শুকনো অশ্রুচিহ্ন আর দহনের ছাই উড়িয়ে কে প্রথম স্বেচ্ছামৃত্যুর নীল বর্শায় নিজেকে বিদ্ধ করেছিলেন?
Published : 27 Jun 2024, 01:57 AM
শুকনো অশ্রুচিহ্ন আর দহনের ছাই উড়িয়ে কে প্রথম স্বেচ্ছামৃত্যুর নীল বর্শায় নিজেকে বিদ্ধ করেছিলেন? কেন জ্বলে উঠেছিল ওই দিব্যোন্মাদ আগুন? কেবলই বিষাদ? না কি কোথাও অন্যতর অনন্ত আনন্দের চুম্বনচিহ্ন হয়ে উঠেছিল আতিশয্যময়?
গ্রিক-রোমান সভ্যতায় রয়েছে তুষারমথিত আত্মহত্যার আশ্চর্য ধ্রুপদি অধ্যায়। যেন তা এক অনিঃশেষ মুগ্ধ মাদকতা, আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো। রেনেসাঁসের নক্ষত্রবীথির নিচে বিস্মিত মানুষ জেনেছে দার্শনিক পিথাগোরাস, টাইটাস লুক্রেশিয়াস ক্যারাস [ Titus Lucretius Carus ], আরিস্তোদোমাস [ Aristodemus ], দেমোক্রিতাস [ Democritus ], লুশিউস আন্নাইউস সেনেকা [ Lucius Annaeus Seneca ], রোমান রাজনীতিক ব্রুতাস [ Marcus Junius Brutus ], ক্লিওপেত্রা--এমন অসংখ্য প্রতিভার আত্মহননের রৌদ্রস্নান। যদিও মধ্যযুগের বিস্তীর্ণ পরিসীমায় এটিকে ঈশ্বরের অবমাননা মনে করা হত। কিন্তু ফ্রেডরিক নিৎশে [১৮৪৪-১৯০০] ঈশ্বরের মৃত্যু এবং জীবনের অর্থহীনতা ঘোষণা করলে মহাকাল যেন হয়ে ওঠে রক্তশূন্য, দুঃস্বপ্নে ভরা অলঙ্ঘনীয় ক্যাকটাস। দ্বিধা, দোলাচলতা, টুকরো টুকরো ভঙ্গুর শিলার মতো ছড়িয়ে পড়ে মানুষের সমস্ত মনস্তাত্ত্বিক আধেয়। রোমান কবি ও দার্শনিক লুক্রেশিউসের স্নায়ু ছিঁড়ে উন্মীলিত কণ্ঠপুঞ্জ নতুন করে হয়ে ওঠে গভীর অনুরাগের শিল্পিত নির্মমতা। তিনি যেমন বলেছিলেন, মানুষ মুক্তি চায় নিজের কাছ থেকেই, কিন্তু তুমুল ব্যর্থতাই তাকে প্ররোচিত করে আত্মহত্যায়, এবং এই সত্য সে তখনই উপলব্ধি করে। লুক্রেশিউসও বেছে নিয়েছিলেন স্বেচ্ছামৃত্যুর নান্দনিক হিংস্রতার নৈঃশব্দ্য। স্টোয়িকবাদী দার্শনিক সেনেকা করোটি ও রক্তের ভেতর বিদীর্ণ হাহকার নিয়ে এই উপসংহারে পৌঁছেছিলেন--আত্মহত্যার মানবিক সৌন্দর্য্য হল মানবস্বাধীনতার চূড়ান্ত প্রমাণ। সমাধির নিস্তব্ধতা চুরমার করে দেওয়া এই এপিটাফময় উপলব্ধি কি আমাদের রক্তহীন মজ্জার ভেতর যন্ত্রণার ভাস্কর্য গড়ে তোলে? অথবা এই বোধ নিজের জীবনকে অগ্নিদগ্ধ করতলে ধরে তার ওপর প্রভুত্বের ক্রুশ এঁকে দেয়, গেঁথে দেয় কালপুরুষের তীব্র তরবারি?
যদিও সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, আইনের নিষ্প্রদীপ চোখে চিরকালই আত্মহত্যা ভয়াবহ অপরাধ, পাপ। এসব প্রতিষ্ঠান মানুষের নিজের কাছ থেকে মুক্তির শোকার্ত, গ্লানিময়, ক্লান্ত নিস্তব্ধতা ছুঁয়ে দেখেনি, বুঝতেও চায়নি। তবু এইসব দুর্মর দেওয়াল অতিক্রম করে স্বেচ্ছামৃত্যুকেই উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদীপময় ভেবেছেন কবি ও ধর্মযাজক জন ডান [ John Donne , ১৫৭২-১৬৩১], লিখেছেন ‘ ÔDeath Be Not ProudÕ ’ কবিতাটি। আর আত্মহত্যার স্বপক্ষে উষ্ণ অভীপ্সায় রচনা করেছিলেন Biathanatos [১৬০৮]; সমকালীন নিশ্ছিদ্র নিস্তব্ধতায় সেটি ছিল অপ্রকাশ্য, গোপন অশ্রুর চিহ্নে মলিন; প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পর। দার্শনিক ডেভিড হিউমের [১৭১১-১৭৭৬] স্বেচ্ছামৃত্যু-বিষয়ক পাণ্ডুলিপি মুখ লুকিয়ে রেখেছিল ভয়সঞ্চারী অন্ধকারে, প্রয়াণ পর্যন্ত; তাঁর Essays on Suicide and the Immortality of the Soul গ্রন্থে বলেছেন, আত্মহত্যা আশ্চর্য এক মীমাংসা; ঈশ্বরের অবমাননা নয়, সমাজের অনিষ্ট নয়, এমনকি নিজেকেও অপমান নয়। অবশ্য রেনে দেকার্তে [১৫৯৬-১৬৫০] স্বেচ্ছামৃত্যুর পক্ষে যাবতীয় যুক্তির বিরোধিতা করেছেন, বলেছেন, আত্মহত্যা পাপ নয়, ভুল। এত অশ্রুপাত, এত বিতর্কবিঘ্ন; তবু সব ক্লিন্নতা ঝরিয়ে মানবমনে স্বেচ্ছামৃত্যুর নিবিড় ও সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা অন্যান্য শরীরবৃত্তীয় তাড়নার মতোই স্বাভাবিক--এই স্নায়ুবাসনার দুষ্পাঠ্য গ্রন্থি উন্মোচনে প্রয়াসী হয়েছেন অনেকেই--যেমন ডেভিড হিউম, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, এমিল ডার্খাইম। তাঁরা দেখিয়েছেন, সমাজ ও জনমনস্তত্ত্বের জটিলতায় জীবন থেকে আত্মবিচ্ছিন্নতার সব উষ্ণতা করতলে গ্রহণ করা এই অনন্ত নিঃসঙ্গতার বিনির্মাণ।
তবু বিবমিষা আর উটের গ্রীবার মতো নিস্তব্ধতা স্নায়ুর ভেতর পুষে আত্মহননই শ্রেয় ভেবেছেন অনেকেই। যেমন সের্গেই এসেনিন শরীরের রক্ত দিয়ে লিখেছিলেন একটি পুরো কবিতা, সেটিই তাঁর সুইসাইড নোট। এই রুশ কবির আত্মহত্যা-পরবর্তী শোকসভায় মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবনের জয়গান গেয়েও খোদ সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় আত্মহননের পথ বেছে নেন ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে একষট্টি বছর বয়সে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছিলেন। ম্যাক্সিম গোর্কি চেষ্টা করেছিলেন আত্মহত্যার। সিলভিয়া প্লাথ, মোপাসাঁ, ভিভিয়েন, অ্যান স্যাক্সটন, জন বেরিম্যান, আর্থার কোয়েসলার, মেরিলিন মনরো, জর্জি কোসিনোস্কি [ Jerzy Kosinski ], ইউকিও মিশিমা [ Yukio Mishima ]--এমন অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী চির ঘুমের আস্বাদে সমর্পণ করেছিলেন আত্মার ললিত উৎকণ্ঠা। বাংলা ভাষার ভূগর্ভলীন সৃষ্টিশীলেরাও, অনেকেই, মনোজগতের রক্তহীনতা থেকে স্পর্শ করেছেন মৃত্যু-উপত্যকা, নিজেরই অভিনিবেশে : ২৯ ডিসেম্বর শীতার্ত নীলক্ষেতের অদূরবর্তী এলাকায় প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে প্লাতো-আরিস্ততল-মার্কস গুঞ্জরিত মস্তিষ্ক ধাবমান ট্রেনের নিচে সমর্পণ করেছিলেন কথাসাহিত্যিক ফজলুল হক [১৯১৬-১৯৪৯], স্লিপিং ট্যাবলেট সেবনে নিথর নিদ্রার বাসনায় মত্ত হয়েছিলেন কবি শামশের আনোয়ার [১৯৪৪-১৯৯৩], সেই শোকার্ত আঁধার ফিকে হতে না হতেই বিস্ময়বিদীর্ণ হাতে গানের বাকশো নিয়ে বেহালার করুণ রাগিণী বেজে ওঠে চব্বিশ বছরের এক গ্লেসিয়ার নক্ষত্রে--শামীম কবীর [১৯৭১-১৯৯৫], অতঃপর বিচিন্তার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সম্পাদকীয় বর্ণমালা ছুঁয়ে ছুঁয়ে মিনার মাহমুদ; তাঁদেরও বিষণ্ণতামুখরিত অবসকিওরিটি ছিল চির ঘুমের দরজা খুলে। আর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে, আফিম খেয়ে রবীন্দ্রনাথের বউঠান কাদম্বরী দেবীর আত্মহননের বিষাদ আশ্চর্য এক কিংবদন্তি। রবীন্দ্রচৈতন্যে সেই গোপন অশ্রু জমে জমে হয়ে উঠেছিল অগলিত বরফ। সম্প্রতি কণ্ঠে রবীন্দ্রগানের অমেয় সুরসমূহ শীতার্তে ডুবিয়ে স্বেচ্ছায় চিরঘুমে চলে গেলেন সাদি মহম্মদ [১৯৫৭-১৩ মার্চ, ২০২৪]। এইসব স্বেচ্ছামৃত্যু-পুরাণ, সৃষ্টিশীল মানুষের মজ্জা ও রক্তের ভেতর কোন নিরাময়ের অনুপান নিয়ে এসেছিল, আমাদের সেই উজ্জ্বল অজ্ঞতার মীমাংসা ঘটেনি। অথবা যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বযুদ্ধের পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার বিরুদ্ধে আত্মিক সংকট থেকে মুক্তির জন্য গণআত্মহত্যা করেছিল একটি সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে কয়েক শত মানুষ--কোনো ডুব সাঁতারে পার হওয়া গেছে কি এমন অন্ধকারআকীর্ণ মৃত্যুদ্রাঘিমা?
আর পঞ্চমীর চাঁদ ডুবে গেলে জীবনানন্দ দাশের অজ্ঞাতনামা নায়ক আট বছর আগের একদিন একগাছা দড়ি নিয়ে বেছে নেয় স্বেচ্ছামৃত্যু, জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার শূন্য করে চলে যায় মরণদ্বীপে। জীবনানন্দ নিজেও আটকে আছেন, দস্যু ট্রাম-দুর্ঘটনা আর স্বেচ্ছামৃত্যুর সংশয়দীর্ণ ক্যাকটাসকাঁটায়। কায়েস আহমেদেরও ‘নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ’ ছিল; তথাপি অর্থ, কীর্তি, স্বচ্ছলতা থেকে তিনি ছিলেন দূরে। গৃহ ছিল কি? কিংবা গৃহী হয়ে উঠবার কোনো ব্যর্থ আয়োজন? অনিকেত অভিজ্ঞতার গ্লানি, ক্লান্তি, অনমনীয় ব্যক্তিত্ব তাঁর অন্তর্গত স্নায়ুর ভেতর বয়ে চলেছিল?
দুই
রক্তের ভেতর অজ্ঞাত, করুণ নিস্তব্ধতার বিবমিষা উচ্ছৃত হয়েছিল। নিষ্প্রদীপ অন্ধকারে স্পর্শাতীত অপমানের যন্ত্রণা আগুনে পুড়িয়ে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন কায়েস আহমেদ? করোটির ভেতর স্বেচ্ছামৃত্যুর নীল বৃক্ষ রোপিত হয়েছিল আত্মগোপনে, নির্জনতা আর নিশ্চুপ অভিব্যক্তির অন্তর্মুখে? ১৯৬৯ সালে বাবা শেখ কামালউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ, ব্যাকুল কায়েস যেতে চেয়েছিলেন মায়ের কাছে, বড় তাজপুর গ্রামে, কিন্তু আশ্চর্য যে, পাসপোর্ট করতে গিয়ে জানতে পারেন--তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের নাগরিক নন। তুমুল কলরোলের মধ্যেও কি তাঁর অস্তিত্ব নিঃসীম শূন্যতায় ডুকরে ওঠেনি? তখন? এবং আমৃত্যু? সতীর্থ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস জানিয়েছেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গেলেন [বড় তাজপুর], ঐ বছর বেশ অনেকটা সময় কাটিয়েছেন নিজের গ্রামে মায়ের সঙ্গে। মনে হয় একটু বড়ো হওয়ার পর থেকে ঐ কয়েকটা দিন তিনি শীতল ছায়ায় কাটিয়েছেন। কিন্তু মায়ের ভালোবাসার ছায়ায় থাকা তাঁর কি পোষায়? যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই কায়েস ঢাকায় ফিরে এলেন, নিজের গ্রামে আর কোনোদিন যাননি। বড় তাজপুর গ্রামে তাঁদের পুরনো নোনা-ধরা বাড়ির খিড়কির দুয়ারে শেফালি গাছের নিচে মোড়া পেতে বসে ছেলের জন্যে পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মায়ের চোখে ছানি পড়ে গেলো।--এই দৃশ্যটা মনে হলেই কায়েস বড্ডো অস্থির হয়ে পড়তেন। কিন্তু এই অস্থিরতা ও উদ্বেগ তিনি বরং মেনে নেবেন, কিন্তু গ্রামে গিয়ে কটা দিন মায়ের আঁচলের নিচে থেকে চোখজোড়া ভরে ঘুমিয়ে আসার চিন্তাও তাঁর স্বভাবের বাইরে।’ [‘মরিবার হ’লো তাঁর সাধ’, কায়েস আহমেদ : নিরাবেগ বোঝাপড়া] এভাবেই স্বজন, খ্যাতি, প্রাচুর্য, প্রতিষ্ঠার ছায়াতল এড়িয়ে গেছেন। একদিকে নিদারুণ আর্থিক টানাপড়েন, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো তখন। মানবজীবন এবং পরিপার্শ্বের বিবিধ উল্লম্ফন দৃশ্যায়িত হচ্ছে তাঁর দৃষ্টি ছুঁয়ে। সমাজতন্ত্রের পতনে হতাশানিমজ্জিত অসংখ্য মানুষ তখন দেশে দেশে আত্মহনন শ্রেয় মনে করেছে। সেইসব আত্মবিপন্নতার গ্লানি নিয়ে কায়েসও কি জানতেন ওইসব ক্ষতচিহ্নে জমাটবাঁধা রক্তজবার মনোমুগ্ধকর বিবমিষা? ওই মৃত্যুর দিগন্তদ্রাঘিমা? অথবা ‘ইউথেনেসিয়া’ [ euthanasia ] নামক স্বেচ্ছামৃত্যুর রাষ্ট্রস্বীকৃত কোনো ‘হ্যাপি ডেথ’-এর গ্রিক-গ্রন্থভূক আভিধানিক প্রণালি? ১৯৯২, ১৪ জুনের রৌদ্রবিবসিত আকাশ ছোঁয়া ইস্পাতের হাওয়ার তরঙ্গে পেয়েছিলেন সুখনিদ্রার অনন্ত নক্ষত্রনিরাময়? গেন্ডারিয়ার সতীশ সরকার সড়কে তিনতলার চিলেকোঠা শিল্পিত হিংস্রতায় ভরে উঠেছিল কুণ্ঠিত শিশিরের শব্দে?
অথচ কী দিব্যোজ্জ্বল গল্প সৃজনের নিভৃত ডালপালা বিস্তৃত হয়েছিল তাঁর একখণ্ড আত্মসমর্পিত আয়তক্ষেত্রে। আমরা অস্ত্রোপচারে হিমশীতল সেই চারটি অস্থিআকীর্ণ মৃদৃ গ্রন্থ দেখি। সেখানে পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে আছে তুষারমথিত অন্তর্দহনের শুকনো অশ্রুচিহ্ন। কিন্তু তার দাগ বিলুপ্ত, ছেঁড়া আস্তিনে ঢাকা; দৃশ্যবিদ্ধ কেবল ধূসরতার আশ্চর্য, কেবল অগ্নিদগ্ধ অনির্বাণ অক্ষরের হাহাকার। আর নাগরিক কোলাহল মুখরতায় প্রায় অদৃশ্য অজ্ঞাত হয়ে যাওয়া এক টুকরো মুখচ্ছবি--রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী [১৯২১-১৯৮৮]; কীভাবে যেন গোপন অভীপ্সার মতো এই সলজ্জ কবি-প্রাবন্ধিক হয়ে উঠেছিলেন কায়েস আহমেদের আত্মার সতীর্থ। রবীন্দ্র তরুমূলে অথবা অনুশীলন সমিতি পার হয়ে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ আর কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য শান্তিনিকেতনের এই প্রাক্তন শিক্ষার্থীটিও কি কয়েসের নৈর্ব্যক্তিক শরীরে ছায়া ফেলে গিয়েছিলেন? ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে তেভাগা, দেশভাগ থেকে ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ--সবখানেই সক্রিয় এই ব্যক্তিটির জীবনী লিখেছেন কায়েস; পরম নিষ্ঠা, বিপুল পরিশ্রম আর মানুষকে পর্যবেক্ষণের গভীর সংবেদে। তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যুর দুই বছর আগে, ১৯৯০ সালে, প্রকাশ হচ্ছে, বাংলা একাডেমি থেকে, ওই ক্ষীণকায় অথচ অভাবিত বই।
নীল আগুনের বর্শা ঝলসে উঠেছিল; আর ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার ধিক্কারে নির্বাসিত একজন সপরিবারে, অন্ধকারের তুমুল মাদকতায় আছড়ে পড়েছিল। অজানা নক্ষত্রের রক্তমাংসে। পূর্ববাংলায়। সেই অন্তর্বিদ্ধ দুঃসময়, খোলামকুচির মতো দুটুকরো মানচিত্র কায়েসের ভূগর্ভলীন মগজ, স্নায়ু আর মজ্জার ভেতর দাউদাউ করে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছিল আমৃত্যু। যে অগ্নিশিখা অন্ধ তীরন্দাজের মতো তাঁরই লাশকাটা ঘর পর্যন্ত পৌঁছুতে চেয়েছিল। অন্তর্মুখ, স্বল্পভাষী, নিভৃতবিলাসী তিনি যেন হয়ে উঠেছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার দগ্ধ গ্রন্থাগার, যার রক্ত আর ছাই লুকোনোর জন্য লিখে চলেছিলেন জগদ্দল পাথরের নিচে চাপা-পড়া মানুষের খণ্ড খণ্ড অভিসন্দর্ভ। বিষাদবিদ্ধ, আহত, রুগ্ন, বিষণ্ণ, বিপন্ন, লাঞ্ছিত জনজীবনের সঙ্গে নিষ্ঠুর, ঘাতক, উগ্রতান্ধদের বিম্বিত হতে দেখি তাঁর গল্প-উপন্যাসোচিত রচনায়। সেসব মানুষ স্মৃতিকাতর, বেদনামগ্ন, জেদি, স্বাপ্নিক। তুমুল স্বচ্ছ, ভীষণ ধারালো, নিষ্প্রদীপ অন্ধকার হাতড়ে মাটি ফুঁড়ে উত্থিত, ঘুমের বন্ধ দুয়ার খুলে উঠে আসা প্রবলভাবে মেরুদণ্ডী। আবার কখনো মানসিক অবসাদে অসুস্থতায় বিকলনময়।
অন্ধ তীরন্দাজ [১৯৭৮], নির্বাসিত একজন [১৯৮৬], দিনযাপন [১৯৮৬], লাশকাটা ঘর [১৯৮৭]--লিকলিকে, রক্তশূন্যতায় স্বাস্থ্যহীন চারটি বই; আশ্চর্য সব উন্মীলন। প্রথম এবং পরবর্তী তিনটি গ্রন্থের উন্মোচনকাল দেখি। যেন সময়ের মুখোশমালা তিনি ছিঁড়ে ফেলতে চাইছেন, যেন অমেরুদণ্ডীদের হঠকারিতার যাবতীয় লিঙ্গ ছিন্ন করতে ব্যাকুল। আট বছরের ব্যবধান দুর্মর হয়ে উঠেছিল কি? নাকি দুঃসময়ের সমস্ত দৈর্ঘ্য, আয়তক্ষেত্র, গণিত তাঁকে টেনে নিয়েছিল অজ্ঞাত অচেনা বিলুপ্তির দিকে? বিলীয়মান শব্দাত্মার আস্বাদ ছুঁয়ে? আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে তাঁর সম্পাদনা যেন নিজেরই করোটির ভেতর বয়ে চলা গোপন অসুখ নিরাময়ের ভেষজ-শুশ্রূষা। কায়েস আহমেদ মৃত্যু-উপত্যকায় পৌঁছে যাবার দু-বছর পর প্রকাশিত হচ্ছে ওই আমর্মবিদ্ধ বইখানি।
নিঃসঙ্গতার ক্ষতমুখ থেকে যেন উঠে এসেছিলেন নির্বাসিত ওই একজন। নিজেরই রুগ্ন উপন্যাসের চরিত্রের মতো ভুল পরিচয় নিয়ে সহস্র মানুষের ভিড়ে। যে সারা জীবন ‘নিজেকেই পাহারা দিয়ে’ এসেছে, আত্মহননের চেষ্টা করেছে নিজের জন্যই। গল্পের পর গল্পে অস্তিত্বহীনতার ভয়, বিবমিষা অথবা স্বেচ্ছামৃত্যুর স্নায়ুমুখ বিম্বিত হতে দেখি। ‘অন্তর্লীন চখাচখী’র পল্টু যেন লেখকেরই নৈর্ব্যক্তিক পরাসত্তা, ‘... তার ভেতর একটা অস্বস্তি, অস্থিরতা, দ্বিধা, অভিমান, কষ্ট, মায়া সবকিছু মিলিয়ে কেবল কান্না পেতে থাকে।’ অদৃশ্য ও অনিবার্য অশ্রুর শোকার্ত স্বরলিপির মতো তিনিও কি উদ্যাপন করতে চেয়েছিলেন জীবনের তুমুল মাধুর্য? ‘যাত্রা’ গল্পের খুন হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক শিরার ভেতর নিয়ে প্রতিপদে অনুভব করেছিলেন ‘বেঁচে থাকা তার কাছে কী বিপুলভাবে কাম্য’। নাকি ‘মানুষের মরার জন্যে কি কারণের অভাব?’--‘খঞ্জ রোদে শালিখ ফড়িং’য়ের এই অভিজ্ঞানই সত্য হয়ে উঠেছিল আত্মহননের ঠান্ডা শীতল উপলব্ধি? আবার কতিপয় মৃত স্বপ্নের চোখ উপন্যাসোচিত রচনায় অজ্ঞাত কারণে অবিবাহিত যুবতী ছবি নিঃসঙ্গ; অদৃশ্য স্নায়ুধমনীর ভেতর গোপন স্মৃতিবিষাদ নিয়ে নিদ্রাহীন। ছোটভাই টিপু রাতে তাকে পাহারা দেয়, ‘... বুবু যদি সুইসাইড করে’--সমাজের অন্ত্যেবাসী এসব প্রায় অস্ফুট মানুষের স্বেচ্ছামৃত্যুর নিদারুণ স্তব্ধতা যেন ছুঁয়ে গেছে কায়েসেরই রক্তবোধিময় শরীর? অগ্রন্থিত ‘জীবন’ গল্পটি যেন তেমনই দার্শনিক উপলব্ধির নির্জন অক্ষরমালা। গল্পকথকের অভিব্যক্তিতে কায়েস লিখেছেন, “তার [আত্মহত্যার] সলিড কোনো কারণ নেই, এবং তা জীবনানন্দ দাশের ‘বিপন্ন বিস্ময়’ থেকেও নয়, কেমন এক ধরনের কষ্ট...”। কিন্তু যে রুণু এই গল্পে স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেছে, সে ডায়েরিতে লিখেছে বেঁচে থাকার বিস্ময় ও রোমাঞ্চকর অভিপ্রায়; জীবন তার কাছে ‘তীব্র, ঝাঁজালো, অসহ্য এক আনন্দ।’ তাহলে এই দ্বৈরথ, দ্বিধা, অমীমাংসিত; বিভীষিকাময় উলকির মতো কায়েসের রিক্ত নিঃসঙ্গ করোটির ভেতর খেলা করেছিল? জলের মতো ঘুরে ঘুরে? আর তা যেন তাঁরই সঘন আত্মার শীত; তুষারগুঁড়োর স্বেদ-রক্তে নিঃস্ব, নিঃশঙ্ক, অনিবার্য একখণ্ড স্বচ্ছ আইসক্রিম। ওই মনোমুগ্ধ জমাট শীত ছোট্ট আত্মজের স্পন্দনময় মুখে তুলে দিয়েছিলেন, অতঃপর নিজেকে সমর্পণ করেন শ্বাসরোধী স্বেচ্ছামৃত্যুদীপময় অনন্ত ও অমীমাংসিত জিজ্ঞাসায়।
তিন
কায়েস আহমেদের রক্তাপ্লুত গ্রন্থগুলো যেন তাঁরই আত্মজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনিঃশেষ চুম্বনচিহ্নে। যে শিল্পকলা মস্তিষ্ক দিয়ে অনুভব করেছিলেন তিনি, সেসব ইন্দ্রিয়েরই অনুরণন ছিল ঘুম ও জাগরণের দ্বিধায় আচ্ছন্ন। সমস্ত প্রতীক্ষা, ক্লান্তি, উৎকণ্ঠা বিচূর্ণ করে দিয়েছেন অজ্ঞাত ইচ্ছায়। হৃদয়ের কোন বিস্ময় মানুষকে তাড়িত করে স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে মাথা রাখতে! আমরা সেই গোপন ক্লান্তির কথা আবিষ্কার করতে করতে দেখি কায়েসও ছবি হয়ে গেলেন। দুরন্ত ইলেট্রিক হাওয়ার সঙ্গে নিজেকে ঝুলিয়ে দিলেন বিজন জ্যোৎস্নার অনন্ত নক্ষত্রলোকে। আর আমাদের ব্যর্থ আত্মার ছায়ান্ধকারে জেগে রইল সমস্ত বিষাদ আর চাপাকান্নামথিত শীতার্ত অক্ষরমালার মৃত্যুভাস্কর্য।