কিন্তু আমরা দেখি কি, আমাদের দেশের কিছু দুর্নীতিপরায়ণ, মাফিয়া নির্লজ্জ ব্যক্তি নিজেদের দোষ-অপরাধ ঢাকতে, আর রাষ্ট্রকে তাদের অপরাধের বিচার না করার ভয় দেখাতে পত্রিকা খুলে বসে।
Published : 14 Dec 2023, 10:58 AM
অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনার সাথে বুদ্ধিজীবীদের হত্যারও পরিকল্পনা করেছিল রাও ফরমান আলি। সেই কালরাতেই পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে খুঁজে খুঁজে হত্যা করেছিল। কিন্তু যুদ্ধ চলাকালে দখলদারবাহিনী এবং তাদের প্রশিক্ষিত এ-দেশের আধা-সামরিক বাহিনী আল-বদর এবং আল-শামস যে তালিকা তৈরি করেছিল, যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া সকল স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল।
অনেক রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু কত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হলো এই স্বাধীনতা, এই ব্যাপারটি হয়তো তখনও সেই অর্থে আন্দাজ করা সম্ভবই হয়নি! দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই, ১৯৭২ সালের দোসরা জানুয়ারি, ভাষা সৈনিক অধ্যাপিকা হামিদা রহমান দৈনিক আজাদ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। 'কাটাসুরের বধ্যভূমি' শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, কার্ডিওলজিস্ট ডাক্তার ফজলে রাব্বীর লাশটা তখনও তাজাই দেখাচ্ছিল। জল্লাদবাহিনী তার বুকের ভেতর থেকে কলিজাটা স্রেফ উপড়ে নিয়েছে। কেন? কারণ তারা জানত তিনি চিকিৎসক, তাই তার হৃদপিণ্ডটা ঘৃণ্য আক্রোশে উপড়ে ফেলা হয়েছিল।
এরকম একটি ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের বিবরণ পড়ে শিউরে উঠতে হলো? এইসব ব্যাপার সংবেদনশীল মানুষকে তো শিউরে তুলবেই। প্রতিবেদনটি আমার পক্ষেও একবারে পড়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। শিউরে উঠে বারকয়েক লেখা থামাতে বাধ্য হয়েছি। গুলি করে পাকিস্তানি নরপশুরা তো লক্ষলক্ষ মানুষ খুন করেছে, কিন্তু আক্রোশ কতটা ঘৃণ্য হলে একজন মানুষের হৃদয়টা টেনে ছিড়ে ফেলে দেয়!
ডাক্তার ফজলে রাব্বীর কলিজা তুলে নেয়ার বিবরণটি আসলে লেখাটির শুরু মাত্র। সেই নিচু জলাভূমির ভিতর এক ভয়াবহ বীভৎস দৃশ্য'র ঘটনার বর্ণনায় হামিদা রহমান আমাদের আরও দেখান, চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আবদুল আলীম চৌধুরীর চোখ দুটো উপড়ানো। তার চোখ উপড়ে ফেলার কারণ হলো, কেন একজন চোখের ডাক্তার আবদুল আলীম এত মানুষকে দুনিয়া দেখিয়েছেন! কি মর্মান্তিক! একজন রহমবান মানুষ যিনি মানুষকে দুনিয়া দেখালেন, সেই মহান মানুষটিরই চোখের শূন্য কোটরে কি-না জমে ছিলো চাপ-চাপ কালচে রক্ত! দেহটা পড়ে ছিলো তার নিষ্প্রাণ!
সেই সারিতে এক নয়, দুই নয়—একেবারে বারো/তেরোজন মানুষ, যাদের প্রত্যেককে নির্মমভাবে হত্যা করে দেহ মোরব্বার মতো কেঁচে ফেলা হয়েছিলো বেয়নেট দিয়ে। হামিদা রহমান এরপর আর একটু এগিয়ে যেতেই সামনে দেখেছিলেন বড়সড় দু'জন মস্ত মানুষ, যাদের হাত-পা বাঁধা, নাক কাটা, কান কাটা, মুখের কাছ থেকে কে যেন খামচিয়ে মাংস তুলে নিয়েছে । আর একটু এগিয়ে যেতেই বাম হাতের যে মাটির ঢিবিটা ছিল তারই পাদদেশে একটি মেয়ের লাশ। 'মেয়েটির চোখ বাঁধা। মুখ ও নাকের কোনো আকৃতি নেই—কে যেন অস্ত্র দিয়ে তা কেটে খামচিয়ে তুলে নিয়েছে। স্তনের একটি অংশ কাটা... মেয়েটি সেলিনা পারভীন, সাংবাদিক, শিলালিপির এডিটর…।'
আহ! শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। এই মহীয়সীর নামটি ভাবনায় আসলে অনেক কথা চলে আসে। আমার ঠিক জানা নেই আর কোন পেশায় কাজ করলে মানুষের চক্ষুশূল হতে হয়। কিন্তু এদেশে সাংবাদিকতা পেশায় সততার সাথে কাজ করছেন তো আপনি যেন একপ্রকার অন্যায়ই করে ফেললেন। এটাই সম্ভবত একমাত্র পেশা, যে পেশায় সত্য তুলে ধরার অর্থই হলো বিপদের সম্মুখীন হওয়া। একজন সাংবাদিক কোনো অন্যায়, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুমখুনের বিরুদ্ধে তার কলম ধরলেন তো কলমটা তো ভেঙে ফেলার চেষ্টা করা হয়ই, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার হাতসহ গলাটাও কেটে ফেলার পায়তারা করা হয়। স্বাধীন দেশে কত সাংবাদিককেই না খুন হতে হলো!
যখন ভাবি যে এত এত ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই দেশটা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে একদম তলানিতে, লজ্জায় অবনত হতে হয়। লজ্জিত হই, মাথা নত হয়ে যায়। ভাবি পৃথিবীর মানুষ কি ধারণা করে না যে, আমাদের দেশটা এমন একটা দেশ, যেদেশের মানুষের মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা নেই? আমাদের রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকের ভাবনায় কি এই লজ্জাজনক ব্যাপারটি আসলেই কাজ করে না! অথচ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে আমাদের অবস্থান প্রথমদিকে থাকলে, দেশে মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকলে, পৃথিবীর মানুষ ঠিকই জানতে পারবে যে বাংলাদেশের মানুষ রক্তগঙ্গার বিনিময়ে স্বাধীনতা পাওয়া জাতি।
কিন্তু আমরা দেখি কি, আমাদের দেশের কিছু দুর্নীতিপরায়ণ, মাফিয়া নির্লজ্জ ব্যক্তি নিজেদের দোষ-অপরাধ ঢাকতে, আর রাষ্ট্রকে তাদের অপরাধের বিচার না করার ভয় দেখাতে পত্রিকা খুলে বসে। তারা রাষ্ট্রের মধ্যেই যেন ছায়ারাষ্ট্র চালায়। আর সেখানে সাংবাদিক নামধারী কিছু আত্মসম্মানহীন ব্যক্তি পেটে চারটা নর্দমার কোর্মা-পোলাও ঢালতে সাংবাদিকতার নামে তথ্যের বাজার বসায়, এবং প্রকাশকের হুকুম বাস্তবায়ন করে। রাষ্ট্রের একজন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে এই প্রশ্নটি আমি রাষ্ট্রকে বিনয়ের সাথে করতে চাই: তারা পত্রিকা খোলার আদেশ কোথা থেকে পায়? এসব কি ঘটার ছিলো? এসব ঘটানোর জন্য আমাদের সূর্যসন্তানরা নিজেদের রক্ত বিসর্জন দিয়েছেন?
আমাদের স্বাধীন দেশেই সাংবাদিকতা করার কারণে কত মানুষকে গুমখুন, হামলা-মামলার শিকার হতে হয়, পত্রিকা বন্ধের উপক্রম হয়, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন তো পাকিস্তানি নির্লজ্জ, মোনাফেক, হায়েনা, গণহত্যাকারীদের অন্যায্য, ঔপনিবেশিক স্বৈরাচারী শাসনকালে সংবাদিকতা করেছেন। শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীন পত্রিকার বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। বাঙালিদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের একনিষ্ঠ সমর্থক সেলিনা পারভীন যোগ দিয়েছিলেন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতিপর্বে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা এই মহীয়সী থাকতেন পল্টনের জনসভা আর শহীদ মিনার থেকে বের হওয়া নারীদের মিছিলের অগ্রভাগে। তার শিলালিপি পত্রিকায় তখন বাঙালি বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিক্ষক, সাহিত্যিক সকলেই যে লিখতেন তাই নয়, শিলালিপি পরিণত হয়েছিল বাঙালি স্বাধীনতার পক্ষের অন্যতম মুখপাত্রে।
অবর্ণনীয় ও পৈশাচিক অত্যাচারের মধ্য দিয়ে সেলিনা পারভীনকে (হোসেন বা হাসানদের নয়) খুন করা হয়েছে। কারণ: মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও সাহায্য দেওয়াসহ তার নানাবিধ কর্মকাণ্ডের কারণে এমনিতেই তিনি পাকিস্তানি ও আলবদরদের নজরে পড়ে গিয়েছিলেন, দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের বাঙালিদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে লেখা একটি বারুদ সংখ্যা প্রকাশ করায় সেই বারুদ লেখাগুলো তাকে পাকিস্তানিদের লক্ষ্যে পরিণত করেছিল।
আমরা একটি ছবি দেখি যে ছবিটিতে দার্শনিক গোবিন্দচন্দ্র দেব, কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সার, মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, ডাক্তার ফজলে রাব্বী, আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, সিরাজ উদ্দিন হোসেন, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক রশীদুল হাসান, ডক্টর আবুল খায়ের, ডক্টর মুর্তজা, সাংবাদিক সেলিনা পারভিন, খন্দকার আবু তাহের, নিজামউদ্দিন আহমেদ, এসএ মান্নান, এএনএম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, সঙ্গীতজ্ঞ আলতাফ মাহমুদ, সমাজসেবক রণদা প্রসাদ সাহাসহ আরও অনেকে আছেন সেই ছবিটিতে। স্বাধীনতার প্রাক্কালে, ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে, বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী সন্তানদের হত্যা করার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার ঘৃণ্য চক্রান্ত করেছিলো পাকিস্তানি দখলদারবাহিনী। তাদের এ-দেশীয় দোসরদের বিশেষ করে আল-বদর বাহিনীকে নিয়ে তারা এইসব শিক্ষক, বিজ্ঞানী, চিন্তক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, ক্রীড়াবিদদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসে অবর্ণনীয় ও পৈশাচিক অত্যাচারের পর হত্যা করে। আলবদর কর্মীরা ঠাণ্ডা মাথায় যে বুদ্ধিজীবীরা লেখালেখি করতেন তাদের আঙ্গুল কেটে ফেলে, চোখের ডাক্তার হলে চোখ তুলে ফেলে, হার্টের ডাক্তার হলে বুকের পাঁজর ভেঙে কলিজা বের করে, হার্ট উপড়ে হত্যা করে গণসমাধি দেয়।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, হাতেগোনা দু'চারজন ছাড়া সমসাময়িক কোনো কবিসাহিত্যিককেই এমন ভূমিকায় পাওয়া যায় না যারা রাষ্ট্রের চক্ষুশূল হয়ে উঠতে পারেন। অথচ এই রাষ্ট্রের অত্যাচারী স্বভাবটির আমূল কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। একটি ভূখণ্ড স্বাধীন হয়েছে বটে, একটি জাতি-পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে বটে, কিন্তু এই জাতির পরিচয়কে কিভাবে সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যে নির্মাণ করা হচ্ছে, কিভাবে এর সংবিধানকে ধর্মীয় গিলাবে মুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, কিভাবে শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রতিক্রিয়াশীলদের আশাপূরনের বস্তুতে রূপান্তরিত করা হচ্ছে তা নিয়ে আমাদের লেখকশিল্পীদের বিন্দুমাত্র উদ্বেগ নেই। বড়জোর মনে হয়, এরা লেখে, এরা গানবাজনা করে, অভিনয় করে। চারদিকে চেয়ে দেখি, আত্মকেন্দ্রিক আর স্বার্থপর মানুষে যেন ছেয়ে গেছে এদেশ। এরা যেখানে পায়, সেখানেই মুখ ডুবায়। সামান্য কিছু পুরস্কারের লোভ এদেরকে আত্মমর্যাদাহীন করে দেয়। আর অধিকাংশ শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের দেখে মনে প্রশ্ন জাগে: মানুষ এতটা মেরুদণ্ডহীন হয় কিভাবে! মনে হয় মেরুদণ্ড বস্তুটার ব্যাপারে এই সব লোকের ধারণা আছে কি-না সন্দেহ। রাজনৈতিক দলগুলো কি এদেরকে চরম পর্যায়ের লোভী বানিয়ে দেয়? নাকি সামান্য কিছু উচ্ছিষ্ট খাওয়ার জন্য এরা এমন বুভুক্ষু হয়ে থাকে? দেশটা তাহলে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াবে কিভাবে? মানুষের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা কিভাবে হবে?
আমার শহীদ কবি মেহেরুন্নেসার কথা মনে ভাসে। আমাদের সকলের মনে ভাসুক একজন মেহেরুন্নেসাকে যিনি ৭ মার্চ ১৯৭১, রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের সময়ও উপস্থিত ছিলেন। যিনি ২৩ মার্চ ১৯৭১ সালে দুই ভাইকে নিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মিরপুরে নিজ বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। ফলশ্রুতিতে ২৭ মার্চ তাদের বাড়িতে পাকিস্তানি আলবদররা অতর্কিতে আক্রমণ করে তাঁর দুই ভাই রফিক ও টুটুল এবং তার মাকেসহ নারকীয়ভাবে হত্যা করে।
আমরা শহীদ বুুদ্ধিজীবী দিবসে রাষ্ট্রীয় আয়োজনে এদেরকে স্মরণ করি বটে, কিন্তু মনে হয় এই স্মরণ আসলে বিস্মরণকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ তারা যে আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য লড়াই করে প্রাণ দিয়েছিলেন, সেই আদর্শ রাষ্ট্র যতক্ষণ না কায়েক হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে সত্যিকারের সম্মান দেখানো হয় না।