অনেকক্ষণ পর চায়ে একবার চুমুক দিয়ে স্যার জানান, পুরো রবীন্দ্রসাহিত্যে ঘোড়ার অনুপস্থিতির কথা।
Published : 21 Jul 2023, 02:42 PM
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ক্যাম্পাসে একটা লোককে দেখতাম হাঁটতে, নিঃসঙ্গ। নীলক্ষেত থেকে টিএসসির দিকে, কখনও মহসীন হলের কোয়ার্টার থেকে কলাভবনের দিকে তিনি সদয় হৃদয় নিয়ে কোমল পা ফেলে হাঁটতেন। আমি শুধু এইটুকু জেনেছিলাম যে তিনি ইংরেজির অধ্যাপক। কিন্তু বেশ কিছুকাল পর জানলাম তিনিই কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন (৪ জানুয়ারি ১৯৫০-১৬ জুন ২০১৩)।
স্যারের নামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় স্কুলজীবনে। আমার বড় বোন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী হওয়ায় তার লেখা একটা বই আমাদের বাসায় ছিল- এডিথ হ্যামিল্টনের মিথলজি অনুসরণে লেখা চিরায়ত পুরাণ। ফ্রেন্ডস বুক কর্নারের এ বইটির কল্যাণে আমি সেই কৈশোরেই জেনেছিলাম কিউপিড-সাইকি কিংবা পিরামাস-থিসবির প্রেমের কাহিনি। পড়েছিলাম ট্রয়ের যুদ্ধ, ওডিসির কাহিনি, নার্সিসাস, টাইটান ও ঈদিপাস ইত্যাদি চরিত্র সম্পর্কে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে দূর থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম একজন সদ্গুরুর দিকে একজন বিদ্যার্থীর আর্তি নিয়ে। তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক না হয়েও তাই আলো বহন করা প্রমিথিউসের মতো।
কবির সঙ্গে খুব কমই কথা হয়েছিল আমার। প্রথম আলাপ হয় তার কবিতায় ঘোড়ার উপস্থিতি নিয়ে। স্যার হাঁটছিলেন, আমি পেছন থেকে খানিক দৌড়ে গিয়ে তার সঙ্গে প্রায় একই গতিতে এগুতে থাকলাম। ঘোড়ার প্রসঙ্গ আসতেই আমাকে নিয়ে টিচার্স ক্লাবে ঢুকলেন। ক্লাবের বারান্দায় দুজন দুই কাপ চা নিয়ে বসে আছি। শেষ বিকেলের আলো আকাশে তার শেষ রঙ মেখে যাচ্ছে, শিরিষ গাছের ডালে ঝাঁক বেঁধে থাকা ইতস্তত কাকের দল থেমে থেমে ডাকছে। তারও অনেক উঁচুতে গোল হয়ে ধীরে চক্কর দিচ্ছে একদল চিল। স্যার সেইদিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কিছু বলছি না, স্যারও না। অনেকক্ষণ পর চায়ে একবার চুমুক দিয়ে স্যার জানান, পুরো রবীন্দ্রসাহিত্যে ঘোড়ার অনুপস্থিতির কথা। রবীন্দ্রনাথ শুধু একবার লিখেছিলেন, ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন’। কবি জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান ও আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতায় ঘোড়ার টগবগে উপস্থিতি তাকে উদ্বেলিত করেছিল।
খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতায় ‘ঘোড়া’ এসেছে বারবার। তিন রমণীর ক্বাসিদা (১৯৮৪) কবিতাবইয়ের নামকবিতায়- ‘পিপাসার জল নয়, হাতে নিয়ে জলের পিপাসা/ দীপ্ত এক অশ্বারোহী টেনে ধরে ঘোড়ার লাগাম’। ‘ঘোড়সওয়ার’ কবিতায়- ‘ঘোড়ার পায়ের খুরে বনভূমি বেঁধেছে রুমাল/ সেই কবে দিগন্তের তৃণক্ষেত্রে, কমলালেবুর পূর্ণ বাগানের পথে...’। পার্থ তোমার তীব্র তীর (১৯৮৬) কবিতাবইয়ের ‘কার অশ্বমেধ ঘোড়া’ কবিতায়- ‘উঠেছে ঘোড়ার মতো উজ্জ্বল আর্শির মতো ফেনা/ কারখানার চুল্লিগুলো বানিয়েছে টেরাকোটা মাটির মানুষ’। ‘কিহোতি’ কবিতায়- ‘এ পথে ঘোড়ার সম্মুখে নেই ফেরার পথিক, তবু ছেড়েছি ঘরের নিশ্চিত সুখ, পথ হলো ঘরদোর’। জীবনের সমান চুমুক (১৯৮৯) কবিতাবইয়ের ‘কৌন হ্যায়’ কবিতায়- ‘একই অশ্বে যায়, সওয়ারী সওয়ার/ দ্বারে বসে যমের বোনাই ক্ষণে ক্ষণে হাঁক দেয়, কোন হ্যায় যায়েগা কিধার?’ সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর (১৯৯২) কবিতাবইয়ের ‘বেহুলা বাংলাদেশ’ কবিতায়- ‘এই সেই রাজপথ যেখানে একদা আমি ছুটিয়েছি পিপাসার অশ্ব আমার/ এই রাজপথে প্রেমিকার হাত ধরে হেঁটে গেছি/ বাসনার পুষ্পহার নীবিতে...’।
যমুনাপর্ব (১৯৯৮) কবিতাবইয়ের ‘ঘোড়সওয়ার’ কবিতায়- ‘...দিগন্তের হে ঘোড়সওয়ার! আমাকে শেখাও চোরাগুপ্তার গোপন আর্ট/ ভোটের বাক্সে ফোটাবো কী করে হাজার ডাঁটার রজনীগন্ধা/ রজনীগন্ধা নলের ভেতরে বারুদ ঠাসা নিগূঢ় আর্ট!’ জন্মবাউল কবিতাবইয়ের ‘এস্ত্রোগন’ কবিতায়- ‘ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে আকাশ তার রঙ/ আর নিচে নগরীর রাজপথে কীরকম ঠমকে ঠমকে/ যায় লালগাড়ি, নীলবর্ণ ঘোড়ার সওয়ার...’। এমন আরও আরও উদাহরণ দেওয়া যাবে। কবি তার কবিতার অন্তর্যামী বইয়ে একটি প্রবন্ধই লিখেছেন ‘চিহ্নায়নের ঘোড়া’ নামে।
কোন একদিন আধুনিক-উত্তরাধুনিক প্রশ্ন আসতেই তিনি সুবক্তা হয়ে উঠেছিলেন, আমি ছিলাম একমাত্র শ্রোতা। আমি শুধু পোস্টমডার্নিজম নিয়ে সমীর রায়চৌধুরীর কিছু ধারণার কথা তার কাছে বলেছিলাম। সমীর রিলিজিয়নের সঙ্গে ধর্মের তফাৎ দেখিয়েছেন। স্যার বললেন, ‘কেবল উপমায় চোখ আটকে যাবে কেন!’ একইসঙ্গে সাহিত্যের অধ্যাপক, কবি, গদ্যকার ও সম্পাদকের মধ্যে সাহিত্য সমালোচক পরিচয়টুকুতেই বোধ করি তিনি তলোয়ারের মতো ধারালো ছিলেন। তলোয়ার খাপে ভরে ঘোড়ায় সওয়ার হওয়ামাত্র তিনি আবার ‘প্রার্থনায় নম্র’ কবি হয়ে উঠতেন- ‘আমাকে পাবে না প্রেমে, প্রার্থনায় নম্র হও পাবে/ কামে-ঘামে আমি নেই, পিপাসায় তপ্ত হও, পাবে’। আজ প্রায় এক যুগ পর স্যারের সঙ্গে যখন ফেইসবুক চ্যাট হিস্ট্রি খুলি, দেখি আমার একেকটি পাঠমুগ্ধতাও তিনি কীভাবে বিনয়ের সঙ্গে অনাকুল করে নিয়েছিলেন।
তারপর বোধ করি কবির সঙ্গে অনেককাল দেখা হয়নি। ২০১২ সালে আমার প্রথম কবিতার বই সোনালী রোদের সাঁকো প্রকাশিত হয়। ত্রস্ত পায়ে বইমেলায় ঘোরাফেরা করি, স্টলের দিকে যাই, কিছুক্ষণ বসি আবার উঠে যাই। এক লিটলম্যাগ সম্পাদকের অনুরোধে বইয়ের কয়েকটা কপি আমি তার স্টলে দিয়েছিলাম। মেলার বাকি কিছুদিন বাংলা একাডেমির লিটলম্যাগ চত্বরেই সময় কেটেছিল, বিশেষ করে সন্ধ্যার পর। কারণ ওই সময়টাতে কবি-লেখকরা লিটলম্যাগ চত্বরেই আড্ডা দিতেন। একদিন গিয়ে দেখি স্যার বাঁশের বেঞ্চিতে একা বসে আছেন উদাস মনে। কাছে গিয়ে আমার কাঁধব্যাগ থেকে তার লেখা কবিতার অন্তর্যামী, আধুনিক উত্তরাধুনিক ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (২০১০) বইটা বের করে সামনে বাড়িয়ে দিলাম- ‘স্যার, একটা অটোগ্রাফ দিন প্লিজ’।
স্যার বললেন, ‘আমি তো কয়েকদিন ধরেই তোমাকে দেখছি। তোমারও কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে, তাই না!’ স্যারের পেছনেই স্টলটা ছিল। আমি একটা বই টেনে এনে স্যারের হাতে দিলাম। স্যার পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকলেন। ভেতরের একটা পৃষ্ঠায় এসে থামলেন। আমি পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি, পৃষ্ঠাটার আড়াআড়ি কবিতার খন্ডাংশ ছাপা হয়েছে কেবল, বাকিটা ফাঁকা। ছাপা হওয়ার সময় কাগজের ওপর একটা গাছের পাতা উড়ে এসে পড়লে যেমন হবে, তেমন। আমি ভড়কে গেলাম। কিন্তু স্যার উল্লসিত হয়ে বললেন, ‘এইতো পেয়েছি! উত্তরাধুনিক কবিতা!’
আমি স্টল থেকে আরেকটা কপি এনে ওই একই পৃষ্ঠা খুলে দেখলাম। না, এখানে তো ঠিকই আছে। তার মানে স্যারের হাতের ওই কপিটাতে মুদ্রণজনিত সমস্যা হয়েছে। স্যার আমাকে আশ্বস্ত করলেন এবং ওই কপিটাই কিনে নিলেন। আমার অটোগ্রাফ নিলেন। তারপর আমার হাতে থাকা নিজের লেখা বইটাতেও অটোগ্রাফ দিলেন। জীবনে প্রথমবারের মতো স্বচক্ষে কাউকে আমার নামের আগে ‘কবি’ লিখতে দেখলাম।
ত্রিশালের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার পরও তিনি যখন ঢাকা আসতেন কখনও কখনও দেখা হয়ে যেতো ক্যাম্পাসে। ডায়াবেটিস ছিল বলে ততদিনে বেশ হাঁটাহাঁটির অভ্যাস বেড়েছে তার। কখনও টিএসসি, শহীদ মিনার, ফুলার রোড ঘুরে আমরা ঢুকতাম টিচার্স ক্লাবে। আর কেউ থাকতো না। অন্য শিক্ষকরা যেমন সহকর্মীদের সঙ্গে প্রাণোচ্ছল আড্ডা দিতেন, তাকে তেমন দেখতাম না। আমার মতে, খুব নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতেন কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন। ততদিনে তার বেশকিছু বইও আমার পড়া হয়ে গেছে। তার প্রসন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে তার কবিতার প্রতিধ্বনিই শুনতে পেতাম যেন।
নিজের অনূদিত বই বিশ্বকবিতার সোনালি সিংহদ্বার (২০০৫) এর ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, “কবিতাকে করেছি জীবনের ধ্রুবতারা। বিশ্বকবিতার অনুরাগ ঘুরিয়েছে এক সাহিত্য থেকে অন্য সাহিত্যে, এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায়। কবিতা লিখছি দীর্ঘকাল; কবিতা পড়িয়েছি শ্রেণিকক্ষে তিন দশকের বেশি সময়; মূলত ইংরেজি কবিতার সাহচর্য খুলে দিয়েছে বিশ্বকবিতার সিংহদ্বার।...কবিতা মানুষের আজন্ম সহচর, তার অমরতার অভিজ্ঞান। জয় হোক কবিতার।”
স্যার যখন মারা গেলেন তখন ছিল আষাঢ়। বৃষ্টিধোয়া ক্যাম্পাস। রাস্তার কালো পিচগুলোতে বৃষ্টিতে ঝরে পড়া গাছের মরা ডাল আর পাতার ছড়াছড়ি। চারদিকে কামিনী কদমের ঘ্রাণ। বিকেলে স্যারকে নিয়ে আসা হলো বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে। আমি আর আমার অগ্রজ মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক ছুটলাম সেদিকে। কফিনের কাছে যেতে সাহস হলো না আমার। সিদ্দিক ভাই শিশুর মতো কাঁদতে শুরু করলেন। কবির সাদা কাফন থেকে যেন তারই কবিতার ঘ্রাণ ছড়াচ্ছিল- ‘বিদায় বন্ধু। মৃত্যুর তীর থেকে জীবনের সুস্থির প্রতিভূ তোমাকে বিদায়। ...নিবালাম এই দীপ, আকাশের চন্দ্রমল্লিকার নিবিড় সুবাসঘেরা আলোকিত ঘরে চলে যাই/ মরণ এমন দেশ যার ধুম্র আলিঙ্গন থেকে ফেরে না পথিক কোনো/ ফিরবো না আমি কোনোদিন...’।