সমাজ, যৌনতা ও প্রতিবাদের ভাষা: শন্তাল একেহ্রমানের Jeanne Dielman

লিখন চন্দ্র দত্তলিখন চন্দ্র দত্ত
Published : 20 March 2023, 02:31 PM
Updated : 20 March 2023, 02:31 PM

ব্রিটিশ ফিল্মপত্রিকা ‘সাইট এন্ড সাউন্ড’ প্রতি দশবছর অন্তর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ১০০ ছবির একটি তালিকা প্রকাশ করে থাকে। ওই বিশেষ সংখ্যাগুলোতে তালিকাবদ্ধ ছবিগুলোর স্থান ক্রমের সামান্য অদলবদল ছাড়া তেমন কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ে না। কিন্তু এবারের তালিকাটি স্পষ্ট ব্যতিক্রম। দীর্ঘদিন সারির মাঝামাঝি পড়ে থাকা Jeanne dielman (1975) এবার বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্র সমঝদারদের ভোটে ১ম স্থান অধিকার করে নিয়েছে। সাইট এন্ড সাউন্ডের ৯১ বছরের ইতিহাসে এ এক নাটকীয় মুহূর্ত। দীর্ঘদিন জায়গাটি দখল করে ছিল অরসন ওয়েলসের ‘সিটিজেন কেন’, এরপর হিচককের ‘ভার্টিগো’। কিন্তু বার্গম্যান, ফেল্লিনি, তারকোভস্কির মত চলচ্চিত্র মহীরুহদের টেক্কা দিয়ে ২৫ বছর বয়সী তরুণীর সাড়ে তিন ঘণ্টার নারীবাদী ছবি কি করে ১ম স্থান অধিকার করে নিল এই নিয়ে চলচ্চিত্রপাড়ায় যথেষ্ট রহস্যের সঞ্চার হয়েছে। বড় বড় ম্যাগাজিনের রিভিউ থেকে সোশাল মিডিয়া সবখানে ভেসে বেড়ানো মানুষের কমন মনোভাব "এতটা পরিবর্তন না হলেই বোধহয় ভালো হতো"। আবার অনেকের সন্দেহ সাইট এন্ড সাউন্ডের নবনিযুক্ত সম্পাদক মাইক উইলিয়ামস সবকিছুর পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন। প্রশ্ন রয়ে যায় আদৌ এতদিন পর ছবিটির প্রতি ন্যায়বিচার করা হলো, নাকি সোশাল মিডিয়ার এই হাইপ-ট্রেন্ড-ভাইরালের হুজুগে যুগে এটা সাইট এন্ড সাউন্ডের একটা চোরা বিজনেস মডেলের অংশ যা কিনা বৃহৎ পাঠকগোষ্ঠির দৃষ্টি আকর্ষণের একটা সাময়িক চেষ্টা।

১৯৬৫ সালের কোনো এক নিরুত্তাপ দিনে ১৫ বছর বয়সী বেলজিয়ান তরুণী শন্তাল একেহ্রমান কতকটা আনমনেই ঢুকে পড়লেন 'পিয়েগোহ্ ল্যে ফু' দেখতে। এ ছবির শিল্পগত পরিধি, ভাষা ও ভাবনার প্রকাশ, দৃশ্য ও শ্রাব্যের সংঘাত তথা রং ও রাজনীতি মিলেমিশে তৈরি করা চলচ্চৈত্রিক সংগীতের অশ্রুত দ্যোতনা তরুণীর মস্তিষ্কের প্রতিটি শাখা প্রশাখায় কম্পন তুলে চিরকালের জন্য বদলে দিল তার চেতনার দৃশ্যপট। শো শেষ হলে একেহ্রমান হল থেকে বেরিয়ে আসেন কাঁপতে কাঁপতে, ততক্ষণে তার মাথা থেকে উড়ে গেছে চিরকালের লেখক হওয়ার বাসনা। যদিও ওয়াল্ট ডিজনির ছবি দেখা তরুণী এবারই প্রথম শুনলেন 'জাঁ লুক গোদার'-এর নাম। এর ঠিক দশ বছর পর নিজের ছবি jeanne dielman-এর কান প্রদর্শনীর সময় পেছনের সারিতে বসে একেহ্রমান দেখলেন একের পর এক দর্শকের হতাশ ও বিরক্তমুখে হল ছেড়ে যাওয়ার দৃশ্য। তাতে কিছু এসে যায়নি যদিও। Jeanne Dielman তাৎক্ষণিক সাফল্য না পেলেও আলোড়ন তুলেছিল ঠিকই এবং চলচ্চিত্র ইতিহাসে এর অবস্থান যে কোনো অংশেই খাটো নয় তা খুব দ্রুতই প্রমাণ করে দিয়েছিল। একেহ্রমান নিজেই বলেছেন, Suddenly, at 25, I was informed that I was a great filmmaker।

Jeanne Dielman 23, quai du commerce, 1080 Brussels; ছবির নামটা আক্ষরিক অর্থেই ঠিকানা। বেলজিয়ামের এই ঠিকানায় একটা গড়পড়তা মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাটে নিবাস মধ্যত্রিশ জাঁন ও তার সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া ছেলে সিলভাঁর। জাঁনের স্বামী মারা গেছে বছর পাঁচেক এবং এখন তারা ধরতে গেলে বেশ একাকী। সন্ধ্যায় রেডিওতে ধ্রুপদী সংগীত, রোজকার খবরের কাগজ আর মাঝেমধ্যে অতিদূর কানাডাপ্রবাসী বোনের চিঠি পাওয়া ছাড়া প্রয়োজনীয় লেনদেন বাদ দিলে গোটা পৃথিবী থেকে তারা বেশ বিচ্ছিন্নই বলা চলে। নৈশব্দ ও শৃঙ্খলা দিয়েই বোনা জাঁন ও সিলভাঁর ছোট্ট সংসার। জাঁন বাড়িতেই থাকে। নিত্যদিনকার রান্নাবান্না থেকে কাপড় কাচা বা ছোটখাটো সেলাইকাজ সব সে সম্পন্ন করে যান্ত্রিক স্বয়ংক্রিয়তায়। ছেলে স্কুলে যায় আসে। আর সংসার চালানোর জন্য প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট ঘণ্টায় জাঁনকে দরজা খুলে দিতে হয় পরপুরুষের জন্য। তবে শৃঙ্খলিত তাসের ঘর ভেঙে পড়ে তখনি যখন সে এক অনিচ্ছাকৃত অর্গাজমের পর কাঁচি বসিয়ে দেয় তার এক খদ্দেরের বুকে।

কুড়িতে পা দিয়েই একটা দ্বিধা পরিষ্কার হয়ে গেছে। আগে কৈশোরের কাঁচা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মনে হতো মহৎ কিছু একটা করে ইতিহাসে নিজের ছাপ রেখে যেতে না পারলে জীবনখানা বৃথা। তখন কি বুঝেছি শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে যারা ইতিহাস তাদেরই স্থান দিয়েছে; আর বেমালুম ভুলে গেছে তাদের যারা করেছে ক্ষয় পূরণ, নির্মাণ, নিজেদের অতিক্ষুদ্র শরীর দিয়ে যারা বয়ে নিয়ে গেছে সমাজ ও সভ্যতা। তাই জীবন কোনো বিপ্লবী, যোদ্ধা বা সাধুসঙ্গে নয়, জীবন আমাদের মায়েদের কাছে, জীবন 23 quai Commerce-এ বাস করা জাঁন দিয়েলমানের নিত্যদিনকার গৃহস্থালি কাজে। ঘরের প্রয়োজনীয় কাজ করতে করতেই জাঁনের সারাদিন কেটে যায়। হোক তা আলু ছোলা, ছেলেকে খাইয়ে-দাইয়ে স্কুলে পাঠানো, রাতের খাবার তৈরি বা পতিতাবৃত্তি। সবগুলো কাজই সমান একঘেয়ে এবং এতটাই রুটিনমাফিক হয়ে যায় যে জাঁনের কাছে বাড়তি কোনো ভাবনা আসার সুযোগই থাকে না। কাজগুলো তার কাছে কতটা স্বাভাবিক ও নিয়মতান্ত্রিক তার ধারণা পাই প্রথম দৃশ্যেই যখন দেখি চুলায় আলুসেদ্ধ বসিয়ে সে শুতে চলে যায় খদ্দেরের সাথে ও লোকটিকে বিদেয় করে এসেই চুলা বন্ধ করে সেদ্ধ আলু নামায়। এই অনাকাঙ্ক্ষিত রুটিনমাফিক জীবন নিজের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষার একটা পন্থাও বটে। এবং শুধু জাঁন নয়, এটা প্রায় পূর্ব ইউরোপীয় একধরনের সংস্কার, নির্মাতা শন্তাল একেহ্রমানও যার মধ্যে বড় হয়েছেন। একেহ্রমান বেড়ে উঠেছেন এমন এক পরিবেশে যেখানে তাঁকে সারাক্ষণ ঘিরে আছে মা বোন মাসি পিসি কোনো না কোনো নারী। আন্দাজ করে নেয়া যায় এই মহিলাদের জীবনযাত্রাই সচেতনে/অচেতনে পরিস্ফুটিত হয়েছে জাঁন দিয়েলমান চরিত্রে, তথা গড়ে দিয়েছে পুরো ছবির আঙ্গিক ও কাঠামো।

ছবির তিনদিনে আমরা তিনজন খদ্দেরকে পাই। প্রথমজনকে দিয়ে ছবি শুরু হয়। এরপর আস্তে আস্তে জাঁনের শৃঙ্খলিত জগতে আমরা প্রবেশ করতে থাকি। রান্নাঘর, হলওয়ে, ড্রয়িংরুমের মাঝে ধীরস্থির নিয়ন্ত্রিত কাটিংয়ে দেখি লাইট জ্বালানো-নেভানো, খদ্দেরের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে টেবিলে সিরামিকের পাত্রে রাখা বা স্কুলে পাঠানোর সময় ছেলেকে দেয়া, রান্না করা-বাসন মাজা ছাড়াও ডে-কেয়ারের মত দিনের কিছু অংশ পড়শির বাচ্চাকে সামলে রাখা, রাতের খাবারের আগে ছেলের জন্য সোয়েটার সেলাই, কাগজে চোখ বোলানো কিংবা দিনের শেষে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়া। আমরা বুঝতে পারি স্বামীর মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন সে এভাবেই রুটিনমাফিক একঘেয়ে জীবন যাপন করে আসছে এবং এই জীবনেই সে অভ্যস্ত। অঘটন শুরু হয় ২য় দিন খদ্দের যাওয়ার পর থেকে। হঠাৎই সে আবিষ্কার করে, ছোটো ছোটো কাজে তার ভুল হচ্ছে। ছবির মাঝামাঝি এপর্যায়ে একটা সাবকনশাস ভিজুয়াল শকের মাধ্যমে দর্শকের মনে শঙ্কার বীজ বুনে দিতে পরিচালক ছোট্ট একটা fast cutting সিকুয়েন্স যুক্ত করেন। ছবির শুরু থেকে এই পর্যন্ত লম্বা লম্বা সব টেক ও এদের মধ্যবর্তী ছন্দময় কাটিং চলে আসছিল (কাট করা হয়েছে শুধু তখনি যখন জাঁন ফ্রেমের বাইরে চলে গেছে)। এই সিকুয়েন্সে দেখা যায় অকস্মাৎ তার সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। সিরামিকের পাত্রে টাকা রেখে ঢাকনা দিতে ভুলে যায়, আলু পুড়িয়ে ফেলে, কোনো ঘরে লাইট জ্বালিয়ে রাখে তো কোথাও ভুল করে বন্ধ করে দেয়। সবগুলো ডিটেলই নেহাত স্বাভাবিক ও আকারে ক্ষুদ্র, কিন্তু জানের প্রেক্ষাপট থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! আলু পুড়িয়ে ফেলায় তাকে আবার গিয়ে কিনে আনতে হয়, ফলে রান্নায়ও দেরি হয়ে যায়। ছেলে ফিরে এসেই মায়ের অগোছালো চুল খেয়াল করে। রাতে খাওয়ার পর সিলভাঁ আবদার করে আজকের রাতের পায়চারিটুকু মুলতবি রাখলে চলবে কিনা, যেহেতু রাতের খাওয়া দেরিতে হয়েছে। কিন্তু জাঁন রাজি হয় না। আমরা বুঝতে পারি সে তার নিয়ন্ত্রিত জীবনে ঘোরগ্রস্তের মত কোনো ব্যত্যয় ঘটতে দিতে রাজি নয়। পরের দিনটায় ৩য় খদ্দের আসার আগ পর্যন্ত দীর্ঘ সময়জুড়ে অত্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অব্যর্থ ডিটেলে জাঁনের মনোজাগতিক ধস নামতে দেখা যায়। সকালে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় সে আবারও নিত্যদিনকার কাজ শুরু করে। কিন্তু ছেলের জুতা পালিশ করার সময় ডাস্টার ছুটে পড়ে, চামচ মুছে গুছিয়ে রাখার সময় একটা চামচ আশপাশের নৈশব্দকে খানখান করে সশব্দে মেঝেতে পড়ে যায়। বোঝা যায় এগুলো সব তার মাথায় ক্রমাগত ছুটে চলা শঙ্কাভরা চিন্তারাশি ও তাকে দমন করতে ব্যর্থ হয়ে তৈরি হওয়া মনোজাগতিক দ্বন্দ্বেরই বহিঃপ্রকাশ। তবুও জাঁন দিনের কাজগুলোতে মন দিতে চেষ্টা করে। ঘর গোছায়, টুকটাক বাজার করে আনে, ভিল কাটলেট বানায়। দুশ্চিন্তায় ঐ দিন সকালে একঘণ্টা আগে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় দিনের সব কাজ করেও তার হাতে একঘণ্টা ফাঁকা থাকে। আর তখনই যত বাজে চিন্তার সব কোলাহল তাকে আবিষ্ট করে ফেলে। এই শূন্যতাকে ফাঁকি দেয়ার কোনো রাস্তা তার জানা নেই। পড়শি মেয়েটি তার বাচ্চাকে দিয়ে যায় নিয়মমাফিক। মানসিক দ্বন্দ্ব ফাঁকি দিতে জাঁন কিছুক্ষণ বাচ্চাটিতে মন দেয়। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! জীবনের কোনো অমোঘ ভাগ্যরাশি যেন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিণতির দিকে। সেদিন বাচ্চাটিও তাকে জ্বালিয়ে মারে। নানারকম চিন্তার জাল ঘনীভূত হয়। কিন্তু হায়, মানুষ তার চিন্তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে কি কখনো? সে বুঝতে পারে এই বিশৃঙ্খলা অসহ্য থেকে অসহ্যতর হয়ে ধ্বংসের রূপ নিচ্ছে। ৩য় খদ্দের আসে। সেই খদ্দেরের সঙ্গে যখন একটা অনিচ্ছাকৃত অর্গাজম হয়ে যায় তখন বিশৃঙ্খলার ঘোর চূড়ান্তে এসে পৌঁছায়। সে ড্রেসিং টেবিল থেকে কাঁচি তুলে নিয়ে সোজা বসিয়ে দেয় লোকটির বুকে।

ফরাসি নবতরঙ্গের গোদার, অ্যালাঁ হ্রেনে প্রমুখের মত একেহ্রমানও Jeanne Dielman রচনা করেছেন প্রথাগত হলিউডের বিপরীত রীতিতে। ক্যামেরা এখানে সর্বদাই স্থির ও একই উচ্চতায় বসানো (চেয়ারে বসলে স্বাভাবিক মানুষের মাথা যেটুকু উচ্চতায় থাকে সেটুকু)। শটগুলো সব দীর্ঘক্ষণ ধরে চলমান ও একই দৃষ্টিকোণ থেকে ধরা। দু'শো মিনিট অর্থাৎ প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ছবির দৈর্ঘ্য হলেও বাজি ধরে বলতে পারি এই দু'শো মিনিট থেকে মিনিট পাঁচেক ছাঁটাই করলেই ছবিটা আর আগের অবস্থায় থাকবে না। এবং একেহ্রমান যে একজন শিল্পী ও ছবিতে তাঁর শৈল্পিক নিয়ন্ত্রণ কতখানি তার একটা প্রমাণ জাঁনরূপী ডেলফিন সিরিগকে আমরা নগ্ন দেখি একলা একলা স্নানের দৃশ্যে, খদ্দেরের সাথে যৌনদৃশ্যে নয়! টেকনিকের ব্যবহার এ ছবিতে অপ্রতুল, বরং সহজ কথাটা সহজভাবে বলতেই যেন একেহ্রমান বিশ্বাসী। এজন্য খুনের দৃশ্যে জাঁন কাঁচিটা নিয়ে খদ্দেরের বুকে বসালে একটামাত্র অস্ফুট শব্দ করে লোকটা মারা যায়, এজন্যই দৃশ্যের পর দৃশ্যে একেহ্রমান শুধু জাঁনের চুল গোছানো বা অগোছানো দেখিয়ে কিংবা খদ্দেরকে বিদায় করার সময় টাকা নেবার আগে জাঁনের মুখের বদলে হাতগুলো দেখিয়ে অনেক অব্যক্ত কথাকে একসাথে ব্যক্ত করতে সমর্থ হন। হলিউডে আজ পর্যন্ত যত এডিটিঙের কায়দাকানুনের চর্চা হয়েছে তার সবকটারই উদ্দেশ্য ছবির কাটগুলোকে যথাসম্ভব অদৃশ্য করা। এর ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে Jeanne Dielman ছবির সবকটি কাট দৃশ্যমান; তবে পাতলা সুতোর ওপর দাঁড়ানো হলেও তারা ছন্দময়তার কারণে কখনো লাইনচ্যুত হয়ে ছবিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে না। এক দৃশ্য থেকে অপর দৃশ্যে যেতেও ক্রসফেড, ডিজলভ ইত্যাদি কোনো ট্রানজিশনের বালাই নেই। যা আছে তা হলো direct cut এর সাহায্যে সরাসরি দৃশ্যান্তর। এবং আগ্রহীরা খেয়াল করবেন দৃশ্যান্তরের সময় সেই কাট পয়েন্টে বা তার একটু আগে বা পরে কোনো না কোনো সাউন্ড বসিয়ে একেহ্রমান direct cut গুলো বেমালুম গায়েব করে দিয়েছেন। এ ছবি যদিওবা প্রায় সংলাপহীন তবে যেটুকু সংলাপ আছে তার প্রয়োগ স্বাভাবিক রীতি থেকে অনেক দূরে। উদাহরণস্বরূপ প্রথমদিন রাতে শোয়ার আগে মা ও ছেলের কথোপকথন--Would you want to remarry?-No. Get used to someone else?-I mean someone you love?-Oh, you know...-Well, If I were a woman, I could never make love with someone I wasn't deeply in love with.-How could you know? You're not a woman. প্রায়-সংলাপহীন ছবিতে কোনোরকমের build-up ছাড়া সরাসরি এধরনের সংলাপ ব্যবহারের আবহ তৈরি ও সেই সংলাপ সফলভাবে প্রয়োগ, যা একইসাথে অনেক স্তরে ক্রিয়া করছে, নিঃসন্দেহে চলচ্চিত্র পরিচালনায় একেহ্রমানের দক্ষতাকেই প্রকাশ ধরে। Jeanne Dielman এর গোটা জগৎটাই হলো শব্দের জগৎ। অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর থেকে সকাল-সন্ধ্যা বোঝা যায় না; শব্দ দিয়েই পরিবেশের আবহটা তৈরি হয়। এ ছবির informative impact টুকু যদি আসে ছবি দিয়ে তো খাঁটি emotional impact টুকু আসে শব্দ দিয়ে। আলু ছোলা, বাসন মাজা, স্টোভ জ্বালানো, ছুরি-চামচে ঠোকাঠুকি, পায়চারি করা বা রেডিওর সংগীত এসব ছোটো ছোটো শব্দ নিত্যদিনকার জীবনে প্রাণসঞ্চার করে অর্থাৎ এই আলাদা একটা texture যোগ হওয়াতে ছবিটি আরো উপভোগ্য হয়ে ওঠে।

ছবির পরিণতি দর্শককে সজোরে আঘাত করে এবং দর্শক যদি যথেষ্ট সংবেদনশীল দর্শক হন তাহলে তিনি সেই আঘাত কিছুদিন অন্তত বহন করতে বাধ্য ও সেই আঘাতই ক্রমে ক্রমে তার চিন্তাকে চালিত করে ছবির বুদ্ধিবৃত্তিক ভাগটা খোলাসা করতে থাকে। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে বোঝা যায় ৩য় খদ্দেরের মত ২য় লোকটির সাথেও জাঁনের একটা অনিচ্ছাকৃত অর্গাজম হয়ে থাকবে যা কিনা তার অন্তর্জগতে এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। মনোজাগতিক কোন্দল ও তাকে অবদমনের বৃথা চেষ্টা থেকে সৃষ্ট বিরোধের বহিঃপ্রকাশই হলো বাইরের এই বিশৃঙ্খলা। কিন্তু এই অর্গাজম তো আরো অনেকবার হয়ে থাকতে পারে বা ভবিষ্যতেও হবে, কিন্তু এবার জাঁনের এমন কি হলো যে শেষ পর্যন্ত তাকে একটা মানুষকে খুন করে ফেলতে হলো? এর উত্তরের জন্য একেহ্রমান আগেই চিত্রনাট্যে একটা সূত্র বুনে দিয়েছেন। ২য় দিন রাতে শুয়ে পড়ার আগে সিলভাঁ ও জাঁনের কথোপকথন যেখানে সিলভাঁ তার বন্ধু ইয়ানের কথা বলছে- -He bought a book that explains a lot of things about climaxes and orgasms. He says we should be interested in women at our age, but he doesn’t want some young girl. He says a man’s penis is like a sword. The deeper you thrust it in, the better. But I thought a sword hurts. He says, true, but it’s like fire. But then where’s the pleasure? -There’s no point talking about these things.-He’s the one who told me everything when I was ten. I said, “What? Dad does that to mom?” I hated dad for months after that, and I wanted to die. When he died, I thought it was punishment from God. Now I don’t even believe in God anymore. Yan also said it wasn’t just to make babies. So I started having nightmares so you’d stay with me at night and dad wouldn’t have a chance to thrust inside you.-You shouldn’t have worried. It’s late. I’m turning out the light. কৈশোর পার করা ছেলের ক্রমে ক্রমে পুরুষতান্ত্রিক কামনা নিয়ন্ত্রিত যৌনতার জগতে প্রবেশ ও তার নিষ্পাপ মনের ওপর এসবের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এখানে স্পষ্ট। যদিও জাঁন তাৎক্ষণিকভাবে একে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করে, কিন্তু অবচেতনে এটাই তার ভিত নাড়িয়ে দেয়। এই প্রথম ছেলের চোখ দিয়ে সে দেখে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে যৌনক্রিয়া কতটা পাশবিক ও বর্বর এবং নারী তাতে কতটা পণ্যায়িত, তথা ছোট্ট মনের পর্দায় এসবের সামগ্রিক প্রতিবিম্ব কতটা নির্মম। পরে সারাদিন ধরে হয়ত সচেতন মনের তলে তলে চাপা স্রোতের ন্যায় তার এই ভাবনাগুলোই খেলা করেছে যে প্রতিদিন একেকটা লোক এসে কীভাবে লালসাভরা হাতে শানিত ছুরি ঢুকিয়ে দেয় তার যোনিতে। সেখানে যদিও সে ভুক্তভোগী কিন্তু সেই খদ্দেরের সাথে অর্গাজম হওয়া মানে তার নিজেরও অংশগ্রহণ, ও তার থেকে যৌনসুখ লাভের যে তীব্র পাপবোধ তা ভেঙেচুরে খানখান করে দেয় তার সকল সত্তা। মানুষ যেকোনো প্রকার শারীরিক দুরবস্থা সয়ে টিকে থাকতে পারে, কিন্তু বিরোধ যখন তৈরি হয় চেতনায়, তখন চোখের সামনে ভেঙে পড়ে তার চিরচেনা জগৎ। জাঁনের খদ্দেররা সব যদিও নেহাত ভদ্রলোক, তবু এই মানসিক অবস্থায় আর কোনো ব্যক্তি বিবেচনা কাজ করে না, অভিপ্রায়ই সেখানে হয়ে পড়ে মুখ্য। কাঁচি চালানোর সেই মুহূর্তে চিরকালের সমস্ত পুরুষতান্ত্রিক কামনার বিরুদ্ধে সমস্ত অবদমিত নারী একসাথে গর্জে ওঠে। সেই মুহূর্তে শুধু অবশিষ্ট থাকে প্রতিবাদ, না থাকে খদ্দের লোকটি, না থাকে জাঁন দিয়েলমান।

লেখার শুরুতে সাইট এন্ড সাউন্ড বিতর্কের কথা বলেছিলাম। এই ছবির পক্ষে খুব একটা জনসমর্থন না পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কেননা সাড়ে তিন ঘণ্টা বসে বসে আলু ছোলা আর বাসন মাজা দেখবে এমন দর্শকের সংখ্যা যেকোনো দেশেই সীমাবদ্ধ। তবে কোনো ছবিই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ তকমা পাওয়ার যোগ্য কি? শৈল্পিক উৎকর্ষের সম্পূর্ণতা লাভ যেকোনো আর্টের পক্ষেই যখন প্রায়-অসম্ভব। ধরে নিলাম Jeanne Dielman সর্বশ্রেষ্ঠ খেতাবের যোগ্য নয়, তবুও তাকে এই স্থান দানে নতুন করে চলচ্চিত্রপাড়ায় ঝড় তুলবে, আলোচনা হবে সমালোচনা হবে। সবচেয়ে মোদ্দা কথা, আরো বেশিবেশি করে মানুষ এই ছবি দেখবে। তা বাড়তি পাওনা হিসেবে এধরনের মূল স্রোতের বাইরে থাকা ছবিগুলো ও এই চলচ্চিত্রকারদের যারা উত্তরসূরি উভয়ের জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে।

.কান উৎসবে ছবির প্রথম প্রদর্শনীতে একের পর এক দর্শককে হল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে দেখে একেহ্রমান বুঝে নিয়েছিলেন, এ ছবি সহ্য করার ক্ষমতা এদের নেই। এরপর প্রায় অর্ধশতাব্দী কেটে গেছে। এই সময়ের পুরোটা জুড়ে ছবিটিকে কেন্দ্র করে পঠন-পাঠন-আলোচনা-সমালোচনা কিছুই কম হয়নি। তবুও ভরাট গল্প, রংচটা অভিনয়, সর্বপ্রকার সংগীত ও ‘স্পষ্ট সামাজিক বার্তা’ বিহীন এই ছবিটি অনুভব করার সাহস দর্শক অর্জন করতে পেরেছে কি? এই দ্বায়িত্ব এ যুগের দর্শকের এবং তারাই এর উত্তর দেবে।