ভলতেয়ার কেন দরকার

ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি ক্ষুরধার লেখার কারণে হয়ে উঠেছিলেন এক জলন্ত তরবারি।

রাজু আলাউদ্দিনরাজু আলাউদ্দিন
Published : 30 May 2023, 04:32 AM
Updated : 30 May 2023, 04:32 AM

এই যুগ যুক্তির ভোরের যুগ। এই ক্ষণে অন্ধ বিশ্বাসরূপী হাইড্রার কতিপয় মাথা আবারও জাগতে দেখছি আমি। তবে তার বিষের মারণ ক্ষমতা পূর্বাপেক্ষা কম, দাঁতালো চোয়ালের ধারও আগের মতো নয়।

 সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐশ্বরিক করুণা লাভের জন্য ততটা রক্ত ঝরেনি যতটা আগে ঝরেছিল খোলা বাজারে প্রকাশ্যে বিকিকিনি হওয়া ঐশ্বরিক ক্ষমা লাভের জন্য। তবে অন্ধবিশ্বাসের দানব এখনও জীবিত রয়েছে। যে ব্যক্তি সত্যের সন্ধানে ব্রতী হবেন তিনিই নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবেন।

আমরা কি তবে আঁধারে অলস বসে থাকব, নাকি আমরা মশাল প্রজ্জ্বলনে উদ্যোগী হব যা দেখে ঈর্ষা ও মিথ্যার বেসাতি তাদের নিজেদের মশালও প্রজ্জ্বলন করবে?

আমার দিক থেকে আমি মনে করি এইসব দানবের কাছে সত্যকে আর লুকিয়ে রাখা উচিত হবে না, ঠিক যেমন বিষ খাওয়ানো হবে এই আশঙ্কায় আমরা নিজেরা খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত থাকব না।(Collected works of Voltaire, Walter J, Black, Inc, 1927, P 468)

ইংরেজদের আগেই ফরাসিরা এই ভূখণ্ডে উপনিবেশ গড়ে তুললেও ইংরেজদের প্রবল রণশক্তি আর কূটকৌশলের কারণে ফরাসিরা হটে যেতে বাধ্য হয়েছিল। বাকি ইতিহাস সবারই জানা। ইংরেজরা দু’শ বছর আমাদেরকে কেবল শাসনই করেনি, আমাদের মনোজগতেও তাদের উপনিবেশ গড়ার জন্য যা যা করণীয় তার সবই তারা করেছে; ফরাসি বা স্পানঞলদের মতো যদিও ইংরেজরা তাদের ভাষা আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য জবরদস্তি করেনি, বরং আমরাই, বাবু-সমাজ ইংরেজদের কৃপাপ্রার্থী হয়ে বিষয় সম্পদে দ্রুত ফুলে-ফেঁপে ওঠার আশায় ইংরেজি শিখেছি; পরবর্তীকালে এটি হয়ে উঠেছে একই সঙ্গে আমাদের উপার্জন ও জ্ঞানার্জনের ভাষা, এমনকি আমাদের শ্রেণি ও মর্যাদা-নির্ধারক এক ভাষাও। উচ্চবিত্ত ইংরেজি-জানা বাঙালিদের মধ্যে যারা জ্ঞানাকাঙ্ক্ষী ছিলেন তারা ইংরেজদের জ্ঞানভান্ডারে প্রবেশ করেছেন। অল্প যে-কয়েকজন সরাসরি ফরাসি জেনে কিংবা ইংরেজির মাধ্যমে ফরাসি সাহিত্যের স্বাদ আমাদের রসনায় তুলে দিয়েছিলেন, তার ধারাবাহিকতা ক্ষীণ হতে হতে শীর্ণকায় হয়ে গিয়েছিল। তিরিশের দশকে সেটি আবার সুস্বাস্থ্য অর্জন করেছিল বোদলেয়ার অনুবাদের মাধ্যমে–বুদ্ধদেব বসুর হাতে। সেই ধারাবাহিকতায় আরও কিছু ফরাসি লেখকের তর্জমা আমরা পাঠের সুযোগ পেয়েছিলাম বাংলা ভাষায়।

১৭৮৫ সালে ফরাসি চন্দননগরে কর্মরত তরুণ ভাষাবিদ ওগুস্তেঁ ওসাঁ বাংলা-ফরাসি শব্দকোষ প্রণয়নের মাধ্যমে চিত্তাকর্ষক বন্ধন তৈরি করলেও সামাজিক ও রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে সেই বন্ধনের কোনো অনবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা ছিল না। ফলে বিক্ষিপ্তভাবে সত্যেন দত্তের ছন্দোময় প্রশ্রয়ে পুষ্পিত হয়ে উঠলেন ভিক্টর হুগো, লেকৎ-দে-লিল, পল ভের্লেন, বোদলেয়ার, ভলতেয়ার ও আলফ্রেড ডে মুসে-এর মতো ফরাসি কবিকুল। রবীন্দ্রনাথ তার তর্জমায় তুলে নিয়েছিলেন মাত্র দুজন ফরাসি কবিকে, ভিক্টর হুগো আর জাঁ পীরের ফ্লরিয়া নামক স্বল্প পরিচিত এক ফরাসি কবিকে। রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরই কেবল এই ফরাসি সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি এককভাবে সবচেয়ে বেশি নিবিষ্টতার স্বাক্ষর রেখেছেন। মূল ভাষা থেকে অসংখ্য গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস, দর্শন, ভ্রমন-বিষয়ক গ্রন্থের অনুবাদ করেছেন। বহু দশকের ব্যবধানে ননীমাধব চৌধুরীর বাংলা অনুবাদে মূল ভাষা থেকে ফরাসি চিন্তাজগতের এক অনন্য স্তম্ভ জাঁ জাক রুশোর সামাজিক চুক্তি(১৯৭০)র অভ্যুদয় ঘটলেও, ততদিন পর্যন্ত ভলতেয়ার, যিনি বহু বিচিত্র সৃজনীসত্তায় এক চোখ-ধাধাঁনো ব্যক্তিত্ব, প্রখর মননশক্তি আর পান্ডিত্য, বিদ্রোহ আর সৃজনের উত্তাপে –গোটা ইউরোপে জীবদ্দশায় তো বটেই, জীবনান্তেও– প্রণম্য এক অগ্নিপুরুষ, সেই তিনি কিনা শুধুই মাত্র সত্যেন দত্তের সৃজনলোকে চকিতে উদয় হয়ে মিলিয়ে গেলেন। বাঙালি লেখক ও পাঠকরা ইংরেজি ও মূল ভাষার সূত্রে ভলতেয়ারকে কতটুকু জেনেছেন তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু কেবলই বাংলা ভাষায় যাদের উপায়হীন স্বাছন্দ্য তারা ভলতেয়ারের মতো লেখককে তেমনভাবে জানার সুযোগ পাননি। বাংলা ভাষায় ভলতেয়ারের রচনা একেবারেই করমেয়: সত্যেন দত্তের করা ভলতেয়ারের একটি কবিতা (‘বিদায়’) আর অরুণ মিত্র, অশোক গুহর অনুবাদে কাঁদিদ  উপন্যাস।  পুষ্কর দাশগুপ্তর অনুবাদে উপন্যাস ও  উপন্যাসিকা: জাদিগ, আমাদেবেদের পত্র, ইত্যাদি, মেমনোঁ, বিশ্বসংসার যেমন চলছে, মিক্রোমেগাস , সাদা আর কালো । সুনীলকুমার ঘোষ অনূদিত ভলতের-এর পাঁচটি উপন্যাস। সাকুল্যে এই হচ্ছে বাংলায় ভলতেয়ারের রচনা। সন্দেহ নেই যে তার অসংখ্য উপন্যাসের মধ্যে জাদিগকাঁদিদই সবচেয়ে বেশি প্রতিনিধিত্বশীল। কিন্তু যার রচনার পরিমাণ, ছোটবড় নানা আয়তনে প্রায় দুই হাজার গ্রন্থ; তার মাত্র তিনটি বইয়ে মিলেছে আমাদের প্রবেশাধিকার। এ যেন ভার্সাই প্রাসাদের মাত্র একটি স্তম্ভকে স্পর্শ করার সামিল। বাকিটুকু না ছুঁয়ে বা না দেখে গোটা ভলতেয়ারকে, আমাদের প্রবাদে যেমন বলা হয়ে থাকে, অন্ধের হাতি দর্শনের মতোই রয়ে গেছেন এখনও পর্যন্ত।

ভলতেয়ার ইউরোপের জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে নানা বিষয়ে পাণ্ডিত্য, বাগ্মিতা, আর সৃজনীপাচুর্যে এতটাই প্রবল এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন যে আমাদের কালের নন্দিত ইতিহাসবিদ উইল ডুরান্ট যখন খন্ডে খন্ডে পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাস লিখতে শুরু করলেন তখন সহস্রাধিক পৃষ্ঠার একটি খন্ডে, আর কেউ নন, এই ভলতেয়ারই হয়ে উঠেছিলেন সেই একক ব্যক্তিত্ব:The age of Voltaire: A History of Civilization in Western Europe from 1715 to 1756 । ভলয়েতারের আগে বা পরে ইউরোপের আর কোনো মনীষা এককভাবে নিজের যুগকে এতটা প্রভাবিত করেছেন কিনা জানি না। তিনি একাই নিজের বিপুল মেধা ও মনীষার জোরে এমন এক যুগের সূচনা করেছেন যে-যুগ যুক্তি ও বুদ্ধির উত্তাপে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। সে-যুগের লেখক, সাধারণ পাঠক, এমনকি শাসকদেরও আলোড়িত করেছিলেন তার প্রতিভাদীপ্ত লেখার দ্বারা। ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি ক্ষুরধার লেখার কারণে হয়ে উঠেছিলেন এক জলন্ত তরবারি। ইউরোপে, তার আগে এবং পরেও জ্ঞানে, পাণ্ডিত্যে ও সৃজনীশক্তিতে এতটা প্রখর ও শাণিত ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেনি। তার এক একটি গ্রন্থ যেন বারুদে ঠাসা বিস্ফোরকের মতো ছিল যা পাঠের স্পর্শ মাত্রই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে; হয়তো এই কারণেই এনলাইটেনমেন্ট-বিরোধী, এবং ভলতেয়ার-পরবর্তী ফরাসি লেখক জোসেফ দে মেইস্টার ভলতেয়ার সম্পর্কে উষ্মার জহর ঢালতে গিয়ে বলেছিলেন, “নরক তার সব শক্তিই তুলে দিয়েছিল তাঁর হাতে।”
(দর্শনের ইতিকাহিনী, উইল ডুরান্ট, অনু: আবুল ফজল, বাংলা একাডেমী, নভেম্বর ১৯৮০ পৃ-২৪৪)

বিরোধী অবস্থানের হলেও মেইস্টার ঠিকই বলেছেন ভলতেয়ারের অনল-ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে, তবে এই নরকের আগুন তার ক্রোধ, ব্যাঙ্গ ও বিদ্রুপের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। ভলতেয়ার ছিলেন ইউরোপের সেই অতিকায় ড্রাগন যার মুখ থেকে বিচ্ছুরিত হতো আগুনের গোলা আর সেই আগুন ঝলসে দিয়েছে দাম্ভিক রাজপুরুষ থেকে শুরু করে ভন্ড, অজ্ঞ ও বদ্ধমনের ধার্মিক, নিষ্প্রাণ পণ্ডিত একাডেমিসিয়ান থেকে শুরু করে নিষ্ঠুর অন্ধবিশ্বাসীদের মুখমন্ডল। রেনেসাঁর পর গোটা ইউরোপে, একই সঙ্গে সাহস ও ন্যায়বোধে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ভলতেয়ারের সময় দ্বিতীয় কেউ ছিলেন কিনা সন্দেহ। তার যে কোনো চিন্তাই ছিল সংস্কার থেকে মুক্ত, আর সেই মুক্তচিন্তা দিয়ে সংস্কারকে চূর্ণ বিচূর্ণ না করা পর্যন্ত তার শান্তি ছিল না। সৃষ্টিশীলতার এতগুলো মাধ্যমেও--ভলতেয়ারের আগেপরে এবং  দেশে বা বিদেশে- খুব কম লেখকই সাফল্য দেখাতে পেরেছিলেন। কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, চিঠিপত্র, ইত্যাদি মাধ্যমে অবিস্বরণীয় সম্ভার যুক্ত করেছেন; পরিমাণে যেমন তা অনতিক্রম্য, গুণেও তা অনন্য। রেনেসাঁ-উত্তর যুগে তিনি যে-বৈশ্বিক কৌতূহল ও বিশ্বজনীন মন নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন তা মানবজাতির ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে তার পান্ডিত্য ছিল বিশ্বকোষীয়। আর, এ তো এখন স্বীকৃত সত্য যে তার সাহসী রচনাগুলো ফরাসি বিপ্লবের আগুনে জ্বালানি হিসেবে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল, যে বিপ্লবের আগুন পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়েছিল উদ্দীপক শক্তি হিসেবে। এর মানে হচ্ছে ভলতেয়ারের প্রতিভার আগুন আলোয় রূপান্তরিত হয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে, যুগ থেকে যুগান্তরে প্রবহমান।

উইল ডুরান্ট তার Story of Philosophy (প্রকাশ কাল: ১৯২৬) বা দর্শনের ইতিকাহিনী (বাংলা অনুবাদের প্রকাশকাল: ১৯৮০) গ্রন্থে ভলতেয়ার-বিষয়ক ভুক্তির শুরুর দিকেই বলেছেন যে
“এখন যদি আমরা ভল্টেয়ার পড়া ছেড়ে দিয়ে থাকি (আনাতোল ফ্রান্সের মতো লোকেরাও কিন্তু তাঁর রচনা গলধঃকরণ করেই মনের সুক্ষ্ণতা আর বিজ্ঞতা করেছেন আয়ত্ত) তার কারণ আমাদের হয়ে তিনি যে সব শাস্ত্রীয় যুদ্ধ চালিয়েছেন তা আর আমাদের অন্তরে কৌতূহল উদ্রেক করে না–হয়তো আমরা এখন অন্য সমরক্ষেত্রের সম্মুখীন। আমরা এখন পর জগতের ভূগোলের চেয়ে এ জগতের অর্থনীতিতেই বেশি নিমজ্জিত। যে-সব রাজকীয় ব্যাপার আর কুসংস্কার ভল্টেয়ারের সময় ছিল জীবন্ত তার উপর তাঁর বিজয় এত সর্বাত্মক ও পরিপূর্ণ যে তাকে এখন মৃত বললেই চলে।” (পৃ:২৪৬)

ডুরান্টের জীবতকাল পর্যন্ত হয়তো একথা সত্য ছিল কিন্তু ডুরান্টের এই গ্রন্থটি প্রকাশের একশ বছরের মধ্যে পৃথিবী উল্টো পথে হাটতে শুরু করেছে, কতটা উল্টো তার প্রমাণ রয়েছে মারিও বার্গাস যোসার এই পর্যবেক্ষণেই:
“উনিশ ও বিংশ শতাব্দির মুক্তচিন্তাবিদ, অজ্ঞেয়বাদী ও নাস্তিকদের কল্পনার বিপরীতে, উত্তর-আধুনিক যুগে ধর্ম মৃত ও সমাহিত নয়; এমনকি একে চিলেকোঠায় স্তূপীকৃত অকেজো জিনিসপত্রের মাঝেও ছুঁড়ে ফেলা হয়নি। আজকের দিনের বিতর্কের কেন্দ্রে বসে এটি বেঁচে আছে এবং লাথি মারছে।”( Notes on the Death of Culture, Mario Vargas Llosa, Picador, 2015, p 153)


আমার ধারণা ডুরান্ট যদি আজ অবধি বেঁচে থাকতেন তাহলে নিজের উক্তিগুলো তিনি হয়তো প্রত্যাহার করে নিতেন অতীতের ধর্মীয় ও কুসংস্কারের ভূতকে আমাদের বর্তমানের উপর নতুন করে জেঁকে বসতে দেখে। মিয়ানমারের বুদ্ধপন্থীদের(!) হাতে রোহিঙ্গা-হত্যা কিংবা হিন্দুত্ববাদের ভয়াবহ উত্থান আর মুসলিম জঙ্গীদের নির্মম হিংস্রতা এবং ধর্মীয় উন্মাদনার পাশাপাশিই জাতিবিদ্বেষ ও হানাহানিতে আফ্রিকা ও এশিয়া, এমনকি ইউরোপের ভূখন্ডেও ধর্মীয় জাতিবিদ্বেষের হিংস্র তান্ডবে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় লক্ষ লক্ষ মুসলমানের প্রাণহানি দেখেও কি ডুরান্ট বলতে পারতেন ‘যাজকীয় ব্যাপার কুসংস্কার’ বিলুপ্ত হয়েছে বলে ভলতেয়ারের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে? ধর্মীয় ও জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবাদ ও কুসংস্কার এই যুগে যেভাবে মাথা চাড়া দিয়ে দানবীয় রূপ ধারণ করেছে, সেখানে একজন ভলতেয়ারেরই প্রয়োজন আজ সবচেয়ে বেশি। আমরা যখন একে অপরের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি না, অন্য ধর্মানুসারীকে তার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করতে চাই, অন্য বর্ণ ও জাতিকে আমার আদলে ও বিশ্বাসে রূপান্তরিত করতে চাই, তখন আসলে অজান্তে কিংবা সজ্ঞানেই অপরপক্ষের স্বাধীনতাকেই হরণ করে ফেলি। ভলতেয়ারের কাছে ‘স্বাধীনতা’র মূল্য ছিল অপরিসীম। সেটার গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা আজও হারিয়ে যায়নি। Haskell M. block আমাদেরকে ভলতেয়ারের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে স্মরণ করিয়েছেন তার এই কথাগুলোর মাধ্যমে:
   “স্বাধীনতা ও মানবতার পক্ষে তাঁর অবিরত সংগ্রাম আমাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, দাসশ্রম ও চিন্তা নিয়ন্ত্রণের এই সময়ের জন্যও কম অর্থবহ নয়। ভলতেয়ার নৃশংসতা ও আহাম্মকির বিরুদ্ধে যে লড়াই জারি রেখেছিলেন এ শুধু তার জন্যই প্রাসঙ্গিক তা নয়, পৃথিবীতে সুখ সন্ধানের দিকে মানুষকে চালিত করার জন্যও জরুরি। দুই শতাব্দী দূরে তাঁর এই স্বর শুধু হার না মানা ও প্রতিবাদের চীৎকারমাত্র নয়, বরং বাস্তবায়নের জন্য আহবানও বটে। স্বাধীনতা ভলতেয়ারের জন্য কোনো অবস্থা নয়, বরং একটি প্রক্রিয়া, বিশ্রামের ক্ষণ নয় বরং চিন্তা করা এবং বেঁচে থাকার একটি ব্যবস্থা। তাঁর স্থায়িত্ব নির্দিষ্টভাবে তাঁর চিন্তা ও শিল্পের বহুমাত্রিকতার মধ্যে। ভলতেয়ার আমাদের সমসাময়িক। আজকের দিনে তাঁর সমসাময়িকতা কোনো অংশে কম নয়।
(Candide and other writings, Edited by Haskeell M. Block, The Modern Library, 1965, P- IX )
তিনি আমাদের কেবল সমসাময়িকই নন, তিনি আমাদের জন্য এক অনন্য উদ্দীপক ব্যক্তিত্ব। তার সাহস, শক্তি আর মননের প্রাচুর্যই শুধু নয়, কী করে এসবকে অন্ধকারের বিরুদ্ধে এক বিস্ফোরকে পরিণত করতে পারা যায়, তারও এক বিরল দৃষ্টান্ত শুধুই ভলতেয়ার।