবারে শান্ত গলায় তাকে বলতেন, হয়তো তাদের এবার আস্তে আস্তে বের হওয়া উচিৎ। এই পুরো সময়টা জুড়ে কোনো এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকা মিসেস ফস্টারের কাছে ছিলো একেবারে অসম্ভব।

স্ত্রীর এরকম উদ্ভট আচরণের কারণে মিস্টার ফস্টারের হয়তো বিরক্ত হওয়ার অধিকার ছিলোই, কিন্তু এভাবে অহেতুক তাকে অপেক্ষায় রেখে যন্ত্রণা দেয়ার কোনো অজুহাতই তার থাকার কথা নয়। তিনি যে এই কাজটি করেছেন তা নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই। কিন্তু যখনই তাদের একসাথে কোথাও যেতে হতো, মিস্টার ফস্টার একদম ঠিক সময়েই সেখানে পৌঁছে যেতেন। হয়তো বড়জোর দুই-এক মিনিট দেরী হতো। তিনি যে আসলেই ইচ্ছা করে তার স্ত্রীর উপর অত্যাচার চালাচ্ছেন না, সেটা তার আচরণ দেখে বিশ্বাস করা কষ্টকর ছিলো। স্ত্রী যে কখনোই তাকে তাড়া দেয়ার সাহস পাবেন না, সেটাও তিনি বেশ ভালো করেই জানতেন। নিজের স্ত্রীকে তিনি এতোটাই বাগে এনে রেখেছেন। তার সহ্যসীমা পার করে অপেক্ষা করিয়ে রাখলে যে সে হিস্টেরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়বে, এটাও মিস্টার ফস্টারের জানা ছিল। তাদের বিবাহিত জীবনের শেষ কয়েক বছরে দুয়েকবার মনে হয় শুধু বেচারীর ভোগান্তি বাড়াতেই তিনি ইচ্ছে করে ট্রেন মিস করেছেন।

মিস্টার ফস্টার যে ইচ্ছে করেই এমনটা করতেন, সেটাও ঠিক নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তার এই আচরণ আরো অযৌক্তিক লাগতো এই কারণে যে, এই ছোট্ট একটা সমস্যা বাদ দিলে মিসেস ফস্টার বরাবরই স্ত্রী হিসেবে খুবই ভালো ছিলেন। প্রায় ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা বিবাহিত। মিসেস ফস্টার সবসময়ই তার স্বামীর বেশ অনুগত ছিলেন, এ নিয়ে কোন সন্দেহই ছিলো না। মিসেস ফস্টার নিজেও এটা বেশ ভালোভাবে জানতেন। তিনি কখনোই বিশ্বাস করতে চাইতেন না যে তার স্বামী কখনো ইচ্ছা করে তার এই যন্ত্রণা উস্কে দিতে চাইবেন। তবে ইদানীং তার প্রায়ই এ নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে।

প্রায় সত্তর বছর বয়সী মিস্টার ইউজিন ফস্টার তার স্ত্রী মিসেস ফস্টারের সাথে নিউ ইয়র্কের ইস্ট সিক্সটি সেকেন্ড স্ট্রিটের একটা বিশাল ছয় তলা বাড়িতে থাকতেন। চারজন চাকরও ছিলো তাদের। কেমন যেন একটা বিষণ্ণ ভাব ছিলো বাড়িটায়। তাদের সাথে দেখা করতেও খুব কম মানুষই আসতো সেখানে। কিন্তু জানুয়ারির এক সকালে বাড়িটা যেন হঠাৎ করে বেশ জ্যান্ত হয়ে উঠলো। কোন এক কারণে বাড়ির সবাই বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। একজন আয়া প্রতিটা রুমে ডাস্ট শিটের বান্ডিল বিলি করছিলো, আরেকজন সেগুলো দিয়ে আসবাবপত্র ঢেকে দিচ্ছিলো। তাদের বাটলার সুটকেসগুলো নিচে এনে হলরুমে রাখছিলো। আর রান্নাঘর থেকে তাদের বাবুর্চি বারবার বেরিয়ে এসে বাটলারের সাথে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছিলো। মিসেস ফস্টার একটা পুরনো ধাঁচের ফার কোট আর মাথায় একটা কালো হ্যাট পরে এ রুম থেকে ও রুম পায়চারী করছিলেন। যেন সব কাজ ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা তার তদারকি করছেন। কিন্তু আসলে তিনি শুধু চিন্তা করছিলেন যে তার স্বামী দ্রুত তার পাঠকক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে যাবার জন্য প্রস্তুত না হলে তিনি নিশ্চিত প্লেন মিস করবেন।

'কয়টা বাজে, ওয়াকার?' বাটলারের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বললেন তিনি।
'নয়টা বেজে দশ মিনিট, ম্যাডাম।'
'গাড়ি কি এসেছে?'
'জি ম্যাডাম, অপেক্ষা করছে। আমি শুধু এখন লাগেজটা তুলে দিয়ে আসবো।'
'এখান থেকে ইডলওয়াইল্ড পৌঁছাতে এক ঘণ্টা লাগে,' বললেন তিনি। 'আমার প্লেন এগারোটায় ছাড়বে। এয়ারপোর্টের অন্য কাজগুলো সারতে আমাকে নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় আধা ঘণ্টা আগে ওখানে থাকতে হবে। আমার দেরী হয়ে যাবে। আমি জানি আমার দেরী হয়ে যাবে।'
'আমার মনে হয় আপনার হাতে যথেষ্ট সময় আছে, ম্যাডাম,' বেশ সদয়ভাবে বলল বাটলার, 'আমি মিস্টার ফস্টারকে আগেই জানিয়ে দিয়েছি, আপনার নয়টা পনেরোর মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হবে। এখনো আরো পাঁচ মিনিট বাকি আছে।'
'হ্যাঁ ওয়াকার, আমি জানি। আমি জানি! এবার একটু তাড়াতাড়ি লাগেজটা গাড়িতে তোলো, প্লিজ?'

হলের এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারী করতে শুরু করলেন তিনি। আর যতবারই বাটলার আসছিলো তার দিকে, তিনি তাকে জিজ্ঞেস করছিলেন কয়টা বাজে। আপন মনেই তিনি বলতে থাকলেন যে এই একটা ফ্লাইট তার কোনভাবেই মিস করা যাবে না। কয়েক মাস তার লেগে গেছে শুধু স্বামীকে রাজি করিয়ে সেখানে যাবার অনুমতি পেতেই। এখন যদি তার ফ্লাইট মিস হয়ে যায়, তাহলে হয়তো মিস্টার ফস্টার তাকে বলবে সেখানে যাওয়াটাই পুরোপুরি বাদ দিয়ে দিতে। ঝামেলা হলো যে মিস্টার ফস্টার চাইছেন এয়ারপোর্টে গিয়ে মিসেস ফস্টারকে বিদায় জানিয়ে আসতে।

'হা ঈশ্বর!' জোরে বলে উঠলেন তিনি, 'আমি ফ্লাইট মিস করবো। আমি জানি, আমি জানি আমি ফ্লাইট মিস করবো।'

তার বাম চোখের পাশের ছোট্ট মাংসপেশীটা এবার পাগলের মতো লাফানো শুরু করলো। চোখগুলো দিয়েও প্রায় পানি বের হওয়ার উপক্রম হলো যেন।

'কয়টা বাজে, ওয়াকার?'
'নয়টা বেজে আঠারো, ম্যাডাম'
'এবার সত্যিই ফ্লাইট মিস করবো আমি!', জোরে বলে উঠেন মিসেস ফস্টার 'ওহ, ও যদি আসতো!'

মিসেস ফস্টারের জন্য এই যাত্রাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। একাই তিনি প্যারিস যাচ্ছেন মেয়েকে দেখতে। এই মেয়েটিই তার একমাত্র সন্তান। তার বিয়ে হয়েছে এক ফরাসী ভদ্রলোকের সাথে। মেয়েজামাইয়ের ব্যাপারে বেশি তোয়াক্কা না করলেও মেয়েকে তিনি খুবই ভালোবাসতেন। আর তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, তার তিন নাতি-নাতনিকে নিজ চোখে দেখার জন্যে তিনি বহুদিন ধরে ব্যাকুল হয়ে আছেন।

মেয়ের পাঠানো ছবিগুলোতেই শুধু তিনি ওদের দেখেছেন, যেগুলোকে তিনি বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় টাঙিয়ে রেখেছেন। ভারী সুন্দর বাচ্চাগুলো। খুব স্নেহের সাথে আগলে রাখতেন ছবিগুলোকে মিসেস ফস্টার। যতবারই তাদের ঠিকানায় ওদের কোন নতুন ছবি আসতো, তিনি কোথাও বসে দীর্ঘক্ষণ ধরে সেগুলোর দিকে সস্নেহে তাকিয়ে থাকতেন। তাদের চেহারার মধ্যে নিজেদের চেহারার মিল খুঁজতেন। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি একটা কথাই বারবার ভাবছেন। তার কোন ইচ্ছা নেই এমন কোথাও বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেয়ার, যেখানে তিনি এই বাচ্চাগুলোর কাছে থাকতে পারবেন না। তিনি ওদের সাথে দেখা করতে চান, একসাথে হাঁটতে বেরোতে চান, তাদেরকে উপহার কিনে দিতে চান, চান ওদের বড় হয়ে ওঠা দেখতে। তবে তার স্বামী জীবিত থাকতে এরকম চিন্তা মাথায় আনাটাও যে তার প্রতি একরকম বিশ্বাসঘাতকতা, এটা মিসেস ফস্টার অবশ্যই জানতেন। এখন আর বিভিন্ন ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকা না লাগলেও, মিস্টার ফস্টার কখনোই নিউ ইয়র্ক ছেড়ে প্যারিসে থাকতে রাজি হবেন না। উনি যে মিসেস ফস্টারকে একাই সেখানে গিয়ে ছয় সপ্তাহ থাকার অনুমতি দিচ্ছেন, এটাই সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার। তবে মিসেস ফস্টারের খুব ইচ্ছা হয়, তিনি যদি সবসময়ের জন্য সেখানে থেকে যেতে পারতেন! ওদের কাছাকাছি থাকতে পারতেন!

'ওয়াকার, কয়টা বাজে?'
'নয়টা বাইশ, ম্যাডাম'
বাটলার উত্তর দিতে না দিতেই হলরুমের একটা দরজা খুলে গেলো। তার ভেতর থেকে মিস্টার ফস্টার বেরিয়ে এসে হলের মধ্যে ঢুকলেন। এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি বেশ ভালো করে স্ত্রীকে দেখলেন আপাদমস্তক। মিসেস ফস্টারও তাকালেন তার দিকে। মিস্টার ফস্টার ছোটোখাটো গড়নের মানুষ হলেও তার বড় দাড়ি ভর্তি চেহারার সাথে এন্ড্রু কার্নেগীর পুরনো ছবির অনেকটাই মিল পাওয়া যায়।

'তো…' বললেন তিনি, 'আমার মনে হয় তুমি যদি প্লেন ধরতে চাও, তাহলে আমাদের আস্তে আস্তে বের হওয়া উচিৎ।'
'ইয়েস ডিয়ার… ইয়েস! সব রেডি। গাড়ি অপেক্ষা করছে।'
'গুড,' বলে তিনি মাথাটা একদিকে বাঁকিয়ে মিসেস ফস্টারকে ভালো করে দেখতে থাকলেন। অদ্ভূতভাবে মাথা হেলিয়ে কয়েকবার ছোট ছোট ঝাঁকি দেয়ার অভ্যাস ছিল তার। তার সাথে হাত দুটোকে এক করে মাথার উপর নিয়ে আড়মোড় ভাঙায় তাকে দেখে অনেকটা কাঠবিড়ালির মতো লাগছিলো যেন।
'এই যে, ওয়াকার তোমার কোট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরে নাও ওটা।'
'একটু দাঁড়াও,' বললেন মিস্টার ফস্টার, 'আমি শুধু হাতটা একটু ধুয়ে আসছি'

মিসেস ফস্টার অপেক্ষা করতে লাগলেন তার জন্য। লম্বা বাটলারটা কোট আর হ্যাটটা হাতে নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলো।

'ওয়াকার, আমার কি দেরী হয়ে যাবে?'
'না, ম্যাডাম,' বাটলার বলল। 'আমার মনে হয় আপনি ঠিক সময়েই পৌঁছাতে পারবেন।'

মিস্টার ফস্টার আবার ফিরে এলেন। বাটলারটা তাকে কোটটা পরে নিতে সাহায্য করলো। মিসেস ফস্টার প্রায় ছুটে বাইরে বেরিয়ে ভাড়া করা ক্যাডিলাকটায় ঢুকে পড়লেন। পেছন পেছন তার স্বামীও এলেন, তবে খুব ধীরে ধীরে তিনি বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নামলেন। মাঝখানটায় এসে থেমে পড়ে তিনি আকাশের অবস্থা দেখতে উপরের দিকে তাকালেন। তারপর সকালের ঠাণ্ডা বাতাসের গন্ধ টেনে নিলেন নাক দিয়ে।

'একটু কুয়াশা পড়েছে দেখা যাচ্ছে,' গাড়িতে মিসেস ফস্টারের পাশে বসতে বসতে বললেন তিনি। 'আর এয়ারপোর্টের দিকে তো সবসময় অবস্থা আরো খারাপ থাকে। ফ্লাইট যদি এরই মধ্যে ক্যান্সেল হয়ে যায় তাহলে কিন্তু অবাক হবো না আমি।'
'এ কথা বলো না, প্লিজ', বললেন মিসেস ফস্টার।

এরপর গাড়ি লং আইল্যান্ডের পাড় হওয়ার আগ পর্যন্ত দুজনেই চুপ করে রইলেন।

'চাকর-বাকরদের সাথে সব ঠিকঠাক করে ফেলেছিI', মুখ খুললেন মিস্টার ফস্টার। 'ওরা সবাই আজ চলে যাচ্ছে। আমি ওদের সবাইকে ছয় সপ্তাহের বেতনের অর্ধেকটা দিয়ে দিয়েছি। আর ওয়াকারকে বলে দিয়েছি, যখন ওদের আবার প্রয়োজন হবে তখন একটা টেলিগ্রাম করে দেবো।'
'হ্যাঁ,' মিসেস ফস্টার বললেন, 'ও বলেছে আমাকে।'
'আমি আজ রাতে ক্লাবে চলে যাবো। একটু হাওয়া বদল হবে।'
'হ্যাঁ। আমি চিঠি লিখব তোমার কাছে।'
'মাঝে মাঝে আমি বাড়িতে যাবো সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখতে। কোন চিঠি আসলে সেগুলো নিয়ে যাবো।'
'কিন্তু তোমার কি মনে হয় না, সবকিছু দেখভাল করতে ওয়াকারের ওখানে থাকা উচিৎ?' বেশ নম্রভাবেই জিজ্ঞেস করলেন মিসেস ফস্টার।
'আরে ধুর। দরকার নেই তো কোন। আর তাহলে তো আমার ওকে পুরো বেতনটা দিতে হবে।'
'ও হ্যাঁ,' মিসেস ফস্টার বললেন, 'তা ঠিক।'
'আর তার চেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে, একটা বাড়িতে কোন মানুষ একা থাকলে সে ওখানে কী কী করতে পারে তা আমরা জানি না'

বলে মিস্টার ফস্টার একটা সিগার বের করলেন। এরপর সিলভারের একটা কাটার দিয়ে সিগারের মাথাটা কেটে নিয়ে একটা সোনার লাইটার দিয়ে সেটাকে জ্বালালেন। মিসেস ফস্টার শুধু তার হাতদুটো এক করে ফার কোটের নিচে রেখে চুপচাপ বসে রইলেন।

'তুমি চিঠি লিখবে আমার কাছে?', জিজ্ঞেস করলেন মিসেস ফস্টার।
'দেখি,' মিস্টার ফস্টার বললেন। 'তবে মনে হয় না লিখতে পারি। তুমি তো জানোই যে একদম নির্দিষ্ট কিছু বলার না থাকলে আমি চিঠিপত্র লিখি না।'
'হ্যাঁ, জানি। দরকার নেই তাহলে।'

গাড়ি কুইন্স বুলেভার্ড ধরে এগোতে থাকলো। ইডলওয়াইল্ডের জলাভূমির কাছাকাছি যখন তারা এলেন, কুয়াশা আরো ঘন হতে শুরু করলো। গাড়িটাকে বেশ আস্তে এগোতে হচ্ছিলো এজন্য।

'আমি এবার নিশ্চিত যে আমার ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে! কয়টা বাজে?', মিসেস ফস্টার চেঁচিয়ে উঠলেন।
'এরকম করা বন্ধ করো তো,' মিস্টার ফস্টার বলে উঠলেন। 'কয়টা বাজে জেনে তো লাভও নেই এখন কোন। এতক্ষণে ফ্লাইট ক্যান্সেল হতে বাধ্য। এধরনের আবহাওয়ায় ওদের ফ্লাইট কখনোই ছাড়ে না। আমি জানিনা তুমি বের হয়েছই বা কেন!'

ঠিক নিশ্চিত হতে না পারলেও, মিসেস ফস্টারের কাছে মনে হলো মিস্টার ফস্টারের গলার সুর যেন হঠাৎ পাল্টে গেছে। তিনি মিস্টার ফস্টারের দিকে ফিরে তাকালেন। গোঁফের কারণে তার মুখের ভাবে কোনো পরিবর্তন বোঝা যাচ্ছিলো না। ফের একবার মিসেস ফস্টারের মনে হলো, যদি তিনি লোকটার চেহারাটা ভালো করে দেখতে পারতেন। এমনকি, খুব রেগে না গেলে তার চোখ দেখেও কিছু বোঝা যায় না।

'অবশ্য,' বলতে থাকলেন মিস্টার ফস্টার, 'যদি কোনভাবে প্লেন ছাড়েও, তাহলে বলবো যে তোমার কথাই ঠিক। এতক্ষণে তোমার ফ্লাইট মিস হয়ে গেছে। কথাটা মানতে চাইছো না কেন?

মিসেস ফস্টার মুখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের কুয়াশার দিকে তাকালেন। যতই সামনে আগাচ্ছেন তারা, কুয়াশা যেন আরো ঘন হয়ে উঠছে। এখন শুধু রাস্তার ধার আর তৃণভূমির সীমানা চোখে পড়ছে। মিসেস ফস্টার টের পাচ্ছিলেন যে তার স্বামী তখনো তার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি আবার তার দিকে তাকালেন। এবার খেয়াল করলেন যে মিস্টার ফস্টার তার চোখের কোণার সেই বিশেষ পেশীটার দিকেই তাকিয়ে আছেন যেটা এখনো হালকা লাফাচ্ছে।
'হবে না?' মিস্টার ফস্টার বললেন।
'কী হবে না?'
'যেভাবে আমরা এগোচ্ছি, নিশ্চিত মিস হবে। এই কুয়াশার মধ্যে দিয়ে আর দ্রুত চলাও সম্ভব না।'
এরপর তিনি আর কোন কথা বললেন না মিসেস ফস্টারের সাথে। গাড়িটা খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকলো সামনের দিকে। রাস্তার দিকে মুখ করে থাকা গাড়ির হলুদ আলোটা ড্রাইভারকে রাস্তা বুঝতে সাহায্য করছিলো। উল্টো দিক থেকে একের পর এক সাদা এবং হলুদ আলো কুয়াশা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছিলো। বিশেষ করে একটা উজ্জ্বল আলো তাদের ঠিক পেছন পেছন আসছিলো। হঠাৎ একসময় ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিলেন।

'ওই যে!' চেঁচিয়ে উঠলেন মিস্টার ফস্টার, 'আটকে গেছি আমরা। আমি জানতাম এমনই হবে।'
'না, স্যার,' ফিরে তাকিয়ে বললো ড্রাইভার। 'চলে এসেছি। এটাই এয়ারপোর্ট।'

কোন কথা না বলেই মিসেস ফস্টার প্রায় লাফিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে দ্রুত প্রধান প্রবেশ দ্বার দিয়ে ভবনের ভেতরে ঢুকে পরলেন। ভেতরে অনেক মানুষজন ছিলো, যাদের বেশিরভাগই টিকেট কাউন্টারের আশেপাশে এলোমেলোভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রী। মিসেস ফস্টার তাদেরকে ঠেলে এগিয়ে গিয়ে ক্লার্কের সাথে কথা বললেন।

'জী,' ক্লার্ক বলল। 'আপনার ফ্লাইট সাময়িকভাবে স্থগিত হয়েছে। কিন্তু এখনই চলে যাবেন না প্লিজ। আমরা আশা করছি যেকোনো মুহূর্তেই আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে যাবে।'

গাড়িতে এখনো বসে থাকা তার স্বামীর কাছে ফিরে গিয়ে মিসেস ফস্টার তাকে এ খবর জানালেন।
'কিন্তু তুমি আর অপেক্ষা করো না,' মিস্টার ফস্টারকে বললেন তিনি। 'তোমার এখানে থাকার আর কোন মানে হয় না'
'করবো না,' উত্তর দিলে মিস্টার ফস্টার, 'যদি ড্রাইভার আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। পারবে না নিয়ে যেতে, ড্রাইভার?'
'পারবো মনে হয়,' ড্রাইভার লোকটা উত্তর দিলো।
'লাগেজটা বের করা হয়েছে?'
'জ্বি স্যার'
'গুডবাই ডিয়ার,' গাড়ির ভেতর ঝুঁকে মিস্টার ফস্টারের সাদা দাড়িভরা গালে একটা ছোট্ট চুমু খেলেন মিসেস ফস্টার।
'গুডবাই,' উত্তরে বললেন মিস্টার ফস্টার। 'হ্যাভ আ গুড ট্রিপ।'

গাড়ি চলে গেলো। মিসেস ফস্টার একা রয়ে গেলেন এয়ারপোর্টে।

বাকিটা দিন মিসেস ফস্টারের জন্য প্রায় দুঃস্বপ্নের মতো ছিলো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি এয়ারলাইনের কাউন্টারের থেকে যথাসম্ভব কাছে একটা বেঞ্চের উপর বসে ছিলেন। আর প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর উঠে গিয়ে সেই ক্লার্ককে জিজ্ঞেস করছিলেন অবস্থার কোন পরিবর্তন হলো কিনা। প্রতিবার একই উত্তর পাচ্ছিলেন – তাকে আরো অপেক্ষা করতে হবে, কারণ এই কুয়াশা যেকোন মুহূর্তেই থেমে যেতে পারে। অবশেষে সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ লাউডস্পিকারে ঘোষণা করা হলো, যে আগামীকাল সকাল এগারোটা পর্যন্ত ফ্লাইট স্থগিত করা হয়েছে।

এই খবর শুনতে পেয়ে মিসেস ফস্টার ঠিক বুঝতে পারলেন না যে তিনি কী করবেন। ক্লান্ত, অনিশ্চিত অবস্থায় আরো প্রায় আধা ঘণ্টা বেঞ্চের উপর বসে কাটিয়ে দিলেন তিনি এই চিন্তা করে, যে আজ রাতটা কোথায় গিয়ে কাটাবেন তিনি। এয়ারপোর্ট ছেড়ে যাবার কোন ইচ্ছেই ছিলো না তার। স্বামীর সাথে দেখা হোক – সেটা আর চাচ্ছিলেন না তিনি। ভয় করছিলেন যে হয়তো কোন না কোনভাবে মিস্টার ফস্টার তার ফ্রান্সে যাওয়া আটকে দেবেন। তার ইচ্ছা করছিলো এই বেঞ্চের উপরই সারা রাত কাটিয়ে দিতে। সেটাই হয়তো সবচেয়ে নিরাপদ হতো। কিন্তু তিনি এরই মধ্যে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে তার মতো বয়স্ক মানুষের পক্ষে এরকম কিছু করাটা নিতান্ত বোকামি হবে। তাই শেষমেশ তিনি একটা টেলিফোন বুথে গিয়ে বাসায় কল করলেন।

মিস্টার ফস্টার তখন ক্লাবে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হতে যাচ্ছিলেন। তিনিই ধরলেন ফোন। মিসেস ফস্টার তাকে খবরটা জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন চাকরেরা এখনো আছে কিনা সেখানে।
'ওরা সবাই চলে গেছে,' বললেন মিস্টার ফস্টার।
'সেক্ষেত্রে আমি না হয় আজ রাতটার জন্য কোন হোটেলে রুম ভাড়া করে নেবো। তুমি কোন চিন্তা করো না এ নিয়ে।'
'এটা করা বোকামি হবে। আস্ত একটা বাড়ি পড়ে আছে তোমার থাকার জন্য। সেটাকে কাজে লাগাও।'
'কিন্তু বাড়ি তো ফাঁকা।'
'তাহলে আমিও থেকে যাবো তোমার সাথে।'
'কোন খাবার নেই ঘরে। কিছুই নেই।'
'তাহলে ফেরার আগে কিছু খেয়ে নাও। গাধামো করো না তো। সবকিছু নিয়েই একটা হৈ চৈ কান্ড বাঁধিয়ে দেয়ার অভ্যাস তোমার।'
'আচ্ছা ঠিক আছে,' বললেন মিসেস ফস্টার। 'স্যরি। আমি এখান থেকে একটা স্যান্ডউইচ খেয়ে নিচ্ছি। এরপর বাসায় ফিরছি।'

বাইরে কুয়াশা তখন কিছুটা পরিষ্কার হয়ে আসলেও বেশ লম্বা একটা সময় ধরে খুব ধীরে ধীরে ট্যাক্সিটা চললো। সিক্সটি সেকেন্ড স্ট্রিটে তাদের বাড়িতে পৌঁছাতে অনেকটা দেরী হয়ে গেলো। মিসেস ফস্টারের আসার শব্দ শুনতে পেয়ে তার স্বামী নিজের স্টাডি থেকে বেরিয়ে এলেন।
'তো,' স্টাডির দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে বললেন তিনি, 'কেমন লাগলো প্যারিস?'
'কাল সকাল এগারোটায় প্লেন ছাড়বে,' উত্তর দিলেন মিসেস ফস্টার। 'এবার যাওয়া নিশ্চিত'
'মানে, যদি কুয়াশা কাটে।'
'এখনই কমে আসছে। বাতাস ছাড়ছে।'
'ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে। দিনটা অনেক খারাপ গেছে নিশ্চয়ই।'
'হ্যাঁ, তেমন ভালো যায়নি। আমি মনে হয় সোজা ঘুমিয়ে যাবো।'
'আমি সকাল নয়টায় একটা গাড়ি ডেকেছি।'
'ওহ, থ্যাংক ইউ ডিয়ার। আর, আশা করছি নিশ্চয়ই এবার তুমি আর আমাকে এয়ারপোর্টে দিয়ে আসতে যাচ্ছ না?'
'না,' ধীরে বললেন তিনি, 'মনে হয় না যাবো। কিন্তু আমাকে ক্লাবে ড্রপ করে না যাওয়ার তো কোন কারণ দেখছি না।'

মিসেস ফস্টার তাকালেন তার দিকে। ওই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিলো মিস্টার ফস্টার তার থেকে অনেক দুরে দাঁড়িয়ে আছেন। এতোটাই দূরে, যে তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না যে মিস্টার ফস্টার ঠিক কী করছেন বা ভাবছেন, অথবা কেই বা তিনি।
'ক্লাব তো শহরের মাঝখানে,' বললেন মিসেস ফস্টার। 'এয়ারপোর্টের রাস্তার মধ্যে তো পড়ে না।'
'কিন্তু তোমার হাতে তো যথেষ্ট সময় থাকবে, ডিয়ার। তুমি কি আমাকে ক্লাবে দিয়ে আসতে চাচ্ছো না?'
'না, না… অবশ্যই দিয়ে আসবো।'
'বেশ। সকাল নয়টায় দেখা হচ্ছে তাহলে।'

দ্বিতীয় তলায় নিজের বেডরুমে উঠে এলেন মিসেস ফস্টার। সারাদিনের ধকলের পর তিনি এতই ক্লান্ত ছিলেন যে বিছানায় শুয়ে পড়ার কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লেন।
পরদিন সকালে মিসেস ফস্টার আগেভাগেই উঠে পড়লেন। সাড়ে আটটার মধ্যেই তিনি বেরোনোর জন্য প্রস্তুত হয়ে নিচে নেমে এলেন। নয়টা বাজার একটু পরেই তার স্বামীকে দেখা গেলো।

'কফি বানিয়েছো কোনো?' জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
'না, আমি তো ভেবেছিলাম তুমি ক্লাবে গিয়েই ভালোমতো ব্রেকফাস্ট সেরে নেবে। গাড়ি চলে এসেছে। অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। আমি যাওয়ার জন্য রেডি।'

হলে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা। ইদানীং তাদের যেন সবসময় এ জায়গাটাতেই দেখা হয়। মিসেস ফস্টারের পরনে হ্যাট, কোট আর পার্স; মিস্টার ফস্টারের গায়ে হাই ল্যাপেলের একটা এডওয়ার্ডিয়ান জ্যাকেট।

'তোমার লাগেজ?'
'ওটা এয়ারপোর্টে'
'ও, হ্যাঁ,' মিস্টার ফস্টার বললেন। 'অফ কোর্স। তো… তুমি যদি আমাকে আগে ক্লাবে দিয়ে আসতে চাও, তাহলে মনে হয় আমাদের একটু তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়া উচিৎ। তাই না?'
'হ্যাঁ!', বললেন মিসেস ফস্টার 'অবশ্যই, প্লিজ!'
'আমি কয়টা সিগার নিয়ে আসছি শুধু। বেশিক্ষণ লাগবে না, আমি চলে আসছি। তুমি গাড়িতে উঠে বসো।'

মিসেস ফস্টার ফিরে বাইরে বেরিয়ে গাড়ির ড্রাইভার যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেদিকে এগোলেন। তাকে আসতে দেখে ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে দিলো।
'কয়টা বাজে?' ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
'প্রায় সোয়া নয়টা।'

মিনিট পাঁচেক পর বেরিয়ে এলেন মিস্টার ফস্টার। তাকে ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে মিসেস ফস্টার খেয়াল করলেন, সরু স্টোভপাইপ ট্রাউজার পরায় তার পা দুটো যেন ছাগলের পায়ের মতো দেখাচ্ছে। ঠিক গতদিনের মতোই সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মিস্টার ফস্টার মাঝখানে থেমে পড়লেন আকাশের অবস্থা দেখতে। বাতাসের গন্ধ নিলেন ফের। আবহাওয়া তখনও তেমন একটা পরিষ্কার হয়নি, তবে কুয়াশার ফাঁক দিয়ে সূর্য খানিকটা উঁকি দিচ্ছিলো।
'হয়তো এবার তোমার কপাল ভালো হবে,' গাড়ির ভেতর মিসেস ফস্টারের পাশে বসতে বসতে বললেন তিনি।
'তাড়াতাড়ি করুন, প্লিজ,' ড্রাইভারকে বললেন মিসেস ফস্টার। 'কোট তুলতে সাহায্য করার দরকার নেই, ওটা আমিই ঠিক করছি। এগোতে থাকুন, আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।'

ড্রাইভার তার স্টিয়ারিং হুইলের পেছনের সিটে ফিরে গিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট করলো।
'এক মিনিট!' হঠাৎ বলে উঠলেন মিস্টার ফস্টার, 'ড্রাইভার, একটু থামুন তো।'
'কী হলো?' ওভারকোটের পকেটগুলোয় তাকে কিছু একটা খুঁজতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন মিসেস ফস্টার।
'একটা ছোট্ট গিফট ছিলো, অ্যালেনের জন্য। চাচ্ছিলাম তুমি নিয়ে যাও,' তিনি উত্তর দিলেন। 'কোথায় গেলো ওটা? আমার হাতেই তো ছিলো নিচে নামার সময়। আমার স্পষ্ট মনে আছে।'
'আমি তো তোমার হাতে কিছুই দেখিনি। কেমন গিফট?'
'একটা ছোট্ট বাক্স, সাদা কাগজ দিয়ে মোড়ানো। কালকে তোমাকে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। আজকে আর দিতে ভুলে যেতে চাচ্ছি না।'
'ছোট বাক্স!', বললেন মিসেস ফস্টার 'আমি তো কোন ছোট বাক্স দেখিনি!' অস্থিরভাবে গাড়ির পেছনে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন তিনি।

মিস্টার ফস্টার তার কোটের পকেটগুলো হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে থাকলেন। এরপর কোটের বোতাম খুলে জ্যাকেটের আশেপাশেও হাতড়ে খোঁজা শুরু করলেন।
'ওহ! ভুলে গিয়েছি। নিশ্চয়ই আমার বেডরুমে ফেলে এসেছি ওটা। বেশিক্ষণ লাগবে না আমার…', বললেন তিনি।
'ওহ, প্লিজ!', প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস ফস্টার 'হাতে সময় নেই আমাদের! বাদ দাও না! ওটা পরে মেইল করে দিতে পারবে। আর ওটা নিশ্চয়ই আরেকটা ফালতু চিরুনি? তুমি তো সবসময় ওকে চিরুনি দাও।'
'চিরুনি দিলে তাতে কী সমস্যা, একটু জানতে পারি?' রেগে গিয়ে বললেন তিনি।
'কোন সমস্যা নেই, কিন্তু…'
'তুমি থাকো এখানে,' আদেশের সুরে বললেন মিস্টার ফস্টার। 'আমি ওটা নিয়ে আসছি।'
'একটু তাড়াতাড়ি করো, প্লিজ! জলদি নিয়ে এসো!'

মিসেস ফস্টার বসে অপেক্ষা করতে থাকলেন।
'ড্রাইভার, কয়টা বাজে?'

ড্রাইভারের একটা হাতঘড়ি ছিলো। সেটার দিকে তাকালো সে।
'প্রায় সাড়ে ন'টা' হাতঘড়িটার দিকে তাকালো ড্রাইভার।
'এক ঘণ্টার মধ্যে কি আমরা এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে পারবো?'
'এর বেশি লাগার কথা না'

এসময় হঠাৎ তিনি খেয়াল করলেন, সাদা কিছু একটার কোণা মিস্টার ফস্টার যেদিকে বসে ছিলেন, সেদিকের সিটের ফাঁকে ঢুকে আছে। তিনি সেদিকে এগিয়ে গিয়ে জিনিসটাকে টেনে বের করে এনে দেখলেন সেটা একটা কাগজে মোড়ানো ছোট্ট বাক্স। এটা খেয়াল না করে পারলেন না, যে বাক্সটা এতো শক্ত করে আর গভীরে ঢোকানো ছিলো, যেন কেউ ইচ্ছে করে হাতের চাপ দিয়ে ঢুকিয়েছে ওটাকে।

'এইতো!' চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, 'পেয়েছি ওটা! হায় হায়, ও তো এখন ওটা উপরেই খুঁজতে থাকবে! ড্রাইভার, জলদি! দ্রুত একটু উপরে গিয়ে ওকে ডেকে নিচে নিয়ে আসবেন, প্লিজ?

এতক্ষণ যা হচ্ছিলো, তা নিয়ে আইরিশ ধাঁচের চেহারার ড্রাইভারটি তেমন মাথা না ঘামালেও সে গাড়ি থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে বাড়ির দরজার সামনে গেলো। তারপর আবার ফিরে চলে এলো।
'দরজা লক করা,' মিসেস ফস্টারকে জানালো ড্রাইভার, 'চাবি আছে আপনার কাছে?'
'হ্যাঁ… এক মিনিট'

ব্যাগের মধ্যে পাগলের মতো চাবি খুঁজতে শুরু করলেন তিনি। এতো উদ্বেগে তার মুখটা একেবারে টানটান হয়ে আছে। কেটলির নলের মতো খিঁচে আছে ঠোঁট দুটো।
'এই যে! না… আমি নিজেই যাচ্ছি। তাহলে তাড়াতাড়ি ওকে পেয়ে যাবো। আমি জানি ও কোথায় থাকবে।'

এক হাতে চাবিটা নিয়ে তিনি দ্রুত গাড়ি থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে সদর দরজার সামনে উঠে এলেন। চাবিটা দরজার চাবির ছিদ্রে ঢুকিয়ে সেটাকে ঘোরাতে যাচ্ছিলেন তিনি। তারপর হঠাৎই থেমে গিয়ে মাথাটা উপরে তুলে একদম স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে পড়লেন। চাবি ঘুরিয়ে ভেতরে ঢোকার তাড়াহুড়োর মধ্যেও তার পুরো শরীর যেন জমে গেলো। এরপর তিনি অপেক্ষা করলেন… পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ সেকেন্ড পেরিয়ে গেলো। সারা শরীর এমন টানটান করে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি, দেখে মনে হচ্ছিলো যে একটু আগে বাড়ির ভেতর হওয়া কোনো একটা আওয়াজ তিনি পুনরায় শুনতে চাচ্ছেন। হ্যাঁ, কিছু একটা তিনি শুনছিলেন বটে। তার সারা শরীরের ভঙ্গি যেন এটাই জানান দিচ্ছিলো। ধীরে ধীরে নিজের মাথাটা দরজার দিকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। তালায় চাবিটা ঢুকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য দরজায় কানটা পেতে রাখলেন। খুলতে গিয়েও যেন খুলছিলেন না দরজাটা। বরং ভেতর থেকে আসা ক্ষীণ আওয়াজটা বোঝার চেষ্টা করছিলেন।

তারপর আচমকাই যেন তার মধ্যে আবার প্রাণ ফিরে এলো। দরজা থেকে চাবিটা বের করে নিয়ে তিনি দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে আবার নিচে নেমে এলেন।
'নাহ, এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে' ড্রাইভারকে বললেন তিনি, 'ওর জন্য অপেক্ষা করতে পারবো না আমি। আর অপেক্ষা করতে পারবো না। প্লেন মিস হয়ে যাবে আমার। দ্রুত চলুন, ড্রাউভার, জলদি! এয়ারপোর্টে চলুন!'

ড্রাইভার মিসেস ফস্টারকে এতক্ষণ বেশ ভালো করে লক্ষ্য করছিলো। তার মুখটা যেন হঠাৎ একদম বিবর্ণ হয়ে গেছে। সাথে মুখের ভাবটাও নিমিষেই পাল্টে গেছে। আগের সেই নরমসরম, বোকাবোকা ভাবটা আর নেই তার চেহারায়। সেখানে অদ্ভুতরকমের একটা শক্ত ভাব নেমে এসেছে। সাধারণত তার ঠোঁটগুলো যেমন শিথিল হয়ে থাকে, তা বদলে গিয়ে এখন যেন সেগুলো টানটান হয়ে আছে। চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে। কথার মধ্যেও যেন এখন একরকম আদেশের সুর তার।

'জলদি চলো ড্রাইভার, জলদি!'
'আপনার স্বামী যাচ্ছে বেড়াতে না আপনার সাথে?' অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ড্রাইভার।
'না তো! আমি তো শুধু ওকে ক্লাবে ড্রপ করে দিতে যাচ্ছিলাম। সমস্যা নেই। ও বুঝতে পারবে। একটা ক্যাব নিয়ে নেবে। বসে থেকে কথা বলো না, এগোতে থাকো! আমাকে প্যারিসে যাওয়ার প্লেন ধরতে হবে!'

পুরোটা পথ মিসেস ফস্টার পেছনের সিট থেকে ড্রাইভারকে তাড়া দিতে থাকলেন আর ড্রাইভারও দ্রুত গাড়ি ছোটালো। এরপর নির্দিষ্ট সময়ের কয়েক মিনিট আগেই প্লেন ধরতে পারলেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেন আটলান্টিকের উপর ভাসতে লাগলো। মিসেস ফস্টার আরাম করে প্লেনের সিটে হেলান দিয়ে ইঞ্জিনের গুনগুন আওয়াজ শুনতে থাকলেন। অবশেষে তিনি প্যারিস যাচ্ছেন। সেই নতুন ভিন্ন ভাবটা যেন তখনো রয়ে গেছিলো তার মধ্যে। নিজের মধ্যে অদ্ভুতরকমের ভালো লাগা আর শক্তি অনুভব করছিলেন তিনি। হঠাৎ এরকম নতুনভাবে নিজেকে আবিষ্কার করতে পেরে বিস্ময়ে যেন তার শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো। নিউ ইয়র্কের সিক্সটি সেকেন্ড স্ট্রিট থেকে প্লেন যতই দূরে সরে যেতে লাগলো, তার মধ্যে ততই যেন প্রশান্তি নেমে আসতে থাকলো। প্যারিসে এসে পৌঁছানোর পর সেই দৃঢ়তা আর শান্তি ভাবটা যেন আরো বেড়ে গেলো।

নাতি-নাতনিদের সাথে দেখা হলো মিসেস ফস্টারের। ওরা সবাইই ছবির চেয়ে রক্তমাংসে আরো বেশি সুন্দর। একেবারে যেন দেবদূতের মতো বাচ্চাগুলো। নিজেই নিজেকে তিনি বলতে লাগলেন, কতো সুন্দর ওরা! প্রতিদিন তিনি ওদেরকে সাথে নিয়ে হাঁটতে বেরোতেন, কেক খাওয়াতেন, এটা সেটা কিনে দিতেন আর নানান রকম গল্প শোনাতেন।

সপ্তাহে একবার প্রতি মঙ্গলবার তিনি তার স্বামীর কাছে একটি চিঠি লিখতেন। প্যারিসে কী হচ্ছে না হচ্ছে, সে নিয়ে গল্পের ঝাঁপি খুলে বসতেন সেসব চিঠিতে। একটা কথা প্রতিটা চিঠির শেষেই লেখা থাকতো – 'ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো। যদিও আমার মনে হয় না, যে আমি কাছে না থাকলে তুমি সেটা কখনো ঠিকমতো করো।'

ছয় সপ্তাহ যখন শেষ হয়ে আসলো, সবারই বেশ মন খারাপ হয়ে গেলো কারণ মিসেস ফস্টারকে এবার আমেরিকায় তার স্বামীর কাছে ফিরে যেতে হবে। সবার মন খারাপ হলেও, মিসেস ফস্টারের হলো না। বরং তাকে বেশ স্বাভাবিকই মনে হলো। সবাইকে বিদায় জানানোর সময় তার হাবভাব দেখে আর কথা শুনে মনে হচ্ছিলো যেন তিনি খুব দ্রুতই আবার সেখানে ফিরে আসতে যাচ্ছেন।

যাই হোক, তিনি যেরকম বিশ্বস্ত স্ত্রী ছিলেন, তার কোন হেরফের না করে নির্দিষ্ট সময় শেষ হওয়ার পর কোনো বাড়তি সময় ধরে সেখানে আর থাকলেন না তিনি। প্যারিসে পৌঁছানোর একদম ঠিক ছয় সপ্তাহ পর স্বামীকে একটা টেলিগ্রাম করেই তিনি নিউ ইয়র্কে ফেরার প্লেন ধরলেন।

ইডলওয়াইন্ডে পৌঁছে তার জন্য কোন গাড়ি অপেক্ষা করছে না দেখে বেশ কৌতূহল হলো তার। হতেও পারে যে একটু খুশিই হয়েছিলেন তিনি এতে। তবে বেশ শান্ত দেখালো তাকে। ট্যাক্সিতে লাগেজগুলো তুলতে সাহায্য করা কুলিটাকে কোন বাড়তি বকশিসও দিলেন না।

প্যারিসের চেয়ে নিউ ইয়র্কে শীত বেশি। রাস্তার পাশের নর্দমাগুলোয় ময়লা বরফ স্তূপ হয়ে জমে ছিলো। ট্যাক্সিটা এসে সিক্সটি সেকেন্ড স্ট্রিটের বাড়িটার সামনে এসে থামলো। মিসেস ফস্টার ড্রাইভারকে দিয়ে দরজার সামনের সিঁড়ি পর্যন্ত বড় বড় লাগেজ দুটো উঠিয়ে আনলেন। এরপর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে দরজার বেল বাজালেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। তবুও নিশ্চিত হবার জন্য তিনি আবার বেল বাজালেন। উত্তরে শুধু শুনতে পেলেন বাড়ির পেছনের দিকের ভাঁড়ার ঘরে বেলের শব্দ প্রতিধ্বনিত হওয়ার আওয়াজ। তবে এরপরও কেউ এলে তিনি নিজেই তার কাছে থাকা চাবিটা বের করে দরজা খুলে ফেললেন।

ভেতরে ঢুকে প্রথমেই তিনি দেখলেন চিঠির বাক্স গলে আসা একগাদা চিঠি মেঝের উপর এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। ঘরটা বেশ অন্ধকার আর ঠাণ্ডা হয়ে আছে। গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটাকে তখনো একটা ডাস্ট শিট ঢেকে রেখেছিল। আবহাওয়া ঠাণ্ডা হবার পরও পরিবেশটা কেমন যেন অদ্ভুত রকমের গুমোট হয়ে আছে। একটা অদ্ভুত, ক্ষীণ গন্ধ বাতাসে। এরকম গন্ধ তিনি আগে কখনো পাননি।

দ্রুত হেঁটে হলের অন্য পাশে গিয়ে এক মুহূর্তের জন্য বাঁদিকের কোনায় মিলিয়ে গেলেন তিনি। তার এই পুরো কাজটার মধ্যে যেন উদ্দেশ্যমূলক কিছু একটা ছিল; যেন তিনি কোন একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাইছেন। কয়েক সেকেন্ড পর যখন তিনি ফিরে এলেন, তার চেহারায় বেশ একটা তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠেছে।

হলরুমের মাঝখানটায় এসে থামলেন তিনি। যেন ভাবছেন যে এখন কী করবেন। তারপর হঠাৎ করেই তার হাজব্যান্ডের স্টাডির দিকে ঘুরে সেদিকে এগিয়ে গেলেন। ডেস্কের উপর মিস্টার ফস্টারের অ্যাড্রেস বুকটা খুঁজে পেলেন। সেটার পাতাগুলো কিছুক্ষণ ওল্টানোর পর টেলিফোনটা তুলে নিয়ে একটা নম্বরে ডায়াল করলেন তিনি।

'হ্যালো,' বললেন তিনি। 'শুনুন… নাইন ইস্ট সিক্সটি সেকেন্ড স্ট্রিট থেকে বলছি… জি, জি…। আপনারা কী কাউকে খুব দ্রুত এখানে পাঠাতে পারবেন? হ্যাঁ, মনে হচ্ছে দোতলা আর তিন তলার মাঝখানেই আটকে আছে ওটা। অন্তত ইন্ডিকেটর সেটাই দেখাচ্ছে… এখনই পাঠাতে পারবেন? ওহ, দ্যাটস ভেরি কাইন্ড অফ ইউ… আসলে, আমার পায়ের অবস্থা তেমন একটা ভালো না। এতগুলো সিঁড়ি ভাঙতে বেশ কষ্ট হবে। … থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। গুডবাই।'

ফোনের রিসিভারটা আগের জায়গায় রেখে দিয়ে তিনি তার স্বামীর ডেস্কে বসে রইলেন। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকলেন লিফট ঠিক করার জন্যে লোক আসার।