মার্কি দ্য সাদ: কালের নির্জনতা পেরিয়ে

কামাকাঙ্ক্ষায় কল্পনার এক বিরাট ভূমিকা থাকে, তাই মিলনের সময় রূপকথার অশ্বখুরধ্বনি প্রচলিত বাস্তবতাকে ভেঙে নতুন রূপকথার রাজ্যে বেজে উঠতে থাকে। সব কামাচারই হলো মাত্রাভেদে উন্মত্ততা, অবাধ্যতা; কোনো আইন, নিয়ম বা বিষয় তাকে নির্ধারণ করতে পারে না।

কুমার চক্রবর্তীকুমার চক্রবর্তী
Published : 1 June 2023, 09:42 AM
Updated : 1 June 2023, 09:42 AM

১৯৯০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত মেক্সিকান কবি অক্তাবিয়ো পাস অ্যান ইরোটিক বিওয়ন্ড: সাদ নামে যে প্রবন্ধপুস্তকটি লিখেছিলেন, সেখানে তিনি বলেছেন, যে, কীভাবে ১৯৪৬ সালে প্যারিসে অবস্থানকালে তিনি মার্কি দ্য সাদ-এর রচনার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন--সাদ-এর জীবন ও লেখা পড়ে তিনি প্রথমত স্তম্ভিত এবং পরে আকর্ষিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি জানাচ্ছেন: ‘আমি তাঁকে পাঠ করি আশ্চর্য আর আতঙ্ক, ঔৎসুক্য আর বিরক্তি, মুগ্ধতা আর স্বীকৃতির সঙ্গে।’ পাসের এই উক্তি থেকেই প্রতিভাত হয়, যে, গোপনে গোপনে কতটা প্রভাবসঞ্চারী হয়ে উঠেছিলেন মার্কি দ্য সাদ। ১৭৭৬ সালে মার্কি দ্য সাদ তাঁর ওপর আরোপিত আট বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছিলেন; এর একশ বছর পর, ১৯৮৬ সালে, জ্যাঁ-জ্যাক পুভের বারো খণ্ডে সাদ-এর সম্পূর্ণ রচনাবলি প্রকাশের ঘোষণা দেন। এই শতাব্দব্যাপী নীরবতা এবং বিচ্ছেদকালে নিষিদ্ধঘোষিত সাদের লেখার অনেককিছুই নষ্ট হয়ে যায়, আর যা রয়ে যায় তা রক্ষিত থাকে কিছু কঠিন ও বেয়াড়া পাঠকের গোপন কুঠুরিতে, নিষিদ্ধ ও গুহ্যগ্রন্থের মতো। শতবছরের নির্জনতার পর সাদের পুনরুজ্জীবন সম্ভব হয় কয়েকজন কবি-লেখকদের মাধ্যমেই--গিয়োম আপোলিনের নামের এক বিখ্যাত কবি আর মেধাবী এবং জ্ঞানী সমালোচক মরিস হাইন এবং পরাবাস্তববাদীরা সাদকে এক দ্রোহের প্রতীক হিসেবে প্রতীকায়িত করেছিলেন --অক্তাবিয়ো পাস এমনটাই জানাচ্ছেন আমাদের। পাস বলছেন, ‘সাদকে পাঠ করা আবশ্যক। তিনি কি একজন বিপজ্জনক লেখক? আমি মনে করি না বিপজ্জনক লেখক বলে কিছু আছে: কোনো বইয়ের বিপদ লুকিয়ে থাকে না ওই বইটিতে, বরং তা থাকে পাঠকের অনুভূতিতে।’ পাসের মতে সাদ আমাদের উত্তেজিত বা পরিবর্তিত করতে চাননি, চেয়েছিলেন আমাদের উপলব্ধি করাতে। তাঁর বইয়ের নাম থেকেই তা বোধগম্য হতে পারে: শয়নঘরের দর্শন। এই বইয়ে, এবং তাঁর প্রায় সব বইয়েই ধর্ষমর্ষকামের ছায়ায় এটাও বলতে চেয়েছেন যে, সময় এসেছে বোঝার যে নৈতিকতাই ধর্মের ভিত্তি হওয়া উচিত, ধর্ম কখনও নৈতিকতার ভিত্তি হবে না। এই জড়বাদী দর্শনে তিনি গির্জার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানকে সোচ্চার করেছিলেন এই বলে যে, ‘এই চার্চ এবং রাজকীয় স্বৈরাচারীরা সবসময় হাত-ধরাধরি করে চলে: রাজা ধর্মের ‘‘পারমার্থিক উদ্দেশ্যের’’ ধ্বজাধারী; ধর্ম রাজার ‘‘পারমার্থিক অধিকারের’’ ধ্বজাধারী।’ সাদ যে আমাদের নতুন ও ভিন্নভাবে উপলব্ধি করাতে পেরেছেন, মনোলোক অধিকার করতেও পেরেছেন, তা আজ দিবালোকের মতো সত্যি।

কামাচারকে বিধিবদ্ধ করা উচিত কি না, এই ধারণা আধুনিক চিন্তার এক বড়ো সমস্যা বলে মনে হয়। যদি প্রজননের সঙ্গে একে মিলিয়ে দেখা হয় তবে কামাচারের শৃঙ্খলাকে তার নৈতিকভিত্তি হিসেবে বিবেচনায় কোনো আপত্তি থাকার কিছু থাকে না, কিন্তু বিষয়টা এখানে শেষ তো নয়ই বরং শুরু। কামাচার শৃঙ্খলিত বিষয় নয়, বরং বিশৃঙ্খলা ঘটানোই তার ধর্ম। এখানেই এসে পড়ে এর স্বাভাবিকতার বিষয়টি। ফ্রয়েড বলেছেন, যখন কোনো যৌনউদ্দীপনা যৌনমিলনের ‘জীবগত স্বাভাবিক’ উদ্দেশ্য থেকে চ্যুত হয়, তখনই তা অস্বাভাবিক যৌনাচারে পরিণত হয়। ‘বায়োলজিক্যাললি নরমাল’ বলতে ফ্রয়েড প্রজননক্রিয়াকেই হয়তো বুঝিয়েছেন যেখানে শিশ্ন ও যোনীর স্বাভাবিক সহগামিতা সমাদৃত। কিন্তু যখন শিশ্ন যোনীগামী না হয়ে অন্য উপায়ে তার উদ্দেশ্যসাধনে অগ্রসর হয়, তখনই কামাচার অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে যাকে বলা হয় যৌনবিকৃতি। আর এভাবেই পশুমৈথুন, নেক্রোফিলিয়া, পেডোফিলিয়া, স্যাডো-ম্যাসোসিজম, সমকামিতা ইত্যাদি অস্বাভাবিক যৌনাচারকে বিকৃত বা পারভার্সান বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দেয়, কামাচারে স্বাভাবিকতা বলতে তাহলে কতটুকু বোঝায়? এর সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন এবং দুর্মরভাবে জড়িয়ে আছে যৌননৈতিকতার বিষয়টি। নৈতিকতা বস্তুত এক বাস্তব যুক্তির শর্ত যা বাস্তবায়নমুখী। আমাদের জীবনে যে-সমস্ত নিষেধ রয়েছে তার সমর্থনে এক জাতীয় নৈতিক যুক্তির প্রণোদনা সাধারণভাবে কার্যকর থাকে। এর বরখেলাপ বা বিরুদ্ধাচারণই অনৈতিক হিসেবে পরিগণিত হয়। সমাজে এই ভাবনা কার্যকর থাকে যে যৌক্তিক পূর্ণতার সাথে সদ্গুণের সম্পর্ক রয়েছে। আরিস্তোতলেস যে এউদাইমোনিয়ার কথা বলেছেন তা-ও হলো সদ্গুণের সাপেক্ষে আত্মার কার্যকলাপ। সুতরাং যৌননৈতিকতা হলো কাম-ইচ্ছার এবং তা পূরণের এক মূর্তপ্রকাশ যখন আমাদের শরীর আমাদের চিন্তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় আর চিন্তা আমাদের সদ্গুণের দ্বারা আলোকিত থাকে। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দেয় তখন যখন মনে করা হয় যে কামাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে জড়িত থাকে হিংস্রতা ও উল্লঙ্ঘন, আর এই ধারণার পেছনের ইতিহাসও হালে পানি পায়। কামাকাঙ্ক্ষায় কল্পনার এক বিরাট ভূমিকা থাকে, তাই মিলনের সময় রূপকথার অশ্বখুরধ্বনি প্রচলিত বাস্তবতাকে ভেঙে নতুন রূপকথার রাজ্যে বেজে উঠতে থাকে। সব কামাচারই হলো মাত্রাভেদে উন্মত্ততা, অবাধ্যতা; কোনো আইন, নিয়ম বা বিষয় তাকে নির্ধারণ করতে পারে না। কামাচারের ক্ষেত্রে কল্পনা এতটাই পাখা মেলে দেয় যে তা নৈতিক ফলাফলকে উপেক্ষাই শুধু করে না, অবজ্ঞাও করতে থাকে। আনন্দ আর বেদনা এমনই এক আশ্চর্যের যুগল যে তারা বিরোধাভাসে সম্পর্কিত। আনন্দ এমনই এক হাতিয়ার যে, সব মানবীয় চিন্তা আর কার্যকে সে পথ দেখায় এবং পরিচালনা করে, আর সব আনন্দই সহজাতভাবে ধংসাত্মক--বলেছেন পাস। আর এখানেই চলে আসে মার্কি দ্য সাদ বা ‘স্যাডো-ম্যাসোসিজম’।

আকাঙ্ক্ষার উদ্দেশ্যসাধনের তিন ধরনের রূপ দৃষ্টিগোচর হয়: ডন জুয়ানিজম, ট্রিস্টানিজম, স্যাডো-ম্যাসোসিজম। ডন জুয়ানিজম হলো প্রলুব্ধ করার মাধ্যমে ব্যাভিচারে রত হওয়া, এখানে কল্পনার সবটুকুন প্রচেষ্টাই যৌন-ইচ্ছায় নিয়োজিত হয়। ট্রিস্টানিজম-এ প্রেমের মাধ্যমে পারস্পরিক মুক্তি নিশ্চিত হয়। ডন জুয়ান-এ অসংখ্য নারী এবং প্রত্যেকেই আকাঙ্ক্ষার একই উদ্যাপনে রত থাকে, কিন্তু ট্রিস্টান-এ একজন নারীই থাকে যে মৃত্যুর মাধ্যমে নির্বাপিত হওয়ার প্রেরণাকেও ধারণ করে থাকে। স্যাডো-ম্যাসোসিজম-এ আকাঙ্ক্ষা বিকৃত হয় পাশবাচরণের মাধ্যমে। ম্যাসোসিস্ট ব্যথাকে উপভোগ করতে চায়, অভিজ্ঞতায় আনতে চায়, আর স্যাডিস্ট ব্যথাকে প্রয়োগ করতে চায়। এ এক আশ্চর্য আকাঙ্ক্ষা যা ব্যথা পেয়ে ও দিয়ে আনন্দ পায়। মার্কি দ্য সাদও তাঁর উপন্যাসে বলেন: Nature has created us so that we feel pleasure only by the way of pain.

পাস বলেছেন, সাদ-এর গুরুত্ব শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে নয়, যেমনটা পুর্ভে তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, বরং সাহিত্য অপেক্ষা মনস্তত্ত্ব এবং দার্শনিকতার কিছু বিবেচনায় তাঁর বিশেষত্ব রয়েছে। তাঁর চিন্তায় রয়েছে ভিন্নতা সেটাই তাঁর লেখার প্রধান আকর্ষক। তিনি এমন-এক সমাজের প্রস্তাবক যেখানে আইন হবে শিথিল আর সংরাগ হবে শক্ত। সাদ-এর নিকট অমঙ্গলই একমাত্র বাস্তবতা। যে অন্ধকার মানবজীবনের এক আড়াল-করা অমাবস্যা, সেই অন্ধকারকেই প্রকাশ করেছেন তিনি। তিনি ব্যতিক্রমের ব্যতিক্রম ছাড়া আর কিছু নন। পাস বলেছেন, সাদ আয়নাবাজির অনেক প্রতিফলনের এমন এক প্রতিফলন যা বহুগুণিত হয়ে অবশেষে মিলিয়ে যায়।

প্রধান গ্রন্থঋণ :

১. দ্য কমপ্লিট মার্কি দ্য সাদ, হলোওয়ে হাউস পাবলিশিং কো. লস এঞ্জেলেস, ক্যালিফোর্নিয়া,২০০৮; ফরাসি থেকে অনুবাদ: ডা. পল জে. জিলেট।

২. সেক্সুয়াল ডিজায়ার: আ মোরাল ফিলোসোফি অব দ্য এরাটিক, রজার স্কুটন, দ্য ফ্রি প্রেম, নিউ ইয়র্ক, ১৯৮৬।

৩.দ্য স্যাডিয়ান উইমেন, অ্যাঞ্জেলা কার্টার, ভিরাগো, লন্ডন, ১৯৭৯।

৪. অ্যান এরোটিক বিওয়ন্ড: সাদ, অক্তাবিয়ো পাস, হারকোর্ট ব্রাস অ্যান্ড কোম্পানি, অরলান্ডো, ফ্লোরিডা, ১৯৯৮; স্পেনিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: এলিয়ট ওয়েনবার্গার।