ডেটলাইন: ছাব্বিশে মার্চ

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কুমিরা একটা বিখ্যাত স্থান, এখানে মুক্তিযুদ্ধের একটা স্মারক স্তম্ভ স্থাপিত হওয়া উচিত ছিল।

ফারুক মঈনউদ্দীনফারুক মঈনউদ্দীন
Published : 25 March 2023, 06:30 PM
Updated : 25 March 2023, 06:30 PM

জীবনে প্রথমবারের মতো অটোমেটিক রাইফেল কিংবা মেশিনগান দিয়ে ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শুনি একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চে। তখন আমি চট্টগ্রামের কুমিরার মসজিদ্দা স্কুলে। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক, আওয়ামী লীগের নেতা এম এ মামুন, তাঁর উৎকণ্ঠা উদ্বেগ এবং সাথে সম্পৃক্ততা স্বভাবতই বেশী। ইতিমধ্যে গভীর রাতে রেলওয়ের টেলিগ্রাফ বার্তার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী কুমিরা রেল ষ্টেশনে পৌঁছে গেছে। মধ্যরাতের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে তাঁকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে সেই বার্তা সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। আমরা এসবের কিছুই অবগত ছিলাম না। এই ঘটনা আবারো প্রমাণ করে যে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতের পর কোনো এক সময়ে রেলওয়ের সিগন্যাল ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নানান টালবাহানা, বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রীত্বের ব্যাপারে ভুট্টোর ঈর্ষাকাতর বিরোধিতা-এসব ছিল বাংলার মানুষের ক্ষোভের ইন্ধন। সে ক্ষোভ ও হতাশার আগুনে ঘৃতাহুতি দেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে ইয়াহিয়া খানের পয়লা মার্চের ঘোষণা। বাংলাদেশের মানুষ এবার প্রকৃত বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, অসহযোগ আন্দোলনে স্থবির হয়ে পড়ে গোটা দেশ। এসব ইতিহাস সবারই জানা।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশজুড়ে যে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়, বর্তমান প্রজন্মের যাঁরা আন্দোলন বলতে দেখেছে রাস্তায় গাড়ি ভাঙার মহোৎসব কিংবা বিভিন্ন ভবনের আগুন জ্বালানো, তারা ভাবতেও পারবেন না, সেই অসহযোগ আন্দোলন ছিল সত্যিই অহিংস, গাড়ি-ঘোড়া নির্বিঘ্নে চলছে, কেবল চলছে না অফিস-আদালত, মিল-কারখানা, স্কুল-কলেজ। দেশে কী কী চলবে আর কী কী চলবে না তার স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায়। আজকের বিভ্রান্ত প্রজন্মের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও পাকিস্তানী কঠোর সামরিক শাসনের মধ্যে এটা ছিল এক ঐতিহাসিক এবং কার্যকর বেসামরিক শাসন, যার মূল ব্যক্তি ছিলেন শেখ মুজিব। তিনি যখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত নেতৃত্ব নিয়ে প্রায় সমান্তরাল শাসন চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন জঘন্য ইতিহাস বিকৃতিকারীদের কথিত স্বাধীনতার ঘোষকটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্নেল থেকে ওপরের সারির অফিসারদের স্যালুট ঠুকে নিজের আনুগত্য প্রকাশ করছিলেন।

আমরা তখন স্কুলের উচু ক্লাশের ছাত্র, পড়াশোনা নেই, অঢেল ছুটি। আমি বছরখানেকের জন্য মসজিদ্দা হাই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। চট্টগ্রামের কুমিরাতে ‘জেল স্কুল’ নামে সমধিক পরিচিত আবাসিক স্কুলটি যেন ছিল বাবামায়ের অবাধ্য অমনযোগী ছাত্রদের সংশোধন কেন্দ্র। অসহযোগ আন্দোলনের ডামাডোলে স্কুল বন্ধ, বন্ধ পড়াশোনাও, স্কুল ভবনের ছাদে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে রেখে আশেপাশের এলাকা চষে বেড়াতাম আমরা সমবয়সী কয়েকজন। কখনো পাহাড়ে, কখনো সমুদ্রে ছাড়া গরুর মত ঘুরতে ঘুরতে আমরা যথার্থ অর্থেই হয়ে পড়ি প্রায় ঘরছাড়া। পড়াশোনা শিকেয় উঠেছিল। দেশের সমস্যা বলে কথা, এ অবস্থায় পড়াশোনা করে কী হবে--ভাবখানা এরকম।

উন্মাতাল সে সময়টাতে আমাদের এসব উড়নচন্ডী চলাফেরার মাঝে আমাদের সবার আলোচনার একটা প্রধান বিষয় ছিল স্থানীয় বিহারী সম্প্রদায়। বাঙালি-বিহারী মারামারি শুরু হলে ওদেরকে নিয়ে কী করা হবে সেটা নিয়ে জোর তর্ক হতো। স্থানীয় হাফিজ টেক্সটাইল মিল, হাফিজ জুট মিল এবং কুমিরা পাহাড়ের ওপর যক্ষ্মা স্যানিটোরিয়ামে বেশ কিছু বিহারী কর্মচারী ছিল। তবে বিহারীদের সংখ্যা যাই হোক না কেন আমাদের মধ্যে জ্যাঠা মতো যারা ছিল তাদের মতে এসব বিহারীকে বড় হাঁড়িতে রান্না করে খেয়ে ফেলাটা এমন কঠিন কিছু কাজ নয়। আমরা একবার দলবল নিয়ে হাফিজ টেক্সটাইল মিলের পূর্ব পাশের রেললাইন দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। মিলের সীমানার ভিতরে ছিল এক সারি ল্যাট্রিন। এক বিহারীকে এগুলোর একটির ভিতর ঢুকতে দেখে আমাদের মধ্য থেকে কেউ একজন ছোট একটা নুড়ি ছুঁড়ে মারে ল্যাট্রিনের ভিতর। বিহারী লোকটা সাথে সাথে দরজা খুলে মাথা বের করে খুব রাগ রাগ চেহারা করে বলে, কিঁউ পাত্থর মারা? লোকটা এবং আমাদের অবস্থানের মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া ছিল বলে ব্যাপারটা আর বেশিদূর যেতে পারেনি। সেটাই বিহারীদের সাথে ছিল আমাদের মুখোমুখি হওয়ার একমাত্র উদাহরণ। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কালো পোশাক পরা ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স নামের আধা-সামরিক বাহিনীর একটা দল এলাকায় ঘাঁটি গাড়লে এসব বিহারীরা দাপটের সঙ্গে চলাফেরা শুরু করে। তখন আমাদের দলের মধ্যকার বিহারী ভক্ষনেচ্ছু তরুণদের কে কোথায় ছিল সেটা আর জানা যায় নি।

এসময় আমার মামা সম্পর্কের একজনের বিয়ে উপলক্ষে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে উঁচু বাঁশের আগায় লাউড স্পিকার ফিট করে কয়েকদিন ধরে ঢালাও মাইক বাজানো হয়। আজকাল গ্রামের বিয়েতে মাইক বাজানো বন্ধ হয়ে গেছে। তখন এসব উপলক্ষে শামসাদ বেগমের অবিস্মরণীয় গানগুলোই বাজানো হতো বেশি। সেবার এসব গতানুগতিক গান ছাড়াও বাজতো সত্তরের নির্বাচন উপলক্ষে জনপ্রিয় কিছু গান। মাত্র কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অবিশ্বাস্য বিজয়ের পর এসব গান খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বারবার শুনতে শুনতে কয়েকটা গান প্রায় মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল, যেমন ‘হুলো বিড়াল সামাল থাইকো থাবা আর বাড়াইও না, ও বিড়াল রুই মাছের মাথা খাইও না।’ পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে লেখা এই গানটায় ছিল একসঙ্গে ব্যঙ্গ ও তাদের শোষনকারী চরিত্রের প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। কিংবা ‘আরে ও আমার বাংলাদেশের মাঝিভাই, জয় বাংলা বলিয়া আইস রঙ্গিন পাল উড়াই’। এসব গান এখন আর কোথাও শোনা যায় না।

ইয়াহিয়া খান যখন ঢাকায় বেইলী রোডের বাড়িটিতে বসে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে প্রহসনমূলক আলোচনা চালিয়ে কালক্ষেপণ করছিলেন, তখন দেশজুড়ে মানুষের মধ্যে আশংকা, গুজব এবং ক্ষোভ অগ্নিগর্ভ বোমার মত বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠছিল দিনে দিনে। পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতের প্রহর থেকে ঢাকায় যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নারকীয় হত্যাকান্ড শুরু হয়, তখন আমরা সারাদিনের ঘোরাঘুরির পর ক্লান্ত শরীরে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। ছাব্বিশে মার্চ হয়ে ওঠে গুজব এবং উৎকণ্ঠার দিন। এর মধ্যে ঢাকা রেডিও শুরু করে অস্বাভাবিক আচরণ। কোনো নিয়মিত অনুষ্ঠানের পরিবর্তে ক্রমাগত যন্ত্রসঙ্গীত বেজে যাচ্ছিল, তার মাঝে কিছুক্ষণ পর পর হেঁড়ে গলায় অবাঙালি উচ্চারণে এক ঘোষক বলছিলেন, ‘এক জরুরি এলান, ঢাকা শহর ও শহরতলীতে কারফিউ জারী করা হইয়াছে। কেহই এই কারফিউ ভঙ্গ করার অধিকার রাখে না, যে কারফিউ ভঙ্গ করিবে তাহাকে গুলি করিয়া মারা যাইতে পারে।’ স্মৃতি থেকে লেখা হলেও মোটামুটি এটাই ছিল ঘোষণার ভাষা।

ছাব্বিশ তারিখ দুপুরের আগে থেকেই কুমিরার রাস্তায় গাছ ফেলে ব্যরিকেড দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে যায়। বর্তমানে যেখানে মোরগ মার্কা ঢেউ টিনের কারখানা, ছোট কুমিরার সেই মোড়ের আগে একটা গাছ ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়েছিল। আগের মধ্যরাতে ঢাকা শহরে পাক বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের খবর ততক্ষণে সারাদেশে পৌঁছে গেছে, তাই স্থানীয় জনগণের মধ্যে আশংকা ও উদ্বেগ ছিল সীমাহীন। কুমিরার দক্ষিণাংশ থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম শহর পর্যন্ত ছিল বাঙালি সেনাদের (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল্স-ইপিআর এবং ইষ্ট বেঙল রেজিমেন্ট-ই বি আর) দখলে। কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর একটা কনভয় চট্টগ্রাম দখল করতে আসবে, এমন সংবাদের ওপর ভিত্তি করে পাক বাহিনীর গতিপথ রুদ্ধ করার জন্যই এই ব্যারিকেডের ব্যবস্থা। গুল আহমদ জুট মিল বরাবর দেওয়া হয়েছিল আরেকটা ব্যারিকেড।

সেদিন বিকেল নাগাদ ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড প্রায় জনশূন্য হয়ে যায়। রাস্তার পাশে মোড়ে মোড়ে উৎসুক জনতার জটলা। আমরা মসজিদ্দা স্কুলের বারান্দায় নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়ানো। এসময় রাস্তা দিয়ে কুচকাওয়াজ করে যাচ্ছিল খাকি পোশাক পরা আনসার বাহিনীর একটা দল। হঠাৎ দলনেতার হুইসেল শুনে দলটা চোখের পলকে লাফ দিয়ে রাস্তার ঢালে নেমে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। সাথে সাথে উৎসুক জনতা ছুটে পালাতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আত্মগোপনকারী দলটা রাস্তার পাশের আড়াল থেকে বেরিয়ে আবার সারিবদ্ধ হয়। তখন বোঝা যায় এটা ছিল ওদের মহড়া। এত উৎকণ্ঠা ও শঙ্কার মধ্যেও লোকজন একটা মজার খোরাক পায়।

বিকেলে আসরের আজানের খানিক পর খই ফোটার মত ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শোনা যায় গুল আহমদ জুট মিলের ওদিক থেকে। সেবারই অন্যান্য মানুষের সঙ্গে আমিও প্রথম বারের মত ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শুনি। তখনও ধারণা করতে পারিনি পরবর্তী মাসগুলোতে এই শব্দই আমাদের যুগপৎ শঙ্কা ও উদ্দীপনার উৎস হবে। লোকজন বেশিরভাগই বাজার এলাকা ছেড়ে দূরে সরে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানী সেনাভর্তি বড় বড় ট্রাক, অফিসার বহনকারী জিপের কনভয় মসজিদ্দা স্কুলের সামনের মোড় পেরিয়ে ব্যারিকেডের মুখোমুখী হয়, থেমে যায় কনভয়ের গতি। ট্রাক থেকে ঝুপঝুপ করে লাফিয়ে রাস্তায় নামে পাকিস্তানী সৈন্যরা। রাস্তায় আড়াআড়িভাবে ফেলে রাখা বড় গাছটা সরানোর জন্য নিজেদের শক্তি খরচ করতে নারাজ তারা। তাই রাস্তার পাশ থেকে তখনো পালিয়ে যায়নি এমন লোকজনকে ধরে লাথি মেরে নিয়ে যায় ব্যারিকেড সরানোর কাজে। দোতলা স্কুল ভবনের নিচের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখলেন প্রধান শিক্ষক এম এ মামুন। প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বশালী মানুষটি উত্তেজনায় অভ্যাসবশত হাত কচলাতে কচলাতে হয়তো ভাবছিলেন তাঁর পরবর্তী করণীয়গুলোর কথা।

কুমিরা বাজার সংলগ্ন খালের ওপর ছিল কাছিমের পিঠের মতো উঁচু একটা ব্রীজ, সেটার দক্ষিণপাশে ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান। এপাশে পাকিস্তানী বাহিনীর ব্যারিকেড সরানোর কাজ কতদূর হলো সেটা মসজিদ্দা স্কুল থেকে বোঝার উপায় ছিলনা। সেখানে কী ঘটছিল সে সম্পর্কেও আসছিল নানান পরস্পরবিরোধী খবর।

সূর্য ডুবে যাওয়ার পর গোধুলির ম্লান আলো যখন ধীরে ধীরে রাতের অন্ধকারের গহ্বরে ঢুকে যাচ্ছিল, ঠিক সে সময় কুমিরা ব্রীজের দিক থেকে একটানা গুলির শব্দ শুরু হয়। শুরু হয়ে যায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ। আমরা যারা নিরাপদ দূরত্ব থেকে যাবতীয় ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছিলাম, তারা সবকিছু ছেড়ে ফসলহীন মাঠের ওপর দিয়ে ছুটতে শুরু করি গুলির উৎস থেকে যতখানি সম্ভব আরো নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে ছুটতে ছুটতে স্বজন-বিচ্ছিন্ন মানুষের আর্তনাদ এবং চিৎকার আমাদের জীবনে প্রথমবারের মতো বিশ্বপ্রলয়ের অভিজ্ঞতার সঞ্চার করে। মাত্র কয়েকমাস আগে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে তীব্র সামুদ্রিক জলোচ্ছাস এবং সাইক্লোনেও বোধহয় মানুষ এতখানি অসহায় বোধ করেনি। ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে পরিবারের সবাইকে রেখে আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন এম এ মামুন। স্থানীয় থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে আত্মগোপন না করলে তাঁর ভাগ্যে কী ঘটতো, সেটা কারো অজানা নয়।

ছাব্বিশে মার্চ সন্ধ্যায় শুরু হওয়া যুদ্ধ সাতাশ তারিখ প্রায় দুপুর পর্যন্ত চলেছিল। সেদিন দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় আমরা খবর পাই, সাতাশ তারিখ সকালে পাকিস্তানী বাহিনীর গুলিতে নিহতদের একজন ছিলেন মসজিদ্দা স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী কামালউদ্দীন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্কুলের এই ছাত্রটি ছাত্রলীগের সকল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। অসমর্থিত সূত্রে যতটুকু জানা যায়, কুমিরাতে পাকিস্তানী বাহিনীর অ্যামবুশের ওপর পাথর ছুড়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন কামালউদ্দীন। সে অবস্থায় পাকিস্তানী সেনার গুলিতে প্রাণ হারান তিনি। সেদিনের যুদ্ধে তিনিই ছিলেন স্কুলটির ছাত্রদের মধ্যে প্রথম শহীদ।

একটা তথ্য অনেকেই জানেন না, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তথা মুক্তিবাহিনীর প্রথম সম্মুখ যুদ্ধটা হয় কুমিরাতেই। সে হিসেবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কুমিরা একটা বিখ্যাত স্থান। পরবর্তী সময়ে দেরিতে হলেও এখানে মুক্তিযুদ্ধের একটা স্মারক স্তম্ভ স্থাপিত হয়েছে।

সেদিনের যুদ্ধ সাতাশ তারিখ প্রায় দুপুর পর্যন্ত চলেছিল। পাবিস্তানী বাহিনী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরোধ ভেঙে চট্টগ্রাম অভিমুখে চলে যায়। ফলে চট্টগ্রামের উত্তরাংশ তথা সীতাকুন্ড ও মিরেশ্বরাইতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং স্থানীয় জনগনের দখলে চলে আসে। এই অবস্থা চলে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের তিনদিনের মাথায় চট্টগ্রামের দিক থেকে উত্তরদিকে অগ্রসরমান পাকবাহিনী ক্রমাগত প্রতিরোধের সম্মুখে পড়ে। বিশ তারিখে মিরেশ্বরাই এলাকা দখলে রাখা বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর সম্মিলিত বাহিনী অগ্রসরমান পাকিস্তানী বাহিনীর গতি রোধ করার জন্য যে তুমুল লড়াই চালায়, তার তীব্রতা আঁচ করতে পারি ভোর থেকে শুরু হওয়া ক্রমাগত কামানের গোলার শব্দে। কামানের ভারি গম্ভীর শব্দে কেঁপে উঠছিল ঘরবাড়ি। সারাদিন ধরে থেমে থেমে গোলার আওয়াজ পাওয়া যায়, তারপর বিকেল নাগাদ ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। পরে জানতে পেরেছিলাম, সেই যুদ্ধে উভয় পক্ষের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। অবশ্য বেঙ্গল রেজিমেন্টের যোদ্ধারা পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়ে মস্তান নগরের দিকে নতুন ঘাঁটি গাড়ে। এভাবেই পাকিস্তানিরা ধীরে ধীরে পুনর্দখল করে নিচ্ছিল বাঙালি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাগুলো। তবে সেই দখলও যে দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারেনি, তার প্রমাণ পাওযা যাচ্ছিল ডিসেম্বরের প্রথম থেকে।