বাঙ্গালীর সাংস্কৃতিক কৃতিত্বকে গ্রামীণ মানুষের সাংস্কৃতিক কৃতিত্ব বিবেচনা করার পাশাপাশি পণ্ডিত হিসেবে নিজেকে অভিহিত করতেন 'সর্বহারাদের সংস্কৃতি'র একজন বলে।
Published : 10 Jul 2023, 11:46 AM
অগ্রণী বাঙ্গালী মুসলিম পণ্ডিত হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত ভাষাতাত্ত্বিক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ভাষাতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদের উত্থানের সাথে যুক্ত ভাষাতত্ত্ববিদ হিসেবে মাতৃভাষা এবং বাঙালি পরিচয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মিলন'-এর দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে যে-কথাগুলো বলেছিলেন সে-কথাগুলোর গভীরতা এতটাই সুদূরপ্রসারী যে বাঙ্গালীমাত্রকে তা আজও অনুধাবন করতে হয়। বলেছিলেন তিনি, 'পৃথিবীর ইতিহাস আলোচনা করে দেখ, মাতৃভাষার উন্নতি ছাড়া কোনো জাতি কি কখনও বড় হতে পেরেছে? আরব পারস্য জয় করেছিল, কিন্তু পারস্য আরবের ভাষা নেয়নি। শুধু নিয়েছিল তার ধর্মভাব আর কতকগুলো শব্দ। সেদিন অতি কাছে যেদিন বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভাষার স্থান অধিকার করবে।'
তিনি জ্ঞান করতেন, যে, বিদেশি ভাষার সাহায্যে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার মতো সৃষ্টি ছাড়া প্রথা কখনও টিকতে পারে না। ১৯২৫ সালে গৌড়ী বা মাগধী প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে প্রমাণ করার পর অধ্যয়ন করেছেন জার্মানির ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর ১৯২৮ সালে বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদাবলি বিষয়ে গবেষণা করে প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট অর্জন করেছেন। এছাড়া ধ্বনিতত্ত্বে মৌলিক গবেষণার জন্য প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমাও লাভ করেছিলেন। এসব তো তিনি অর্জন করেছিলেনই, ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ'র ছিলো অবাধ বিচরণ। ১৮টি ভাষা জানতেন তিনি। ফলে বিভিন্ন ভাষার সঞ্চিত জ্ঞান দ্বারা ছিলেন অভিগমনে ছিলেন সহজ ও সক্ষম।
বাংলা ভাষার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা জ্ঞানতাপসকে জীবদ্দশায় 'চলমান বিশ্বকোষ' বলে অভিহিত করা হতো। উল্লেখ করতে হয় বিভিন্ন ভাষায় অদম্য আগ্রহী শহীদুল্লাহ ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে--১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে--ধর্মীয় নয়, জাতিগত পরিচয় হিসেবে বাঙালিত্বকে স্বীকার করে সভাপতির অভিভাষণে ঘোষণা দিয়েছিলেন, 'আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়; এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ রেখে দিয়েছেন যে, মালল-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি দাড়িতে ঢাকবার কোনো জো-টি নেই।'
নিজের বাঙালিত্বকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন তিনি আর সবকিছুর থেকে বেশি। কিন্তু তারপরও শহীদুল্লাহকে হিন্দুত্ববাদের রোষাণলে পড়তে হয়েছিলো। ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেনের সহকর্মী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ শুরু করার পর ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আমন্ত্রণে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে সংস্কৃতের শিক্ষক পদ ছিল দুটি, বাংলায় একটি। আর শাস্ত্রী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ। যদিও জনাব শাস্ত্রীর আমন্ত্রণেই ডক্টর মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একমাত্র প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেছিলেন, ডক্টর শহীদুল্লাহ্ রিডারের বেতন-ভাতা দাবি করলে বিভাগীয় অধ্যক্ষ শাস্ত্রী শহীদুল্লাহর দাবির প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে লিখিত চিঠিতে উপাচার্যকে শহীদুল্লাহকে বর্ধিত বেতনে না-নেয়ার বদলে ঢাকা কলেজের সংস্কৃতের প্রভাষক অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্তকে নিযুক্ত করার সুপারিশ করেন।
শাস্ত্রীর দত্তগুপ্তকে সুপারিশে হিন্দুত্ববাদী আচরণ প্রকটভাবে ধরা দেয় না। তবে শহীদুল্লাহ্কে হিন্দুত্ববাদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তার প্রমাণ পাওয়া যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের তৎকালীন বেদ বিষয়ক অধ্যাপক সত্যব্রত সামধ্যায়ীর একজন মুসলমান ছাত্রকে বেদ পড়াতে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর স্মৃতিচারণে পরবর্তীকালে বলেছিলেন, 'পণ্ডিত সত্যব্রতের সামনে আমি এই তর্ক তুলেছিলাম যে, শাস্ত্রে শুদ্র এবং নারীকে বেদ পড়ানো নিষিদ্ধ বলা আছে। তাই কোন যুক্তিতে আমাকে বেদ পড়ানো হবে না! আমি তো নারীও নই শূদ্রও নই, তাহলে আমাকে বেদ পড়াতে আপনার আপত্তি কোথায়?' একে তো শিক্ষায় কুসংস্কার চলে না, শহীদুল্লাহ'র যুক্তির প্রতি কোনো রকম কর্ণপাত করেননি প্রতিক্রিয়াশীল ব্রাহ্মণ সত্যব্রত। শহীদুল্লাহ তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হলে আশুতোষ সত্যব্রতকে অনুরোধ করেন। কিন্তু উপাচার্যের অনুরোধ রক্ষা করতে সত্যব্রত অস্বীকার করেন। তার বদলে উপাচার্যকে তিনি হুমকি প্রদান করেন যে, যদি মুসলমান ছাত্রকে বেদ পড়ানো হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পদত্যাগ করবেন।
বলা যায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর লেখার মধ্যে দিয়ে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল। দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করলে এর প্রতিবাদে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সর্বপ্রথম প্রস্তাবটির প্রতিবাদ করেন। ১৯৪৭ সালের ৩রা আগস্ট আজাদ পত্রিকায় 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা' নামে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেন। প্রবন্ধটিতে তিনি বলেন, 'পাকিস্তান ডোমিনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বিভিন্ন, যেমন পশতু, বেলুচি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি এবং বাংলা; কিন্তু উর্দু পাকিস্তানের কোনো অঞ্চলেই মাতৃভাষা রূপে চালু নয়। যদি বিদেশি ভাষা বলিয়া ইংরেজি ভাষা পরিত্যক্ত হয়, তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ না করার পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। যদি বাংলা ভাষার অতিরিক্ত কোনো দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা গ্রহণ করিতে হয়, তবে উর্দু ভাষার দাবি বিবেচনা করা কর্তব্য। বাংলাদেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দি ভাষা গ্রহণ করা হলে, ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হবে। ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহনরূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষার স্বপক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন আমি একজন শিক্ষাবিদ রূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।'
এই কথাটাই তখনকার বাঙালি সুধীসমাজ লুফে নেন। এবং এই কথাটার উপরই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। ডক্টর শহীদুল্লাহ পাকিস্তান জান্তার দ্বারা বাংলা লিপির আরবি ও উর্দুকরণ করার প্রচেষ্টাতেও প্রতিবাদ করেছিলেন। ডক্টর আনিসুজ্জামান একবার বলেছিলেন, 'ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সারা জীবন আমাদের মাতৃভাষা বাংলার প্রতি তাঁর অসীম ভালবাসা প্রকাশ করেছেন। আমাদের কেবল তাঁকে একজন খ্যাতিমান ভাষাবিদ হিসাবেই মনে করা উচিত নয, যিনি বাংলা ভাষার পক্ষে লড়াই করেছিলেন। পাকিস্তানের সেই অশান্ত সময়ে তিনি বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতির দাবি করেছিলেন।'
একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন তিনি। নিজের ধর্ম সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি তাঁর ধর্মীয় গ্রন্থগুলিতে প্রতিফলিতও হয়েছে। ইসলামের আসল অর্থ তুলে ধরার জন্য গ্রামে গিয়ে তিনি ওয়াজ-মেহফিলে বক্তৃতা দিতেন, যাতে করে সাধারণ মানুষ ধর্মের আসল অর্থ অনুধাবন করে ধর্মান্ধতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। ধর্মে যদিও দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে তাঁর বাস ছিলো অনেক দূরে। তাঁর সন্তান মুর্তজা বশীর ছিলেন আর্ট কলেজের ছাত্র এবং মনেপ্রাণে সাম্যবাদী এবং নাস্তিক্যবাদী। কিন্তু মুর্তজা বশীরের চিত্র প্রদর্শনী যখনই হতো, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সেসব প্রদর্শনীতে উপস্থিত থাকতেন এবং প্রশংসাও করতেন। পাশাপাশি তিনি তাঁর হিন্দু ছাত্রদের বাড়িতে যেতেন, ছাত্রের বিয়েতে গিয়ে ভোজসভায় অংশও নিতেন, এবং ছাত্রদের স্ত্রীদের বৌমা বলে সম্বোধন করতেন। যার কারণে মুর্তজা বশীর তাঁর পিতার প্রগতিশীল মানসিকতা এবং জীবনবোধকে শ্রদ্ধা করে তাঁর নিকট শিল্পীদের সাথে গল্প করে বলতেন, আমার আব্বা কতটা প্রগতিশীল সেটা তিনি তাঁর যাপিত জীবনের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন।
জীবনভর ভাষা ও সাহিত্য সাধনায় রত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলেন সেই বিরলপ্রজ আলেমদের একজন যিনি জনমানসের চিন্তার বিকাশ ঘটাতে শুধু আগ্রহী ছিলেন তাই নয়, বাঙ্গালীর সাংস্কৃতিক কৃতিত্বকে গ্রামীণ মানুষের সাংস্কৃতিক কৃতিত্ব বিবেচনা করার পাশাপাশি পণ্ডিত হিসেবে নিজেকে অভিহিত করতেন 'সর্বহারাদের সংস্কৃতি'র একজন বলে। বলা হয় তাঁর হাত দিয়েই হয়েছে বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা। ১৮৮৫ সালের আজকের তারিখে তিনি পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জ্ঞানতাপসের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।