কবিতার পরমায়ু

মানুষেরা মরে গেলে সেদিন আর কোনো 'মানব'-যে থাকবে না, বস্তুর রূপান্তর হবে মাত্র— এই সত্য আমাদের মেনে নিতেই হবে। জীবনানন্দ দাশ এটি করেননি। তিনি প্রলোভিত হয়েছেন এবং পাঠককে ইচ্ছাপূরণের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ফলে কবিতাটি বিনষ্ট হওয়ার দিকে এক পা এগিয়ে রয়েছে।

একরাম আলিএকরাম আলি
Published : 17 May 2023, 04:30 AM
Updated : 17 May 2023, 04:30 AM

আমরা আজ বলতে চেষ্টা করব কবিতার পরমায়ু নিয়ে দু-চারটে কথা। কিন্তু বলব-যে, কবিতার কি আদৌ প্রাণ আছে? কবিতা কি কোনো সজীব বস্তু?

কোনো-এক নিভৃততম মুহূর্তে একটি কবিতার জন্ম হয়েছিল। ভাষা, শব্দ, তাদের বিন্যাস, অলঙ্কার, চিত্রকল্প, কখনো-বা ছন্দ— এসমস্ত উপকরণ দিয়ে, সবার নয়, বিশেষ কোনো মানুষের মন উৎসাহী হয়েছিল তার চন্দ্র সূর্য নক্ষত্র আকাশ, তার কল্পনা বোধ প্রজ্ঞার সাহায্যে নিজেকে জগতের তরঙ্গে প্রবাহিত হতে দিয়ে একটা কিছু লিখতে। তার আগে ছিল তাঁর ক্রমপ্রস্তুতি। এই যে কল্পনা, নিজের এই কল্পনাকেও শিক্ষিত করতে হয়েছে তাঁকে।

তারপরও তাঁর রচনাকে বলতে পারি— সৃষ্টি? বলতে পারি কি এত বড়ো কথা? হ্যাঁ, বলব। কেননা, পড়বার সময় সেই লেখাটিরই ভেতর কোথাও আমরা গোলমালে পড়ে যাই। ব্যবহৃত উপকরণগুলোর বাইরে, এমনকি সেই মানুষটির চেষ্টারও বাইরে, লেখাটির নিভৃতে, প্রকৃতির কোনো নির্জনতর পিপাসাকে আমরা দেখি। আর, সেইগুলোই হয়ে ওঠে আমাদের মূল আকর্ষণ। সেই পিপাসা আমাদের মুগ্ধ করে। নতুন কোনো নিভৃতির ভেতর হেঁটে যেতে প্ররোচিত করে। সেই অতিরিক্ত কিছুকে আমরা কী বলব? যা-ই বলি না কেন, এখন আমরা বলতে পারি, কিছু-একটার জন্ম হল—যা এই প্রকৃতিতে, এমন রূপে, ছিল না। যা কবিতা। যিনি জন্ম দিলেন, তাঁকে আমরা বলব—কবি। আর কবিতাকে বলব—একটি সপ্রাণ অস্তিত্ব।

যদি এমন হয়, যে-ভাবেই হোক, জন্ম যদি হয়, তাহলে তো কবিতার মৃত্যুও অবশ্যম্ভাবী!

কিন্তু, মৃত্যু কী ভাবে হয় কবিতার? সে-মৃত্যু কি প্রাণীর মতো? পত্রপুষ্পশোভিত উদ্ভিদের মতো? প্রিয়তম পাঠককে নিজের রূপ রস, নিজের সর্বস্ব দিতে দিতে একদিন তার পাতা ফুল, তার সমস্ত রহস্য কি নিঃশেষ হয়ে যায়?

বিজ্ঞান বলছে, জীবনের সমাপ্তি স্তরে-স্তরে ঘটে। দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন সময়ে মারা যায়।
কবিতার পরমায়ু কি এইভাবে অংশে-অংশে শেষ হয়? কোনো কবিতায় শব্দের জীর্ণতা এবং অর্থপতন, অলংকারের পুনরাবৃত্তি, একঘেয়ে এবং শৃঙ্খলিত ছন্দ, বহুব্যবহৃত চিত্রকল্প, অবৈজ্ঞানিক চিন্তা— এসব একসঙ্গে-যে ঘটে, নাও হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটে না। তাই, প্রাণের মৃত্যুর সঙ্গে কবিতার মৃত্যুর একটি সম্পর্কের স্বচ্ছ জালিকাকে আমরা দেখতে পাই।

বিভিন্ন ধর্মীয় শাস্ত্র, যেমন সেমেটিক ও ভারতীয় ধর্মসমূহ, মনে করে— মৃত্যুতে সচেতনতা লোপ পায় না। কিছু-কিছু সংস্কৃতিতে মৃত্যুকে কোনো একক ঘটনার চেয়ে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রক্রিয়া বলতে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তর। আর, এইখানেই লুকিয়ে রয়েছে জটিল সমস্যার একটা সূত্র— অমরতার সমস্যার। কেননা, এইসব শাস্ত্রে বা বিশ্বাসে অমরতা একটি অফুরন্ত এবং পল্লবিত সম্ভাবনা। আর সম্ভাবনার এই ধারণাটি মানুষ সম্ভবত পেয়েছে মৃত্যু-পরবর্তী অবস্থার জগৎ থেকে,  নিজস্ব কল্পনায় তার অপূর্ণ জীবন আর স্বপ্নকে পূর্ণ করতে, পার্থিব ক্ষমতা প্রসারিত করতে, গগন-প্রান্তে সে-জগৎ নির্মাণ করেছে মানুষই।

এখানে বলতে পারি, কবিতার কোনো রূপান্তর নেই। যদি পাঠকের মন থেকে কোনো কবিতা নিশ্চিহ্ন হয়, যদি তার পরমায়ু শেষ হয়, তাহলে সেই কবিতাটি শেষ হয় চিরতরে। এভাবে পৃথিবী থেকে কত-যে কবিতা বিলীন হয়ে গেছে!

তবু থেকে যায় একটা কথা। একটি মৃত বা প্রায়-মৃত কবিতাকে কোনো বিশেষ পাঠকের কাছে পুনরুজ্জীবিত হতে আমরা কি কখনো দেখিনি? হয়তো আবার মৃত্যু ঘটবে কবিতাটির। তবু, অন্তত একজনের নিভৃত কক্ষে, স্বল্প সময়ের জন্য হলেও, বিস্মৃতির ধুলো ঝেড়ে সে তো আবার জেগে উঠল! হয়তো জেগে উঠল একটি নিঃসঙ্গ শব্দ, ভাঙা একটি পঙক্তি, দুটি ছিন্ন ডানা নিয়ে। হতেও তো পারে।

আরো কিছু কাজে লাগতে পারে মৃত কবিতা। কিছু ক্ষেত্রে লাগছেও। তার শবদেহ থেকে আমরা খুঁজে নিচ্ছি অন্য কিছু। যেমন, এখানে আজ যাঁরা উপস্থিত হয়েছি, কেউ আর কাব্যপাঠের নিভৃত আনন্দের জন্য কষ্ট করে ইনিড পড়ি না। ওপর-ওপর কাব্যটি এবং তার কবি ভার্জিল সম্বন্ধে একধরনের জানা আমাদের আছে। ওইটুকুই আমাদের ভার্জিল।

তবু দেখা যাচ্ছে, কাব্যটির সাহিত্যিক পরমায়ু শেষ হলেও রয়েছে অন্যতর ভূমিকা। ইনিড এখন হয়ে উঠেছে নৃতত্ত্ব গবেষণার উপাদান। নৃতত্ত্ববিদেরা প্রাচীন মহাকাব্যগুলোর সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করছেন বিশ্ব-ইতিহাসের নতুনতর ব্যাখ্যার সন্ধানে, যে-ব্যাখ্যার সাহায্যে মানুষের মনের স্থায়ী আর কালাতীত চিন্তার কাঠামোটি আবিষ্কৃত হতে পারে।

দুই

কবি তবু অক্ষরে-শব্দে-চিত্রকল্পে-ছন্দে-অলঙ্কারে আলো ফেলে-ফেলে খুঁজে যাচ্ছেন অমরতাকে।

একটি কবিতার পরমায়ু কত দিন, সেটি কবির বা তাঁর পাঠকের অধিগম্যতার বাইরে। আর, এইখানেও থেকে যাচ্ছে অমরতার সম্ভাবনা! সে-অমরতা আমাদের আয়ুর মাপের হলেও।

কিন্তু, আমাদের বাঙালি কবিদের মনে অমর হওয়ার আকুতি কখন জেগে উঠল? নাকি বরাবরই ছিল এই আকুতি?

না। ছিল না। উনিশ শতকের আগে হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যে যে-বাঙালির মন আমরা দেখি, সেই মনের নিভৃতেও অমর হওয়ার বাসনা ছিল না। অমরতার আকুতি প্রথম আমরা দেখি মাইকেল মধুসূদন দত্তর স্বপ্নদর্শী চিত্তে।

অবর্ণনীয় দুর্দশাগ্রস্ত এক জীবন তাঁর। অথচ কী গৌরবে ভরা!

১৮২৪-এ মধুসূদন দত্তের জন্ম। ১৮৪৩-এ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ। ১৮৪৮-এ জীবিকার সন্ধানে মাদ্রাজ যাত্রা। ওই বছরই ইংরেজ তরুণী রেবেকা টমসনের সঙ্গে বিয়ে। পরের বছর প্রথম সন্তানের জন্ম। ১৮৫১ সালে মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে কলকাতায় আসেন। ১৮৫৫ সালে পিতা রাজনারায়ণ দত্তের মৃত্যু। পিতৃসম্পত্তি উদ্ধারের আশায় কলকাতা ফেরার উদ্যোগ। রেবেকার সঙ্গে বিচ্ছেদ। হেনরিয়েটার সঙ্গে নতুন সংসার।

কলকাতায় ফেরেন ১৮৫৬-তে।

১৮৫৬-র আগে সবই তাঁর ইংরেজি রচনা। ওই বছরের ২ ফেব্রুয়ারির পর থেকে ১৮৬২ সালের জুন পর্যন্ত পাঁচ বছরই তাঁর সৃষ্টির সেরা সময়। ১৮৭৩ সালে ‘মায়াকানন’ নাটক রচনার ব্যর্থ চেষ্টা ছাড়া ‘শর্মিষ্ঠা’ থেকে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’— মাত্র পাঁচ বছরে লেখা। এবং কলকাতায়। লন্ডনবাসের সময়, ১৮৬৬ সালে, লেখেন শুধু ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ নামে একশোটি সনেট।

১৮৬২-র ৯ জুন আটতিরিশ বছর বয়সে ব্যারিস্টার হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিলেত গমন। তখনো তিনি এবং তাঁর পরিবার বিদেশে গিয়ে ভার্সাইয়ের ভয়ঙ্কর দারিদ্র্যের মুখোমুখি হননি, যেখানে অনাহারে বা অর্ধাহারে দিনের পর দিন সপরিবার তাঁদের দিনাতিপাত করতে হয়েছে।

সেই প্রথম কোনো বাঙালি কবি তাঁর কবিতার, কবিজীবনের, অমরত্ব চেয়ে মিনতি জানালেন মাতৃভূমির কাছে, মাতৃভাষার কাছে।

৯ জুন ১৮৬২ সালে বিলেত যাওয়ার আগে ৪ জুন রাজনারায়ণ বসুকে এক চিঠিতে লিখছেন—

Well!— I am off, my dear Raj Narain! Heaven alone knows if we are to see each other again! But you must not forget your friend. It’s long separation— four years!  But what is to be done? Remember your friend and take care of his fame.

ওই চিঠিতেই তিনি পাঠাচ্ছেন সেই বিখ্যাত কবিতা, যেটি পরে ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত কবিতাবলী’-র অন্তর্ভুক্ত হবে। ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ নামের সেই কবিতায় মধুসূদন দত্তর একান্ত মিনতি ছিল—

রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে
সাধিতে মনের সাধ,     ঘটে যদি পরমাদ,
মধুহীন করো না গো তব মনঃকোকনদে।
প্রবাসে দৈবের বশে,     জীব-তারা যদি খসে

এ দেহ-আকাশ হতে, খেদ নাহি তাহে।
জন্মিলে মরিতে হবে,      অমর কে কোথা কবে,
চিরস্থির কবে নীর, হায় রে, জীবন-নদে?...

‘রেখো মা দাসেরে মনে,’— এমন মিনতির পর শেষ স্তবকে লিখছেন: ‘অমর করিয়া বর দেহ দাসে, সুবরদে!’

এইখানে এসে বাংলা কবিতাজগৎ এক নতুন বাঁক নিল। এবার থেকে কবিরা চাইবেন অমরত্ব। এর আগে হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যে কোনো কবির এমন মিনতি ছিল না। চর্যাপদের সাধক-কবিদের থেকে শুরু করে বৈষ্ণব, শাক্ত, মঙ্গলকাব্য এবং বাংলা কাব্যধারার কোনো কাব্যে— এমনকি ভারতচন্দ্রেও— আমরা দেখিনি কবির বিস্মৃতিভীতির প্রকাশ। এবার কবিকে বলতে হচ্ছে— ‘রেখো মা দাসেরে মনে’। এবং পরবর্তী কবিদেরও মনে এই আকুতি সঞ্চারিত হয়েছে।

মধুসূদন-পূর্ববর্তী প্রায় প্রত্যেক প্রধান কবির কাব্যরচনার বিষয় ছিল স্ব-স্ব উপাস্যকেন্দ্রিক। যেমন চণ্ডীদাস ছিলেন বৈষ্ণব কবি। তেমনই বলতে পারি— শাক্তকবি রামপ্রসাদ সেন। মঙ্গলকাব্যের কবিদেরও উদ্দেশ্য স্ব-স্ব দেবদেবীর মহিমা প্রকাশ। দেবী চণ্ডী, মনসা, ধর্ম ঠাকুর, কালী, অন্নপূর্ণা— লোকসমাজে এঁদের প্রতিষ্ঠা দিতে, অমর করতেই, সেসব কবিরা ছিলেন সচেষ্ট। ব্যক্তির, কবি-ব্যক্তির, অমরতা সেখানে তুচ্ছ। বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তই প্রথম কবি,  যাঁর সঙ্ঘাতপূর্ণ জীবনে মুখোমুখি দেখা হল একইসঙ্গে নির্জন এবং উতরোল কবিতার সঙ্গে। কোনো দেব-দেবীর মাধ্যম সেখানে রইল না আর।

অমরতার সুশীতল ছায়াতলের খোঁজে সেই প্রথম কোনো কবিকে আমরা বেরিয়ে পড়তে দেখলাম।

বাংলা কাব্যজগতের প্রধান চরিত্রগুলির মধ্যে, সহজ করে ধরে নিতে পারি, মাইকেল মধুসূদন দত্তই প্রথম কবি, যিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যে ছিলেন সুপণ্ডিত। মনোমোহন ঘোষের মতে—

As a linguist and scholar, he had scarcely an equal among his contemporaries, and there is hardly any individual, even in these days, among his countrymen, who could excel him in his knowledge of the European languages and in literature both ancient and modern, of European countries.      

সযত্নে হোমার এবং ভার্জিল পড়েছেন। অন্য সব বিখ্যাত কবিদের প্রসঙ্গ তাঁর চিঠিপত্রে বারবার এসেছে। যেমন এসেছেন দান্তে, মিলটন। যুগে যুগে মানুষ যে-অমরত্বের অন্তহীন নিস্তরঙ্গে এঁদের দেখতে চেয়েছেন, মধুসূদন দত্তও নিশ্চয়ই তেমনই দেখতে চেয়েছিলেন নিজেকে। 

তিন

যদিও পৃথিবীতে প্রায় অর্ধেক মানুষ অপুষ্টির শিকার, বলা উচিত— না-খেয়ে অথবা কম খেয়ে তারা মৃত্যুর সঙ্গে একতরফা লড়াই করছে, তবু অনাহারই মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণ নয়। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি প্রাণের ভিতর সঙ্গী হয়ে এসেছে মৃত্যু। যেন তার যমজ।

প্রতিটি প্রাণীর, বৃক্ষের, শারীরিক গঠনের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ধ্বংসের বীজ। আর, সেই বীজই অঙ্কুরিত হয়ে একদিন প্রাণের সর্বনাশ ঘটাতে পারে।

কবিতায় এটা কীভাবে সম্ভব? কবিতার কোন অন্তরীক্ষে লুকিয়ে থাকে কবিতারই মৃত্যুবীজ? কবিতাটি লিখেছেন কোনো-একজন কবি। প্রতিটি শব্দ নির্বাচনে সদা সতর্ক থেকেছেন। আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন কবিতাটিকে সবরকম সুরক্ষা দিতে। যেন নির্মাণ করছেন লোহার নিশ্ছিদ্র দুর্গ! তবু সেই দুর্গে কেমন করে ঢুকে পড়ে মৃত্যুবীজ এবং কবিতাটির ধ্বংসসাধনে তারই গোপন কন্দরে বছরের পর বছর ঘাপটি মেরে থাকে, উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায়?

বাইশটি কবিতাংশ নিয়ে ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’ নামে একটি কবিতা পুস্তিকা। লেখক, গৌতম বসু। আমি তখন বীরভূমে। কলকাতায় এলে উচ্ছ্বাসপূর্ণ বাক্য-সহ বইটি আমাকে দেন পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল। কোনো বই পেলে সঙ্গে সঙ্গে আমি পড়তে পারি না। সেলফে থাকতে থাকতে বইটা যখন সেলফকে আত্মস্থ করে নেয়, তখন আমি পড়ি। তেমনই ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’। মাসটা ছিল অক্টোবর। তারিখ ৫। সাল ১৯৮২।

মনে আছে। কেননা ওই তারিখে পার্থপ্রতিমকে লেখা আমার একটি নাতিদীর্ঘ চিঠি রয়েছে। চিঠির একটা অংশে  লিখেছিলাম:

“না, মনখারাপ নেই। মন ভালোও নেই। মন আজ নেইই মনে হচ্ছে। কেননা, আজ ‘আমি’ নেই। একসময় ‘তুমি’ যেমন প্রবলভাবে ছিল, কিছুদিন ধরে বাংলা কাব্যজগতে ‘আমি’ও তেমনই প্রবলভাবে হাঁটে হাঁড়ি ভাঙার কাজ করেছে।... এতদিনে, এই বিরাশিতে, ‘আমি’র মুক্তি হল। ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’ নামে একটি পুস্তিকা, যেটি আপনিই আমাকে দিয়েছিলেন, এই মুক্তির কথা ঘোষণা করেছে। গোটা পুস্তিকাটিতে মাত্র একবারই ঐ ‘আমি’র ব্যবহার দেখে এত দিনে হাঁফ ছেড়েছি।

যে জানে শেষাংশ কীভাবে গীত হবে সেইজন সমাপ্তির রাজা

সেই বিদ্যা একমাত্র বিদ্যা, আমি মূঢ়...

এবং সত্যি উনি রাজা। গৌতম বসু। পার্থ, পুরুলিয়া যাওয়া হয়নি। এবং পারিবারিক কারণে যখন যাওয়া হবেই না স্থির জানলাম, তথন প্রায় বিরক্ত হয়ে ঐ পুস্তিকাটি হাতে টেনে নিই। এখন পুরুলিয়া নামক মরক্কোয় না যাওয়ার জন্যে আমার কোনো ব্যর্থতাবোধ নেই। পুস্তিকাটি আমিই খুলেছিলাম। পরে আমাকেই পুস্তিকাটি খোলে এবং খুলে দেখায়-যে গৃহকে সাধারণ ভেবে কত দিন আমি পার হয়ে গেছি!”

এসব গতজন্মের কথা। তারপর এত-এত বছর পার হয়ে গেছে। আমাদের—আমার ও গৌতম বসুর— বন্ধুত্ব গড়ে, ভেঙে একরকমের অটুট থাকলেও আমাদের গোত্র কোনো-এক সময় পৃথক হয়ে যায়।

উনিশশো বিরাশি থেকে দুহাজার তেইশ সাল। একচল্লিশ বছর। মানুষের জীবনে একচল্লিশ বছর কম সময় নয়। কত-কত অসুখ তাকে ঘায়েল করে। কোনোটা সারে, কোনোটাকে সঙ্গে নিয়েই বাঁচতে হয়। কিন্তু কোনো অসুখই সম্পূর্ণ সারে না। শরীরে থেকে যায় সেসবের চিহ্ন।

একচল্লিশ বছর পর কেমন আছে পুস্তিকাটির কাব্যস্বাস্থ্য? এই প্রশ্নটি আমাদের আলোচনাকে হয়তো বেষ্টন করে থাকবে। বা, বলা যেতে পারে-- এই প্রশ্নটিকে ছাড়িয়ে গিয়ে আমরা সংক্ষেপে দেখতে চেষ্টা করব, কবিতার পরমায়ু নির্ভর করে কোন্ কোন্ গুণের বা ত্রুটির ওপর।

সৃষ্টির মধ্যে যেমন বিনাশের বীজ দেখা যায়, তেমনই কবিতার মধ্যেও মৃত্যুর আর বিস্ময়ের আলিঙ্গনাবদ্ধ  চলে যাওয়া আমাদের চোখে পড়ে।

গৌতম বসুর থেকে বছর পাঁচেকের বড়ো রণজিৎ দাশ। সমসাময়িকই বলা যায়। যদি পড়ি তাঁর কবিতা, পড়েছি এখানে উপস্থিত সবাই, দেখব— গৌতমের কবিতার বিপরীত মেরুতে তাঁর কবিতার অবস্থান। আমরা একটিই কবিতা পড়ব এবং সেটির কিঞ্চিৎ খ্যাতিও আছে। কবিতাটির নাম— ‘শার্লক হোমস-এর ভারত-ভ্রমণ’:

সকল দেয়াল জুড়ে অজস্র ঘুঁটের সারি, দ্যাখো।

প্রতিটি ঘুঁটের তালে হাতের গভীর ছাপ

দেখতে পাচ্ছো, প্রিয় ওয়াটসন?

 

এদেশে, আমার

এটিই তদন্তসূত্র। বলো দেখি ওয়াটসন

হাতের ছাপের এই রৌদ্র ও পূরীষময় আশ্চর্য দেয়ালপুথি

যার প্রতি ভাঁজে ভাঁজে ফুটে আছে

শীর্ণকায় নারীদের শোকাচ্ছন্ন দ্রাবিড় আঙুল—

এর মধ্যে তুমি কোন্ অপরাধ, মৃদুহত্যা, সূর্যদাহ এবং ঈশ্বর

অবরোহ প্রণালীতে একে একে শনাক্ত করেছো?

 

কবিতায় বর্ণিত দৃশ্যটিকে দেখার চেষ্টায় এখানে এসে গেছে ব্রিটিশ-দৃষ্টি। শার্লক হোমস বা ওয়াটসনের উপস্থিতির কারণেই নয়, কবিই নিজেকে স্থাপন করেছেন ওই ভূমিকায়। এমনকি, যে-কবিতাগ্রন্থে রয়েছে কবিতাটি, সেটির নাম—  সময়, সবুজ ডাইনি। আমাদের মনে পড়েই যে, গ্রিন উইচ মিন টাইমে আমরা সবাই বাঁধা। কিন্তু সেই বন্ধন ছিন্ন করার প্রয়াস দেখি না রণজিৎ দাশের লেখায়। বরং, যেন ব্রিটিশ-গৌরবের আলো পড়ে ঝলমল করতে চাইছে কবিতাটি। এ হেন পরমুখাপেক্ষিতা কোনো কবিতাকে মুক্তচিত্ত করতে পারে না। আর, এইখানেই কবিতাটির পরাজয়।

গৌতম বসু এসবের থেকে যোজন-দূরত্বে।

এই দুই কবিই কিন্তু নিজের নিজের কবিতার পরমায়ু দীর্ঘ করার সাধ্য-অনুযায়ী চেষ্টা করেছেন।   

সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতা গ্রন্থে ‘সংকলকের নিবেদন’-এ গৌতম বসু লিখছেন— ‘লেখকের অমরতার সঙ্গে পাঠক-সংখ্যার একটি সুসম্পর্ক কখনও কখনও থাকে, কখনও কখনও থাকেও না।‘

এখানে অমরতার প্রসঙ্গটি এসেছে, আমরা ধরে নিতে পারি, মানুষের আয়ু-পরিধির নিরিখে। অর্থাৎ, সেই অমরতার শেষ বিন্দুটি দেখা যায়। আক্ষরিক অর্থে অমর নয়— অমর, তবে আমাদের মাপে। তবু আমরা ‘অমর’ শব্দটি বলতে এবং লিখতে ভালোবাসি। ‘অমর’ শব্দটিকেই আমরা অমরত্ব দিতে চাই; যদিও জানি যে, শব্দটির সর্বাঙ্গে মিথ্যা লেগে আছে, যে-মিথ্যেটুকু আমরা ভালোবাসি।

অন্নপূর্ণা ও শুভকাল অকুণ্ঠ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। এবং পরের বছরগুলোতে অতিশয় তৃণাংকুর পথে, রসাতল, নয়নপথগামী, স্বর্ণগরুড়চূড়া এবং জরাবর্গ প্রকাশিত হলেও প্রথম গ্রন্থের সেই মুগ্ধতাচিহ্ন পাঠকের চোখ থেকে আজো মুছে যায়নি। তাহলে কি পুস্তিকাটির সম্ভাবনা রয়েছে অমর হওয়ার? সেই উনিশশো একাশির অন্নপূর্ণা ও শুভকাল-এর?

এই প্রশ্নের উত্তরে নিরুপায়ভাবে আমাদের সহ্য করতে হবে বিবৃত সত্যটিকে যে, ব্রহ্মাণ্ডের আর সমস্ত কিছুর মতোই এই আশ্চর্য কবিতাপুস্তিকাটিও অমর নয়। হতে পারে না। কেননা, কবি নিজে পুস্তিকার বাইশটি কবিতার অনেকগুলোতেই রেখে গেছেন তাঁর অসহায়তা। তাঁর দগ্ধতাচিহ্ন। এই অসহায়তা যেমন কবির, তেমনই মানুষেরও।

কোথায় সেই অসহায়তা? দ্বিতীয় কবিতাতেই আমরা পাই এবং পেয়ে মুগ্ধ হই— ‘থালার বৃত্তাকার ক্ষুধা;’ সপ্তম লেখায় পাই— ‘এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল রামপ্রসাদ সেন।‘

উদাহরণ আর বাড়াব না আমি। কেননা, এগুলো অতি বিখ্যাত সব পঙক্তি বা বিবরণ। কেন এগুলোই অন্নপূর্ণা ও শুভকাল-এর মৃত্যুবীজ? কারণ, এইসব বিশেষ ভাবনা, চিত্রকল্প, পাঠকের চোখ এবং মন ধাঁধিয়ে দেয়। খিদেকে থালার বৃত্তে রূপ দিয়ে পাঠকের সমস্ত মুগ্ধতা শুষে নেওয়ার ফলে, বাকি কবিতাটি ক্রমে নিষ্প্রাণ, অস্পষ্ট হতে থাকে। দূরে, হেলাফেলার তালবনে ঘুরে বেড়ায় কবিতাটির অবশিষ্ট পঙক্তিমালা। এরা, এইসব বিখ্যাত চিত্রকল্প, কবিতাকে বিশেষ সাহায্য করে না। কবিকেও না। বরং এই দুই পক্ষের ক্ষতিই করে। যত দিন পারে, স্বার্থপরের মতো নিজের মহিমার ধ্বজা ঊর্ধ্বে উড্ডীন রাখার চেষ্টা করে যায়।

উদাহরণ হয়ে এখানে থাকল জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত একটি কবিতার পঙক্তি।

'মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব/থেকে যায়;'— ক-জন মনে করতে পারব, কোন্ কবিতা থেকে অহরহ আমরা আওড়াই কবির এই স্ফটিকোজ্জ্বল আশাটুকু? সবাই পারব না। তারপর একটু ভাবি যদি, দেখব, কী বিপজ্জনক এই পঙক্তি!

কেন বিপজ্জনক?

‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’— চণ্ডীদাসের সেই পাঁচশো বছরের পুরোনো পঙক্তিটি কেন আজো মনে রেখেছি আমরা? আমাদের মানব-পতাকাটি চির-উড্ডীন দেখতেই তো? কবিতার কাজ নয় মানুষকে মহান করে দেখা। এই পৃথিবীকে অবিনশ্বর রূপে প্রতিষ্ঠিত করাও কবির কাজ নয়। মানুষ যতটুকু, ততটুকুই| এই পৃথিবীও| এমনকি ব্রহ্মাণ্ডও| বস্তু সদাপরিবর্তনশীল| হয়তো-বা রূপান্তরকামীও| ধ্বংস হয়, বিচূর্ণ হয়| আবার নতুন রূপে প্রকাশিত হতে চায়| শূন্য অনন্ত বলে চিরকাল অনড় থাকতে চেয়েছে| পারেনি| বস্তু প্রতি মুহূর্তে শূন্যকে আঘাত করে-করে শূন্যতা বিনষ্ট করে গেছে| এমন চরম সংঘাতে মানুষ নামের তুচ্ছ প্রজাতিটিকে অমরত্ব দানের চেষ্টা কি অতি-সরলীকরণ নয়?


যদি এমন হত পঙক্তিটি: 'ঈশ্বরের মৃত্যু হলে তবুও ঈশ্বর থেকে যায়', তাহলেও মুক্তি পেতেন না কবি| স্থান-কাল-পাত্রভেদের কারণে একটু প্রসারতা পেত বড় জোর| তা-ও হত কি! জানি না|
এমন মায়াময় পঙক্তি থেকে হয়তো-বা আমাদের সতর্ক-দূরত্বে থাকা উচিত| এমন কবিতা শুধু শুনতে বা পড়তে ভালো লাগে। কেননা এতে রয়েছে অসহায়, মরণশীল মানুষের ইচ্ছাপূরণের আকাঙ্ক্ষা। অর্থাৎ, মানুষ মরে গেলেও মানবসমাজ তো বেঁচে থাকবে! ফলে আশাও থাকছে। কিন্তু একদিন সমস্ত মানুষেরই মৃত্যু হবে। মানুষেরা মরে গেলে সেদিন আর কোনো 'মানব'-যে থাকবে না, বস্তুর রূপান্তর হবে মাত্র— এই সত্য আমাদের মেনে নিতেই হবে। জীবনানন্দ দাশ এটি করেননি। তিনি প্রলোভিত হয়েছেন এবং পাঠককে ইচ্ছাপূরণের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ফলে কবিতাটি বিনষ্ট হওয়ার দিকে এক পা এগিয়ে রয়েছে।

আমরা আর-একটি কবিতার কাছে যাব। এবং এখানেও কবি সেই জীবনানন্দ দাশ।

আমরা জানি— বনলতা সেন’ নয়, বাংলাভাষায় জীবনানন্দ দাশের প্রথম পরমাণুশক্তিধর কবিতা ‘বোধ’। এরকমই আরেকটি-- ‘আট বছর আগের একদিন’। কিছু আগে-পরে ‘সুরঞ্জনা’। ‘সুরঞ্জনা’-নামের আশ্চর্য কবিতাটি প্রথম দুটোর থেকে সমদূরত্বে রয়ে গেছে আজো। প্রায়-নিরলংকার ‘সুরঞ্জনা’ উপমা-উৎপ্রেক্ষাকে তুচ্ছ করেছে। বৃহদায়তন পটভূমিতে আঁকা চিত্রকল্পকে খণ্ড-টুকরো কেন, বলা যায়, নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। ভেসে আছে শিশিরসিক্ত অবয়বহীনতা। তারপর এই পৃথিবীর কয়েকটি নরম আর অতি-চেনা শব্দের সাহায্যে সংঘটিত হয়েছে সম্পূর্ণ অচেনা এক মনোজগতের অপরূপ বিস্ফোরণ।

তবু মৃত্যু আসে। মলিন হয় পার্থেননের গৌরব।

বহুবার পড়া ‘আট বছর আগের এক দিন’। আজ মনে হল-- আরে, ‘অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে’? লিখেছেন জীবনানন্দ দাশ? দেখি তো। হ্যাঁ, ঠিকই। দেখে মর্মাহত হলাম। তাঁর বিশাল আর অতুলনীয় সৌধের একটা খিলানের অংশ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল যেন।

‘জানি-- তবু জানি

নারীর হৃদয়— প্রেম— শিশু— গৃহ— নয় সবখানি;

অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়—

আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে

খেলা করে;

এই যে বিস্ময়, যা বিপন্ন, বাংলা কবিতায় নবীন এক আগন্তুক, সে কি খেলা করতে পারে? ‘অন্তর্গত রক্তের ভিতরে’?

পালটা প্রশ্ন যদি আসে— কেন পারে না? উত্তরে বলতেই হয়, পারে না। কেননা, নয় এ মধুর খেলা! এ সেই ‘আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে...’ বা ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে’। সেই মরমী, কখনো অতি-অলৌকিক, কখনো লীলারূপী, কখনো দেহাতীত এই কাজটি আর যা-ই হোক, ‘বিপন্ন বিস্ময়’-এর পক্ষে করে ওঠা অসম্ভব। বিশেষত ‘অন্তর্গত রক্তের ভিতরে’। সে তো এসেছে আমাদের ক্লান্ত করতে। ক্লান্ত, ক্লান্ত করতে— যার পরিণতি লাশকাটা ঘর।

তবে কি লেখার এই বাঁকে চিন্তার, শব্দ-অন্বেষণের, শৈথিল্য ঘটেছিল কবির? যা-ই ঘটুক, এটা সেই ধ্বংসবীজ, কবিতার অপরূপ খিলান যে ধসিয়ে দিতে পারে। এত বছর পর সত্যিই খানিকটা দিয়েছেও।

অথচ, ‘বোধ’ কবিতায় তিনি তো লিখেছিলেন ‘কাজ’ শব্দটি, যা বোধ করতে পারে বলে প্রতীতি জন্মায়।

আলো-অন্ধকারে যাই— মাথার ভিতরে

স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে,

তবে এই কবিতাতেও জীবনানন্দ দাশ সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেননি নিজের নতুন অবস্থানে। প্রথম পঙক্তির যুদ্ধোত্তর জটিল ‘মাথা’ থেকে চতুর্থ পঙক্তিতে গিয়েই উনিশ শতকীয় হৃদয়ের শরণাপন্ন হয়েছেন কবি। সেই উনিশ শতক, যেখানে স্বপ্ন শান্তি ভালোবাসা বিকশিত হতে পারার সম্ভাবনা দেখেছিল মানুষ। হয়তো ভুল ছিল দেখায়। তবু, সেই একই আশ্রয়ে বোধ? যে-বোধ কবিরও অনেকটা অচেনা? কেননা, মনে রাখতেই হচ্ছে, শুধু বোধ নয়, তিনি লিখছেন ‘কোন্ এক বোধ’।

স্বপ্ন নয়-- শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়

হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;

আমরা জানি— হৃদয়ের মাঝে কোনো চিন্তার বা বোধের জন্ম হতে পারে না। হৃদয়ের চিন্তাশক্তি নেই। তার কাজ শরীরের রক্ত পরিশুদ্ধ করা এবং সেই পরিশুদ্ধ রক্ত শরীরে সঞ্চালন করা। চিন্তার আঁতুড়ঘর এক এবং অদ্বিতীয় মাথা। মস্তিষ্ক। মনও কি? নিশ্চিত রূপে জানি না।

যেমন ধরা যাক এই ছোট্ট কবিতাটির কথাও:

ভাঙা অক্ষর, হরফের খাঁজে

আঁশ।

অশুচিপত্রে নরকের ডাকছাপ।

বোবা ও বধির।

কালো ফুল মুখে ডানা মেলে দেওয়া

সাপ।

 

স্বাধীন, অসুন্দর।

কবিতার নাম: ‘আমার কবিতার বই’। কবি মৃদুল দাশগুপ্ত। বড়ো-বড়ো ঘাস মাড়িয়ে কবিতাটিকে আমরা আসতে দেখি বুনো আলপথে। পঙক্তিগুলি ভাঙা, উঁচুনীচু আর শুকনো আঁশ লেগে-থাকা দক্ষিণ বাংলার মতো স্যাঁতসেঁতে। বোবা। দূর নরকের জঙ্গল থেকে সে আসে এক দলা গুমোট হাওয়ার মতো। চরিত্রে সে এমনই দখনে, এমনই মুক্ত, এমনই বেপরোয়া-যে, কোনো দিকে দৃকপাত নেই। আশ্চর্য হওয়ার মতো এই কবিতাটি রয়েছে গোপনে হিংসার কথা বলি-নামের বইটিতে।

তাহলে কবিতাটি কি চিরজীবী? কবির আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও বলব-যে—না। দু-দু-টি বিপজ্জনক অংশ রয়েছে কবিতায়। ‘অশুচিপত্রে’ শব্দটি এবং ‘ডানা মেলে দেওয়া সাপ’। প্রথমত, সূচিপত্র থেকে অশুচিপত্রে লোভনীয় রূপান্তরের দুর্বলতা কবি কাটাতে পারেননি। দ্বিতীয়টি, অর্থাৎ ডানা মেলে দেওয়া সাপের চিত্রকল্পটি আমাদের যেন চেনা-চেনা। তবু কবিতাটি কেন এত টানে? আজো টেনে রেখেছে কেন? মুখে তার কালো ফুল। কিছু পিছুটান থাকলেও মধ্যবিত্ত সৌন্দর্যধারণাকে ধ্বংস করার মতো ক্ষমতা আজো রয়ে গেছে কবিতাটির মধ্যে। যতদিন এই ক্ষমতা থাকবে, তত দিনই কবিতাটির পরমায়ু।  

তবু আমরা আশাবাদী এবং চিত্রা কাব্যে (প্রকাশকাল ১৩০২ বঙ্গাব্দ) ‘১৪০০ সাল’ নামের এক কবিতায় আমাদের কবি লিখেও গেছেন—

          আজি হতে শতবর্ষ পরে

কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি

      কৌতূহলভরে—

   আজি হতে শতবর্ষ পরে।

সে-শতবর্ষ আমরা পেরিয়ে এসেছি কবে, তা দশক তিনেক হল। কবিতাটি আজো-যে পড়া হয় কখনো কখনো, সে-শুধু কবির ওই শতবর্ষীয় আকাঙ্ক্ষার আর কৌতূহলের জন্য।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র-রচনাবলীর বিখ্যাত ষোড়শ খণ্ডে কবিতাটি সম্বন্ধে একটি মাত্র ছোট্ট তথ্য রয়েছে। সেটি হল— ‘কবিকণ্ঠে এই কবিতাটির আবৃত্তি-রেকর্ড [রেকর্ডসংখ্যা BD1243, P8366] করা হয়েছিল।‘ ব্যস! এইটুকুই।

তাই বলতে চাইছি— কবিতাকে ফাঁপিয়ে দেখার, বড়ো করে দেখার, চেষ্টা আমরা করতে পারি না। কবিতা যতটুকু, ততটুকুই। সৃষ্টির আর সব কিছুর মতোই— মরণশীলও। আর সেইজন্যেই, কবিতা পড়ার সময় বিনীতভাবে এই কথা মনে রাখতে চাই— কোনো অমর বাণী আমি পড়ছি না।

তবু, আমাদের জীবনের চেয়ে অন্তত কিছু বেশি আয়ুসম্পন্ন এইসব পঙক্তিমালা পড়ার সুযোগ, চিন্তার নতুন পথে বিচরণের সুযোগ-যে পাচ্ছি, এই-বা কী কম? আমাদের কবিরা, বিশেষ করে বলব— আজকের আলোচ্য কবি, যিনি প্রয়াত, রচনা করেছেন এমন সব কবিতা, দৃশ্যমালা, যেখানে রয়েছে সঞ্চিত আর অনাথ— দ্বিবিধ ভয়। অবিরাম প্রসবিনী ঝড়ের যন্ত্র। জানিয়ে গেছেন, শব্দও একপ্রকার অন্ধকার, যে-অন্ধকারে তিনি ছিলেন কান পেতে। দেখেছেন নিদ্রার শোভা। আমাদের দেখিয়েছেন শূন্যতা থেকে আলোর ঝুলন্ত ফাঁস। আর, নীচে মাতার বঁটিতে সন্তানের মাথা!

পরমায়ুর দৈর্ঘ্য যত ক্ষুদ্রই হোক, নিজের সময়ে বসে, আমাদের নশ্বর জীবনের এক কোণে, কোনো কবির কবিতা যদি দিতে আসে এমন সব সফেন সমুদ্র-মন্ত্রণা, যদি টেনে নিয়ে যায় গার্হস্থ্যজীবনের অচেনা তরঙ্গমর্মরে, সেটুকুই কি যথেষ্ট নয়?

 (১৩ মে, মহাবোধি সোসাইটি হলে পঠিত ‘গৌতম বসু স্মারক বক্তৃতা’।)