আমির খসরুর গীতিকবিতা

সৈয়দ তারিকসৈয়দ তারিক
Published : 10 April 2023, 06:29 AM
Updated : 10 April 2023, 06:29 AM

ত্রয়োদশ শতকের ভারতে গুণবান কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন হজরত আমির খসরু। ১২৫৩ সালে জন্ম তার। বিভিন্ন রাজদরবারে রাজকবির ভূমিকায় সভাসদ ছিলেন তিনি। আবার তিনি ছিলেন হজরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার প্রিয় মুরিদ। বলা হয়, তার এক পা থাকত রাজদরবারে, অন্যটি নিজাম উদ্দিনের খানকায়। এই দ্বৈততা বড় বিস্ময় জাগানিয়া। 

সঙ্গীতে আমির খসরুর অবদান বিশাল। কাওয়ালি ও গজল গানের প্রবর্তক তিনি। বহু রাগের স্রষ্টা। তবলা ও সেতার তিনিই উদ্ভাবন করেন। মিশ্রভাষা উর্দুরও তিনিই জনক বলে বর্ণনা আছে। মূলত ফারসি ও হিন্দিতেই অধিকাংশ রচনা তার। তুর্কি, আরবি এইসব ভাষায়ও দখল ছিল তার।

নিজাম উদ্দিনের যেমন তিনি প্রিয় ছিলেন, তেমনি তারও গুরুপ্রেম ছিল বিস্ময়জাগানিয়া। বিশেষ করে তার কবিতায় ও গানে নিজামপ্রশস্তি ও গুরুবাদ যেভাবে অভিব্যক্ত হয়েছে তা অতুলনীয়। 

১৩২৫ সালে সালে তিনি প্রয়াত হন। তার মাজার শরিফ দিল্লিতে তার মুরশিদ নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার পাশেই। এখানে কবি সৈয়দ তারিক কর্তৃক বাংলায় তার রচিত কিছু গীতিকা অনূদিত হলো ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে।

আজ রাঙ হ্যায় রি

[গুরুপ্রেমের অপূর্ব নিদর্শন এই গানটি। নুসরাত ফতেহ আলি শাহ এটি গেয়েছেনও বড় চমৎকার। ]

মাটির প্রদীপ ওগো, শোনো অনুরোধ,

আজ রাতে প্রাণনাথ আসবেন নিকটে আমার

জেগে থেকো তুমি আর জ্ব'লো সারারাত।

রঙ ঝলমলাচ্ছে আজ, মা গো,

রঙ ঝলমলাচ্ছে

আমার খাজার ঘরে 

রঙ ঝলমলাচ্ছে আজ, মা গো, 

রঙ ঝলমলাচ্ছে।

আমার খাজার ঘরে রঙ ঝলমলাচ্ছে,

প্রাণনাথ এসেছে আমার ঘরে আজ। 

রঙ ঝলমলাচ্ছে আজ, মা গো, 

রঙ ঝলমলাচ্ছে।

রাসুলের পাক বর্ণ এই রঙ,

মাওলা আলির হাতে তৈরি এই রঙ,

এই রঙে ওড়না রাঙবে যার

ভাগ্যবান সেই জন।

রঙ ঝলমলাচ্ছে আজ, মা গো, 

রঙ ঝলমলাচ্ছে।

আমার প্রিয়র ঘরে

ওগো সখি, আমার প্রিয়র ঘরে

রঙ ঝলমলাচ্ছে আজ, মা গো, 

রঙ ঝলমলাচ্ছে।

পেয়েছি আমার পীর

নিজাম উদ্দিন আউলিয়াকে,

পেয়েছি আমার পীর

সাবির আলাউদ্দিন আউলিয়াকে,

নিজাম উদ্দিন আউলিয়া,

আলাউদ্দিন সাবির।

যখনই তাকাই, দেখি,

আমার সাথেই রয়েছে সে;

মা গো, রঙ ঝলমলাচ্ছে আজ,

রঙ ঝলমলাচ্ছে।

অনেক ঘুরেছি আমি কাছে-দূরে শুধু খুঁজে খুঁজে,

আহা, অনেক ঘুরেছি আমি কাছে-দূরে শুধু খুঁজে খুঁজে;

তোমার রঙেই আমি ধরা খেয়ে গেছি, ওগো নিজাম উদ্দিন, 

তোমার রঙেই আমি পুরোপুরি হয়েছি আটক।

আর যতকিছু সব ভুলে গেছি, মা গো,

এমনই রঙ যে এটা, আগে দেখি নাই;

মাহবুবে এলাহি, ওগো, খোদার প্রেমিক,

এমনই রঙ যে এটা, আগে দেখি নাই।

খসরু, বাসর রাত জেগে কাটিয়েছি

প্রিয়তম স্বামীর সাথেই,

আমার শরীর আর আত্মা প্রিয়র

এক রঙে হয়েছে রঙিন;

এমনই রঙ যে এটা, আগে দেখি নাই,

মাহবুবে এলাহি ওগো, খোদার প্রেমিক,

এমনই রঙ যে এটা, আগে দেখি নাই।

গোকুল দেখেছি আমি, মথুরা দেখেছি

পূর্ব দেখেছি আমি, পশ্চিম দেখেছি

উত্তর দেখেছি আমি, দক্ষিণ দেখেছি

কোথাও দেখিনি আমি এই রঙ, যে-রঙ তোমার,

এমনই রঙ যে এটা, আগে দেখি নাই;

মাহবুবে এলাহি, ওগো, খোদার প্রেমিক,

এমনই রঙ যে এটা, আগে দেখি নাই।

ঘুরেছি জগৎজুড়ে, খোদার কসম,

তোমার মতন রূপ দেখিনি কোথাও,

দেখেছি অনেক মুখ অপরূপ, দারুণ সুন্দর,

পাইনি একটাকেও তোমার সঙ্গে তুলনার।

জগৎ জগৎ জগৎ জগৎ

জগৎ করেছে উজ্জ্বল

খাজা নিজাম উদ্দিন

পুরো জগৎ করেছে উজ্জ্বল

আলাউদ্দিন সাবির

পুরো জগৎ করেছে উজ্জ্বল।

বৃষ্টিধারা

বৃষ্টিধারায় মেঘেরা ঝরায় মাধুরিমা

ঝরায় মাধুরিমা

মেঘেরা ঝরায় মাধুরিমা...

খাজেগানদের দরবারে

মেঘেরা আজকে দেখ করুণাধারায় কেমন পড়ছে ঝরে,

মেঘেরা ঝরায় মাধুরিমা...

বৃষ্টিধারায় মেঘেরা ঝরায় মাধুরিমা

খাজা ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকর

কুতুব উদ্দিন কাকি

খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি

খাজা নিজাম উদ্দিন 

খাজা নাসির উদ্দিন চেরাগি।

আজ নাসির উদ্দিন চেরাগির বিখ্যাত মাশুক

আমার প্রেমিক হয়েছে

নিজাম উদ্দিন আউলিয়া জগৎকে উজ্জ্বল করেছে 

পুরো জগৎকে উজ্জ্বল করেছে 

সারা জাহানকে উজ্জ্বল করেছে।

তোমার চেহারা মেলে এরকম আর কেউ নাই

তোমার মুখের ছবি নিয়ে যাই সকল জায়গায়

এমনই রঙ যে এটা, আগে দেখি নাই;

মাহবুবে এলাহি, ওগো, খোদার প্রেমিক,

এমনই রঙ যে এটা, আগে দেখি নাই।

নিজাম উদ্দিন আউলিয়া জগৎকে উজ্জ্বল করেছে

সারা জাহানকে উজ্জ্বল করেছে

যেটাই সে চায় সেটা পূর্ণ হয়ে যায়

মা গো, রঙ ঝলমলাচ্ছে।

নমি দানামচে মঞ্জিল

আজব এক জায়গায় 

ছিলাম কাল রাতে।

প্রেমে আধেক-খুন-হওয়া 

লোকেরা ছিল আমার চারপাশে; মনোবেদনায় তারা

ঘুরে বেড়াচ্ছিল ইতস্তত।

পরির মতন 

এক রূপবতী ছিল,

শালপ্রাংশু ছিলো সে, 

গোলাপের মতো ছিল মুখ।

তার প্রেমিকদের হৃদয় নিয়ে সে নিষ্ঠুরভাবে খেলছিল 

ধ্বংসের লীলা। 

সেই জান্নাতি জলসায়

আল্লাহ নিজেই

কর্তা ছিলেন সমস্ত অনুষ্ঠানের;

ওহ খসরু, 

সেই মাহফিলে

নবিজিও প্রদীপের মতন

আলো ছড়াচ্ছিলেন।

চোখের দৃষ্টিতে

আমার চেহারা-পরিচয় সবকিছু নিয়ে নিয়েছ তুমি :

শুধু একবার তাকিয়ে : চোখের দৃষ্টিতে।

প্রেমের শরাব খাইয়ে মাতাল করেছ তুমি :

শুধু একবার তাকিয়ে : চোখের দৃষ্টিতে।

সবুজ বালা-পরা সুন্দর আমার কব্জিটা 

মুঠোয় নিয়েছ তুমি :

শুধু একবার তাকিয়ে : চোখের দৃষ্টিতে।

আমার প্রাণ দিয়ে দিলাম তোমাকে, 

ওগো আমার পোশাক-রাঙানো-জন,

তোমার রঙে রাঙিয়ে নিয়েছ আমাকে :

শুধু একবার তাকিয়ে : চোখের দৃষ্টিতে।

আমার সমস্ত জীবন তোমাকে দিয়ে দিলাম, 

ওগো নিজাম,

আমাকে তোমার বিয়ের কনে বানিয়ে ফেলেছ :

শুধু একবার তাকিয়ে : চোখের দৃষ্টিতে।

কয়েকটি কবিতাংশ

খেলছি আমি প্রেমের খেলা 

প্রিয়র সাথে,

জিতলে আমি : আমার তিনি

হারলে যাব তার হাতে।

তোমার প্রেম চৈতন্যের ওপাড়ের খবর নিয়ে আসে,

ধার্মিকদের আনত করে মদের গেলাসে। 

এসেছ মাতাল হয়ে ফিরে

মেহমান হয়েছিলে কার?

জানি তুমি চিনির স্ফটিক,

আখক্ষেতে ছিলে তুমি কার?

যে জন তোমার প্রেমে হয়েছে মাতাল

শরাবের নাই তার কোনো দরকার।

দাও এগিয়ে ওষ্ঠ-অধর

হৃদয়খানি দেব আমি;

কাবাব তোমার, মদও তোমার

সকল মালিক একাই তুমি।

খসরু, দেখছ, প্রেমের নদীটা

আজব ধারায় বয়,

যে-ই ঝাঁপ দেয় সে-ই ডুবে যায় :

ডুবলে সে পার হয়।

(ভিন্ন অনুবাদে)

খসরু হে, 

প্রেমের নদীতে আজব ঢেউ বয়ে যায়;

উপরে যে ভাসে, অবশ্যই ডুববে সে;

ডুবেছে যে সেই বেঁচে রবে।

যদি তারে দেখতে না পাই,

তার কথা ভেবে যেতে পারি :

ওতেই আমার সুখ হোক।

ভিখিরির কুঁড়েঘরখানি

আলোকিত করে দিতে হলে

মোমের চাইতে সেরা জ্যোৎস্নার আলোক।

প্রেমে ভবঘুরে হলো হৃদয় আমার,

এমনই থাকুক চিরকাল।

প্রেমে পড়ে দুর্দশায় পড়েছে জীবন,

হোক না কঠিন দশা আরও আরও তার।

লোকে ভাবে, তারা বেঁচে রয়েছে কেননা

আত্মা আছে তাদের ভিতরে;

কিন্তু আমি রয়েছি তো বেঁচে

কেননা আমার মাঝে ভালোবাসা আছে;

এবং শহিদ আমি প্রিয়র পীড়নে

(প্রেমিকজনার কাছে প্রিয়তর আর কিছু নাই

সেই বেদনার চেয়ে যা প্রিয় যা জাগায়)।

আমি হয়ে গেছি তুমি আর তুমি হয়েছ আমি,

শরীর আমি, আত্মা তুমি,

পরে আর কেউ বলতে পারবে না :

তুমি একজন আর আমি আরেকজন।

তারানা

আমি যার মাওলা

আলি তার মাওলা

আমি যার মাওলা রে...

দারা দিলে দারা 

দিলে দারে দানি

হুম তুম তানা 

নানা নানা নানা রে

ইয়ালালি ইয়ালালি ইয়ালা

ইয়ালাইয়ালা রে

আমি যার মাওলা....

চ্যশমে মাস্তে আজাবে

নুসরাত ফতেহ আলির কণ্ঠে ফারসি গানটি শুনেছেন অনেকেই। হজরত আমির খসরু এর রচয়িতা। ফারসি-আরবি-উর্দু এইসব ভাষার কোনোটাই জানি না আমি। কিন্তু সুফিভাবধারার বিপুল রচনা আছে এইসব ভাষায়। ইংরেজি অনুবাদে এগুলোর ভাবটুকু বোঝার চেষ্টা করি মাঝে-মাঝে। কখনও-বা সেইসব মণিমাণিক্য বাংলায় রূপান্তরের ইচ্ছা জাগে। কাব্যের অনুবাদের অনুবাদ -- কাজেই মূলভাষা যারা জানেন তারা মূলের সাথে এইসব ভাবানুবাদের আক্ষরিকতায় বিস্তর ব্যবধান পেতে পারেন। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাহিত্যে এটাই প্রচলিত। ওমর খৈয়ামের যে কটা অনুবাদ প্রচলিত আছে সেগুলোর কয়েকটা নিয়ে বসলেই বিষয়টা সম্যক মালুম হয়ে যায়। যাই হোক, আমার ওইসব পাঠ হতে বাংলায় রস পরিবেশনের এই কম্প্রহাতের প্রয়াস পাঠককে খানিক আনন্দ দিলে বা আরও পাঠে উৎসাহিত করলে আমার প্রয়াস সার্থকতা পাবে।

প্রচণ্ড বেদনায় ভেঙে খানখান হয়ে গেছি আমি,

ভাবাচ্ছন্ন তোমার দুটি চোখ আমাকে হতবুদ্ধি করে দিয়েছে,

জীবন আমার গেছে বরবাদ হয়ে,

তোমার পূজায় উৎসর্গিত ও অতিবাহিত সে।

*

আজব তোমার উল্লাসভরা চোখ,

আজব লম্বা চুল।

আজব মদের উপাসক তুমি,

আজব দুষ্ট প্রেমিক।

যখনই খোলে সে তলোয়ার,

সেজদায় আমি নত করি ঘাড়,

অনায়াসে যেন খুন হয়ে যেতে পারি।

আজব তার সে করুণা,

আজব আমার নিবেদন।

মৃত্যুকালের ছটফটানির ভিতর

দুচোখ আমার চেয়ে থাকে শুধু 

তোমার মুখের দিকে।

আজব তোমার মেহেরবানি গো,

আজব তোমার দেখভাল-উপদেশ।

আজব ফষ্টিনষ্টি তোমার

আজব প্রেমের ছলনা।

আজব হেলানো-টুপি-পরা ওগো

আজব পীড়নকারী।

সত্যকথাটি দিও না গো বলে তুমি,

খসরু, দুনিয়া কুফরিতে ভরপুর।

আজব উৎস গোপন ভেদের,

আজব গুপ্তজ্ঞানী।

প্রেমের কাফের

প্রেমের কাফের আমি, রীতিনীতি দরকার নাই।

আমার প্রতিটা শিরা টানটান, সুরযোগ্য তারের মতন।

বামুনের পৈতার দরকার নাই তো আমার।

আমার শয্যার পাশ থেকে ভাগো তুমি, মূর্খ ডাক্তার।

প্রেমের আরোগ্য শুধু প্রেমিকের মুখদর্শনে :

আর কোনো ওষুধের দরকার নাই তার কোনো।

আমাদের নৌকায় মাঝি যদি না থাকে তো নাইবা থাকুক।

আমাদের মাঝে আছে প্রিয়তম, সাগরে করি না কোনো ভয়।

লোকে বলাবলি করে : খসরু পূজারি মূর্তির :

সত্য কথাই এটা, অপরের অনুমতি খোঁজে না সে মোটে,

দুনিয়ার কিছু তার প্রয়োজন নাই।