কোথাও পড়েছিলাম, ‘তোমার বই যতক্ষণ ফুটপাতে না আসবে ততক্ষণ তুমি জনপ্রিয় লেখক নও’।
Published : 09 May 2023, 09:20 PM
তার মৃত্যুর খবরটা যখন পাই তখন আমি অফিসে। ডেস্কে বসেই কম্পিউটারের মনিটরে ছাপা হওয়া সংবাদে তার মুখটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। যে কোন মৃত্য সংবাদ পেলেই নিজেকে খুব একা লাগে, গত সন্ধ্যাটাও ভারি হয়ে বুকে চেপে বসেছিল। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের (১০ মার্চ ১৯৪৪ – ৮ মে ২০২৩) চলে যাওয়া আমাদের স্তম্ভিত করে দিয়েছে।
কৈশোরে কুমিল্লার রাজগঞ্জ বাজারের দিকে এক সারি পুরনো বইয়ের দোকানে প্রথম পেয়েছিলাম সমরেশ মজুমদারের বই। জরাজীর্ণ দোকানগুলো স্কুল-কলেজের গাইড বই আর কোরান-হাদিসের বই দিয়ে ঠাসা থাকতো, কিছু মলিন বহুল ব্যবহৃত বই দোকানের বাইরে ফুটপাতে স্তুপ করে ফেলে রাখা হতো। ভাঙারি কিংবা ফেরিওয়ালার কাছ থেকে এগুলো সংগ্রহ করতো তারা। সেই স্তুপ ঘেঁটে গল্প-উপন্যাস আর কবিতার বই টেনে বের করতাম। দোকানি জিজ্ঞেস করতো, ‘কী বই চাই?’ কিন্তু আমি কোন নির্দিষ্ট নাম বলতে পারতাম না।
কখনও কখনও আমার খোঁজাখুঁজি দেখে বিরক্ত হয়ে দোকানি তাড়া দিতো, ‘নাই, নাই, পরে আসেন’। এমনি একদিন খুঁজে পেয়েছিলাম সমরেশের ‘মেয়েরা যেমন হয়’ বইটি। সেদিন কিনতে পারিনি, কয়েক পৃষ্ঠা দাঁড়িয়ে পড়ে চলে এসেছিলাম। পরে একদিন গিয়ে কিনে ফেলেছিলাম সেই বইটিসহ মুনীর চৌধুরীর অনুবাদে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের নাটক ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’। দুটি বই-ই আমার কিশোর মনে দাগ ফেলেছিল।
তরুণ বয়সে ঢাকার পুরানা পল্টনের ফুটপাত, নীলক্ষেতের ফুটপাত যাকে আমরা ‘নীলক্ষেত বিশ্ববিদ্যালয়’ বলে পরিচিতি করে তুলেছিলাম কিংবা মিরপুর দশ নাম্বার গোল চত্বরের ফুটপাত ছিল আমার ভরসা। হাতের কাছে সমরেশ পেয়েও কোনদিন কিনিনি। তাহলে আমার বুকশেলফে ‘গর্ভধারিণী’, ‘কালপুরুষ’, ‘কালবেলা’ আর ‘উত্তরাধিকার’ কী করে এলো! অফিস থেকে বাসায় ফিরে রাতে শেলফ থেকে বইগুলো নামিয়ে টেবিলে রাখছিলাম আর একেকটি স্মৃতি মনে পড়ছিলো। বেশ মলিন বইগুলো। এগুলোও ফুটপাত থেকেই কারও না কারও কেনা, তারপর আমাকে উপহার দেওয়া। সম্পূর্ণ পড়াও হয়নি মনে হয় সবকয়টা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েদের সমরেশের বই পড়া শুরু ফুটপাত থেকে কিনে। হলগুলোতে দেখতাম ছাত্রদের পড়ার টেবিলে যে দুই-তিনটা সৃষ্টিশীল বই পাওয়া যেতো তার মধ্যে থাকতো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ ও সমরেশ মজুমদার। ছেলেদের চেয়ে বোধ করি অপরিণত মেয়েরা এসব বই কিনতো বেশি, তাদের কাছে টাকা থাকতো। ছেলেরা সিগারেট খেয়ে আর আড্ডা মেরেই পয়সা উড়িতে দিতো। তাছাড়া প্রত্যেক জনপ্রিয় লেখক মাত্রই মেয়েদের কাছে জনপ্রিয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা বই না কিনলে বা পড়লে সেই বই জনপ্রিয় হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। আমার কাছে সমরেশের যে বইগুলো আছে সেগুলো মেয়েদের কাছ থেকেই পাওয়া, তাদের কারও সঙ্গে আমার এখন যোগাযোগ নেই। একটা বইয়ের গল্প শুধু তার ভেতরের পৃষ্ঠাতেই থাকে না; বইটির প্রকাশনা, বেচা-কেনা, হাতবদল কিংবা অটোগ্রাফ ঘিরে তৈরি হয় আরও নানা গল্প-উপগল্প। সমরেশের বইও যেন তাই, নিমিষে আমাকে কতোগুলো মেয়ে-মুখ মনে করিয়ে দিলো, মনে করিয়ে দিলো রাস্তায় ঘোরাঘুরির দিনগুলো।
একবার জন্ম নিলে যেমন মানুষকে মরতে হবে; এদেশে একবার লেখা হলে সেই বই ফুটপাতে আসতে হবে। আমি কয়েকজনকে চিনতাম যারা ফুটপাত থেকে নেশার মতো বই সংগ্রহ করতো। পথ চলতে গিয়ে আমরা হয়তো প্রায়ই এরকম বইয়ের পৃষ্ঠায় মুখ গুঁজে থাকা আত্মাগুলোর সঙ্গে ধাক্কা খাই। সিনেমা হল বা সাহিত্যের কোন আড্ডায় তাদের পাওয়া যায় না। সাহিত্যিক পরিচয়টুকুও হয়তো তাদের কাছে মূলবান নয়। তাদের সে সময় নেই, তাদের মাথা ফুটপাতের বইয়ে ভরে গেছে। তাদের সময় কাটে ফুটপাতে রোদে দাঁড়িয়ে বা হাঁটু ভাঁজ করে বসে বইয়ের পৃষ্ঠায় চোখ বুলিয়ে। প্রায়ই আমি তাদের দেখতাম ফুটপাথে ছড়িয়ে থাকা বইয়ের স্তুপের মধ্যে মুক্তো খোঁজার চেষ্টা করছে। তারা হয়তো কাঁচাবাজার করতে বেরিয়ে পুরনো বই নিয়ে ঘরে ফিরতো। আমি এমন একজন মানুষকে জানি যে তার পরিবার চালাতে পারে না, কিন্তু রুশ ‘প্রগতি’ বা ‘রাদুগা’ প্রকাশনীর বই সংগ্রহ করার ঝোঁক তার প্রবল। বাড়িতে খুব বেশি কিছু নেই, তবে একটি সম্পূর্ণ আলমিরা রুশ সাহিত্য দিয়ে ঠাসা। বিশেষ বইয়ের প্রতি ঝোঁক থাকলেও জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের কোন বইয়ে কী আছে তা ঠাস করে বলে দিতে পারে তারা। ফুটপাতে পছন্দের বই খুঁজে পেয়ে উচ্ছাসও প্রকাশ করতে দেখা যায়। বছর কয়েক আগে মেক্সিকোর কনদেসার ফুটপাতে অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী জন ন্যাশের বই খুঁজে পেয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক কৌশিক বসুকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখেছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
কোথাও পড়েছিলাম, ‘তোমার বই যতক্ষণ ফুটপাতে না আসবে ততক্ষণ তুমি জনপ্রিয় লেখক নও’। আবার এমনও অনেকে বলে, ‘যে দেশে বই বিক্রি হয় ফুটপাতে আর জুতো বিক্রি হয় শীতাতপ শো-রুমে সেদেশে...’। কথা হলো ফুটপাতে অনেক অখ্যাতদের বইও পাওয়া যায়। আর জুতোরও উপযোগিতা আছে, যেমন আছে বইয়ের। তবে জনপ্রিয় হওয়ার একটা বড় উপায় হচ্ছে কাচের শো-কেস বা মনোহারি তাক থেকে বেরিয়ে ফুটপাতে সাধারণের নাগালের মধ্যে চলে আসা। হয়তো পাইরেটেড, তবে ব্যবসায়িক ভঙ্গি বাদ দিলে একটি বইয়ের মূল যে শক্তি, তার সঞ্চারণ ক্ষমতা, তা আমাদের মতো দেশে অনেকটাই তৈরি হয় ফুটপাতের মাধ্যমে। সেই প্রেম-বিরহের বই, নারী ক্ষমতায়নের কথা বলা বই জড়াজড়ি করে থাকে কোরআন-হাদিসের বইয়ের সঙ্গে। সব জনপ্রিয় বইমাত্রই ফুটপাতে পাওয়া বই। ওপার বাংলার অনেক জনপ্রিয় লেখককে এপার বাংলাও জনপ্রিয় করেছে ফুটপাত। ফুটপাতে পাওয়া না গেলে সীমানা পেরিয়ে আসার কারণে মূল্য বেড়ে যাওয়া ওই বই সাধারণের নাগালে কমই পৌঁছতে পারতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনিয়রের কাছে একটা গল্প শুনেছিলাম এমন- তার এক বন্ধু সমরেশের কোন একটি উপন্যাস পড়া শেষে নীলক্ষেতের ফুটপাতে বিক্রি করে আরেকটি বই এনেছিল, ওইদিন বিকেলে আরেক বন্ধু গিয়ে সমরেশের ওই বইটাই ফের কিনে এনেছিল। তারা সেটা বুঝেছিল বইয়ের ফ্লাই লিফে কিছু লেখা দেখে।
২০১৫ সালে কলকাতায় ‘বাংলাদেশ বইমেলার’ শেষ দিন পাইরেসি সমস্যা নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন সমরেশ মজুমদার। সেই আলোচনায় একটি ঘটনা বলেন তিনি। ঢাকার বাংলাবাজারে নিজের একটি বই দেখে নিজেই চমকে যান তিনি। বইটি উল্টেপাল্টে বুঝতে পারেন পাইরেটেড কপি। নাম-পরিচয় আড়াল করে বইটি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিক্রেতা জানান, এটি সমরেশ মজুমদারের বই, দাম চারশ টাকা। তারপর তিনি এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এ বিষয়ে নালিশও করেন। নিজের বইয়ের পাইরেসি নিয়ে কথা বলা লেখকের অধিকার। কিন্তু ততদিনে জীবনের সত্তর বছর পেরিয়ে আসা সমরেশের কাছ থেকে লেখকি বণিকবৃত্তির চেয়ে দার্শনিক মনোভঙ্গিই আশা করেছিলাম পাঠক হিসেবে। তিনি মজা করতে পারতেন, শিল্পীসত্তাকে চোর-সাধু সবার জন্যই উন্মুক্ত করে পারতেন, বলতে পারতেন, ‘এসব বই কি সত্যি আমি লিখেছি!’ তবে ঢাকায় পুরনো বই বাজারের রয়েছে জটিল সাংগঠনিক দিক, পুরনো বই বিক্রেতাদের সেই ‘ট্রেড সিক্রেট’ নিয়ে হয়তো অন্য কোন একদিন আলোচনা করবো।
সমরেশের প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’, এতে আমরা দেখি নায়ক চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফুটপাতে নেমে যায়। কর্মহীন ফুটপাতের বিষাদ যেন উপন্যাসের পরতে পরতে। ‘গর্ভধারিণী’ উপন্যাসের নায়িকা জয়িতাও তার বন্ধুদের নিয়ে ঘর পালিয়ে নেমে পড়ে রাস্তায়। তার ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালপুরুষ’, ‘কালবেলা’ আর ‘মৌষলকাল’ উপন্যাসের নায়ক রাজনীতি সচেতন অনিমেষও ঘর ফেলে নেমে পড়ে মুক্তিকামী রাস্তায়। আজও হয়তো ফুটপাতে বই খুঁজতে গিয়ে সমরেশের দেখা পাবো, সেই কৈশোরের মতো, আজ হয়তো কিনবো না, তবে নেড়েচেড়ে মায়া রেখে আসবো।