হৃদয়রাজ্যটির সার্বভৌমত্ব তো শুধুই তার, ফলে প্রেমিকের চিরাচরিত স্বভাব এই যে, সে খেলা দেখাবে তার দেখানোর ইচ্ছায়।
Published : 27 Dec 2023, 11:01 AM
তােমারে যে ভালােবাসে এর থিকা আরাে পাঁচগুণ
আল্লার কসম আমি দিমু তারে এই জামাখান,
আমার কলম আমি দিমু তারে, শরীলের খুন
দোয়াত ভরায়া দিমু, অনুরােধ খালি একখান--
সে য্যান আমার থিকা আরাে ভালাে পদ্য লেখে আর
যাদুমন্ত্রে রূপার শিকল হাতে দিতে পারে তার।
পরানের গহীন ভিতর-এর ফ্ল্যাপে লেখা পঙক্তিগুলো দিয়ে লেখাটি শুরু করার কারণ এই: সৈয়দ শামসুল হক 'সচিত্র সন্ধানী' পত্রিকায় নবী মুনশী ছদ্মনামে ১৯৮০ সালে কবিতাগ্রন্থটির সনেটগুলো যখন প্রকাশ করেছিলেন, তার বিবাহিত জীবন তখন প্রায় ১৫ বছরের। শিল্পসাহিত্যের আউলিয়াদের কাছে তো বটেই, দেশের সাহিত্যের পাঠকদেরও হয়তো অজানা নয় সৈয়দ হকের ওপেন সিক্রেটটি যে, তিনি ছিলেন ব্যাপক কামুক ও প্রেমিক। যদিও ফ্রয়েড আমাদের ধারণা দিয়েছেন 'সমস্ত আচরণের চালিকা শক্তি হলো যৌনাকাঙ্ক্ষা', আর এটা না-থাকাটাই অস্বাভাবিক ব্যাপার, নারীপ্রহরায় পরিব্যপ্ত হক সাহেবে ঈর্ষান্বিত হয়ে অনেকে আবার বাড়িয়েও বলেন, সৈয়দ হক শুধু কামুকই ছিলেন। ফলে, উদ্ধৃত পঙক্তিগুলো পাঠ করে এই বিস্ময়ে বিস্মিত হতে হয়, কোন সে তুমুল রূপবতী হক কবির মতো কামুক প্রেমিককে এমন তুমুল প্রেমে হাবুডুবুরত রাখতে পেরেছেন! আল্লাবিল্লাহ না-করা সৈয়দ হক প্রেমের উত্তাপে পুরোপুরিভাবে মুসলমানের সাচ্চা বাচ্চার মতন কি-না আল্লাহর কসম খেয়ে তার প্রেমিকাকে তার চেয়ে যে বেশি ভালােবাসে, প্রেমিকাকে নয় সেই প্রেমিককেই দিতে চেয়েছেন তার থেকে বেশি আরাে পাঁচগুণ ভালবাসা! শুধু তাই নয়, তার শরীরের খুন পর্যন্ত ভরিয়ে দিতে চেয়েছেন দোয়াতে!
প্রেমের দ্বারা চেতনা যে পূর্ণশক্তি লাভ করে সেই পূর্ণতার দ্বারাই সে সীমার মধ্যে অসীমকে, রূপের মধ্যে অপরূপকে দেখতে পায়—তাকে নূতন কোথাও যেতে হয় না, বলেছেন কবি রবীন্দ্রনাথ। হক কবির বেলায় তাই হয়তো ঘটে থাকবে: কবি সীমার মধ্যে অসীমকে, রূপের মধ্যে অপরূপকে দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের বিস্ময়ের অন্ত রয় না যখন কবির দ্বিধাথরথর তুমুল পঙক্তিগুলোর শেষ পঙক্তি দুটির গভীরে আমরা মনোনিবেশ করি। কবিদের সম্বল তো কবিতা, সৈয়দ হকও তার কবিতা দিয়েই প্রেমের বাহুবন্ধনে জড়িয়ে নিতে চেয়েছেন প্রেয়সীকে। কিন্তু প্রেমে থরথর কবি হৃদয়ের গোপন-গভীর তীরতীর তীব্র তলদেশের তারোধিক গভীরে দুঃখ রেখে বানপ্রস্থ প্রেমিকদশার পরও তার কবিতার ও প্রেমিকার প্রতি রাখা ঈমান থেকে সরে না-এসে বলেন: 'সে য্যান আমার থিকা আরাে ভালাে পদ্য লেখে আর/ যাদুমন্ত্রে রূপার শিকল হাতে দিতে পারে তার।'
প্রেমিক কবে, কোন কালে পাওয়া-না-পাওয়ার পরোয়া করে! হৃদয়রাজ্যটির সার্বভৌমত্ব তো শুধুই তার, ফলে প্রেমিকের চিরাচরিত স্বভাব এই যে, সে খেলা দেখাবে তার দেখানোর ইচ্ছায়। সে ডাহুক উড়িয়ে দিয়ে বুকের গভীরে দীর্ঘ হাহুতাশ করবে; সোনার মোহর তার পড়ে থাকবে পথের ধূলায়; ধরার তীব্র আকাঙ্ক্ষা সে বুকে পুষে রাখবে ঠিকই কিন্তু প্রেমের গোঁ-ভররত প্রেমিক ধরবে না ডাহুকটিকে। কেনইবা সে ধরবে! সে তো জীবন বাজি রেখেছে পরানের গহীন ভিতরে। অদৃশ্য এক রুমাল নাড়ানো--এ মূলত প্রেমিক বাজিকরের বড় দারুণ বাজি।পরানের গহীন ভিতর-এ হক সাহেব গ্রাম-বাংলার প্রেমিকের প্রেমের বাজি, জীবনের ক্লেদ, জটিলতা, জীবন-জিজ্ঞাসা আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেই প্রেমিকশোভার রূপটি প্রতিবিম্বিত করেন এই ভাবে: 'তোমার সাক্ষাৎ পাই যেইখানে দারুণ বিরান,/ ছায়া দিয়া ঘেরা আছে পরিস্কার তোমার উঠান/ অথচ বেবাক দেখি শোয়া আছে মরনের খাটে।'
কবিতাগ্রন্থটিতে একটি ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় নিহিত রেখেছেন সৈয়দ শামসুল হক। প্রেমিকের তীব্র দহনই শুধু কবিতাগ্রন্থটিতে তিনি প্রকাশমান রাখেননি; কবি প্রেম, প্রেমিকার হৃদয়টিতেও সিঞ্চনরত থেকেছেন। গ্রন্থটির শেষ সনেটেও সৈয়দ শামসুল হক নারী হৃদয়ের আকুতি এঁকেছেন।চিত্রকল্প, উপমার প্রয়োগে তিনি কথকের ভূমিকায় রেখেছেন নারীকে। তার নারীত্বকে ধারণ করা ব্যাপারটি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় যখন আমরা পাঠ করি:
তোমার খামচির দাগ এখনো কি টকটাকা লাল,
এখনো জ্বলন তার চোৎরার পাতার লাহান।
শয়তান, দ্যাখো না করছ কি তুমি কি সোন্দর গাল,
না হয় দুপুর বেলা একবার দিছিলাম টান?
না হয় উঠানে ছিল লোকজন কামের মানুষ,
চুলায় আছিল ভাত, পোলাপান পিছের বাগানে,
তোমারে পরান দিছি, তাই বইলা দেই নাই হুঁশ,
আমি তো তোমারে নিতে চাই নাই ঘরের বিছানে।
হ, জানি নিজের কাছে কোনো কথা থাকে না গোপন।
দিনের দুফুর বেলা যেই তুমি আসছিলা ঘরে
আতখা এমন মনে হইছিল- আন্ধার যেমন,
আতখা এমন ছায়া সোহাগের আর্শির ভিতরে।
আবার ডাকলে পরে কিছুতেই স্বীকার হমু না।
বুকের পাষাণ নিয়া দিমু ডুব শীতল যমুনা।
[পরানের গহীন ভিতর ৬]
মানুষ কখনো এমন বৃক্ষের সন্ধান করে, যার ডালে নাই কোন পরী? বাংলা জনপদের আর কোন কোন অঞ্চলে গাছের ডালে পরী বসে থাকার ব্যাপারটি চালু আছে তা আমার জানা নেই। কিন্তু রংপুর অঞ্চলের মানুষজন এই ব্যাপারটির সাথে পরিচিত। তারা গাছের ডালে পরী খুঁজতো। কিন্তু এর থেকে যদি ধারণা করা হয় কবি রংপুর অঞ্চলটিকে উপস্থাপন করেছেন, ভুলটি ভাঙতে তিন নম্বর সনেটটি পাঠ করাই যথেষ্ট হয়ে যায়। এখানে এসে আমাদের থামতেই হয়, কেননা সৈয়দ হক এই সনেটটিতে মরমে-আঘাত-লাগা বাংলার সেই চিরায়ত প্রেমিক-প্রেমিকাদেরই উপস্থাপন করেছেন যারা প্রেমের বিচ্ছেদে ধুতুরা খাওয়া মানুষদের থেকেও বড় যন্ত্রণায় পোড়ে। বিষের পেয়ালায় চুমুক না-দিয়েও তারা হাত-পা শরীর অবশ করে; তারা নীল হয়ে যায় প্রেমবিষের দংশনে। উল্লেখ করি, সৈয়দ হক তার অসম্ভব কবিত্বের মুন্সিয়ানায় সনেটটিতে নরনারী নির্বিশেষে প্রেমের স্বরূপটিই ফুটিয়ে তুলেছেন।
কতবার গেছি আমি গেরামের শ্যাষ সীমানায়
আদাড় বাদার দিয়া অতিঘোর গহীন ভিতরে,
কত না গাছের পাতা কতবার দিয়াছি জিহ্বায়,
এমন তো পড়ে নাই পানি এই পরানে, শিকড়ে।
তয় কি অচিন বৃক্ষ তুমি সেই ভুবনে আমার,
আমারে দিয়াছো ব্যাধি, নিরাময় অসম্ভব যার?
[পরানের গহীন ভিতর ৩]
অধ্যাপক মোহাম্মদ সামাদ বলেছিলেন সৈয়দ হককে অনুসরণ করে সামাদের কালের ও তার পরবর্তী কালের কবিরা আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লেখার চেষ্টা করেছেন। আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লেখার রীতিটি বাংলা সাহিত্যে অনেক পুরনো ব্যাপার তো বটেই, মোহাম্মদ সামাদের মতো অনেকে এই ভুলপাঠ করে সাহিত্যের পাঠকদের মধ্যে একটি ভুলবার্তা প্রদান করে থাকেন। উল্লেখ করি, সৈয়দ হকের পরানের গহীন ভিতর মোটেও রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত নয়। বাংলা সাহিত্যে ধ্রুপদি মর্যাদা লাভ করা কবিতাগ্রন্থটির কবিতাগুলো কবি এমন এক আশ্চর্য ভাষায় লিখেছেন যে ভাষাটি কবির নিজের সৃষ্ট। ‘আসলে ভাষাই হইল একমাত্র ভাবের পালক... ভাষাই আপন করে আর সেই ভাষা করে পর,’ এই কথা উল্লেখ করে সৈয়দ হক বিভিন্ন জায়গায় বলেওছিলেন যে এটা কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভাষা নয়। কবিত্বের অপূর্ব জাদুর কাঠিতে বাংলার মানুষের মুখের ভাষার যে সুমিষ্ট ও সহজ অভিব্যক্তি, কবি তা ধারণ করে কবিতার পঙক্তিতে সপ্রাণ করে তুলেছেন।
প্রত্নতত্ত্ব আমাদের বুঝতে সাহায্য করে না শুধুমাত্র কোথায় এবং কখন মানুষ পৃথিবীতে বাস করত, কিন্তু তারা কীভাবে বসবাস করেছিল তাও। প্রত্নতাত্ত্বিকরা সময়ের সাথে পরিবর্তন পরীক্ষা করে, নিদর্শন এবং ব্যাখ্যা খোঁজেন। কিন্তু কবি সৈয়দ হক বাঙালির প্রেম, বিরহ, কামতৃষ্ণা, বিচ্ছেদবেদনা, প্রবৃত্তির সবটুকু সারাৎসার ধারণ করে আমাদের আত্মপরিচয়েরই প্রত্নচিহ্নই যেন এঁকেছেন কবিতাগ্রন্থটিতে৷
আবার তোমার কোলে ফিরা যায় তোমার সন্তান,
আবার তোমার কোলে, খালি কোল, উথলায়া পড়ে
দুধের ঘেরানে ভরা, জননী গো, পুন্নিমার চান–
আবার সে ঘরে ফিরা আইসাছে সারাদিন পরে।
আবার সে আইসাছে করালের ঘুম চক্ষে নিয়া,
চক্ষের ভিতরে তার গেরেপ্তার বিহানের সোনা,
তবনের নীল খোপে শিমুলের লাল রঙ নিয়া,
আবার সে আইসাছে, জননী গো, তুমি কাইন্দো না।
[পরানের গহীন ভিতর ২৪]