প্রমির চোখে গভীরভাবে চোখ রেখে কিছু একটা বলতে চায়। গলা শুকিয়ে আসে, কণ্ঠ ভারী হয়ে ওঠে।
Published : 14 Feb 2025, 12:18 PM
তুমি আমাকে ছেড়ে যাচ্ছো না কেন রায়হান?
প্রশ্নটা ধক্ করে লাগে রায়হানের। প্রশ্নের অভিব্যক্তিতে কোনো হতাশা, অভিযোগ কিংবা ক্ষোভের স্পর্শ নেই। কিন্তু কোথায় যেনো লুকিয়ে আছে অনেক কিছুই । সে ঠিক ধরতে পারে না- প্রমি কি মুক্তি চাইছে? নাকি অনিশ্চিত একটা সম্পর্ককে আশ্বস্ততার চাদরে মুড়ে দেয়ার পথে রায়হানের একঘেয়ে যে অজুহাত সেটা মেনে নিতে পারছে না? ভেতরটা ফাঁপা লাগে রায়হানের। হাহাকার হয়ে বাজে। কেবল একটাই স্পষ্ট শব্দ বেরোয় তার কণ্ঠনালি ভেদ করে-ভালোবাসি!
নিকষ নিস্তব্ধতার ঝাঁপি নামে বসে থাকা পার্কের বেঞ্চি জুড়ে। কারো মুখেই কোনো শব্দ বেরোয় না। বেশ কিছুক্ষণ। চারপাশে স্বাভাবিক ছন্দে বাতাস বয়ে চলে। কংক্রিটের শহর থেকে খানিক দূরের গুছানো রিসোর্টের এক চিলতে এই পার্কে হুট-হাট দু একটা পাখির ডাক শোনা যায়। মাঝে মাঝেই ওদের পাশ দিয়ে হেঁটে যায় ঘুরতে আসা যুগল। ওদের স্বতঃস্ফূর্ত হেঁটে চলা, যুবকের বাহুর নিচে আগলে ধরা যুবতীর শাড়ি সামলে সাবলীল ঘুরে বেড়ানো- বেশ আগ্রহ নিয়েই বেহায়ার মতো তাকিয়ে দেখে রায়হান। ভালো লাগে তার। কী নির্ভরতা! কী স্বাভাবিক ছন্দ ! ওদের নিশ্চয়ই অনিশ্চয়তার রেশ নেই কোনো। কিংবা কে জানে, হয়তো আছে!
বেশ কিছুদিন ধরেই কেমন জানি একটা অদৃশ্য অস্বস্তির ছায়া ওদের সম্পর্কের মাঝে উঁকি দিচ্ছিলো। ঠিক অস্বস্তিও না, আবার সাবলীলও না। যেটাকে ডিফাইন করাও দুরহ। এমন না যে ওরা একে অপরকে ভুল বুঝছে, আবার এমনও না যে সব ঠিকঠাক চলছে। ঠিক কী কারণে এই দূরত্ব, সেটা বোঝাও মুশকিল। সেটা কাটাতে কিনা কে জানে, শহরতলীতে কোথাও নিরিবিলি সময় কাটানোর চিন্তা থেকে এই রিসোর্টে আসা।
সুন্দর গুছানো চারপাশ। কৃত্রিম লেক ঘিরে রেখেছে রিসোর্টকে। চারদিকে সারি সারি নারকেল আর সুপুরি গাছ, মাঝে প্রশস্ত লনে ছড়ানো রঙিন ক্যানভাস চেয়ার, যেখানে বসে বিকেলের নরম রোদ গায়ে মাখা যায়। রিসোর্টের মূল ভবনটি কাঠ ও লাল ইটের সংমিশ্রণে তৈরি, যেন গ্রাম্য ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মিশেল। একতলায় খোলা বারান্দা, যেখানে দুলতে থাকা কুণ্ডলী বাঁধানো দোলনাগুলো অতিথিদের আমন্ত্রণ জানায় যেনো। ভেতরে ঢুকলেই কাঠের আসবাব, দেওয়ালে পুরনো দিনের জল রঙের ছবি—একটা নস্টালজিক আবহ তৈরি করে। রিসোর্টের অভ্যর্থনা কর্মী জানাচ্ছিলো- চারপাশে ঘিরে আছে যে লেকটা, সেটায় সন্ধ্যার আলো-আধারিতে ভেসে বেড়ায় কাঠের নৌকাগুলো। লেকের ধারে কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে গেলে রিসোর্টের কটেজগুলোর দেখা মেলে—প্রত্যেকটিই আলাদা আলাদা নকশার, কিন্তু সবগুলোতেই খোলামেলা বারান্দা, যেখানে বসে রাতের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাবে নিশ্চিত।
কেনো বাসো?
হু?
কেনো বাসো?
নিকষ নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রমিই জানতে চায় ফের। প্রশ্নটা যেন দূর পাহাড়ের গম্ভীর ডাক হয়ে রায়হানের ভেতর প্রতিধ্বনি তোলে। চোখে চোখ রেখে তাকায় সে। সেখানে প্রশ্নের চেয়েও বেশি কিছু লুকিয়ে আছে। হয়তো আকুতি কিংবা বিরক্তি। রায়হান ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু এটা বুঝতে পারে, উত্তরটা এড়িয়ে গেলেই সে হারিয়ে যাবে পুরোপুরি । তাও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সে। গলার কাছে আটকে থাকা কথাগুলো বেরোতে চায়, কিন্তু পারে না।
কদিন আগেই প্রমি বলছিলো- রায়হান, তোমাকে প্রায়োরিটি দিতে গিয়ে আমি ভেবেছিলাম এভাবে এক সময় আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো। হাজারো বিষয়ে আমারো দায়বদ্ধতা আছে, ফলে আমার প্রায়োরিটি দেয়াটা খুব সস্তা না। আই হ্যাভ টু পে ফর ইট ইন এভ্রি সিঙ্গেল মোমেন্ট। আমারো চারপাশের হাজারটা সামাজিক প্রশ্ন ঠেলে টিকে থাকতে হয়। তোমাকে প্রায়োরিটি দেই, কারণ- ভালোবাসি। তোমার জন্য সীমাহীন মায়া আমার। আমার প্রতিটি অস্তিত্বে জড়িয়ে আছো তুমি। অথচ তোমার প্রায়োরিটি লিস্টে আমি তলানিতে, কিছু একটা চাইলেই যেনো মহাকাশ ভেঙে আসে তোমার, মায়ার ছোঁয়া আমি পাই না। নিজেকে খুব তুচ্ছ লাগে, জানো? কিন্তু আমার সেই ভাবনাটা ভুল, আমি প্রায়োরিটি দিতে গিয়ে শূন্য হয়ে যাইনি, বরং আরো বেটার কিছু করার ইচ্ছে জেগেছে আমার।
তোমার কি মনে আছে রায়হান? সেদিনের কথা? ব্রিজের উপর শত মানুষের ভিড়ে আমাকে প্রথম চুমু খেয়েছিলে? মনে আছে সেদিন সারাটা রাস্তা হাতটা ধরে বসে ছিলে? কী তীব্রতা ছিলো তোমার চাওয়ায়! অথচ দেখো, ইদানিং আমি হাত ধরে থাকলেও তুমি ফোনে নোটিফিকেশন চেক করো। ধরে থাকা হাতের কোনো রেসপন্স থাকে না। কোনো উষ্ণতা থাকে না। খানিক বোধকরি অস্বস্তিও থাকে। ধুলোর আস্তরে ঢেকে যাচ্ছে না সম্পর্ক নামক বোধটা?
রায়হান ভাবনার ঝাঁপি সাজিয়ে বসলেও প্রমি কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ায়। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে হাতের নখ খুঁটে। যেনো বুঝাতে চায়- "কেন এসব প্রশ্ন করা? এরচে' ঢের ভালো চুপ করে থাকা"।
আমি কী করবো, প্রমি? তোমার মতো করে তোমাকে হয়তো আমি কখনোই ভাবি নাই। স্বার্থপরের মতো তোমাকে আঁকড়ে ধরে শ্বাস নেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছি তোমার দমটা বন্ধ করে। আমার প্রকাশ হয়তো অতটা না, যতোটা ভেতরে খুবলে খায়। তোমার মনের অগোচরে প্রশ্ন জাগতেই পারে আমি আদৌ ভালোবাসি কিনা, সেটাই স্বাভাবিক। আমার অনিশ্চিত অস্তিত্বে তুমি হয়তো ক্লান্ত। কিন্তু কীভাবে তোমাকে বুঝাই-"কেহ দেখিবে না মোর অশ্রুবারিচয়"। কীভাবে বুঝাই ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে আসার অনুভূতি। রায়হানের গলাটা খানিক ধরে আসে।
কার লেখা লাইনটা? পরিচিত মনে হচ্ছে? প্রমি পরিবেশ স্বাভাবিক করতেই হয়তো প্রশ্ন করে। রবি বুড়ো? .........ও আচ্ছা! ধরতে পেরেছি এবার। চেরি পিকিং করেছো দেখে বুঝি নাই। কতোবার ভেবেছিনু থেকে পিক করেছো। কেহ জানিবে না মোর গভীর প্রণয়/ কেহ দেখিবে না মোর অশ্রুবারিচয়! কিন্তু গাধু, তোমার প্রণয় তো জানিবে না টাইপ না। জানিয়েছো তো আমাকে! প্রমি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে পরিবেশ। রায়হানের হাত ধরে টেনে তোলে। এলোমেলো হাঁটতে থাকে ওরা লেকের পাশ ঘেঁষে। কিন্তু রায়হান বুঝতে পারে প্রমির ক্লান্তি। বুঝতে পারে নিজের অসহায়ত্ব। বুঝতে পারে সে তলিয়ে যাচ্ছে।
দেখো রায়হান, যা পেয়েছি, সেটাই বা কম কীসে বলো? তু ঝুম গানটা শুনেছো না? কোক স্টুডিওর? ওখানে একটা লাইন আছে দেখবে- Sab nu samajh ke ki karna ae ( why delve into what is beyond my control?)। বাদ দাও, লেটস ফোকাস অন দা ডে। আবহাওয়াটা বেশ চমৎকার, না? প্রমির চোখেমুখে এখন আর প্রশ্ন নেই, আছে কেবল শূন্যতা। যেই শূন্যতা কাটিয়ে সে পরিবেশ স্বাভাবিক করতে চাইছে। আর সেই শূন্যতাই রায়হানের ভেতরে একটা গহ্বর তৈরি করছে, যা ক্রমশ তাকে গ্রাস করে ফেলছে।
সন্ধ্যের আগেই ওরা ফিরে আসে রিসোর্টের অনাবিল সৌন্দর্য উপেক্ষা করে। ফিরতে ওদের হতোই। শহরতলী থেকে দূরে গিয়ে 'আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়াতে' চেয়েছিলো ওরা, আরো বেশি বাইরে চলে যেতে নয়। কিন্তু বুঝতে পারে ক্রমশ ওরা বাইরের পানেই চলেছে একাকী। অমন অস্বস্তি নিয়ে রিসোর্টে থাকতে চায়নি বলেই ফিরে এসেছে।
সেদিনের পর শীতল দূরত্বের মধ্যেও কথা হয় ওদের, কখনো অপ্রয়োজনীয় কিছু নিয়ে, কখনো অভ্যাসবশত। সম্পর্কটা যেন একটা দোদুল্যমান দড়ির ওপর দাঁড়িয়ে, ভারসাম্য হারালেই তলিয়ে যাবে, অথচ দুজনেই এক অদৃশ্য টানে তা ধরে রাখার চেষ্টা করে।
অবশেষে, একদিন সত্যিই ছিঁড়ে যায়। তুমুল কোনো ঝগড়া নয়, কোনো হঠাৎ সিদ্ধান্তও নয়—একটা ধীরলয়ের দূরত্ব, একটা বুঝতে পারা - একসঙ্গে থাকলে শুধুই ক্লান্তি বাড়বে। তবু, শেষ মুহূর্তে রায়হান এক মুহূর্ত দাঁড়ায়। প্রমির চোখে গভীরভাবে চোখ রেখে কিছু একটা বলতে চায়। গলা শুকিয়ে আসে, কণ্ঠ ভারী হয়ে ওঠে। তাও বলে- ‘কেমনে প্রকাশি কব কতো ভালোবাসি’?
প্রমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। হালকা করে হাসে। সেই হাসিতে অভিমান নেই, অভিযোগও নেই—শুধু একরাশ বিষাদ লেগে থাকে। খুব আস্তে বলে— আমাদের গল্পটা কখনো সহজ ছিল না রায়হান, কখনো হবেও না। If all my wishes were to come true, what would be left in the world to do? তুমি ভালো থেকো, রায়হান।
সময় বড্ড নিঃস্পৃহ, সব নিয়েই যেনো ভীষণ উদাসীন। সেই সময়ের ছোঁয়ায় সবাই এগুতে থাকে সম্মুখ পানে। সম্মুখ পানের অনেকগুলো নিঃশব্দ রাত সাক্ষী হয়ে সঙ্গ দেয় প্রমিকে। বিছানার বালিশটা ক্রমে স্যাঁতস্যাঁতে হয়। পুরোনো টেক্সট স্ক্রল করতে করতে কখন যে ভোর হয়ে যায়, টেরও পায় না প্রমি। একেকটা শব্দে আটকে যায় চোখ, সার্চ অপশনে একেকটা শব্দ লিখে খুঁজে ফিরে ভালোবাসার আপন গন্ধটা। দুমড়ে মুচড়ে গলার কাছে কিছু একটা এসে আটকে যায়। পুরোনো ছবিগুলো মুছতে গিয়ে থেমে যায় হাত। তবুও, সময়ের নিঃস্পৃহ প্রবাহে একটা সময় এসে ছেড়ে আছি ভাবলেই বুকের ভিতরের হাহাকারটা জাগে না আর প্রমির। বরং স্মৃতিগুলোকে মনে হয় বয়ে বেড়ানো এক বোঝা।
কিন্তু রায়হান পারেনি সময়ের নিস্পৃহ ছোঁয়াটাকে আপন করে নিতে। ওর কাছে সম্পর্কটা কখনোই ফুরোয়নি, কেবল হাতের মুঠো থেকে ধীরে ধীরে গলে বেরিয়ে গেছে। বারবার ফিরে যেতে চেয়েছে সে, কিন্তু পারেনি। সামনে এগিয়ে যেতে চেয়েও পারেনি, আবার পেছনেও ফিরতে পারেনি। তার কাছে সম্পর্কটা যেন একটা অসমাপ্ত চিঠি, যার শেষ লাইনটা লেখা হয়নি। তবু জীবন এগোয়। এগুতেই হতো। কখনো কি আবার কথা হবে ওদের? হয়তো হবে, হয়তো না। কেউ কাউকে পুরোপুরি হারায় না, আবার ফিরে পাওয়ার আশাটুকুও ধীরে ম্লান হতে থাকে। সময়ের স্রোতে সম্পর্কের সংজ্ঞাও বদলে যায়। অনুভুতি, অধিকার, স্পেসও। হয়তো একদিন নতুন কারো পাশে বসবে ওরা। আলাদা ভাবে। হাসবে, হাতে হাত রাখবে, কিন্তু কোথাও একটা কণামাত্র অনুভূতি হয়তো থেকে যাবে পরস্পরের জন্য। আনডিফাইন্ড একটা কণা, একটা আক্ষেপ, একটা অশ্রুবারিচয়। যেটা ঠিক ভালোবাসাও নয়।