এদুয়ার্দো গালেয়ানোর যে-কোনো লেখাই ভিন্নধর্মী জাদুতে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। তার ঝুলি বিস্ময়ের ভান্ডারে পরিপূর্ণ। তাকে কখনই একটি নির্দিষ্ট ধারার সাহিত্যিক হিসেবে বিবেচনা করা সম্ভব নয়। মানুষ তাকে “অনুভূতি-চিন্তা-ভাষা”র উদ্ভাবক হিসেবে কৃতিত্ব দেয়, তবে গালেয়ানোর কাছে এ হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠতা এবং আত্মনিষ্ঠার বিশেষ সমন্বয়।
তার হাতে ইতিহাস, রাজনীতি, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, সাংবাদিকতা ইত্যাদি জীবন্ত হয়ে উঠেছে, মানুষের সাথে মিশে গেছে। গালেয়ানোর ভাবনাগুলো, দৈনন্দিন উপলব্ধিগুলো অনেকটা গদ্য-কবিতার মতো। কেউ কেউ যুক্তি দেন, সেগুলি আসলে ছোট গল্প, প্রবন্ধ, জীবন নিয়ে সরস চিন্তার ক্ষুদ্র বীজ। তিনি যেমন সাহিত্যের সাথে রাজনীতির সংযোগ স্থাপন করেছেন, তেমনি ইতিহাসকেও সাহিত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। রাজনীতি তার হাতে কাব্যিক হয়ে ওঠে, যেখানে কবিতা রাজনীতিকে ভয় পায় না।--আসাদ মিরণ
কেউ না
মাছিরা নিজেদের জন্য একটি কুকুর কেনার স্বপ্ন দেখে, এবং তাদের কেউই দারিদ্র থেকে পালানোর স্বপ্ন দেখে না: সেই কোন এক জাদুকরী দিনে, হঠাৎ করেই সৌভাগ্য তাদের উপর এক পশলা বর্ষা হয়ে ঝরে পড়বে-বর্ষায় বালতি ভরে উঠবে। কিন্তু সৌভাগ্য গতকাল, আজ কিংবা আগামীকাল বর্ষা হয়ে আসে না, কখনোই আসে না। এমনকি সৌভাগ্য গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টির ফোঁটা হয়েও পড়ে না, নগণ্য জনরা যতই কাকুতি-মিনতি করে ডাকুক না কেন, এমনকি তাদের বামহাতের তালু চুলকালেও সে আসে না, অথবা তারা ডান পা ফেলে দিনের শুরু কিংবা ঝাড়– দিয়ে নতুন বছর আরম্ভ করলেও না।
নগণ্য জনরা: কারও সন্তান নয়, কোন কিছুর মালিক নয়।
নগণ্য জনরা: কেউ নয়, কারোর নয়, তারা খরগোশের মতো দৌড়ায়, জীবনের মধ্যে মারা যায়, সবকিছুতেই পেঁচিয়ে যায়।
যারা নগণ্য, যদিও তারা তা নয়-
তারা ভাষা জানে না, কিন্তু উপভাষায় বলতে পারে।
তাদের ধর্ম নেই, কিন্তু অন্ধবিশ্বাস আছে।
তারা শিল্প সৃষ্টি করতে পারে না, কিন্তু হস্তশিল্প পারে।
তাদের সংস্কৃতি নেই, কিন্তু লোককাহিনী আছে।
তারা মানুষ নয়, কিন্তু মানব সম্পদ।
তাদের মুখ নেই, কিন্তু বাহু আছে।
তাদের নাম নেই, কিন্তু সংখ্যা আছে।
তারা পৃথিবীর ইতিহাসে আবির্ভূত না হলেও, পুলিশের লাল খাতায় তাদের নাম আছে।
নগণ্য জন, যাদের বুলেটের সমান মূল্যও নেই, সেই বুলেটই তাদের হত্যা করে।
নারীর জানালা
সেই নারীটি এক গোপন কক্ষ।
তার কোণে, সে ভাষা রাখে এবং ভূত লুকিয়ে রাখে।
শীতের রাতে, সে উষ্ণতা দেয়।
যারা সেখানে প্রবেশ করে, তারা বলে, আর কখনও ছেড়ে যাবে না।
আমি তাকে ঘিরে থাকা গভীর পরিখা অতিক্রম করি।
সেই ঘরে আমার বসতি হবে।
তার ভিতরে সেই সুরা অপেক্ষা করছে যে আমাকে পান করবে।
খুব মৃদুভাবে আমি দরজায় টোকা দেই, এবং অপেক্ষা করি।
আগুন
প্রতিটি মানুষ তার নিজ আলোয় জ্বলজ্বল করে
অন্য সবার মাঝে।
দুটি আগুন কখনোই সমান নয়।
কোনটা বড়, কোনটা আবার ছোট,
আগুন সব রঙের হয়।
নিরিবিলি ধরনেরও আগুন মানুষ হয়,
যারা বাতাসের কথাও জানে না,
কখনো সেখানে পাগলাটে আগুন মানুষও থাকে,
যারা স্ফুলিঙ্গে বাতাস পূর্ণ করে।
কিছু আগুন, নির্বোধ আগুন,
না তারা আলো দেয়, না তারা পোড়ায়;
কিন্তু তারা জীবনকে এতটাই বাসনায় পোড়ায় যে
চোখের পলক না ফেলে তুমি তাদের দিকে তাকাতে পারবে না,
যে কাছে আসে, সেই কেবল আলোকিত হয়।
পদ্ধতি
কর্মকর্তারা কাজ করেন না।
রাজনীতিবিদরা ভাষণ দেন, কিন্তু কিছুই বলেন না।
ভোটাররা ভোট দেন, কিন্তু নির্বাচিত করেন না।
মিডিয়া ভুল খবর দেয়।
স্কুলগুলি উপেক্ষা করতে শেখায়।
বিচারকরা ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করেন।
সেনাবাহিনী তার দেশবাসীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত।
পুলিশ অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করে না, কারণ তারা অপরাধ করতে ব্যস্ত।
দেউলিয়া সামাজিকীকরণ করা হয়, মুনাফা বেসরকারীকরণ করা হয়।
টাকা মানুষের চেয়ে মুক্ত।
মানুষ পণ্যের সেবায় ন্যস্ত।
বিশ্বব্যাপী ভয়
যারা কাজ করে, তাদের চাকুরি হারানোর ভয়,
আর যারা কাজ করে না, তাদের কখনই চাকুরি খুঁজে না পাওয়ার ভয়।
যে ক্ষুধাকে ভয় পায় না, তার খেতে ভয়।
গাড়ি চালকের হাঁটার ভয়, পথচারীর ধাক্কার ভয়।
গণতন্ত্র মনে করতে ভয় পায়, ভাষা বলতে ভয় পায়।
সাধারণ মানুষের সেনাবাহিনী ভয়, সেনাবাহিনীর অস্ত্রের অভাবের ভয়।
আবার অস্ত্রের ভয়, যদি যুদ্ধ না হয়।
এটা ভয়ের সময়।
পুরুষের হিংস্রতায় নারীর ভয় এবং নির্ভীক নারীতে পুরুষের ভয়
ডাকাতের ভয় আর পুলিশের ভয়।
তালা ছাড়া দরজার ভয়।
ঘড়ি ছাড়া সময়ের ভয়।
টেলিভিশন ছাড়া শিশুর ভয়।
রাতে বড়ি ছাড়া ঘুমাতে ভয় আর সকালে বড়ি ছাড়া ঘুম থেকে ওঠার ভয়।
একাকিত্বের ভয় এবং ভিড়ের ভয়।
কী ছিল, সেই ভয়।
কী হবে, সেই ভয়।
মৃত্যুর ভয়
বেঁচে থাকার ভয়।
ভয়ের শাসন
আমরা ভয় নিয়ন্ত্রিত একটি পৃথিবীতে বাস করি। ভয় সেখানে শাসন করে, ক্ষমতা ভয়কে গ্রাস করে, ভয় ছাড়া ক্ষমতা কী হতে পারে? ভয় ছাড়া যে ক্ষমতা, সে নিজেই নিজেকে চিরস্থায়ী করার জন্য জন্ম নেয়।
ক্ষুধার প্রাতঃরাশের ভয়।
নীরবতার ভয়, যা রাস্তা স্তব্ধ করে দেয়।
ভয় হুমকি দেয়-
ভালোবাসলে এইডস হবে।
ধূমপান করলে ক্যান্সার হবে।
শ্বাস নিলে দূষণ হবে।
পান করলে দুর্ঘটনা ঘটবে।
খেলে কোলেস্টেরল হবে।
কথা বললে বেকার হবে।
হাঁটলে আক্রমণের শিকার হবে।
ভাবলে মন খারাপ হবে।
সন্দেহ করলে পাগলামি হবে।
অনুভব করলে নিঃসঙ্গ থাকবে।
সময় বলছে
আমরা সময়ের।
আমরা তার পা এবং মুখ।
সময় আমাদের পায়ে পায়ে হেঁটে চলে।
আজ অথবা আগামীকাল,
তুমি জানো, সময়ের বাতাস পথ মুছে ফেলবে।
অনস্তিত্বের যে যাত্রা, তা কি কারো পদচিহ্ন?
সময়ের মুখ যাত্রার কথা বলে।