কিন্তু বাঙালির কাছে আড্ডা হলো শরীর ও মনকে সবল-সতেজ করার বটিকা বিশেষ।
Published : 16 Feb 2024, 12:45 PM
বাঙালি যে মনে প্রাণে এক আড্ডাবাজ জাতি তা এক সন্দেহাতীত বিষয়। এ জাতির সাথে আড্ডার দিক থেকে কেবল ফরাসিদের তুলনা চলে। অন্য ভাষায় আড্ডার তাই সমার্থক শব্দ পাওয়া যায় না। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, দেশের বাইরে আড্ডার ধারণাটি তাঁকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হয়েছে। ”আড্ডা জীবনভর” প্রবন্ধে তিনি লিখছেন: “আমাদের আড্ডাটা হচ্ছে কেউ কারও সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসে না। কোন একটা জায়গাতে এসে জড়ো হয়। যেমন কফি হাউসে। তরপর যে কোন্ কথা হবে তার ঠিক নেই। বিষয়বস্তু ঠিক থাকবে না। এক বিষয় থেকে আর এক বিষয়ে চলে যায়। এটাই তো আড্ডার বৈশিষ্ট। অন্য দেশে নির্দিষ্ট একটা জায়গায় (লোকজন) অ্যপয়েন্টমেন্ট করে আসে। বিশেষ একটা বিষয় নিয়ে তারা কথা বলে, সাধারণত তাই হয়।“
বাঙালির আড্ডার একটি অনন্য বৈশিষ্ট হচ্ছে ঋতু আর সময়ের তাল-লয়ের মত আড্ডার বিষয়ের উঠানামা। সকালে মর্নিং ওয়াক শেষে যে আড্ডা হয়, তার সাথে সন্ধ্যার চায়ের আড্ডার মিল নেই। আবার চাঁদনী রাতের আড্ডা কিংবা বর্ষার সন্ধ্যায় মুড়িমাখা সহযোগে কিংবা শীতের সন্ধ্যায় রাস্তার পাশে পিঠার দোকানে জমে উঠা আড্ডা, প্রতিটি ভিন্নধর্মী আমেজের।
বাঙালির শ্রেষ্ঠ আড্ডা-প্রিয় ও অতীব রসিক লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর গদ্য যেন এক অনবদ্য আড্ডারই বহিঃপ্রকাশ। আড্ডা নিয়ে লিখেছেনও ঢের। আমাদের ঢাকায় আড্ডার ইতিহাসও অনেক পুরনো। আড্ডাই বলুন আর গল্পের মজলিস কিংবা আখড়াই বলুন, এর কতগুলো অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ ও গুণাবলী রয়েছে। বলা যায়, ঐ সব নিমিত্তকে ঘিরে কয়েক রকম আড্ডা তৈরি হয়েছে। যেমন, গল্পের আড্ডা, গানের আড্ডা, খেলাধূলার আড্ডা এমণকি নেশার আড্ডা ইত্যাদি! এর বাইরে বলা যেতে পারে রাজনৈতিক আড্ডা, অসামাজিক আড্ডা, সাধু-আড্ডা এসবও রয়েছে বাঙালির নিত্য সঙ্গী হয়ে। অক্সফোর্ড অভিধান বলছে, গুরুত্ব নেই এমন বিষয়ে কথা বলাই হলো আড্ডা (chit-chat) আর Gossip শব্দটিকে পাশ্চাত্যরা নেতিবাচক অর্থে যেমন, পরচর্চা, পরনিন্দা ইত্যাদি বোঝাতে ব্যবহার করে। কিন্তু বাঙালির কাছে আড্ডা হলো শরীর ও মনকে সবল-সতেজ করার বটিকা বিশেষ। তাই বাঙালির খোশ-গল্পে মশগুল হওয়া নির্মল ও জীবন সঞ্জীবনী বলে ধরে নেয়া যায়।
যে কোন সামাজিক আড্ডা আমাদের শরীর ও মনের ওপর বিশেষ ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। আড্ডার কারণে শরীরে নানা রকম হ্যাপি হরমোন, যেমন, ডোপামিন, সেরোটনিন, অক্সিটোসিন, এন্ডারফিন ইত্যাদি তৈরি হয়। এসবের অভাব ঘটলে মানসিক অবসাদ, একাকিত্ব, সহিংসতা এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে। করোনাকালে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বাড়ি-বন্দী হয়ে মানসিক উদ্বেগের শিকার হয়েছিলেন, তাঁরা বাড়ি থেকে বের হতেও ভয় পেতেন। আড্ডা আমাদের ভালো থাকতে সাহায্য করে আর পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলে। আর এই ভালো থাকার উপর নির্ভর করে মেধা, মনন, দক্ষতা, সৃজনশীলতা, মনোসংযোগ ইত্যাদি বিষয়গুলো। আমাদের বিউটি বোর্ডিং আর ওপারের কফি হাউজের আ্ড্ডা যে কত জনপ্রিয় ও খ্যাতিমান লেখক-কবি, চিত্রকর ও গায়ক তৈরি করেছে তা আমরা কমবেশি জানি।
আড্ডা অনেক পুরনো
আড্ডার ইতিহাস অন্তত দুই লক্ষ বছর পুরনো । প্রাচীন মানবের নিরাপত্তার জন্য সন্ধ্যায় একত্রে সময় কাটানো একটি জরুরি বিষয় ছিল। সে সময় শিকার ধরার জন্য তাদের নিজেদের মধ্যে কিছু পরিকল্পনা বা ধারণা আদান-প্রদানের প্রয়োজন হতো। ভয়ঙ্কর কোন পরিস্থিতি থেকে সঙ্গী-সাথীদের বাঁচানোর বিষয়টি ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাই মনে করা হয়, মানুষের প্রথম শব্দ হয়তো ছিল, ”এই দ্যাখ।” অথবা, “বাঘ”, “ঈগল”, “চিতা” ইত্যাদি। গোষ্ঠীর কোনো সদস্য কী ভূমিকা পালন করবে, তা আগে থেকেই পরিকল্পনা করতে হতো। পরের দিন অনেকেই সময়মত হাজির হতে পারত না। তাদের গঞ্জনা সহ্য করতে হতো। সম্ভবত এখান থেকে নিন্দার চর্চা শুরু হয়েছে। পরশ্রীকাতরতার আরেকটি কারণ ছিল যৌনসঙ্গীর জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। এ ধরণের আড্ডার আগে মানুষের পূর্ব পুরুষেরা (Apes) পরস্পরের মাথায় উকুন বেছে দেয়া (Grooming), পরস্পরকে পরিস্কার করার মাধ্যমে সামাজীকিকরণ করত। প্রায় কয়েক লক্ষ বছর আগে যখন আগুন আবিষ্কার হলো, তখন সান্ধ্যকালীন আড্ডার ধরন ও বিস্তৃতি বেড়ে গেল। আগুনের উত্তাপ ছাড়াও বড় একটি বিষয় ছিল আগুনের কারণে ভয়ঙ্কর পশুরা মানুষের কাছে ভিড়তো না। সন্ধ্যায় পশু-পাখি শিকার করার দরকার ছিল না। ফলে, মানুষ আগের মত তাড়াতাড়ি না ঘুমিয়ে আগুনের চারপাশে বসে নানা গল্প-সল্পে মশগুল থাকতো। আগুন আবিষ্কারের পরে মানষের আড্ডা দুধের সরের মত সুমিষ্ট ও লোভনীয় হতে থাকে।
বাঙালির আড্ডা
মোগল আমলের আগেও ঢাকায় মোরগ লড়াই, গান-বাজনা ও আরো কিছু খেলাধূলার প্রচলন ছিল। তবে, নবাবদের সময়ে আড্ডার মাত্রা বেড়ে যেতে থাকে। ইতিহাসে দেখা যায়, নবাবগণ নাচ-গানের আসরের বিষয়ে অত্যন্ত সমঝদার ছিলেন। সেসময় লক্ষ্ণৌ থেকে নতর্কীগণ (কাঞ্চনী) আসতেন বাংলায়। কারণ, নবাবেরা তাঁদের অনেক মাশোহারা দিতেন। আর সাধারণ মানুষও রাগ সংগীতের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন। অন্তত ১,২০০ জন কাঞ্চনী পুরনো ঢাকায় অবস্থান করতেন যাঁরা মাসিক বেতনভূক ছিলেন বলে জানা যায়। ইতিহাস-বিদ হাকিম হাবিবুর রহমান তাঁর ঢাকা পঞ্চাশ বছর আগে ( ঢাকা পাঞ্চাশ বারস্ পাহেলে) বইটিতে লিখছেন, নবাবপুরে নবাববাড়ির বাইরেও অনেক বৈঠকখানা ছিল যেগুলোতে সাধারণ মানুষেরও প্রবেশিধকার ছিল। তিনি বলছেন: ”এটা ঐ সময়ের কথা যখন সমস্ত হিন্দুস্থানের নামিদামি গায়ক, রবাব ( বিশেষ বীণা বাদক), এবং সেতার বাদক মার্যাদা লাভের আশায় এখানে বারংবার আসতেন, বছরের পর বছর এখানে থাকতেন এবং ঢাকার অনুরাগী হয়ে পড়তেন, মিঠন খানের (সে সময়কার লক্ষ্ণৌ-এর বিখ্যাত গায়ক) মত সারা জীবনের জন্য এখানেই রয়ে যেতেন…।”
চায়ের আড্ডা
আমরা জানি যে ব্রিটিশ শাসকেরা বিনে পয়সায় বাঙালিদের মধ্যে চা বিতরণ করতেন যাতে করে পরবর্তীতে চা একটি লোভনীয় বাণিজ্যে পরিণত হয়। ’ঢাকাই খাবার ও খাদ্য সংস্কৃতি বই’য়ে সাদ উর রহমান জানাচ্ছেন, ”১৯১৫ সালে কলকাতায় চায়ের দোকান ছিল ৪৪৪টি যা পরের বছর শেষ নাগাদ বেড়ে দাঁড়ায় ১,১২৪ টিতে । তিনি আরো লিখছেন: ১৯১৮ সালে শুরু আর ১৯২০ সালের জুলাই নাগাদ ভারতজুড়ে ৭,০০০ দোকানে প্যাকেটে চা বিক্রি শুরু হয়। একই সময়ে টি চেজ কমিটি ৭০ লক্ষ ইনভেলাপ প্যাকেট সরবরাহ করে।” এই বাংলায় তো প্রবাদই আছে ”চায়ের কাপে ঝড় তুলে” গল্প চালিয়ে যেতেন আড্ডাবাজেরা! চা ও হুক্কার ব্যবহার ছিল ব্যাপক। ঢাকায় কাশ্মীরি চায়ের প্রচলন সম্পর্কে হাকিম হাবিবুর রহমান বলছেন: ”বিশেষত নিমকিন (নোনতা) কাশ্মীরী চা-এর স্বাদই ছিল আশ্চর্য ধরনের। এক ধরনের চা বিবাহ শাদীতে পান করানো হতো, যাকে ’গোলাম্নেবাদ’ বলা হতো। সঠিক শব্দ সম্ভবত হচ্ছে ’গোলাব বানাত’, মূলত এটি ছিল শরবত, যা বিবাহের মহফিলে পান করানো হতো।”
পরবর্তীতে আমরা দেখেছি, বড় বড় রেল স্টেশনে কয়লার আগুনে গরুর দুধের চা কিভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। বড় বড় রেল জংশন যেমন, পার্বতীপর, ঈশ্বরদী, যশোহর, চট্রগ্রাম এসকল স্টেশনে দিনে একবার চা না পান করলে আমাদের অনেকেরই দিন যেন ”রসকষহীন” মনে হতো। আর ঐ সব রেল স্টেশনে বইয়ের দোকানকে ঘিরে প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ ছাত্রদের এক নৈমিত্তিক অথচ সৃষ্টিশীল আড্ডা জমে উঠত।
ঢাকার বিউটি বোর্ডিং
একাধিক বইয়ে সদর ঘাটের কাছে বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিং নামক রেস্টুরেন্টে নানা সৃজনশীল আড্ডা বিষয়ে উদ্ধৃত করা আছে। তার মধ্যে ‘আমার ঢাকা আমাদের ঢাকা’ ( নজরুল ইসলাম ও কাজী মদিনা সম্পাদিত) বইয়ে লেখক আখতার হোসেন আড্ডা বিষয়ক এক প্রবন্ধে বলছেন, সকাল ১০ টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলত সে আড্ডা। বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বিভিন্ন স্তরের লোক বিউটি বোর্ডিং ঘিরে আড্ডায় অংশগ্রহণ করতেন। “কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, আব্দুল গাফফার চৌধুরীসহ তৎকালীন বহু তরুণেরা আড্ডায় মাতোয়ারা হয়ে যেতেন সেখানে। বিউটি বোর্ডিং ছাড়া সমসাময়িক ক্যাপিটাল রেস্টুরেন্টেও আড্ডা হতো। পরবর্তীতে একই ধরনের সৃজনশীল আড্ডা অন্যান্য রেস্তেরাঁয় বিশেষত গুলিস্তানের রেক্স, নিউমার্কেট ও ঢাকা কলেজের কাছে চিটাগাং হোটেলে কবি সাহিত্যিকদের আড্ডা চলত। পরে ৭০ এর দশকের মধ্যভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হাকিম মিয়া ও শরীফ মিয়ার ছাপড়ায় সকাল থেকে রাত অব্দি চলত আড্ডা। আর মধু’র কেন্টিন ছিল মূল রাজনৈতিক আড্ডার কেন্দ্র। এর পরে আজিজ সুপার মার্কেটে (স্টেডিয়াম মার্কেটের ম্যারিয়েটা গ্রন্থ বিপনী বন্ধের পর) আড্ডা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। এছাড়াও, বেইলী রোডের নাটক পাড়া ও শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গনে ঢাকার আড্ডার রেশ কিছুটা রয়ে গেছে।
আড্ডার জনপ্রিয় স্থান সমূহ
আগে যেসব স্থানে আড্ডা হতো, এখন নানা কারণে তা পরিবর্তিত হয়েছে। আগে চৌরাস্তার মোড়ে চায়ের দোকান, স্টেশনের চায়ের দোকান, ক্লাব ঘর, পুরানো দিনে খেয়াঘাট, রেস্তোরাঁ, সিনেমা হলের আশে পাশে, স্টেশনের বুকস্টলে আড্ডা জমে উঠতো। এছাড়া লাইসেন্সপ্রাপ্ত বার ও দেশী কেরু কোম্পানির পানীয় বিক্রয়ের ঘুপড়ি, অনুমোদনবিহীন আরো কিছু স্থান আড্ডার জন্য জনপ্রিয় ছিল, যেমন মেথরপট্টির কথা বলা যায়। পুরনো দিনে হোমিও ডাক্তার খানা, ধনী ব্যক্তির বৈঠক ঘর ইত্যাদি ছিল আড্ডা দেয়ার মোক্ষম স্থান। এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খোলা নাটমঞ্চ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র, ফেব্রুয়ারী মাসের বইমেলা, শীতকালীন গানের আসর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বর, মধু দা’র কেন্টিন, শিল্পকলা একাডেমি, বেঙ্গল শিল্পালয়, দৃক গ্যালারি ইত্যাদি স্থান আড্ডার অনন্য স্থান দখল করে আছে।
হারিয়ে যাচ্ছে আড্ডা
নতুন নতুন স্মার্ট ফোন ও স্যোসাল মিডিয়া এবং অফিস-ফ্যাক্টরিতে বাড়তি কাজের চাপে আমাদের হাজার হাজার বছরের পুরনো যুথবদ্ধ জীবনের আড্ডা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। বন্ধুরা পাশাপাশি বসে সবাই মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে কথা বলে। প্রয়োজনে অনেক সময় পাশে কাউকে পাওয়া যায় না। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, মোবাইল ফোনের নানাবিধ চাতুর্যপূর্ণ অ্যাপের কারণে আমরা সারাদিন বেশ কয়েক ঘন্টা এই যন্ত্রটি নিয়েই ব্যস্ত থাকি। এতে আমাদের নানা ধরনের মানসিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে যা মনোবিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে। ভেবে দেখুন: আগে কিছু জায়গায় গিয়ে ভিডিও গেম খেলতে হতো। ধরুন আমি/আপনি মাত্র ঘন্টা দু’য়েক কোন গেম সেন্টারে গিয়ে ভিডিও গেম খেলে আসতাম। ভেবে দেখুন ঐ যন্ত্রটি আমার সাথেই থাকে আর আমি সকাল থেকে রাত অব্দি নানা অজুহাতে তাতে (মোবাইল ফোন) খেলাধূলা-ফেসবুকিং করেই যাচ্ছি। আমাদের সন্তানদের হাতেও স্মার্ট ফোন ধরিয়ে দিয়েছি। গবেষকেরা বলছেন, গ্যাজেটের অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের আমাদের একনিষ্ঠ মনোযোগ মারাত্বকভাবে নষ্ট করে দেয়। সৃষ্টি হয় শুচিবাই (Obsessive Compulsive Disorder) ও চূড়ান্ত মনোযোগহীনতার রোগ। অনেকের স্বল্প মেয়াদী স্মৃতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় (Attention Deficit Hyperactivity Disorder)। আমরা আগে যেখানে বেশির ভাগ সময়ে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বা শিক্ষক-শিক্ষিকার বক্তৃতার প্রতি যে মনোযোগ দিতাম এখন সেখানে intermittent অর্থাৎ অনিয়মিত বা টুকরো-টুকরো মনোযোগ দেই। এতে করে পেশাগত ক্ষেত্রেও মারাত্মক সমস্যার সৃস্টি হচ্ছে। ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে সামনা-সামনি বসে আড্ডা দেওয়ার রেওয়াজ।
আড্ডা চর্চার সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হবে
আড্ডার সংস্কৃতির চর্চা প্রথমেই শুরু করতে হবে পরিবারে। পারিবারিক আড্ডার গুরুত্ব অপরিসীম। সম্ভব হলে দুপুর ও রাতে পরিবারের সব সদস্যদের একসাথে খেতে বসা উচিত, টিভি দেখা উচিত। এতে করে বাবা-মা ও ছেলে-মেয়েরা ভাব বিনিময় করার সুযোগ পায়। বাবা-মা এবং সন্তানরা পরস্পরের বন্ধু হয়ে ওঠে। এ বন্ধুত্ব জীবনকে সুন্দর করে তোলে। এ ধরনের পরিবারের সন্তানরা সফল হয়ে থাকে। কর্মক্ষেত্রেও সহকর্মীদের আড্ডা হলে তাদের মধ্যে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে, টিম স্পিরিট ভালো হয় এবং কর্মক্ষেত্রে অনেক সমস্যা সমাধানের ধারণা আড্ডা থেকে উঠে আসে।
দুঃখজনক বিষয় হলো নানা অজুহাতে, বিশেষ করে নিরাপত্তা ইস্যুতে ঢাকার আড্ডার জায়গাগুলোতে মাঝে মাঝে পুলিশি হয়রানি ও ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, গণগ্রন্থাগার সহ আরও অনেক পাবলিক প্লেসে গেলে নানা রকম নোটিশ চোখে পড়ে, এই যেমন, এখানে বসা নিষেধ, এখানে প্রবেশ নিষেধ ইত্যাদি। শুধু এই কথাটি বলা বাকি---এদিকে তাকানো নিষেধ। অথচ, নব্বুই এর দশকেও এ বিষয়গুলো ছিল না। আগে দেখেছি সন্ধ্যায় নানা পেশাজীবির লোকজন কাজকর্ম শেষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটু আড্ডা দেয়ার জন্য আসতেন। টিএসসি’র পাশে আয়োজন করা হতো পথ-নাটক কিংবা গান-কবিতার আসর। সে সময় অবশ্য স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল। যাহোক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কেউ কেউ হয়তো কিছু নেশা করতেন। কিন্তু, এই স্থানটি সন্ধ্যার পর বন্ধ করে দেয়া হয়। মানুষজনকে সৃজনশীল, মননশীল ও অধিক উৎপাদনশীল করতে হলে তাদেরকে নির্মল আড্ডার সুযোগ করে দিতে হবে।