এম এন রায়: মেক্সিকো-প্রবাসের স্মৃতি-৯

তারপর ট্রেনের জানালায় হঠাৎই ভেসে উঠল লম্বা গাছ ও টেলিগ্রাফের খুঁটিতে ঝোলানো কিছুক্ষণ আগে হত্যা করা নয়টি তাজা মৃতদেহ।

প্রিসিলা রাজপ্রিসিলা রাজ
Published : 12 March 2024, 08:02 AM
Updated : 12 March 2024, 08:02 AM

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার আরবেলিয়া গ্রামে শাক্ত ব্রাহ্মণ ভট্টাচার্য পরিবারে ১৮৮৭ সালে জন্ম নরেন্দ্রনাথের যিনি পরে এম এন রায় হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামী, কমিউনিস্ট বিপ্লবী ও তাত্ত্বিক মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সমধিক পরিচিতি উদার মানবতাবাদের (radical humanism) তাত্ত্বিক ও প্রবক্তা হিসেবে। বিপ্লবী জীবনে তাঁকে বহু ছদ্মনাম নিতে হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি প্রয়াত হন এই মনিষী।

মেক্সিকো সফর তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। এক অর্থে তার রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেও মানবেন্দ্রনাথের মেক্সিকো-সফর বড় ধরনের বাঁক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ইংরেজিতে লিখিত তাঁর স্মৃতিকথা Memoirs ১৯৬৪ সালে দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয়। ৬২৮ পৃষ্ঠার এই দীর্ঘ স্মৃতিকথার শতাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে মেক্সিকো বাসের রোমাঞ্চকর ও ঘটনাবহুল স্মৃতি। মূল গ্রন্থের ৫ম অধ্যায় থেকে ২৯ অধ্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত সেই স্মৃতিচারণ। স্মৃতিকথার এই নির্বাচিত অংশ কলামিস্ট অনুবাদক প্রিসিলা রাজ-এর অনুবাদে ধারাবাহিকভাবে বাংলা ভাষায় প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আজ থাকছে মেক্সিকো সফরের নবম পর্ব। এই অনুবাদে মূল বইয়ের পর্ব-বিন্যাস অনুসরণ ও উল্লেখ করা হয়েছে।

১৩

ডাকাতদলের সঙ্গে প্রথম মোকাবেলা

অজানা-অচেনা বন্ধুদের মাধ্যমে অস্ত্রের সন্ধানে রোমাঞ্চকর চীন অভিযানের লম্বা প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। পুরো বিষয়টা নিয়ে আমার মধ্যে একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল। মনটা আমার ঠিক অভিযানের সঙ্গে ছিল না। মূলত স্বভাবের বশেই এর মধ্যে জড়িত হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু মনের ভেতরে জোর বিশ্বাসটা যেন ছিল না। এ এমন এক অভিযান যা এক তরুণ বিপ্লবীর মনে গভীর আবেদন সৃষ্টি করেছিল আর সেই মরীচিকার পেছনে দেড় বছর ধরে তাকে দৌড় করিয়েছিল। কিন্তু এখন এতে আর আমার কোনো বিশ্বাস ছিল না। মুক্তির নতুন স্বপ্নের টান তখনও এত প্রবল হতে পারেনি যার দ্বারা পুরানো টান পুরোপুরি উপেক্ষা করা সম্ভব। তবে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম আর সেটা হচ্ছে, যদি নয়া অভিযানে সফলকাম হই তবে দেশে আমার সহযোদ্ধারা কেবল যে নতুন অস্ত্র পাবে তা-ই নয়, লড়াইয়ের নতুন স্বপ্নও পাবে। মুহূর্তের জন্য থেমে যে কথাটা ভাবিনি তা হচ্ছে, যদি নতুন স্বপ্ন তাদের মধ্যে আবেদন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়? কিন্তু করবে না-ই বা কেন? সকলের মধ্যেই তো দরিদ্র-শোষিত-নিচের তলার মানুষকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করার আবছা আকাঙ্ক্ষা কাজ করে। আমাদের সকলের অনুপ্রেরণার উৎস বঙ্কিম চট্টপাধ্যায়ের আনন্দমঠ। বিপ্লবের আদর্শকে আমরা ওখানেই খুঁজে পাই। সত্যি বলতে কী, ওই গ্রন্থের মূল চরিত্রগুলোকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে তারই চরিত্রাভিনয় করি আমরা। তাঁরা একেকজন সন্ন্যাসী আর তাঁদেরই পদক্ষেপ অনুসরণ করব বলে প্রতিজ্ঞা করেছি আমরা। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার উজানে কোনো এক স্থানে আনন্দমঠ স্থাপন, আমাদের আদর্শ দ্বারা সেখানকার জনগণের হৃদয় জয় করা, তাদের সশস্ত্র করা এবং অপরাজেয় এক বাহিনীকে সম্মুখভাগে রেখে ক্রমশ অগ্রসর হয়ে দেশের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরে প্রবেশ করার যে স্বপ্নকল্পনা তা থেকে আমার একটাই কথা মনে হয়েছে; আর সেটা হলো, যদি আমার অভিযান সফল হয় তবে আমি ভারতে ফিরে আসব শুধু অস্ত্র নিয়ে নয়, বরং বিপ্লবের এক নয়া আদর্শও আমার সঙ্গী হয়ে আসবে।

যুক্তরাষ্ট্র হয়ে যাতে যেতে না হয় সেজন্য আমাকে সমুদ্রপথে যাত্রা করতে হলো। তখনকার দিনে সাউথ আমেরিকান লাইনের জাপানী উচ্চশ্রেণীর যাত্রী বহনকারী জাহাজগুলো প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে কোনো কোনো মেক্সিকান বন্দরে ভিড়ত। আমাকে তারই একটাতে যাত্রা করতে হতো।

আরেকটা সতর্কতাও অবলম্বন করার ছিল। এসব জাহাজ আবার সানফ্রান্সিসকোয় থামত। এগুলোর মধ্যে খুব কম জাহাজই ছিল যেটা থামত না। আমাকে ওইসব বিরল জাহাজের একটাতেই চড়তে হবে। তবে জাপানে নামা এমন কী থাকার ব্যাপারেও কোনো সমস্যা হতো না। একটা আধা কূটনৈতিক পাসপোর্ট ছিল এবং ইয়োকোহামায় মেক্সিকান কনসাল-জেনারেল বরাবর লেখা আমার পরিচয় উল্লেখপূর্বক চিঠিও ছিল সঙ্গে। উনি আমাকে একটা জাপানী ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেনে সাহায্য করবেন। তবে আমার জন্য নিকটতম প্রশান্ত মহাসাগরীয় মেক্সিকান বন্দরে পৌঁছানোটাই সবচেয়ে কঠিন ছিল। এজন্য মানসানিয়্যো( Manzanillo) নামে একটা জায়গায় পৌঁছাতে হবে। যে লাইনের রেলে যেতে হবে সেটার শেষ অংশ গেছে ডাকাতভরা একটা পর্বতসঙ্কুল এলাকার ভেতর দিয়ে। ওখানে যাওয়ার কোনো নিয়মিত ট্রেনও নেই। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অন্যান্য বন্দর আছে বটে কিন্তু ওগুলোতে পৌঁছানো আরো অসম্ভব। আবার যে জাহাজে আমার যাওয়ার কথা সেটা যে মানসানিয়্যোর মতো ছোট বন্দরে থামবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। থামতে পারে, যদি সেটার তামাক নেওয়ার কথা থাকে। মানসানিয়্যোর আশেপাশের অঞ্চলে প্রচুর তামাকচাষ হয়।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল বরাবর যাত্রাপথের প্রথমাংশ তুলনামূলক নিরাপদ, যদিও রেললাইনের বড় অংশ গিয়েছিল সাপাতিস্তাদের এলাকার মধ্য দিয়ে। প্রশান্ত মহাসাগরের ঢালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর গুয়াদালাহারা যেখানে নিয়মিত রেলসংযোগ ছিল। রাজধানী মেক্সিকো সিটি থেকে একটা যাত্রীবাহী ট্রেন সেনাপ্রহরায় প্রতিদিন গুয়াদালাহারার উদ্দেশে ছেড়ে যেত। দূরত্ব খুব বেশি নয়। ভোর ভোর ট্রেন ছাড়লে আলো থাকতে থাকতেই পৌঁছানো সম্ভব ছিল। অবশ্য পথিমধ্যে যদি বড় কোনো অঘটন না ঘটত। আমার জন্য যাত্রার শুরুর অংশ বিনা ঘটনায় কেটে গেল। দেশটির ভৌগোলিক প্রকৃতির মধ্যে প্রায় বর্বরোচিত একটা জৌলুস আছে। গেরিলা অপারেশনের জন্য একেবারে আদর্শ। ঘন বনের বুনোটে ঢাকা পর্বতসঙ্কুল গোপন আস্তানাগুলো থেকে সাপাতিস্তাদের যে কেন উৎখাত করা যাচ্ছিল না তার কারণটা সহজেই অনুমেয়।

সন্ধ্যার পরপর আমাদের ট্রেন গুয়াদালাহারা পৌঁছে গেল। আমার জন্য কোথায় থাকা সবচেয়ে ভাল হবে তা আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওটা ছিল পশ্চিমের রাজধানী শহরটির সবচেয়ে উত্তম হোটেল। গুয়াদালাহারার চলতি নাম ছিল পশ্চিমের রাজধানী। মেক্সিকোর প্রাণকেন্দ্রে ছিল শহরটির অবস্থান। বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধের আগের বছরগুলোতে খুব কম বিদেশীই ঝঞ্ঝাসঙ্কুল দেশটির এত ভেতরে যাওয়ার সাহস করেছেন। অসাধারণ সৌকর্যপূর্ণ এক ক্যাথেড্রালই স্প্যানিশ শাসনের শেষ চিহ্ন। এমন কী কনকিস্তাদোরেসের রক্তচিহ্নও অদৃশ্য হয়েছিল। গৃহযুদ্ধের বিপদ থেকে বাঁচতে ঔপনিবেশিক অভিজাত শ্রেণী চম্পট দিয়েছে। প্রতিবেশী অঞ্চলটি ফল উৎপাদনকারী এলাকা, মেক্সিকোর ফলবাগান যাকে বলে। শহরটির পথে পথে বন থেকে সংগ্রহ করে আনা আম, কমলা, সাপোতেসহ হরেক রকমের ফল স্তূপ করে রাখা হয়। এর মধ্যে অনেক ফল আছে যেগুলো হয়ত মেক্সিকোর বাইরে পরিচিত না।

ভাগ্য ভাল যে গুয়াদালাহারা এত আনন্দের জায়গা। ওখানে কয়েকদিন থামতে হয়েছিল আমাকে। যাত্রার পরের অংশটি মিলিটারি কনভয়ে যেতে হলো। সেখান থেকে আমাকে যত দ্রুত সম্ভব রওনা করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে স্থানীয় গ্যারিসন প্রধানের কাছে আগে থেকেই নির্দেশনা ছিল। তিনি আমাকে জানালেন, গেরিলাদের অপসারণ করার জন্য কনভয় আগেই পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ আসল যুদ্ধের জন্য সৈন্যদল বেরিয়ে গেছে। গ্যারিসন প্রধান জানালেন আমি এখন কিছুটা শান্তিতে যাত্রা করতে পারব। খুব বেশি দূরের পথ নয়। চার থেকে ছয় ঘণ্টা হবে। ভদ্রলোকের পরিকল্পনা ছিল, নিয়মিত সৈন্যদল রাস্তা পরিষ্কার করার পর আমাকে দ্রুত পার করে দেওয়া। সুতরাং যে কোনো মুহূর্তে রওনা দিতে হবে বলে আমাকে জানিয়ে রাখা হলো। সেটা গভীর রাতেও হতে পারে। বাস্তবেও তাই ঘটল।

রাত বারোটার কিছু পরই রওনা করলাম আমরা। ট্রেনযাত্রা। তবে ওটাকে ট্রেন বলা যায় কিনা সন্দেহ। একটা ইঞ্জিনের ডগায় দুটো বগি জোড়া দেওয়া। তার একটাতে সৈন্য ভর্তি। সেদিন দিনেরবেলায় সৈন্যদের দু’টি কনভয় পাঠানো হয়েছিল। প্রথমটা কোনো ঝামেলা ছাড়া পার হয়ে গেলেও দ্বিতীয়টা এনকাউন্টারে পড়ে। কিন্তু আক্রমণকারীদের তারা হটিয়ে দেয়। ধারণা ছিল ওরা তখনই ফিরে আসবে না এবং সেই ছোট্ট ফাঁকে আমাদের তীরের বেগে বেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো রেলপথের অবস্থা নিয়ে। পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া রেললাইনে অত্যন্ত ধীর সতর্কভাবে ট্রেনকে এগোতে হবে। ফলে ঘণ্টায় ১৫ থেকে ২০ কিমির বেশি যাওয়া সম্ভব না। সব বাতি নিবিয়ে জানালার সার্সি টেনে দেওয়া হয়েছিল। বুলেটের ঘায়ে ভাঙা জানালার কাচ বুলেটের চেয়েও মারাত্মক হতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই কারো চোখে ঘুম ছিল না। কনভয়ের কমান্ড্যান্টের নির্দেশ ছিল বাইরে কোনো গুলির আওয়াজ শোনামাত্র বগির প্রত্যেকে যেন মাটিতে শুয়ে পড়ে। ডাকাতদল যদি ট্রেনে উঠেই পড়ে তবে তাদের মোকাবেলা করার জন্য আমাদের প্রত্যেকের কাছে মাউজার পিস্তল দেওয়া হয়েছিল। তবে তার আগে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আক্রমণকারীদের ঠেকাতে প্রাণপণ লড়াই করবে লাগোয়া বগির সৈন্যরা।

ক্রমে পূর্ব দিগন্তে সূর্য ওঠার আভাস দেখা গেল। দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা। হঠাৎ গুলির শব্দে চারপাশের নৈঃশব্দ ভেঙে খানখান হয়ে গেল। তীব্র ঝাঁকি খেয়ে ট্রেনটাও থেমে গেল। সৈন্যদল বগি থেকে লাফিয়ে নেমে আমার বগির দু’পাশে বন্দুক তাক করে পজিশন নিল। আমিও মাউজারের নল জানালার ওপর রেখে পজিশন নিলাম। কমান্ড্যান্ট চেঁচিয়ে আদেশ দিতেই সৈন্যদল দু’পাশের জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ের ঢাল লক্ষ্য করে গুলিবৃষ্টি শুরু করল। কোনো প্রত্যুত্তর এল না। নিঃশব্দে শত্রুর পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। কিন্তু অপরপক্ষের নড়াচড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। ওরা ওখান থেকে সরে গেছে বলে মনে হলো। ভোরের আলো-আঁধারি কেটে গিয়ে ঝলমলে দিন উঁকি দিতে লাগল। পশ্চিমে আমাদের সম্মুখে প্রশান্ত মহাসাগর প্রস্ফুটিত হয়ে উঠল। রেলগাড়ি দুলে দুলে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মানসানিয়্যো পৌঁছে গেলাম আমরা।

মানসানিয়্যো প্রায় পরিত্যক্ত একটা বন্দর। ক্রান্তীয় অঞ্চল বলে দুপুরবেলা খুব গরম হয়ে যায়। কয়েকটা জেলেনৌকা ছাড়া জলে আর কোনো কর্মচাঞ্চল্য চোখে পড়ল না। সানডিয়াগোর দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বন্দর ও পানামার মধ্যে উপকূলীয় জাহাজের সাপ্তাহিক যাতায়াত ছাড়া মহাসাগরগামী জাহাজ এখানে খুব কমই থামে। শুনলাম দক্ষিণ আমেরিকাগামী জাপানী এক জাহাজের এখান থেকে তামাকের বড় চালান তুলতে থামার কথা। কিন্তু কেউই ব্যাপারটা নিশ্চিত করে বলতে পারল না। দক্ষিণগামী উপকূলীয় জাহাজ ভেড়ার কথা কয়েকদিন পরে। সেটায় চেপে তিনশ’ মাইল দক্ষিণে গিয়ে মেক্সিকান বন্দর সালিনা ক্রুসে পৌঁছানো যায়। সেখানে জাপানী জাহাজের নাগাল পাওয়া যেতে পারে। তামাক তুলতে সেই জাপানী জাহাজ কবে আসবে তার ঠিক নেই। সেটার জন্য অনির্দিষ্টকাল বসে না থেকে তিনশ’ মাইল পাড়ি দিয়ে সালিনা ক্রুসে গিয়েই জাহাজ ধরব বলে স্থির করলাম।

মার্কিন জাহাজটা বেশ বড়। সেটায় চড়ে উপকূল ধরে যাত্রার অভিজ্ঞতা বেশ উপভোগ্য হলো। কয়েকজন মাত্র যাত্রী। দ্বিতীয় দিন কয়েক ঘণ্টার জন্য আকাপুলকোয় থামলাম আমরা। বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক বন্দর এই আকাপুলকো। বিরাটাকার গভীর উপসাগরাকৃতির খাঁড়ি। তার চারপাশে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। খাঁড়ির সঙ্কীর্ণ প্রবেশপথের বিপরীতে পাহাড়ের সুউচ্চ শীর্ষে একটি সাদা রঙের গীর্জা দাঁড়িয়ে আছে। বন্দর থেকে বেশ দূরে তার অবস্থান। আশেপাশের পাহাড়গুলোও জনবিরল। একাকী গীর্জায় কারা যায় প্রার্থনা করতে? হাতে গোণা কজনের বেশি নয়। অবশ্য যদি এখনও আদৌ কেউ যায়। অতীতে ছোটখাটো পাপের জন্য সন্ন্যাসিনীদের নির্বাসনদণ্ড কাটাতে হতো এই গীর্জায়। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে হুয়ারিস্তার (মেক্সিকোর ফরাসী আক্রমণের প্রতিরোধযুদ্ধের নেতা বেনিতো হুয়ারেস) অনুসারীরা গীর্জাটা বন্ধ করে দেয়। তার ফলে কয়েকশ‘ পতিত দেবদূতী মুক্তি পেয়েছিল। সালিনা ক্রুস ছোট হলেও গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। এখান থেকে রেললাইন টেনে নেওয়া হয়েছে তেহুয়ান্তাপেক যোজক পর্যন্ত যেটা কিনা সরু একফালি স্থলভূমি। তেহুয়ান্তাপেক যোজকের অবস্থান প্রশান্ত মহাসাগর ও মেক্সিকো উপসাগরের মধ্যে। দূরত্বের দিক থেকে মাত্র শ‘খানেক বা তার বেশি কিছু হবে। পানামা যোজকের প্রস্থের সমান প্রায়। শুরুতে তেহুয়ান্তাপেক যোজকে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে জলপথ নির্মাণ করা হবে বলে ঠিক করা হয়েছিল। রাজনৈতিক কারণে পরে সে পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। সেই জলপথ নির্মাণের জন্য আরো দক্ষিণের একটি যোজক বেছে নেওয়া হয়। মেক্সিকোর সরকার তার সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে আপোস করেনি। তবে পরবর্তীকালে কোনো জাপানী কোম্পানি মেক্সিকোর সরকারের কাছে তেহুয়ান্তাপেক যোজকের সমান্তরালে খাল নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। দৃশ্যত, ওয়াশিংটনের চাপে সে প্রস্তাব আর এগোয়নি।

তেহুয়ান্তাপেক যোজকের সরু উর্বর স্থলভূমিটি ক্রান্তীয় গাঢ় সবুজে ঢাকা। এখানকার স্থানীয় মানুষগুলোও অসম্ভব সুদর্শন। কিন্তু যোজকের বেলাভূমির অংশটি বালুময় ও দিনরাত এর ওপর দিয়ে কঠিন ঝোড়ো হাওয়া যোজকের মূলভূমির দিকে বয়ে চলেছে। আমাদের জাহাজ থেকে একমাত্র আমিই এই বন্দরে অবতরণ করলাম। এখানে কয়েক ঘণ্টা বিশ্রামের পর জাহাজটা দক্ষিণদিকে যাত্রা করে গেল। বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে জাপানী জাহাজকে লক্ষ্য করে এখানে এসেছি সেটা কবে পৌঁছাবে তার কোনো সংবাদ এরা জানে না। ফলে ওতে উঠতে চাইলে এখানকার বালিয়াড়ি ঘেরা একটা ছোট হোটেলে অনির্দিষ্টকালের জন্য উঠে পড়তে হবে। প্রশান্ত মহাসাগরের অকূল বারিধির মধ্যখানে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতার জবাব নেই। কিন্তু দিনের বেলা সারাক্ষণ ঝোড়ো বাতাসের গর্জন আর তার ফলে হোটেলের টিনের ছাদে ছোট ছোট নুড়ি পাথরের আঘাত ও জানালার শার্সিতে ধূলার আস্তর সহ্য করাটা খুব স্বস্তিকর ছিল না। হোটেলের তত্ত্বাবধায়ক ভদ্রলোক মাপ চাওয়ার ভঙ্গিতে বলেন, সালিনা ক্রুস চিরকাল এমন নিঃসঙ্গ প্রায় ভূতুড়ে ছিল না। পোরফিরিও দিয়াসের সুদিনগুলোতে তেহুয়ান্তাপেক রেলপথের কল্যাণে এখানে পানামা খালের মতো মানুষের ভীড় লেগে থাকত। আর এখন দিনে দু’দিক থেকে একটা ট্রেন চালানোই দারুণ মুশকিল হয়ে পড়েছে। এক বছর আগে সেটাও সম্ভব ছিল না। ডাকাতের দল মাইলের পর মাইল রেললাইন উপড়ে ফেলেছিল। দেশে এখন শান্তি অনেকটা ফিরলেও গাঢ় বনে ঢাকা পাহাড়শীর্ষগুলো এখনও বিভিন্ন ডাকাতদলের জন্য চমৎকার হাইডআউট হিসেবে কাজ করছে। তাদের সাহায্য করছে সুদর্শন অমায়িকভাষী গর্বিত স্থানীয় তেহুয়ানানরা।

কয়েকদিন অপেক্ষার পর খবর এল আমার জাহাজ সালিনা ক্রুসে থামছে না। চিলি থেকে সেটা রওনা দিয়েছে বিরাট মালের বোঝা নিয়ে। হনুলুলু থেকে সরাসরি রওনা হয়ে পানামায় থেমে আবার যাত্রা করেছে। এরপর মাসখানেক পর একবার যাত্রাবিরতি করবে। এখন একটাই বিকল্প আছে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে দক্ষিণগামী যে জাহাজ আসছে সেটায় চড়ে ভালপারাইসোতে যাওয়া আবার একইভাবে ফিরে আসা। ওটা মোটেই বাস্তবসম্মত কোনো পরিকল্পনা হবে না। সব মিলিয়ে খুব বিরক্তিকর ও হতাশাজনক অভিজ্ঞতা হলো এ পর্যন্ত। কিন্তু একইসঙ্গে এক ধরনের স্বস্তিও পেলাম। হঠাৎ করেই উপলব্ধি করলাম বুনোহাঁসের পেছন পেছন আর দৌড়াতে রাজী নই আমি। পেছনে মেক্সিকোর হাতছানি টের পেলাম। নতুন বন্ধু হয়েছে ওখানে। নতুন আগ্রহের জায়গা খুঁজে পেয়েছি। নতুন রাজনৈতিক পথে হাঁটার পরিকল্পনা করেছি সেখানে বসে। অপরদিকে, পুরানো অভিযানে ফিরে যাওয়ার পথ আমার জন্য বাস্তবিকভাবেই রুদ্ধ হয়ে গেছে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় আর মেক্সিকোয় ফেরার টান শেষ পর্যন্ত ফিরে যাওয়ার দিকেই নিয়ে গেল আমাকে। তার ফলে ভাঙাচোরা রেলপথে সুন্দরী তেহুয়ান্তাপেক অতিক্রমের কষ্টকর যাত্রা শুরু করতে হলো।

প্রায় একশ’ মাইলের যাত্রা। দিনের আলো থাকতে থাকতে শেষ করতে হবে। দৈনিক একটা ট্রেন যায়। সঙ্গে অবশ্য পাহারা থাকে। সহজেই টিকেট জুটে গেল। লম্বা ট্রেনের বেশিটাই মালবাহী বগি। কেবল ল্যাজের দিকে যাত্রীবাহী দু’টো বগি এঁটে দেওয়া হয়েছে। সাধারণত যাত্রীবাহী বগি থাকে ট্রেনের শুরুর দিকে। এখানে উল্টো ব্যবস্থা কারণ ডাকাতদলের মালের দিকেই মনোযোগ বেশি। রক্তপাতে ততটা আগ্রহী নয় তারা। পেছনদিকে মালবাহী ওয়াগন থাকলে কেটে ইঞ্জিন থেকে আলাদা করে ফেলার ঝুঁকি আছে। যাত্রাপথের মাঝামাঝি সময় একটা গাঢ় সবুজে ঢাকা গভীর গিরিখাতের মধ্যে ঢুকল ট্রেনটা। হঠাৎ করেই সামনে গোলাগুলির শব্দ পাওয়া গেল। ব্রেক কষে থেমে গেল ট্রেনটা। সঙ্গে থাকা বন্দুকধারী পাহারাদারের দলটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ডাকাতদের দিকে ধেয়ে গেল। ব্যাপারটা অল্পেই থেমে গেল। আধা ঘণ্টার মধ্যে সব শেষ। ট্রেন চলা শুরু করল। তারপর ট্রেনের জানালায় হঠাৎই ভেসে উঠল লম্বা গাছ ও টেলিগ্রাফের খুঁটিতে ঝোলানো কিছুক্ষণ আগে হত্যা করা নয়টি তাজা মৃতদেহ।

অল্প সময় পরে মোটামুটি বড় একটা স্টেশনে থামা হলো। এলাকার প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র এই স্থান। মোটের ওপর শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজ করে। স্টেশনের প্ল্যাটফরমে ফলবিক্রেতারা গিজগিজ করছে। বেশিরভাগই তারা নারী। ছবির মতো পোশাক পরা দারুণ সুন্দরী সব মেয়ে। লম্বা, ঋজু, মুখগুলো যেন ভাস্করের ছুরিতে খোদাই করা। পুরুষগুলোও তাদের উপযুক্ত। দারুণ সুন্দর তবে ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে চলেছে। কারণ তেহুয়ানরা স্বগোত্রে বিয়ে করে। অসম্ভব গর্বিত জাতি তারা। কিছুমাত্র কম বনেদী রক্তের সঙ্গে নিজেদের রক্ত মেশাবে না। স্বগোত্র বিয়ের ফলে জন্মহার কমে যায়। আর তার ফলে এ ধরনের জাতিগোষ্ঠী একটা সময় বিলুপ্ত হয়ে যায়। প্রিয়দর্শন এক জাতির ওপর মৃত্যুর ছায়া ঝুলতে দেখে দুঃখ হয় আমার।

পুয়ের্তো মেক্সিকো, এখানকার বন্দর সালিনা ক্রুসের সাক্ষাৎ বিপরীত। চিয়াপাসের পর্বতসঙ্কুল জলাভূমিতে উৎসারিত স্রোতধারা যেখানে সাগরে মিশেছে সেখানে গড়ে উঠেছে এই বন্দর। উজানের গ্রামগুলো থেকে কলা ও আনারস বোঝাই হয়ে নৌকাগুলো সমুদ্রবন্দরের দিকে নেমে আসে পাইকারদের কাছে বেচাবিক্রির জন্য। সেখান থেকে জাহাজে বোঝাই হয়ে ফল চলে যায় ভেরাক্রুস বা যুক্তরাষ্ট্রের উপসাগরীয় বন্দরগুলোতে। এখান থেকে ভেরাক্রুস মাত্র ষাট মাইল দূরে কিন্তু কোনো রেলসংযোগ নেই। ফলে ভেরাক্রুসে যেতে চাইলে ফলবাহী মেক্সিকান জাহাজে করেই যেতে হয়। সেদিন সন্ধ্যায় একটা জাহাজ এখান থেকে ছেড়ে যাচ্ছে খবর পেয়ে সেটা ধরতে ছুটলাম। অবশেষে ময়লা ছোট জাহাজটাতে উঠেও গেলাম। কলা দিয়ে জাহাজের পেট বোঝাই, ফলে ওজনের কারণে জল ডেকের মাত্র কয়েক ফুটের মধ্যে চলে এসেছে। কলাবোঝাই পেটের মতন জাহাজের ডেকও মানুষ, গবাদিপশু আর পাখির খাঁচা দিয়ে কানায় কানায় ভরা। আমি আবার প্রথম শ্রেণীর যাত্রী। তাই কপালে একটা নড়বড়ে নোংরা ক্যানভাসে মোড়ানো ডেকচেয়ার জুটল। সেটায় বসার পর বেশিক্ষণ লাগল না অবশ্য চারপাশটা যাত্রীদের মালামাল, বাক্সপ্যাঁটরা, বান্ডিলবাঁধা জিনিসপত্তর আর ঝুড়ি দিয়ে ভরে যেতে। পায়ের কাছে কুণ্ডলি পাকিয়ে একটা কুকুর শুয়ে পড়ল। মাথার ওপর খাঁচায় পোরা একটা টিয়া চ্যাঁ চ্যাঁ করে ডাকতে শুরু করল। মনটা কেমন ভড়কে গেল। কিন্তু পরদিন সকালেই এই অগ্নিপরীক্ষা থেকে মুক্তি মিলবে এই বলে মনটাকে চাঙ্গা রাখতে চেষ্টা করলাম। তাছাড়া জাহাজটা ছাড়লে তাজা বাতাসের ঝাপটায় বোঁটকা গন্ধটা থেকেও স্বস্তি মিলবে।

মাঝরাতের কাছাকাছি সময়ে (ঘড়ির কাঁটায় চলার বদগুণ কখনও ছিল না মেক্সিকানদের) প্রাচীন ইঞ্জিনখানার হাঁপানি শোনা গেল। কঁকিয়ে উঠে ডাক ছাড়তে ছাড়তে বিরাট একখানা কাঁপুনি দিয়ে জাহাজটা চলতে শুরু করল। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ঝড় ধেয়ে এল। অচিরেই তা ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে বলে মনে হলো। এ ধরনের ছোট নড়বড়ে নৌকা উপকূল থেকে খুব বেশি দূরে যাওয়ার সাহস করে না। ভয় হচ্ছিল যে-কোনো সময় ঝড়ের ধাক্কায় আমরা বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ব। ফলে জাহাজের কাপ্তেন কূল থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব রেখে আগাচ্ছিল। সেটাও আরেক ভয়। ঝড়টা ক্রমশ শক্তি পাচ্ছিল। ডেকের ওপর কেরোসিন কুপিগুলো সব নিভে গেল। ঘুটঘুটে আঁধারের মাঝখানে আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছিলাম যখন ফসফরাস মাখানো ঢেউগুলো ভয়ানক উঁচুতে উঠে জাহাজটাকে নিয়ে খেলায় মেতে উঠছিল। মহিলাদের মরণ চীৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। পুরুষগুলো শাপশাপান্ত করছিল। পাশের কুকুরটাও তারস্বরে ডেকে যাচ্ছিল। সব মিলিয়ে এক বিকট প্রাণান্তকর পরিস্থিতি। ঢেউয়ের পর ঢেউ ডেকের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল। ভয়ঙ্কর দুলুনির কারণে সব যাত্রী সামুদ্রিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হলো। এমন কী কুকুর আর টিয়াটাও বাদ গেল না। জরাজীর্ণ নৌকাটা যে-কোনো মুহূর্তে উল্টে পড়বে বলে আতঙ্ক হচ্ছিল। সেই ভয়েই মনে হয় অন্যদের মতো আমার আর বমি পেল না। অবশ্য সমুদ্রযাত্রা আমাকে কাবু করতে পারেনি কখনও। এমন কী কুখ্যাত চীন সাগরের ঢেউয়েও আমার পেটের কোনো বিকার হয়নি। জীবনে একবারই সামুদ্রিক অসুস্থতা পেয়ে বসেছিল আমায়। সেটাও আবার সবুজ কাচের মতো ভূমধ্যসাগরের বুকে। যাই হোক, এই অগ্নিপরীক্ষা ঠিক কতক্ষণ চলেছিল খেয়াল ছিল না আমার। একসময় নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল ডেকের বুকে। সাগরের তর্জন তখনও চলছে। ঝোড়ো বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দও বন্ধ হয়নি। এ বাদে ডেকের ওপরটা নিঃশব্দ হয়ে এসেছিল। মৃত্যুর নিস্তব্ধতা নয়। প্রত্যেকটা প্রাণীর সকল প্রাণশক্তি শুষে নিয়েছিল ঝড়টা। পুব আকাশে হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখা দিল। বিরাট লাল থালাটা সাগরের বুক থেকে উঠে এল। ঝড় থেমে গেলেও সাগর তখনও ফুঁসছে। ভাঙাচোরা জাহাজটা ছয় ঘণ্টা ধরে এমন একটা ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে গেল। কী করে - সেটাই আশ্চর্য।

দিনের আলো যাত্রীদের জাগিয়ে দিয়েছিল। অতিরিক্ত শ্রান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল সবাই। জেগে উঠে নিজেদের মাথা ও জিনিসপত্র গোনাগুনতি শুরু করে ওরা। না, কোনো যাত্রী খোয়া যায়নি। তবে জিনিসপত্রের বড় অংশ ভেসে গেছে ঝড়ে। ভেরাক্রুস পৌঁছাতে আর কত দেরী? কাপ্তেনের জানা নেই। মনে হচ্ছিল জাহাজটা অনেকদূর ভেসে গেছে। তবে সূর্যের চিহ্ন ধরে জাহাজের অবস্থান আবার মেপে নিল সে। প্রায় মাঝদুপুরে এসে কাপ্তেন টের পেল ঝড়ের কারণে আমরা ভেরাক্রুস পার হয়ে অনেকটা দূর চলে এসেছি। জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে চলা শুরু হলো আবার। বিকেলের দিকে গিয়ে ভিড়লাম ভেরাক্রুস বন্দরে।

মেক্সিকোর প্রধান বন্দরে সেটাই ছিল আমার প্রথম পদার্পণ। কিন্তু পর্যটনের রুচি ততক্ষণে ঘুচে গেছে আমার। সভ্যতায় ফেরার জন্য প্রাণটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। সেই সন্ধ্যায় ট্রেন ধরার সময় ছিল না। রাত কাটানোর জন্য হোটেলে গিয়ে উঠলাম। দারুণ হোটেল। একেবারে আন্তর্জাতিক মানের আরাম-আয়েশ। স্নান সেরে ভাল খাবার খেয়ে আরামদায়ক বিছানায় দারুণ ঘুম দিলাম একটা। সকালে উঠে শহর ঘুরতে বেরোলাম। পরবর্তীকালে এখানেই আরো কয়েকবার ফিরে আসতে হয়েছিল আমায়।

ভেরাক্রুস থেকে রাজধানীতে ফেরার রেলযাত্রা নিরাপদ। ট্রেনগুলোও টাইমটেবিল মেনে নিয়মমতো যাতায়াত করে। আন্দেজ পর্বতমালার মধ্য দিয়ে আর্জেন্টিনা থেকে চিলি যাওয়ার রেলপথ বাদে ভেরাক্রুজ-মেক্সিকো রেললাইনকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রেলযাত্রা বলা হয়। উত্তর-দক্ষিণমুখী এই লাইনটা সাগরপৃষ্ঠ থেকে ক্রমে উঠে গেছে আট হাজার ফুট উঁচুতে। ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে রওনা হয়ে শেষ হয়েছে চিরতুষারাবৃত পবর্তমালার পাদদেশে। রাতের ট্রেনে চাপলে অবশ্য বাইরের দৃশ্য দেখা সম্ভব নয়। ঘুম যখন ভাঙল ট্রেন ততক্ষণে মেক্সিকো মালভূমিতে এসে পৌঁছেছে। ধোঁয়া উদ্গীরণরত পর্বত তখনও প্রহরায় দাঁড়িয়ে এবং শ্বেতাঙ্গিনী গভীর নিদ্রায় শয়ান। খুশিতে মনটা ভরে উঠল। যেন নিজের বাড়িতে ফিরে এলাম আমি।

চলবে