“কাফকা-কে ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আমরা নতুন করে ভাবনা চিন্তা শুরু করব।”

দেবব্রত চক্রবর্তী দীর্ঘ দিন ধরে মূল ভাষা থেকে জার্মান সাহিত্য অনুবাদ করে আসছেন। ৩ জুন কাফকার মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষ্যে কাফকা ও তার অনুবাদের নানান দিকে প্রাবন্ধিক অনুবাদক দেবব্রত চক্রবর্তী কথা বলেছেন বিডিআর্টস-এর সথে।

রাজু আলাউদ্দিনরাজু আলাউদ্দিন
Published : 2 June 2023, 06:18 PM
Updated : 2 June 2023, 06:18 PM

ড. দেবব্রত চক্রবর্তী  ভারতবর্ষস্থ পশ্চিমবঙ্গের লেখক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও কবি৷ জন্ম ১৯৫০ খৃষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গে৷ শিক্ষা প্রথমত সংস্কৃত নিয়ে, পরে জার্মান ভাষা শেখেন বছর পাঁচেক৷ প্রথমে চাকরি শুরু করেন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায়৷ পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মান শেখাতে আরম্ভ করেন ১৯৯২ থেকে৷ এখানে ছাত্রদের জার্মান শিখিয়েছেন প্রায় তিন দশক। সামান্য কিছুদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ছিলেন সংস্কৃত অলঙ্কারের অধ্যাপনসূত্রে৷ কিছুদিন মাঝখানে জার্মান শিখিয়েছেন রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও৷ মোরিৎস ভিনটারনিৎস, গ্যুন্টার গ্রাস, টোমাস মান, রিলকে, কাফকা প্রমুখের জার্মান সাহিত্য মূল জার্মান ভাষা থেকে বাংলায় এবং কখনও ইংরেজীতে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছেন। প্রাগ-এর চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতবিদ্যা বিভাগে পড়িয়েছেন পাঁচটি টার্ম।

ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় ভারতবিদ্যায় বক্তৃতাসুত্রে, তাছাড়া ইউরোপের আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনুবাদ অনুষঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ২০০৫-এ জার্মানির ষ্ট্রালেন-এর বিশ্বখ্যাত অনুবাদক-সংস্থা উইবারসেৎজ়ার কলেগিয়ুম-এ তিনি ট্রান্সলেটর-ইন-রেসিডেন্স ছিলেন। অনুবাদ ও সাহিত্য প্রকল্পে যোগ দিয়ে গেছেন জার্মানি, অস্ট্রিয়া, চেক রিপাবলিক, সুইজারল্যান্ড, গেছেন পোল্যান্ড ফ্রান্স সহ ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশে৷

দেবব্রত চক্রবর্তীর রচনাগুলি :

 অনুবাদ : সবগুলিই মূল জার্মান ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ এবং সমস্ত অনুবাদগ্রন্থের সঙ্গে আছে ভূমিকা ও বিস্তৃত প্রয়োজনীয় টীকাটিপ্পনি৷

গ্যুন্টার গ্রাস-এর জিভ কাটো লজ্জায় কেলকাতা সফরনামা), এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স, ১৯৯০ (নিঃশেষিত), টিন ড্রাম (উপন্যাস), রূপালী ২০১৫ (নিঃশেষিত), পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে (আত্মজীবনী), ২০১৮ (ভিনটারনিৎস বুকস)।

টোমাস মান-এর ভেনিসে মৃত্যু নেভেলা), এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স, ১৯৯৮ (নিঃশেষিত), মূল জার্মান ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ ।

মোরিৎস ভিনটারনিৎস-এর গান্ধী পরিক্রমা (প্রবন্ধ সঙ্কলন), প্রথম সংস্করণ ১৯৯৪, দ্বিতীয় সংস্করণ, এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স, ২০১৮। বিশ্বহৃদয় পারাবারে রবীন্দ্র বিষয়ক প্রবন্ধ ও একটি পুস্তিকার সমাহার), ২০২২ আনন্দ পাবলিশার্স/সিগনেট।

Moriz Winternitz, Rabindranath Tagore : The Poet’s Religion and World Vision, English Translation from German, 2011   (নিঃশেষিত), Available at Amazon.

লিয়ন ফয়েষ্টরভাঙার-এর কলকাতা, চৌঠা মে নোটক), নিউ এজ, (নিঃশেষিত)১৯৯৪। মূল জার্মান ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ । ই-বই হিসাবে পাওয়া যায়৷

রাইনার মারিয়া রিলকে-র ডুয়িনো এলিজিগুলি কাব্যগ্রন্থ), ২০১৫ (ভিনটারনিৎস বুকস)। ও ওগোস্তা রোদ্যাঁ ২০১৯ (ভিনটারনিৎস বুকস)।

ফ্রানৎস কাফকা-রূপান্তর, নভেলা ২০২২, গল্পমালা প্রথম পর্ব, ২০২২ (ভিনটারনিৎস বুকস)।

পাওল নাটোর্প-এর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কয়েক প্রহর, ২০২২ (নিজস্ব প্রকাশ)।

 নিজস্ব রচনা :

জার্মানির প্রাজ্ঞতীর্থে রবীন্দ্রনাথ, কলকাতা ২০১৪ | এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স।

সেতুবন্ধ গড়ে তোলো ২০১১/ Bau Dir Eine Brücke, Bilingual Edition (German-Bengali, Bengali-German) of the Poems of Helmuth A. Niederle and Debabrata Chakrabarti, 200 INR

নৈশ আলাপের সুচিকর্ম /Tapestry of Nocturnal Conversations, Bilingual Edition (Bengali-English) of the Poems of Shankarnath Chakraborty and Debabrata Chakrabarti, 60 INR

ছায়ানটের রাগিণীতে, ইতিহাসবিদ দিলীপকুমার বিশ্বাস : শতবর্ষপূর্তির স্মৃতিতর্পণ, ২০২২ নিজস্ব প্রকাশ) মুদ্রিত মূল্য ৮৯৫ টাকা।

নিজস্ব ইংরেজী গ্রন্থ :

Moriz Winternitz

With Tagore at the Crossroads of East and West (now in Press)

এছাড়াও ভারত, জার্মানি ও অস্ট্রিয়াতে প্রকাশিত অনেকগুলি বইয়ে তার কবিতার জার্মান অনুবাদ ও প্রবন্ধ অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। অজস্র প্রবন্ধ ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় স্থান পেয়েছে।সম্প্রতি কাফকা-র ডী ফেযারভাণ্ডলুঙ বা রূপান্তর এবং তাঁর গল্পসঙ্কলন (প্রথম পর্ব) মূল জার্মান ভাষা থেকে বাংলায় অনূদিত হয়ে ভিনটারনিৎস বুকস কর্তৃক কলকাতায় প্রকাশিত হয়েছে৷ এই সূত্রে বিডি আর্টস-এর পক্ষ থেকে রাজু আলাউদ্দিন কথা বললেন অনুবাদক দেবব্রত চক্রবর্তীর সঙ্গে৷বি.স.

রাজু আলাউদ্দিন: আপনি সরাসরি জার্মান ভাষা সাহিত্য ও গবেষণাধর্মী অনুবাদ করে আসছেন বহুদিন থেকে। প্রচুর প্রবন্ধও লিখেছেন৷ কবিতা লেখেন, আবার কবিতার অনুবাদও করেন৷ ইংরেজীতেও অনুবাদ করেছেন কিছু৷ জার্মানির প্রাজ্ঞতীর্থে রবীন্দ্রনাথ বা ছায়ানটের রাগিণীতে-র মতো স্বরচিত গ্রন্থও আপনার আছে৷ বাংলায় অনুবাদ করেছেন সবই জার্মান ভাষা থেকে৷ যেমন মোরিৎস ভিনটারনিৎস-এর রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী সম্পর্কিত রচনাবলী,  গ্যুন্টার গ্রাসের জিভ কাটো লজ্জায়, টিন ড্রাম, পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে, টমাস মানের ভেনিসে মৃত্যু, পাওল নাটোর্প-এর রবীন্দ্রাথের সঙ্গে কয়েক প্রহর, ইত্যাদি৷ সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ফ্রানৎস কাফকা (১৮৮৩-১৯২৪)-র দুটো বই। একটি রূপান্তর অন্যটি তাঁর গল্পমালা (প্রথম পর্ব) । কাফকা-য় কি আপনি আগে থেকেই আকৃষ্ট ছিলেন?

দেবব্রত চক্রবর্তী: আকৃষ্ট ছিলাম তো বটেই৷ অনেক বছর ধরেই ভাবছিলাম অনুবাদ শুরু করব৷ কিন্তু অন্য কাজের চাপে পৌঁছতে বড্ড দেরি হয়ে গেল৷

রাজু আলাউদ্দিন: রূপান্তর অনুবাদের পেছনে অনুভাষ ও টীকাটিপ্পনি যুক্ত করেছেন। বোর্হেসের ভাষায় কাফকা crystal clear শৈলীতে লিখেছেন। তারপরও কেন অনুভাষ ও টীকাটিপ্পনির দরকার হল, বলবেন কি?

দেবব্রত চক্রবর্তী: কথাটা জানতাম৷তবে কাজ শুরু করবার আগে বিশ্বাস করিনি৷ কাজ করতে গিয়ে দেখলাম কথাটা হয়তো ঠিক৷ আমার অনুবাদের সঙ্গে সাধারণত ভূমিকা এবং প্রভূত টীকাটিপ্পনী থাকে৷ গ্রাস-এর টিন ড্রাম-এ চল্লিশ পাতা, পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে নামক তাঁর আত্মজীবনীতে বোধ হয় সত্তর পাতা টীকা দেওয়া হয়েছে৷ সব অনুবাদের বইতেই টীকা   স্বমহিমায় উপস্থিত৷ তবে এখানে দেখবেন, মাত্র দু পাতা টীকার প্রয়োজন হয়েছে৷

   এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলবার ইচ্ছা হচ্ছে৷ বোর্হেস-এর মাতৃভাষা স্প্যানিশ যেমন জার্মান ভাষার অনেকটা কাছাকাছি, তেমনি তাঁর সংস্কৃতিও হয়তো অনেকখানি জার্মান কিংবা ধরুন ইউরোপীয়দের  মতো৷ আমাদের বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা হলেও এটি বহুদূর একটি দেশের ভাষা, আর এর সংস্কৃতি তো একেবারেই ভিন্ন৷ সুতরাং তাঁর অনুভবের কথা আমাদের ক্ষেত্রে সত্যি না হলেও হতে পারে৷ মনে রাখতে হবে যে বাঙলায় যাঁরা সফলভাবে অনুবাদ করবেন, তাঁরা তাঁদের নিজেদের নিজেদের জায়গা থেকে এই একই টেক্সট-কে দেখবেন সম্পূর্ণ অন্যরকম ভাবে৷ অর্থাৎ অনুবাদকের অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, রুচি ও তাঁর পারিপার্শ্বিক থেকে ওই গদ্যাংশটাকে দেখবার চরিত্র সবসময় বদলে যাবে, একথাই বলতে চাইছি৷

 কাফকা-র ক্ষেত্রে ভাষাটা আমার কাছে ততটা সমস্যার বলে মনে হয়নি, ভাষার থেকে বেশী প্রাধান্য দিতে হয়েছে শব্দে রচিত তাঁর ছবিগুলিকে৷ ভালটার বেনিয়ামিন-এর ক্ষেত্রে দেখেছি এই ছোট ছোট ছবি কখনও কখনও অনুবাদ করা একেবারে প্রাণান্তকর হয়৷ কিন্তু কাফকা-য় ছোট ছোট ছবির যে রূপ চিত্রিত থাকে সেগুলি crystal clear, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই৷ ওই ছবিগুলিকে আমাদের ভাষায় আনতে বেগ পেতে হয় না৷ এমনও হতে পারে যে বোর্হেস শৈলী নয়, ছবি-অনুবাদের স্বচ্ছতা(clarity)-র কথাই অবচেতনে বলেছেন৷

 রাজু আলাউদ্দিন: কাফকা অনুবাদ করতে গিয়ে আপনি কি বাংলাভাষায় কোনো প্রতিবন্ধকতা অনুভব করেছেন?

দেবব্রত চক্রবর্তী: এই ব্যাপারে আমি দুটি বিষয়ের কথা বলব৷ কিছু পারিভাষিক শব্দ সব সময়ই একটা অসুবিধা তৈরি করে৷ যদি অভিধানে তার অনুবাদ না থাকে বা যদি তা বাংলায় প্রচলিত না হয়৷ যেমন বিশেষ ধরণের অপরিচিত আসবাব, বিশেষ বিশেষ বস্তু, ধর্মীয় অনুষঙ্গ, আবহাওয়া জনিত বিশিষ্টতা, যা আমাদের বাঙালীদের চোখে এবং ধারণায় নেই৷ তার জন্য প্রথমত চেষ্টা করি একটা বাংলা শব্দ তৈরি করতে৷ একেবারেই অসম্ভব হলে ইংরেজী শব্দটা দিই কিন্তু দু ক্ষেত্রেই টীকা দিই৷ আবার দেখুন আংকল, আন্ট – এই ধরণের ক্ষেত্রে সমস্যা একেবারে আালাদা৷ যদি সঠিক সম্পর্কটা বইতে না লেখা থাকে, তাহলে কি করব? এক একটা আংকল বা আন্ট পাঁচ রকম৷ দুই বাংলায় আবার তার শব্দব্যবহার বিস্তর আলাদা৷ মুশকিল না?

কাফকা-য় অবশ্য এরকম সমস্যা আমার বিশেষ আসেনি৷

  আমি সাধারণত বাঙলা শব্দকেই পূর্বিতা দেবার পক্ষপাতী৷ আর বাঙলা অসম্ভব সমৃদ্ধ ভাষা৷ সংস্কৃত ভাষা থেকে তার বেশীর ভাগ শব্দই সৃষ্ট এবং পুষ্ট৷ আরবী ফারসী ভাষাও আমরা দশ বারো হাজার ব্যবহার করি৷ সংস্কৃত ভাষা পিছনে থাকবার জন্য শব্দ উদভাবন করতেও আমাদের কোনও অসুবিধা হয় না৷ যদিও সংস্কৃতের ছাত্র বলে সেখানে আমি একটু বাড়তি সুবিধা পাই৷

অপ্রাসঙ্গিক হলেও রূপান্তর-এর প্রথম লাইনটা উদাহরণ হিসাবে যদি সংস্কৃতে অনুবাদ করে এখানে দেওয়া যায়, তাহলে বুঝবেন বাংলার কাছাকাছি হলেও অনুভবের দিক দিয়ে বা শ্রুতির দিক থেকে এই অনুবাদপ্রক্রিয়া কত আলাদা এবং ধ্বনিমাধুর্যের দিক থেকে কত বিশিষ্টতার অভিসারী৷

কাফকায়াঃ রূপান্তরম্:

একদা প্রাতঃ দুঃস্বপ্নদর্শনাৎ নিদ্রাতঃ উত্থায় গ্রেগর-জ়ামসা উদ্বিগ্নচিত্তঃ আত্মানং শয্যোপরি ধৃতবিশালকীটরূপং শয়িতং দৃষ্টবান্…

রাজু আলাউদ্দিন : বোর্হেস মনে করেন উপন্যাস নয়, কাফকা-র সেরা কাজ তাঁর গল্পগুলো। আপনি তার গল্পগুলো পড়ে এবং অনুবাদ করতে গিয়ে কি সেরকম অনুভব করেছেন?

দেবব্রত চক্রবর্তী: হ্যাঁ, পড়া আর অনুবাদ করা – এই দুটোর মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান৷ এমনি পড়ছি ঠিক আছে৷ কিন্তু যেই অনুবাদের জন্য পড়ছি এবং পাশাপাশি অনুবাদ করছি, তখনই আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে৷ এ পড়া হল গদ্যের অনেক গভীরে প্রবেশ করা, তার অস্থি মজ্জা মাংসের মধ্যে চলে যাওয়া৷ মূল রচনাও যদি অসংগতিপূর্ণ হয় তাহলেও অনুবাদের গদ্যাংশটা একেবারে হাঁ করে বেঢপ ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে৷ কিন্তু আমি কাফকা-র যে বইদুটি অনুবাদ করেছি, তার মধ্যে রূপান্তর গল্পটা অতি সংহত, স্বল্পাক্ষর, অসন্দিগ্ধ এবং তার ভাষা বাহুল্যহীন, সামগ্রিকভাবে অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ, তার পরিসরও উপন্যাসের চেয়ে ছোট৷ গল্পগুলিও তাই৷ অনুবাদের ফলে সেদিক থেকে কোনও অসুবিধা হয়নি৷ কিন্তু তাঁর উপন্যাসের পাঠক হিসাবে আমার নিজের মনে হয়েছে যে ছোট পরিসরেই তিনি স্বচ্ছন্দ বেশী৷ 

রাজু আলাউদ্দিন: পশ্চিমবঙ্গে অনেকেই কাফকার অনুবাদ করেছেন। সেই অনুবাদণ্ডলোর মান সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে জানতে চাই।

দেবব্রত চক্রবর্তী:  কাফকা-র কোনও পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা অনুবাদ আমি হাতে পাইনি, তাই বলতে পারছি না৷ শুনেছি মূল জার্মান ভাষা থেকে রূপান্তরের নাকি একটা অনুবাদ হয়েছে৷ কিন্তু একেবারেই শোনা কথা৷ অন্য কিছু কিছু জার্মান লেখকের অনুবাদ দেখেছি, পড়েছি৷ তবে সেসব ইংরেজী থেকে অনুবাদ৷৷ইংরেজী থেকে প্রবীর ঘোষের করা টোমাস মান-এর অনেকগুলি অনুবাদ আছে৷ পড়তে ভালই লাগে৷৷ নীহার ভট্টাচার্য মূল জার্মান থেকে ব্রেশট ও হাইনরিশ ব্যোয়ল-এর অনুবাদ করেছেন, পড়েছি৷ ভাল৷ গোড়ার দিকের প্রচেষ্টা, খুবই সাধুবাদ দেব তাঁকে৷

   অনুবাদের মানের কথা বলছেন৷ দ্বিতীয় ভাষা থেকে অনুবাদ হলে সে অনুবাদ যে সরে যাবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই৷ তত্ত্বের দিক থেকে অনুমোদন করা যায় না৷৷ কিন্তু অনুবাদ হয়ে যাবার পর তাদের আবার ফেলে দেওয়া বা তাদের দূর ছাই করাটাও সমীচিন নয়৷ যাঁরা ইংরেজী অনুবাদ পড়তে পারেন না, তাঁদের কথা ভেবেই তো এঁরা এই পরিশ্রম করেছেন? তো ক্ষতি কি?   দুধের স্বাদ না হয় ঘোলেই মিটল! কিন্তু যাঁরা মূল ভাষা থেকে ইংরেজীতে অনুবাদ করেন তাঁরাই কি সবসময় সঠিক অনুবাদ করেন? গ্যুন্টার গ্রাস-এর টিন ড্রাম রালফ মানহাইম (Ralf Manheim) যখন ইংরেজীতে অনুবাদ করলেন ১৯৬১-তে, তখন তাঁর অনুবাদে কত অজস্র ভুল ছিল বলুন তো? সেই জন্যে তো এটা ২০০৫ -এ আবার অনুবাদ করানো হল (Mitchel Breon)৷ গ্রাস ইনটারভিউ-তে বললেন, হ্যাঁ এবার কোনও ভুল নেই৷ কিন্তু নান্দনিক দিক থেকে কি খুব ভাল হয়েছে অনুবাদ? আমার তো মনে হয়েছে হয়নি৷ গ্যুন্টার গ্রাস-এর সেই লেবার পেইন এই অনুবাদে কোথায়?

   অনুবাদের মান নিয়ে বিচার করে কিছু বলতে গেলে দুটি ভাষা দেখে মিলিয়ে বলাটাও জরুরী৷ ইদানীং সর্বভারতীয় একটি অনুবাদ-পুরষ্কার প্রদানে বিচারক হিসাবে উপস্থিত হয়ে যে অভিজ্ঞতা হল, সেটা ভাল নয়৷ দেখলাম তাঁরা অনূদিত বইটাই দিলেন, মূল বই দিলেন না৷ সত্যি যদি মান বিচার করতে হয়, তাহলে দুটি ভাষার মধ্য দিয়ে যাওয়াই বিধেয়৷ ধ্যান ধারণাগুলি আামাদের একেবারেই শৈশবোচিত৷ আমি এখানে কোনও আপোষ করবার পক্ষপাতী নই৷   

রাজু আলাউদ্দিন: আপনি কি তাঁর উপন্যাসগুলো অনুবাদ করার পরিকল্পনা করেছেন?

দেবব্রত চক্রবতী: খুবই ইচ্ছা আছে৷কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা সময় কমে আসছে৷ সন্দেহ হয় সুযোগ পাব কি না৷

রাজু আলাউদ্দিন: বিশ্বসাহিত্যে অনেক বড় বড় লেখকের আবির্ভাব ঘটেছে৷আবার অতিদ্রুত অনেকেই বিলুপ্ত ও বিস্মৃত হয়ে গেছেন। কাফকা-র বেলায় কী ঘটবে বলে আপনি মনে করেন?

দেবব্রত চক্রবতী: বিলুপ্ত হয়েছেন সবসময় তাঁদের দোষে নয়৷মানুষের জীবনের সমস্যা, তাদের রুচি ও প্রবণতার বদল ঘটেছে বলে তাঁরা বিস্মৃত হয়েছেন৷ যুগ বদলেছে, আবহাওয়া বদলেছে - হয়তো তাই৷ অনেক সময় আমরা দেখি ফিরেও আসেন তাঁরা৷ যদিও বিশ্বসাহিত্যের রথী নন, তবু বাংলাদেশে আমার পিতৃপুরুষের গ্রামে একজন লেখক ছিলেন৷ তিনি জগদীশ গুপ্ত৷ এখন তিনি আবার একেবারে রাজবদুন্নতধ্বনিঃ-র মতো না হলেও ফিরে এসেছেন৷

কিন্তু কাফকা-র প্ল্যাটফর্মটা লক্ষ করুন, চিরকালীন৷ তিনি রূপকথার গায়ে ঠেস দিয়ে দিব্যি চুটিয়ে রাজত্ব করে যাচ্ছেন৷ এমন তাঁর চালচিত্র যে আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে তিনি চির আকর্ষণীয়৷ সাধারণ মানুষের তো কথাই নেই, যাঁরা বুদ্ধিমান অংশীদার, তাঁরাও সহজে তাঁর আষাঢ়ে গল্প বিশ্বাস করে নিয়েছেন এবং কাফকা-র জাদুটাকে বাস্তবতার সঙ্গে মিশিয়ে একটা রসায়নের চেষ্টা করেছেন৷ তখন এই গল্প তার ব্যাপ্ত রূপ পেয়েছে৷

 রূপান্তরের প্রসঙ্গে বলব, অবন ঠাকুরের বুড়ো আংলার সঙ্গে এর বেশ মিল আছে৷ যদিও অভিপ্রায়ের দিক থেকে দুই লেখকের মধ্যে অনেক ফারাক৷

কাফকা-র অপ্রতিরোধ্য শক্তি তাঁর রূপকথার চালচিত্রে যেমন নিহিত ছিল, তেমনি সেটা ছিল সার্বজনীন একটা স্তরে৷ তার অনেক গভীরে তিনি রেখেছেন মানুষ ও তার অসহায়তাকে৷ মানুষ আজও দিশাহীন৷ তার এই পরিত্রাণহীন অবস্থার নানান রশ্মি তাঁর রচনার গভীরে পরতে পরতে মিশে আছে৷ ব্যক্তি হিসাবে, রাষ্ট্রশক্তির পুতুল হিসাবে মানুষ কোনও না কোনও গভীর অসুখের সঙ্গে বিজড়িত৷ কাফকা-র পদচারণা ওইখানে৷ এই অবস্থাটা যতদিন প্রাসঙ্গিক থাকবে ততদিন তাঁর প্রাসঙ্গিকতাও নিশ্চল থাকবে৷ যে নন্দিত বাসভূমি আমাদের কাম্য, আমরা যদি সত্যি সত্যি কোনওদিন সেখানে পৌঁছতে পারি তখন আমরা কাফকা-কে কিভাবে দেখব সেটা বলতে পারি না৷ হয়তো কাফকা-কে ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আমরা নতুন করে ভাবনা চিন্তা শুরু করব৷   

মানুষের গভীর সমস্যা নিয়ে রূপকথার গভীরতা থেকে সার্বজনীন স্তরে উন্নীত হওয়া - তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে বলেই মনে হয়।

রাজু আলাউদ্দিন: কাফকার কোন দিকটি বা দিকগুলো আপনার কাছে অন্য লেখকদের থেকে আলাদা মনে হয়?

দেবব্রত চক্রবর্তী: আমার তো মনে হয় তিনি গোটাটাই আলাদা৷ তবে তাঁর ভেতরকার অনেক উপাদান তাঁর পূর্বসূরীরা কিছু কিছু করে আগেই দেখিয়ে গেছেন৷ সত্যি বলতে কি কাফকা-র পেশকারীটাই স্বতন্ত্র৷ তাঁর পূর্বসূরীদের সঙ্গে তাঁর মিল হয়তো দেখানো যায় পৃথক পৃথক ভাবে, কিন্তু সেগুলি বাইরের মিল৷ মিল হৃদয়ঙ্গম করতে না করতেই দেখা যায় তিনি তাঁর স্বকীয় জগতে সরে গেছেন৷

রূপান্তর অনুবাদের যে অনুভাষ অংশ আছে, সেখানে আমি তাঁর এই বিশিষ্টতা সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে লিখেছি৷

রাজু আলাউদ্দিন: এক অর্থে গোটা বিশ শতকটাই ছিল তার শাসনে। কেন অন্য কোনো লেখক নয়, কাফকাই কেন এত প্রবল ও প্রভাববিস্তারী হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বসাহিত্যে?

দেবব্রত চক্রবর্তী: সংস্কৃত শাস্ত্রে একটা ন্যায় আছে, অরুন্ধতী ন্যায়৷ পূর্ববঙ্গে অনেক হিন্দুর বাড়িতে একটা রীতি ছিল, বিয়ের দিন রাতে নতুন বধূকে অরুন্ধতী নক্ষত্র দেখানো হত৷ কিন্তু এই নক্ষত্রকে দেখানো খুব কঠিন, কারণ এটি চট করে চোখে পড়ে না৷ তখন অরুন্ধতীর কাছাকাছি কোনও উজ্জ্বল নক্ষত্রকে দেখিয়ে দৃষ্টি ন্যস্ত করে রাখতে বলে তারই কাছাকাছি অরুন্ধতী নক্ষত্রের দিকে দৃষ্টিটাকে সরিয়ে আনতে বলা হত৷

কাফকা-র আগে তাঁর কিছু পূর্বসূরী কাফকায়েস্ক প্রবণতা দেখিয়েছেন৷ তাঁরা হয়তো তাঁদের তাঁদের জায়গায় এত জনপ্রিয় থাকেননি৷ কিন্তু কাফকা আসবার পর আমরা কাফকা-কে দিয়ে তাঁদের “উজ্জ্বলতর” (highlight)করে দেখাতে পেরেছি৷ কাফকা হলেন সেই উজ্জ্বল তারকা, যেখানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে পাশেই ওই সব অরুন্ধতী নক্ষত্রকে দেখা যাবে৷ তাঁর প্রভা-তে তাঁরাও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন৷

 বোর্হেস এই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছেন৷ তিনি জেনো (Zeno:৪৯৫-৪৩০ খৃষ্ট পূর্বাব্দ)-র কথা বলেছেন, বলেছেন হান উ (Han Yu: ৭৬৮-৮২৪)-র কথা৷ সোরেন কীয়ের্কগার্দ(Søren Kierkegaard: ১৮১৩-১৮৫৫), ডানস্যানি (Lord Dunsany: ১৮৭৮-১৯৫৭)-র বিশেষ করে কার্কাসন (Carcassonne) ও রবার্ট ব্রাউনিঙ (Robert Browning:১৮১২-১৮৮৯)-এর Fears and Scruples কবিতাটির কথাও বলেছেন৷ বলছেন, কাফকাই আমাদের সাহায্য করতে পারেন এই আগের লেখকদের নতুন ভাবে পড়তে৷ তিনি যদি কখনও না লিখতেন, তাহলে আমরা এঁদের পড়তে পারতাম না, উদাহরণস্বরূপ, ব্রাউনিংয়ের 'ফিয়ার অ্যান্ড স্ক্রুপলস' যেমন আমরা এখন পড়তে পারি, ব্রাউনিং, ব্লয় এবং কিয়েরকেগার্ডের মধ্যে সখ্য চিহ্নিত করতে পারি, এটা হয়তো সেক্ষেত্রে সম্ভব হত না৷ বোর্হেস বললেন, কাফকা-র কাজ প্রকাশিত হওয়ার অনেক আগেই এঁরা মারা গিয়েছিলেন কিন্তু তিনি এইভাবে তাঁর  নিজস্ব পূর্বসূরিদের তৈরি করলেন৷ কিরকম? না কাফকা-র পরবর্তী কালে যে পাঠকরা আসবেন কাফকা পড়বার কারণেই তাঁরা সেই পূর্বসূরীদের পড়বেন এবং তাঁদের নিয়ে আলোচনা করবেন, তাঁদের প্রাসঙ্গিক করে তুলবেন৷ আর কাফকা-পরবর্তী লেখকরা যে অনেকে কাফকা-র দ্বারা প্রাণিত হবেন এবং তাঁদের লেখায় তাঁর ছাপ পড়বে, এ বিষয়েও তো কোনও সন্দেহ নেই৷  

কাফকা-র শাসনব্যবস্থার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁর প্রবল প্রতাপের নিরিখেও একটা জিজ্ঞাসা ছিল আপনার৷ এমন একটা ব্যাপ্তি তাঁর মধ্যে ছিল বলেই তো তিনি এখনও পর্যন্ত এত সুদূরপ্রসারী৷ তাঁর কাজ বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গীভূত না হলে এটা সম্ভব হত না৷ 

প্রাসঙ্গিক তিনি জার্মান ভাষিত দেশগুলিতে হয়তো আমাদের চেয়ে অনেক বেশী৷ তাঁর লেখার প্রভাব অনেকের মধ্যে্ই অপ্রতিরোধ্য জায়গা করে নিয়েছে৷ বিশেষ করে অস্ট্রিয়ার খ্যাতনামা লেখক শ্রীমতী মারিয়ানে গ্রুবার-এর রচনায় কাফকা-র চিন্তা ভাবনা শক্তিশালী ছাপ ফেলেছে৷ তাঁর ইনস শ্লস (Ins Schloss) বা গড় অভিমুখে নামক উপন্যাস কাফকা দ্বারা প্রভূতভাবে প্রভাবিত৷

রাজু আলাউদ্দিন: বাংলা সাহিত্যে তাঁর ফলপ্রসূ প্রভাব কি আপনি দেখতে পান?

দেবব্রত চক্রবর্তী : এটা তো সত্যিই যে অনুবাদের ফলে একটা দেশের সাহিত্য তার বদ্ধ জলাশয় থেকে মুক্তি পায়৷ বহু অনুবাদের ফলে বাংলা ভাষাও এইভাবে নিজেকে তার সঙ্কীর্ণতা থেকে অনেকখানি ছাড়িয়ে নিয়েছে৷ শুধু তো আমাদের সাহিত্যের কথা নয়, এই সম্পূর্ণ অপরিচিত দেশের সাহিত্যপাঠের ফলে বাঙালীর জীবনের অনেক কূপমণ্ডূকতাও মুক্তি পেয়েছে৷ জীবনের যে কোনও স্তরের ভেদবিচার আস্তে আস্তে ভেঙেছে৷ সুতরাং আলাদা করে কাফকা-র সম্পর্কে বলবার কিছু নেই৷ অনুবাদ হল একটা পবিচয়ের মুখ৷ এই পরিচয় থেকেই শুরু হয় আলাপ, তারপর হয় বিনিময়৷ একটা নতুন পথ তৈরি হয়৷ আমরা তখন সেই পথের একটা সঙ্গমস্থলে এসে দাঁড়াই৷ আমরা গ্রহণ করি, তাকে নিজেদের মতো করে নিজেদের রসায়নে আত্তীকৃত করে নিই৷ তাই বলে ঋণ অস্বীকার করি না৷ কিন্তু বলি ওটা আমার, আমাদের৷ ওখানে এখন আমার জন্মের অধিকার৷ সব ভাল জিনিসগুলিই সব দেশের নিজের হয়ে ওঠে এইভাবে৷ আর দেশে দেশে যাঁরা প্রতিভাধর, তাঁরা এই সাহিত্যের মধ্য দিয়ে, শিল্পের মধ্য দিয়ে নতুন করে নতুন বাণী ছড়িয়ে দেন সারা বিশ্বে৷ রবীন্দ্রনাথ তাই করেছিলেন৷ তাঁর সাহিত্যপাঠের তো কোনও অন্ত ছিল না! ইংরেজী অনুবাদপাঠে তাঁর একটা বিশ্বজোড়া ঠাঁই হয়েছিল৷ বিভিন্ন দিগন্তকে তিনি এক লহমায় তুলে নিয়েছিলেন তাঁর সাহিত্যবোধের আঙিনায়৷ আর তাই অনন্তের হৃদয়বিন্দুতে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি ব্রহ্মাস্বাদসহোদর সাহিত্যের নির্যাস কি তা আমাদের ধরিয়ে দিয়ে গেছেন৷

তাঁর সেই বহুপঠনের ফল এখন আমরা নিজেরা উপভোগ করছি৷ তিনি হয়তো নেই৷ কিন্তু সেই প্রক্রিয়া আমাদের মানবজীবনে সতত বহমান রয়েছে৷ আবার তাঁর মতো নতুন নতুন প্রতিভাবান মানুষ আসবেন, ওইভাবেই তাঁরা একে অন্যকে গ্রহণ করবেন, প্রভাবিত করবেন৷ বাংলা সাহিত্যে এখন কিছু লেখা হচ্ছে না, এমন কথা কেউ কেউ বলছেন৷ এসব সাময়িক মন্তব্য৷ বাংলার জমি বড় উর্বর৷ চিরদিনই তাই৷ তবু এমন হতে পারে যে যুগ হয়তো এখন একটু জিরিয়ে নিচ্ছে৷ কিন্তু মানুষ আবার আসবে, জুড়বে, গড়বে, প্রাণ জুড়াবে৷ কাফকা আমাদের সহায় হবেন৷