পরানের পদ্মবনে পদ্মটা ঠিক কোথায়, কালপুরুষ?

ধ্রুব সাদিকধ্রুব সাদিক
Published : 9 May 2023, 01:44 PM
Updated : 9 May 2023, 01:44 PM

একযুগেরও বেশি সময় আগে যখন সমরেশ মজুমদার পাঠ শুরু করি, কেন এবং কিভাবে পাঠ করেছিলাম সে-ব্যাপারে জ্ঞাত থাকলেও কোথা থেকে এই কথাসাহিত্যিকের ব্যাপারে জ্ঞাত হয়েছিলাম, আজ তা মনে করতে পারাটা দুরূহ ব্যাপার। সমরেশের ত্রিরত্ন--উত্তরাধিকার, কালবেলা আর কালপুরুষ--পাঠ করেছিলাম। কালবেলা পাঠ করা হয়েছে দুইবার। বলতে দ্বিধা নেই, সে-সময় উপন্যাস তিনটি ঘোরের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। রাত-দিন-ভোরের হিসেব ভুলে যাওয়া সময়টিতে অপার মুগ্ধতায় কল্পনায় গেঁথে থাকতো শীত-শীত আমেজ বিরাজিত স্বর্গছেঁড়া নামে এক শান্ত, নিরিবিলি অপরূপ চা বাগান; তার পাশে খুঁটিমারি জঙ্গলের উপর এলায়িত লাল সূর্য; আঙরাভাসা নদী; ভূটানের পাহাড় থেকে ভেসে আসা বিষণ্ণ মেঘদল আর আসাম রোড। দৃশ্যগুলো এমনই অপরূপভাবে প্রতিফলিত যে, মনে হয়েছিলো কোনো এক দক্ষ শিল্পী যেন চা বাগানটির স্নিগ্ধ পরিবেশের দৃশ্য তার শিল্পকর্মে নিপুণভাবে এঁকেছেন।

উত্তরাধিকার এমনই এক উপন্যাস। উপন্যাসটির মাহাত্ম্য এই যে দস্তুরমাফিক নায়ক-নায়িকার উপস্থিতি না থাকার পরও শুধু পরিবেশ, বর্ণনা, রূপরেখা, চরিত্র, সংলাপ প্রভৃতির কারণে মনে ও মগজে আলাদা এক ধরনের অনুভবের সৃষ্টি করেছিল। দাদা সরিৎশেখরের অনুশাসন, সংযম, অধ্যবসায় ও নিয়মানুবর্তিতা মেনে বিশু আর বাপীসহ ডুয়ার্সের চা বাগানের স্থানীয় মদেশিয়া বালকদের সাথে দৌড়ঝাঁপ করে বাল্যকাল কাটে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অনিমেষের। বাবা মহীতোষের সাথে বিস্তর দূরত্ব থাকলেও; মা মাধুরীর মাতৃস্নেহ বঞ্চিত; পিসির থেকে মা'র স্নেহময়তা পাওয়া বালকটির বেড়ে ওঠা এই সবকিছুকে ঘিরে।

মূলত, সমাজ-সংসারের নিপীড়িত, নিচুস্তরের মানুষ আর তাদের দাবিদাওয়া, তাদের স্বপ্ন, বাস্তবতা, রাজনীতি প্রভৃতি নিয়েই কাজকারবার করেছেন সমরেশ মজুমদার। মানুষের জীবন, জীবনের কাহিনীকে নানা ভাব ও ভঙ্গি থেকে আলোকপাত করেছেন তিনি। ফলে অনিমেষের শৈশব থেকে তারুণ্যের শুরুটা বিশদভাবে উঠে আসা উত্তরাধিকার আজও আমাদের কল্পনার চোখে ফিরিয়ে আনে সুপ্ত প্রেম থাকা খেলার সাথী সীতা, ভবানী মাস্টার, অবাঙালি ঝাড়িকাকুর স্নেহ, রম্ভা, উর্বশী, মেনকা, তপু, মন্টু, তপনসহ নানান চরিত্র আর তাদের জীবন। আজও ভাবনায় আসে: বিরামবাবু, নিশীথবাবু, প্রিয়তোষদের থেকে রাজনৈতিক বোধ পাওয়ার আগেই তো আসলে অনিমেষের রাজনৈতিক বোধ আসে। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় প্রথম সে ‘বন্দেমাতরম্‌’ শব্দটি শোনে; কিন্তু যদিও শব্দটির অর্থ সে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারে না, এর ধ্বনি-ব্যঞ্জনা তো ওর মনে রেখাপাত করেই।

উত্তরাধিকার-এর অনিমেষের বালক মনের প্রশ্ন, দৃষ্টিভঙ্গি এই সবকিছু স্বয়ং জলপাইগুড়ি জেলার ভূমিপুত্র সমরেশ মজুমদারের জীবনকথা। জলপাইগুড়ির গয়েরকাটায় জন্মেছিলেন, পাঠশালায় পড়েছিলেন, শুধু সেখানে গেলেই তার মন ভালো হয়ে যেতো। ওখানকার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার কালে মানুষজন জিজ্ঞেস করতো কেমন আছেন--এইসব স্মৃতি মাঝে মাঝে তার মনের মধ্যে স্মৃতির ঢলও নামাতো। তার সাহিত্যে বারবার ফিরে এসেছে উত্তরবঙ্গের মানুষ, পাহাড়, নদী, পথঘাট ইত্যাদি। প্রান্তে বেড়ে ওঠা মানুষ তিনি, ফলে প্রান্ত আর কেন্দ্রের মধ্যকার বিস্তর তফাতটা তার কাছে অনায়াসে প্রতিভাত হবে স্বাভাবিকভাবেই। মাত্রই ইংরেজদের শাসন থেকে মুক্ত হওয়া ভারতের একটি প্রান্তিক অঞ্চলের প্রারম্ভিক সময়টাকে ভিত্তি করে লেখা উত্তরাধিকার-এ আমরা তার প্রতিফলন দেখতেও পাই। সর্বত্র ভাঙাগড়ার কালে একটি প্রান্তিক অঞ্চলের শিশুর দ্বারা ঔপন্যাসিক প্রথম স্বাধীনতা দিবসে পতাকা উত্তোলন করান। কারণ  তিনি কেন্দ্রের বদলে প্রান্তকেই মূল জ্ঞান করেন। সমরেশ অবশ্য বলেছিলেন, সাধারণ মানুষ কংগ্রেস থেকে মোহমুক্ত হতে পারলেও তাদের বিরোধীদের দলবদ্ধ না-হতে পারাটাই তিনি কিশোর অনিমেষের চোখ দিয়ে দেখাতে চেয়েছিলেন।

বড় পটভূমিতে লেখা সমরেশ মজুমদারের প্রথম কাজ উত্তরাধিকার। কিন্তু উপন্যাসটা লিখতে গিয়ে তার মনে হয়েছিল তিনি আর পারছিলেন না। ফলে এক আন্দোলনের দিন উত্তাল কলকাতায় এসে পুলিশের গুলিতে অনিমেষকে গুলিবিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে উপন্যাসটি শেষ করেছিলেন। কিন্তু নাছোড় পাঠকদের চাওয়ায় এই প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন কালবেলা এবং কালপুরুষ৷ এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছিলেন, ‘কালবেলা-র অনিমেষের চরিত্রে শৈবালের কিছুটা ছায়া পড়েছিল।' কিন্তু কে এই শৈবাল মিত্র? শৈবাল মিত্র ছিলেন সমরেশের সহপাঠী। ১৯৬০ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজের প্রথম বর্ষে পড়ার সময় তিনি একটি খাতা এগিয়ে দিয়ে সমরেশ মজুমদারকে বলেছিলেন, ‘দেখ তো, এটা কবিতা হয়েছে কি না!’

সেদিন শৈবালকে সত্যিই কিছু বলতে পারেননি সমরেশ। কিন্তু এরপর কালবেলা-য় আমাদের যা দেখিয়েছেন তা এক অস্থির সময়ের বিস্তৃত পটের স্থির ছবি। অনিমেষ-মাধবীলতার জীবনের চড়াই-উৎরাই, উত্থান-পতনের কাহিনী ঘিরে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক এবং সামাজিক নিখুঁত চিত্র এই উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে। মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি থেকে সরে এসে অনিমেষ যোগ দেয় নকশাল আন্দোলনে। কিন্তু কখন সে যোগ দেয়! এই প্রশ্নটাই আজ ঘুরপাক খেয়েছিলো। যদিও হন্তদন্ত হয়ে খুঁজছিলাম কিন্তু বিশেষ বেগ পেতে হয়নি খুঁজে পেতে। সুবাস বলে, 'অনিমেষ আমরা একটা আগুন জ্বালাতে চাই। যে আগুনে আমাদের নকল চামড়ার খোলস পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, একটা নতুন ভারতবর্ষ নিজের পায়ে দাঁড়াবে শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে।' এরপর অনিমেষ কয়েক পাতার একটি লিফলেট কয়েকবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আগাগোড়া পাঠ করে আর শিরায় শিরায় টের পায় তার মধ্যে বাজছে নতুন শব্দ। এতদিন যে বিক্ষিপ্ত মানসিকতায় একই ঘোলাজলে সে পাক খাচ্ছিল তা থেকে সে ছিটকে বেরিয়ে আসে:

“ভারতবর্ষের বর্তমান কমিউনিস্ট পার্টিগুলো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের অতীত প্রতিশ্রুতিগুলো বিস্তৃত হয়ে ঔপনিবেশিক সংসদীয় কাঠামোয় নিজের মানানসই করে নিয়ে রাজ্য সরকার পাওয়ার জন্য বেশি মন দিয়েছেন। এর প্রতিক্রিয়া হয়েছে তরুণ কমিউনিস্টদের মধ্যে। আমরা ভারতবর্ষের অতীত বিপ্লবী পর্বের (তেভাগা সংগ্রাম ও তেলেঙ্গানার সশস্ত্র আন্দোলন) উৎস থেকে প্রেরণা নিয়ে নতুনভাবে বিপ্লব পরিচালনা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। যেহেতু তৃতীয় বিশ্বে জনগণের মধ্যে সবচেয়ে শোষিত ও পীড়িত অংশ কৃষক সমাজ এবং যেহেতু এ অঞ্চলে অতীতে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে এই কৃষক সাধারণেরই ছিল সর্বাধিক অগ্রণী ভূমিকা, তাই আমাদের এই নতুন বিপ্লব এই অবহেলিত শ্রেণীর পাশে দাঁড়াব আমরা।

তৃতীয় বিশ্বে বিল্পবের কেন্দ্রস্থল গ্রাম। এই তত্ত্বকে আরও একধাপ এগিয়ে লিনপিয়াও সিদ্ধান্তে এসেছিলেন য়ুরোপ ও আমেরিকা শহরের মত, আর আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকা এই পৃথিবীর গ্রামাঞ্চল। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার তত্ত্ব প্রয়োগ করে তিনি গণমুক্তির সংগ্রামকে জোরদার করতে যে আহ্বান জানিয়েছেন আমরা সর্বান্তঃকরণে তা সমর্থন করি।

আমাদের দেশের ইতিহাস হচ্ছে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও সামান্তবাদী শোষণের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের বীর কৃষক শ্রেণীর বিরামহীন সংগ্রামের ইতিহাস। ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যার শতকরা পঁচাত্তর ভাগই হলেন কৃষক এবং এরাই সবচেয়ে বেশি শোষিত। তাই সশস্ত্র কৃষক গেরিলা দল সংগঠিত করে গ্রামে গ্রামে অঞ্চলভিত্তিক ক্ষমতা দখল করতে হবে। গত দুই শতকে কৃষক আন্দোলনের অনুপ্রেরণা আমরা কাজে লাগাবো। সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা সিধু-কানু এই কৃষক বিদ্রোহের পূর্বসূরী।

সংগঠন পর্যায় সম্পূর্ণ হলে কৃষক গেরিলার দল সশস্ত্র সংগ্রামের ছোট ছোট ঘাটিগুলোকে বিস্তৃত করে জনযুদ্ধের প্রচণ্ড ঢেউ সৃষ্টি করতে পারবেন, গড়ে তুলবেন গণফৌজ, যে গণফৌজ দ্বারা গ্রামাঞ্চলে চার পাহাড়ের প্রতিক্রিয়াশীল শাসনকে উচ্ছেদ করবে, শহরগুলোকে ঘিরে ফেলে দখল করে নেওয়া হবে এবং সমগ্র দেশে গণতান্ত্রিক একানয়কত্ব কায়েম করে দৃঢ়তার সঙ্গে তাকে সর্বহারার এই শ্রেণীর কর্মীদের শ্রেণীচ্যুত হয়ে ভূমিহীন ও গরীব কৃষকের পাশে গিয়ে লড়াই করতে আহ্বান জানানো হচ্ছে।’

লড়াইটা যেহেতু নিজেদের সঙ্গে নিজেদের তথা শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের আর অধিকার যেহেতু কেউ হাতে তুলে দেয় না, অনিমেষ মনে করতেন ক্লীব সমাজ ব্যবস্থা এবং মেরুদণ্ডহীন লোভী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চুরমার করে দেওয়ার জন্য সংগঠিত শক্তি দরকার আর গ্রামের কৃষকদের সংগঠিত করেই সেটা সম্ভব। স্বার্থপর মানুষ যারা বিভিন্ন পার্টির চূড়ায় দিনের পর দিন অধিষ্ঠিত থাকেন, তাদের ছুঁড়ে ফেলে না দিতে পারলে কখনই মানুষের স্বাধীনতা আসে না বলেও মনে করতেন অনি।

কালবেলা সেই উপন্যাস যেখানে নির্দিষ্ট একটি বিপ্লবের কথা বলা আছে যদিও কিন্তু যে অন্তর্নিহিত বিপ্লবের কথা উল্লেখ আছে সে বিপ্লবের আর এক নাম মাধবীলতা। মাধবীলতা! মাধবীলতা য়ুনিভার্সিটিতে আসেনি। কেন আসেনি? আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মাধবীলতা ভালবাসে অনিমেষকে। ভালবাসার জন্য সে ঘর ছাড়ে, পরিবার-পরিজন ছাড়ে। সে চাকরি জোটায়। 'আমাদের এখানে মেয়েরা বিয়ে করে না, তাদের বিয়ে দেওয়া হয়', কিন্তু মাধবী এসব হওয়া-দেওয়া বিয়ের কোনোটাতেই নাই৷ মাধবীলতার তো বিয়েই হয় না। জৈবিক কামনায় তাড়িত নয় যদিও কিন্তু বিয়ে না করেই সে জন্ম দেয় অর্ককে। কালপুরুষ-এর অর্ক। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে শুধু নির্যাতিত হয় তাই নয়, অমানুষিক নির্যাতনে অনিমেষ শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। বস্তিতে সন্তানসহ আবাস নেয়া মাধবীর অধিকারবোধ কতটা প্রবল, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায় অনিমেষ জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর। মাধবীলতা সেই নারী যার মিছিলের ধনকে চিলে খেতে পারে না। জীবনযুদ্ধে যে পরাজিত হয় না।

৮১ বছর। দীর্ঘ আয়ুই বটে। রবীন্দ্রনাথের সমানই আয়ু নিয়ে দুনিয়ায় এসেছিলেন সমরেশ। সাতকাহন, গর্ভধারিণী, উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ প্রভৃতির স্রষ্টা আবাস নিলেন অলোকলোকে। কেবলই নক্ষত্রের পতন হয়৷ লেখাটি শেষ করার আগে সাম্প্রতিক সময়ে তার বলা একটি কথা উল্লেখ করতে ইচ্ছে হলো ক্ষমতালোভীদের উদ্দেশ্য করে এই বলে যে পরানের পদ্মবনে পদ্মটা ঠিক কোথায় আপনাদের: 'কালবেলা যখন লিখেছিলাম তখন ভরা বামফ্রন্ট এবং সিপিএম-এর চতুর্দিকে দুর্ণাম। লেখার সময় আমাকে কেউ কেউ বলেছিল তোমায় মারবে। মানে মেরে ফেলবে। কিন্তু কেউ কিছু করেনি। আর ২০১২-১৩ সালে যখন মৌষলকাল লিখলাম তখনও কিন্তু আমাকে কেউ কিছু বলেনি। তবে এখন লিখলে কী হত জানি না।