আমি চেয়েছিলাম আমার অনুভূতি, আমার শরীর, আমার জীবন তাদেরকে বিলিয়ে দিতে।
Published : 14 Oct 2024, 01:39 AM
মাত্র ক’দিন আগেই সাহিত্যে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম নোবেল-জয়ী ও এশিয়ার প্রথম নারী নোবেল-বিজয়ী ঘোষিত হলেন হান কাং। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক, যদিও কেবলমাত্র অথবা প্রধানত কথাসাহিত্যিক, আরো নির্দিষ্ট করে বললে, নিরামিষভোজী উপন্যাসের লেখক হিশেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তাঁর বিশ্বপরিচিতি। ২০১৫ সালে ডেবোরা স্মিথের অনুবাদে নিরামিষভোজী-র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ আর ২০১৬ সালে বইটির আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারপ্রাপ্তির দৌলতে বিশ্ব-পাঠকের দৃষ্টি প্রথম আকৃষ্ট হয় হান কাং, তথা দক্ষিণ কোরিয়ায় সাহিত্যের দিকে। এর মাত্র নয় বছরের মাথাতেই সমস্ত সাহিত্য-জ্যোতিষীর মুখে ছাই গুঁজে নোবেল কমিটির এই স্বীকৃতিপ্রদান নিশ্চয়ই তাঁর কল্পকাহিনির শিল্প-কুণ্ডলিনী ও সাহিত্যিক মোহিনীশক্তিরই একরকম প্রমাণ। এখন পর্যন্ত ইংরেজিতে অনূদিত-প্রকাশিত হয়েছে সাকুল্যে তাঁর চারটি উপন্যাস: নিরামিষভোষী (২০১৫), মানুষের কর্মকাণ্ড (২০১৬), শ্বেত-পুস্তক (২০১৭) ও গ্রিক পাঠমালা (২০২৩), এবং অচিরেই প্রকাশিতব্য আরেকটি উপন্যাস হচ্ছে আমাদের বিচ্ছেদ নেই ।
নিচের সাক্ষাৎকারটি ২০১৬ সালে ‘দ্য ওয়াইট রিভিউ’ সাময়িকীর তরফে ই-মেইলের মাধ্যমে গৃহীত হয়েছে দক্ষিণ কোরীয় ভাষায় এবং ডেবোরা স্মিথের দ্বারা ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।
এই আলাপচারিতাটি আগাগোড়া হান কাং-এর সাহিত্যিক সত্তার প্রকৌশল ও অপরিহার্য রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতেই মশগুল, যার ফলে তারকাদের দৈনন্দিন টুকিটাকি নিয়ে যাঁরা আগ্রহী তারা নিঃসন্দেহেই হতাশ হবেন। বিশেষত, মানুষের কর্মকাণ্ড উপন্যাসটির নিরন্তর দ্বৈত ব্যবচ্ছেদ চলেছে এখানে, সেইসঙ্গে নিরামিষভোজীর সাথে এর কিছুটা তুলনামূলক আলোচনাও। বাংলাদেশের সদ্য পতিত স্বৈরশাসন ও সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে এই সাক্ষাৎকার, হান কাং-এর সাহিত্যের প্রধানতম উপজীব্য ও মানুষের কর্মকাণ্ড উপন্যাসের দৈব-সংযোগ আবিষ্কার করে পাঠকেরা নির্ঘাত বিস্মিত হবেন। বৃহত্তর সাহিত্য-ভাবনার ক্ষেত্রে হান কাং-এর দ্বিধান্বিত ও অপ্রত্যাশিত কিছু উত্তর কৌতূহলজনক মনে হতে পারে। তাছাড়া, এই কথোপকথনে তাঁর ঘোর-ধরানো আবার ঘোর-ছাড়ানো গদ্যশৈলীর আলতো স্পর্শ যে একেবারেই অলভ্য, তা নয়। সাক্ষাৎকারটি ইংরেজি থেকে বাংলা তর্জমা করেছেন অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক মুনযির।
দ্য ওয়াইট রিভিউ: বিশ শতকের কোরিয়ার ইতিহাস তো ট্রমায় সমৃদ্ধ—আপনি আলাদা করে গুয়াংজু অভ্যুত্থানকেই বেছে নিয়েছিলেন কেন?
হান কাং: বিশ শতক শুধু কোরিয়ায় নয়, সমগ্র মানব জাতির ওপরেই গভীর ক্ষত ফেলে গেছে। ১৯৭০ সালে আমার জন্ম হয়েছিলো বলে ১৯১০ থেকে ১৯৪৫ সাল নাগাদ চলা জাপানি দখলদারি কিংবা ১৯৫০-এ শুরু হয়ে ১৯৫৩-এর সন্ধি মারফত শেষ হওয়া কোরীয় যুদ্ধ, এদের কোনোটারই অভিজ্ঞতা আমার হয় নি। আমি কবিতা ও কল্পকাহিনি প্রকাশ করতে শুরু করেছিলাম ১৯৯৩ সালে, আমার বয়স যখন তেইশ; ১৯৬১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পরে সেটাই ছিলো সামরিক বাহিনীর কারো নয়, বরং বেসামরিক কোনো রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় আসার প্রথম বছর। সেই সুবাদে, আমি আর সম-প্রজন্মের লেখকেরা অনুভব করলাম যে, লেখার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক বিবৃতি ব্যক্ত না-করতে-পারার অপরাধবোধ ছাড়াই মানুষের অভ্যন্তর নিয়ে অনুসন্ধান করার স্বাধীনতা আমরা অর্জন করে ফেলেছি।
কাজেই আমার লেখালেখি এই অভ্যন্তরেই অভিনিবিষ্ট ছিলো। রেললাইনে পড়ে যাওয়া একটি শিশুকে উদ্ধার করার জন্যে মানুষজন নিজেদের জীবন দিয়ে দিতেও দ্বিধা করবে না, আবার তারাই আউশভিৎসের মতো বীভৎস সহিংসতার জন্যে দায়ী। মানবীয়তার যে বিস্তীর্ণ বর্ণালি, সুমহান থেকে নিয়ে নৃশংস পর্যন্ত যার বিস্তার, ছোটোবেলা থেকেই সেটা আমার জন্যে ছিলো যেন দুরূহ এক বাড়ির কাজ। বলতে পারেন, আমার বইগুলো মানবীয় সহিংসতার এই উপজীব্যেরই রকমফের। মানবীয়তাকে আলিঙ্গন করা আমার জন্যে কেন এতো যন্ত্রণাদায়ক ছিলো তার মূল কারণ খুঁজে বের করতে চেয়ে আমি আপন অভ্যন্তর হাতড়ে দেখেছিলাম, আর সেখানে দেখা মিলেছিলো গুয়াংজুর, যার পরোক্ষ অভিজ্ঞতা ১৯৮০ সালে আমার হয়েছিলো।
দ্য ওয়াইট রিভিউ: বইয়ে আপনার স্মৃতি প্রক্রিয়ার অক্ষর এঁকে উপন্যাসটিতে আপনি অন্যতম চরিত্র হিশেবে হাজির হন। জীবন ও শিল্প, এবং অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সেতুবন্ধ তৈরি করার এ অতি কার্যকর একটি পন্থা। প্রথম কিভাবে ওই ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলেন?
হান কাং: আমার জন্ম হয়েছিলো গুয়াংজুতে এবং ঐ হত্যাযজ্ঞের মাত্র চার মাস আগে সপরিবারে চলে গিয়েছিলাম রাজধানী সউলে। নিতান্তই ভাগ্যগুণে আমরা শহরবদল করেছিলাম, আর এই আপাত-নগণ্য সিদ্ধান্তের কল্যাণেই আমরা অক্ষত থাকতে পেরেছিলাম । সেই ঘটনাটি একরকম বেঁচে-যাওয়া-মানুষের অপরাধবোধে পরিণত হয়েছিলো, এবং বহু দিন ধরে আমার পরিবারকে পীড়া দিয়েছিলো। প্রথম যে-দিন আমি সেই হত্যাযজ্ঞের দলিল-রূপে গোপনে প্রকাশিত ও প্রচারিত একটি আলোকচিত্রপুস্তিকা দেখলাম, সেদিন আমার বয়স ছিলো বারো। গুয়াংজুতে গিয়ে আমার বাবা ওটা সাথে নিয়ে ফিরেছিলেন। বড়োদের হাতে হাতে ঘোরার পরে, শিরদাঁড়া পেছনে দিয়ে ওটা একটা বইয়ের তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো। না-জেনে-বুঝেই ওটা খুলেছিলাম, কী আছে ভেতরে তার কোনো ধারণা ছাড়াই। এতোই ছোট ছিলাম যে, ওটার পাতায় পাতায় বিধৃত, হতবিহবল করে দেওয়া সহিংসতার প্রমাণ কী করে গ্রহণ করতে হয় তা জানা ছিলো না।
মানুষ একে অপরের সাথে এমনসব করতে পারলো কেমন করে? এই পয়লা প্রশ্নের পিছু পিছু চটজলদি এলো আরেকটি প্রশ্ন: এমন সহিংসতার মুখে আমাদের করণীয় কী? এটা আমি এখনো ভুলি নি, রক্তদাতা দরকার এমন বিনতি প্রচারিত হওয়ায় হাসপাতালের বাইরে মানুষের অন্তহীন সারির আলোকচিত্র। কতো অজস্র সাধারণ মানুষ নিজেদের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে সহিংসতায় আহত হওয়া ব্যক্তিদের সাহায্য করতে চলে এসেছিলো। সামরিক শাসনের ফৌজ যখন গুয়াংজু জনগোষ্ঠীর দশ দিনের বেসামরিক সরকারের অবসান ঘটিয়ে প্রাদেশিক দপ্তরে ফিরলো, তখন ক’দিন আগ পর্যন্তও যেসব নাগরিকেরা ছিলো শাদাসিধে নাগরিক তারাই মৃত্যু হতে পারে জেনেও সেখানেই অবস্থান করার যে-সিদ্ধান্ত নিলো সেটাও ধরা ছিলো ঐ আলোকচিত্রপুস্তিকায়। ওমনি করেই, আমি উপহার পেলাম দু’টি অসামাধানযোগ্য ধাঁধা, যাদের সিলমোহর পড়ে গেলো আমার হৃদয়ে—একটি মানবীয় সহিংসতার, অন্যটি মানবীয় মর্যাদার। মানুষের কর্মকাণ্ড সেই দু’টি ধাঁধার দিকে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে, খুঁজে-হাতড়ে যাওয়ারই বিবরণী।
দ্য ওয়াইট রিভিউ: আপনি ২০১২ সালের শেষে পাক গেন-হের নির্বাচিত হওয়ার কিছু দিন পরেই ২০১৩ সালে মানুষের কর্মকাণ্ড লেখা শুরু করেছিলেন। অনেকের মতেই, এখন ওনার আমলকে এভাবে দেখা যেতে পারে যে, ১৯৮০ সালের গুয়াংজু হত্যাযজ্ঞের সময়কার দক্ষিণ কোরিয়ায় যা যা ছিলো সেরকমই সব টানাপড়েনের মিলনস্থল হয়ে ওঠাটা এর লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য—‘একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের অপেক্ষায় থাকা এক গাদা শুকনো খড়-কুটো’, ভূমিকায় স্মিথ যেমনটি লিখেছেন। ওনার নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা মানুষের কর্মকাণ্ড–এর প্রারম্ভকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিলো?
হান কাং: এ-কথা সত্যি যে, আমি গুয়াংজু সম্পর্কিত নথিপত্র একত্র করা শুরু করেছিলাম ২০১২ সালের ডিসেম্বরে। তবে এ-বিষয় নিয়ে লেখা প্রয়োজন এমন তাগিদ আমার মধ্যে ছিলো ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে। ঐ সময়ে সউলের ইয়ংসান জেলার একটি ভবনে পুনরুন্নয়ন প্রকল্পের নিশান লাগানো হলো, আর যারা সেখানে ছোটোখাটো ব্যবসায়ীদের কাছে দোকান ভাড়া দিতো তারা নিজেদের জন্যে বরাদ্দ যৎসামান্য ক্ষতিপূরণের প্রতিবাদে ভবনের ছাদে গিয়ে বসে থাকার আয়োজন করলো। সরকার এই প্রতিবাদ কার্যক্রম ভণ্ডুল করতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে বসলো যার এক পর্যায়ে বেধে গেলো অগ্নিকাণ্ড, যাতে প্রাণ গেলো পাঁচ বিক্ষোভকারীর ও এক পুলিশ কর্মকর্তার। খবরে জ্বলন্ত ভবনটাকে দেখে আমার মাথায় এলো গুয়াংজুর কথা। আমার মনে হলো, গুয়াংজু আমাদের কাছে ভিন্ন এক চেহারায় ফিরে এসেছে, নাম বিশেষ্য হয়ে আর নয়, বরং সাধারণ বিশেষ্য হয়ে; মনে হলো, নিজেদের অজান্তেই আমরা এতো কাল গুয়াংজুর ভেতরেই বসবাস করে আসছি; মনে হলো, ঐ হ্রস্ব বহ্নিশিখায় গুয়াংজু নিজেকে উদ্ঘাটন করছে। যেহেতু আমার বিশ্বাস জন্মেছিলো যে, গুয়াংজু এখন এমন একটি নাম যা নির্দিষ্ট কোনো একটি স্থান বা দেশের বদলে সর্বজনীন কোনো কিছুর বেলায় প্রযোজ্য, সেজন্যে এরপর আমি যেসমস্ত নথিপত্র পাঠ করেছিলাম সেসমস্ত কেবল গুয়াংজু সম্পর্কিতই নয়, বরং আউশভিৎস, বসনিয়া, নানজিং, আর আমেরিকার আদি বাসিন্দাদের ওপরে চালানো হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কিতও ছিলো।
দ্য ওয়াইট রিভিউ: সম্প্রতি সউলে অনেক বছরের মধ্যে সর্ববৃহৎ বিক্ষোভ সমাবেশ দেখা গেছে। উপর্যুপরি রাষ্ট্রীয় হামলায় আহত হয়েছেন ডজন ডজন মানুষ, যার মধ্যে রয়েছেন ঊনসত্তর বছর বয়স্ক একজন কৃষক যিনি জলকামানের প্রচণ্ড ধারায় ধরাশায়ী হওয়ার সময় পাওয়া আঘাতের ফলে এখন কোমায় শয্যাশায়ী থাকবেন। এই লোকটি কৃষি বাণিজ্য সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে রাজপথে ছিলেন। অবিশ্বাস্যভাবে, পাক গেন-হে এই বিক্ষোভকারীদেরকে তুলনা করলেন আইসিসের সদস্যদের সাথে! আপনি কি দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ইতিহাস পুনরাবৃত্তির দৃষ্টান্ত বলে বিবেচনা করেন, ‘প্রথম বার থাকে বিয়োগ-নাট্য, পরের বার হয় প্রহসন’?
হান কাং: ২০১৩ সালের প্রথম দিকে, যখন পাক গেন-হে সবে নির্বাচিত হয়েছেন, একটা প্রতীকী ঘটনা ঘটেছিলো: রেলপথ বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে রেল-কর্মীদের বিক্ষোভ প্রদর্শনের প্রতিক্রিয়ায় ব্যাপক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মোতায়েন। এটা চোখ-ধাঁধানো আলোক-সংকেতের মতো কাজ করেছিলো, উন্মোচন করে দিয়েছিলো সামাজিক সুযোগসুবিধা-বঞ্চিত মানুষ আর এদেরকে দেয়ালের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া শ্রমপেশাজনিত ঝঞ্ঝাট নিয়ে বর্তমান সরকারের মনোভাব। বিশেষ করে, গণ-বিক্ষোভ দমনে এই সরকারের যে পদ্ধতি তার সহিংসতা কৃষক বেক নাম-কিকে কোমায় ফেলেছে। জলকামানের সফেদ ঝাপটে নিছক শূন্য মুষ্টি সম্বল ক’রে বিক্ষোভরত ঊনসত্তর-বছর-বয়সীর মাটিতে লুটিয়ে পড়ার একটি আলোকচিত্র দেখে আমি গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছি। তার ওপর, সরকার-অনুমোদিত আটটি পাঠ্যপুস্তকের যে-কোনোটি থেকে দক্ষিণ কোরীয় শিশু শিক্ষার্থীরা যা ইতিহাস শিখতে পেতো তা যে এখন অবগুণ্ঠনে চাপা পড়ছে, এবং অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের দ্বারা যে লিখিত হচ্ছে সরকার-অনুমোদিত একক পাঠ্যপুস্তক, তা আন্তরিক উদ্বেগের উদ্রেক ঘটায়। যে-নাট্য-জগত সরকারি ভর্তুকির ওপরে ভীষণভাবে নির্ভরশীল সেখানকার অনেকেই গত বছর এ-কথা জানতে পেরে ধাক্কা খেয়েছেন যে, সরকারের সমালোচনা করায় কয়েক জন পরিচালক ও নির্মাতার জন্যে বরাদ্দকৃত সহায়তা বাতিল করা হচ্ছে।
তবে একটা কথা আমি বলতে চাই যে, এমন অনেকেই আছেন যাঁরা ইতিহাসকে ঘুরিয়ে উলটো পথে বসিয়ে দেওয়ার এইসব ‘অকহতব্য’, কিন্তু ‘প্রকৃতপক্ষেই ঘটমান’, অবিশ্বাস্য সব প্রয়াসের বিরোধিতা করার উপায় খুঁজে ফিরছেন। জলকামান দেগে এক বৃদ্ধকে মাটিতে ছিটকে ফেলার দৃশ্যে যদি আমাদের বেদনা বোধ হয়, যদি ‘এ হ’তে পারে না’ এমন বিশ্বাস আমাদের মধ্যে প্রবল হয়, তাহলেও এতো সহজে ও সর্বতোভাবে ইতিহাসকে বিপরীত দিকে চালিত করা অসম্ভব হবে।
দ্য ওয়াইট রিভিউ: আপনি বইটি লিখতে শুরু করার পর থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে গড়িয়েছে? এখন পর্যন্ত মানুষের কর্মকাণ্ড কেমন সাড়া পাচ্ছে, আর আপনি কি মনে করেন বইটি তখন না হয়ে এখন প্রকাশিত হলে অন্যরকম কিছু হতো?
হান কাং: মানুষের কর্মকাণ্ড প্রকাশিত হওয়ার একদম আগ নাগাদও আমি নিশ্চিত ছিলাম না এই উপন্যাস কেমনভাবে গ্রহণ করা হবে। কিন্তু তারপরেও, আমার প্রত্যাশার অন্যথা ঘটিয়ে, কট্টর ডানপন্থি কতোগুলো বাদে প্রায় সমস্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানই বইটিকে দরাজ কভারেজই দিয়েছে। পাঠকদের প্রতিক্রিয়াও ছিলো এমন যে, ‘এই মুহূর্তে আমরা গুয়াংজুকে স্মরণ করতে চাই, আমরা চাই না এর কথা মুছে যাক’। সেই মুহূর্তটি ছিলো ২০১৪ সালের মে মাস; আমার বিশ্বাস বইটি যদি এখন প্রকাশিত হতো তাহলেও প্রতিক্রিয়া এইরকমই থাকতো। তার পর থেকে পরিস্থিতির অবনতিই হয়েছে, আর যেহেতু এমন মনে হচ্ছে যে, পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকেই যাবে সেহেতু দুঃখজনভাবে, কূটাভাসের মতো করে, মনে হচ্ছে যেন একটা সময় মানুষ আগের চাইতেও ঘন ঘন সাধারণ বিশেষ্য হিশেবে এই গুয়াংজু নামটিকে ব্যবহার করতে থাকবে, যে-নামটিতে ওতপ্রোতভাবে সহাবস্থান করছে মানবীয় সহিংসতা ও মর্যাদা।
দ্য ওয়াইট রিভিউ: আপনি বলেছেন, আপনার সমস্ত সাহিত্যকর্মই মানবীয়তার মর্ম বিষয়ক। মানুষের কর্মকাণ্ড একটি অবিশ্বাস্য পরিধি জুড়ে ব্যাপ্ত, বর্বরতা থেকে নিয়ে কোমলতা পর্যন্ত। উপরি-তলের দিকে তাকালে, গণতন্ত্রের সংগ্রামে রত একটি নবীন দেশের যুদ্ধোত্তর বেড়ে ওঠাকে মঞ্চস্থ করা মানুষের কর্মকাণ্ড -কে মনে হয় নিরামিষভোজী উপন্যাসটির চাইতে অনেক আলাদা, যেটির রয়েছে প্রগাঢ়ভাবে ব্যক্তিগত, একক পরিধি।
হান কাং: হ্যাঁ, এই দু’টি উপন্যাসকে যদিও খুবই আলাদা মনে হয়, এদেরকে কিন্তু মানিকজোড় হিশেবেও দেখা যেতে পারে, যাদের একটির শেকড় জড়িয়ে আছে অন্যটির সাথে। নিরামিষভোজী লেখার সময় আমি মানবীয় সহিংসতা ও নির্দোষিতার (অ)সম্ভবতা নিয়ে মনে মনে কতোগুলো প্রশ্ন পোষণ করছিলাম। নিজের মানবদেহকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আর উদ্ভিদে রূপান্তরিত হয়ে গিয়ে মুখ্যচরিত্র ইয়ং-হের সহিংসতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার চরম প্রয়াসের উলটো পিঠে রয়েছে মানবীয়তার ব্যাপারে গভীর নৈরাশ্য ও সংশয়। আমার অন্য আরেকটি বই, গ্রিক পাঠমালা-য় ভাষাকে নিষিক্ত করে রাখে যে-সহিংসতা তাকে প্রত্যাখানের একপ্রকার উপায় হিশেবে মুখ্যচরিত্র বাকশক্তিই খুইয়ে ফেলে।
প্রত্যাখ্যানের এই আঙ্গিকটি আত্মবিধ্বংসী কোনো কাজের মধ্য দিয়ে কোনোক্রমে, নিদারুণ কষ্টেসৃষ্টে মর্যাদা পুনরুদ্ধারের একরকম চেষ্টা নিজের মাঝে ধরে রাখে। মানুষের কর্মকাণ্ডও মানবীয় সহিংসতার ব্যাপারে মনোযন্ত্রণা দিয়ে শুরু হয়, তবে আমি শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে চেয়েছিলাম মানবীয় মর্যাদায়, সেই উজ্জ্বল স্থানে, যেখানে ফোটে ফুল। সেটাই ছিলো আমার উপন্যাসটি লিখে চলার সবচেয়ে বড়ো অনুপ্রেরণা।
দ্য ওয়াইট রিভিউ: বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কথিত পরস্পরসন্নিবদ্ধ কতোগুলো অধ্যায়ের সমন্বয়ে নির্মিত মানুষের কাজকর্ম-এর আখ্যান-কাঠামো রাশোমন -এর কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানকার প্রতিটি জবানবন্দি একেকবার রহস্যের আংশিক উন্মোচন ঘটায়। কেন্দ্রীয় চরিত্র থুং-হোর জীবনের অন্তিম কয়েকটি ঘণ্টার গল্প বলার জন্যে এই আখ্যান-কাঠামোটিই আপনি কেন বেছে নিয়েছিলেন?
হান কাং: থুং-হোর জীবন-মৃত্যু ছিলো এমনই একটি গল্প, যেটি এই রীতিতেই শুধু বলা যেতো। এমন একটি রীতি যার মাধ্যমে থুং-হোর অন্তিম কয়েকটি ঘণ্টার ছড়ানো-ছিটানো খোলামকুচি কুড়িয়ে-বাড়িয়ে পাঠকেরা একটু-একটু ক’রে জুড়ে নিতে পারে এমন মুখচ্ছবি যার সত্যতা ত্রুটিপূর্ণ, এবং বেঘোরে মিলিয়ে যাওয়ার আগে যেটাতে এক পলকের জন্যেই কেবল নজর বোলানো যেতে পারে। এই গঠনপ্রকৃতি আমি নিরামিষভোজীতেও ব্যবহার করেছিলাম। কতোগুলো সংক্ষিপ্ত স্বপ্নসম্ভব স্বগতকথনেই কেবল ইয়ং-হের কণ্ঠস্বর আছে, তাই অনন্যসাধারণ রকমের এই শক্তপোক্ত ও সংকল্পদৃঢ় নারীর চিত্রকল্প তাঁর আশপাশকার কতকগুলো দৃষ্টি ও কণ্ঠের মারফতেই বারোয়ারিভাবে গড়ে নেওয়া হয় একটি বিমিশ্র প্রতিমা-রূপে। আমার আগ্রহ সে-সব গল্প ও সত্যের বিশেষ কিছু মুহূর্ত নিয়ে, যেগুলোকে কাহিনিকথনের ঐতিহ্যবাহী কোনো প্রকরণের সাহায্যে বলা সম্ভব নয়।
দ্য ওয়াইট রিভিউ: এই বহুস্বর গঠনপ্রকৃতিতে উপন্যাসের বেশির ভাগ অংশেই থুং-হো শ্রোতাপক্ষে (মধ্যম পুরুষ) আবির্ভূত হয়। এই সিদ্ধান্তটি আপনি কেন নিয়েছিলেন?
হান কাং: শ্রোতাপক্ষের ‘তুমি’ হচ্ছে খোদ অন্যপক্ষগত (প্রথম পুরুষ) কথকের থেকে পৃথক একটি ‘আমি’ দিয়ে সম্বোধিত জনৈক একবচনীয় ব্যক্তি। এই সম্বোধনের মধ্য দিয়ে যে-স্থান-কালে ‘আমি’ অবস্থিত সেখানে মূর্তিমান হয়ে ওঠে ‘তুমি’। যদিও পনেরো বছরের বালক থুং-হো ১৯৮০ সালের মে মাসটায় প্রাণে বেঁচে যেতে পারে নি, তবুও আঁধারের উপরি-তল ছিন্ন ক’রে এবং বর্তমানের সর্বত্র ছড়িয়ে প’ড়ে অব্যাহত আবাহন তাকে এখানে হাজির করতে পারে। আর সে-জন্যেই থুং-হো-কে স্মরণ ও আবাহন করে নিরন্তর এক কথক-পরম্পরা, একটি ক’রে ভিন্ন চরিত্র প্রতিটি অধ্যায়ের জন্যে, যে-অধ্যায়গুলো পরিবেশন করে সময়ের একেকটি স্বতন্ত্র টুকরো, আর অবশেষে ত্রিশ বছরের বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পরে, সে আমাদের বর্তমানে পা রাখে। কোরীয় ভাষায় বইটির শিরোনাম আদপে ছিলো বালক এগিয়ে আসে।
দ্য ওয়াইট রিভিউ: ‘সম্পাদক’ নামক অধ্যায়ে, রাষ্ট্রীয় বিবাচকদের (সেন্সর) সাথে দ্বন্দ্বে জড়ানো একটি নাটকের সম্পাদক ভুলে-যেতে-চায়-বলে-মনে-করার প্রয়াস হিশেবে আচারনিষ্ঠা সহকারে ফিরে ফিরে দেখে আসে তার জেরার কবলে পড়ার একটি সহিংস ঘটনাকে। সাঙ্ঘাতিকভাবে বিবাচনের শিকার হওয়া সেই নাটকটি তারপর উপন্যাসে অনুষ্ঠিত হয় নিঃশব্দে। সাহিত্যের ধ্রুপদী ট্রমা-তত্ত্বের ইশারা অনুসারে বলা যেতে পারে যে, সম্পাদক চরিত্রটির আর যে-লেখক থুং-হোর মৃত্যুটিকে সাহিত্যে পরিণত করার জন্যে সেটি বারবার দেখে আসেন সে-ই আপনার যে পুনরাবৃত্তি বাতিক তা হচ্ছে আদি ট্রমার অভিজ্ঞতায় আজন্ম-অন্তর্নিহিত অনির্বচনীয়ের জগতে প্রবেশের কোশেশ।
হান কাং: আমি বিশ্বাস করি, ট্রমা নিরাময় করার মতো কিছু নয়, ট্রমা থেকে সেরে ওঠারও কিছু নেই, ট্রমা হচ্ছে বরণ করে নেওয়ার ব্যাপার। আমার বিশ্বাস এই যে, শোক এমন একটি ব্যাপার যা জীবিতের মধ্যে মৃতের জায়গাটুকুর অবস্থান নির্ণয় করে দেয়; এবং সেই জায়গাটুকু বারেবারে দেখে আসার মাধ্যমে, গোটা এক জীবনের সময়ে কি অসময়ে সেটিকে পীড়িত-নীরব আলিঙ্গনে বাঁধার মাধ্যমে, সম্ভবত কূটাভাসিকভাবে, জীবন সম্ভবপর হয়ে ওঠে।
তৃতীয় অধ্যায়ে, ইয়ুং-সুক তার জীবনকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় পরিণত করে ফেলেছে যাতে সে থোং-হো আর হত্যাযজ্ঞের শিকার অন্যান্যদের জন্যে শোক যাপন করতে পারে, দৃঢ়চিত্তে ও একাদিক্রমে। যে-মৃতদেরকে দেয়া হয় নি দস্তুরমাফিক সৎকারের মর্যাদা তাদের তরে রচিত নাটকটিকে বিবাচকেরা প্রায় পুরোপুরিভাবে মুছে ফেলার পরেও সেটি এমন নিঃশব্দেই অনুষ্ঠিত হয় যে, সোচ্চার হওয়ার বদলে অভিনেতাদের ঠোঁটগুলো কেবল কেঁপে কেঁপে ওঠে। এ-নিঃশব্দ দৃশ্য অবশ্য সেই বিবাচনের কবলে থাকা কালপর্বের সত্যিকার পরিস্থিতিরই অংশ; বেপরোয়া একটা-কিছু, এবং একই সঙ্গে একটি অসম্ভব শোককৃত্য।
দ্য ওয়াইট রিভিউ: মানুষের কর্মকাণ্ড-এ আপনার সময়ের ব্যবহার খুবই আগ্রহজনক। ১৯৮০ এর হত্যাযজ্ঞের পর থেকে নিয়ে ২০১৩ সালে বইটি লেখার বর্তমানে এসে আখ্যান শেষ হওয়া পর্যন্ত কিছু দিন বাদে বাদে পড়ছে প্রতিটি অধ্যায়ের ঘটন-কাল, তবে এই অগ্রগতি কড়াকড়িভাবে সরলরৈখিক নয়। যেমন ধরুন, থুং-হোর স্বল্পায়ু জীবনের অন্তিম পর্বের খণ্ড-বিখণ্ড আখ্যানকে একত্রে গ্রথিত করতে পাঠককে খাটুনি করতে হবে এবং তার ফলে তাদের সময়ের অভিজ্ঞতা বলতে যা দাঁড়াবে তা হবে নির্মিত স্মৃতিদ্রব্য। এভাবে সৃষ্টি হয় অতীত ও বর্তমানকে সংযুক্ত করে ফেলা একরকম অনুষঙ্গমালা। এই কাল-সম্পর্ক নিয়ে আপনি কিছু বলবেন? এই সিদ্ধান্তের কি কোনো নীতিগত দিক ছিলো?
হান কাং: আপনি অতীত-বর্তমানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করায় মনে পড়ে যাচ্ছে আমার কুড়ির দশকের একটা সময়ের কথা। যদিও সে-সময় গুয়াংজু নিয়ে কোনো কল্পকাহিনি লেখার অভিপ্রায় আমার ছিলো না, কিন্তু এই ব্যাপারটা আমার মাথার কোথাও সবসময়ই ঘাপটি মেরে ছিলো কোনো দুঃস্বপ্নের খণ্ডাংশ বা প্রচ্ছায় হয়ে। তখন একটা ডায়েরিকে লেখায় ভরিয়ে তুলে যখন নতুন ডায়েরি ধরতাম, প্রতিবারই প্রথম ফাঁকা পৃষ্ঠাটিতে একই কথা লিখতাম, ‘বর্তমান কি অতীতকে রক্ষা করতে পারে? জীবিতরা কি মৃতদেরকে রক্ষা করতে পারে?’ প্রায় কুড়ি বছর পরে, যখন মানুষের কর্মকাণ্ড লিখলাম তখন একটা পর্যায়ে ঐ বাক্যগুলো নিয়ে সাবধানে ভাবতে বসেছিলাম।
মানুষের কর্মকাণ্ড লেখার বেলায় যে-সমস্ত পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা হয়েছিলো আমার, মনে হচ্ছে এখানে সে-সমস্ত নিয়ে কথা বলতে হবে। ২০১২-এর ডিসেম্বরের পরে, তিন মাস ধরে প্রতিদিন আট-নয় ঘণ্টা সময় ব্যয় করেছিলাম গুয়াংজু সম্পর্কিত নৃশংস সব নথিপত্র পাঠে, যার পরে ছিলো বিশ শতক জুড়ে মানব জাতি অন্যান্য যা নৃশংস কাণ্ডকীর্তি ঘটিয়েছিলো তার নজির পাঠের পালা; মানুষের প্রতি যতোটুকুই বা বিশ্বাস ততো দিনে বাকি ছিলো যতোই পড়া হলো ততোই ঝুরঝুরিয়ে ভেঙে পড়লো ততোটুকুও। আমার মনে হলো আটকে গিয়েছি, নিজেকে মনে হলো লেখা চালিয়ে যেতে অপারগ, এবং প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম লেখা। তারপর, ঘটনাচক্রে আমার সামনে পড়লো বেসামরিক যোদ্ধা দলভুক্ত এক সদস্যের ডায়েরির অন্তিম লিপি। তিনি ১৯৮০ সালের মে মাসের ২৭ তারিখ দিবাগত রাতে প্রাদেশিক দপ্তরে থেকে গিয়েছিলেন, এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন। শান্ত, কোমলস্বভাবের সাতাশ বছর বয়সী একজন, যিনি নৈশ বিদ্যালয়ে পড়াতেন। সেই লিপি লেখা হয়েছিলো প্রার্থনার আকারে, আর এভাবে আরম্ভ হয়েছিলো: ‘ও খোদা, বিবেক নামক এই জিনিশটা আমাকে এতো বিঁধায় আর যন্ত্রণা দেয় কেন? আমি বাঁচতে চাই।’ এটি পাঠ ক’রে আমি উপলব্ধি করলাম যে, আগের পাঠপর্বে কিসের অভাব ছিলো। এবং যে-ভাবনা মাথায় এলো তা হচ্ছে, যদিও এই উপন্যাসের শুরু মানবীয় নৃশংসতা ও সহিংসতা দিয়ে, একে এগোতে হবে মানবীয় মর্যাদার দিকে। আমি অনুভব করেছিলাম, উপায় একটাই, যতো দূর যাওয়া যায় সে-দিকে ততো দূর চলে যাওয়া।
দ্য ওয়াইট রিভিউ: চোখে পড়ার মতো ব্যাপার হলো বইটি মৃতদের উদ্দেশ্যে নিশিপালনের জন্যে জ্বালানো মোমবাতি দিয়েই শুরু ও শেষ হয়েছিলো—এই প্রকল্পে শোক কী ভূমিকা পালন করে?
হান কাং: আমি সাধ্যমতো সর্বোত্তম উপায়ে শোক জ্ঞাপন করবো বলে বইটির একেবারে শুরুতে ও শেষে একটি মোমবাতি জ্বালতে চেয়েছিলাম। কারণ ত্রিশ বছরের কালপর্ব পাড়ি দিয়ে, থিত্থির করে জ্বলা অগ্নিশিখার হৃদয় ফুঁড়ে একজন ব্যক্তি বা ক’জন মানুষের ছায়ামূর্তি পুনরাবির্ভূত হয়েছিলো। ওই কায়দায়, আমি অতীত ও বর্তমানকে, মৃত ও জীবিতদেরকে মোমবাতির শিখায় পরস্পরের মুখোমুখি করাতে চেয়েছিলাম। আচমকাই এ-ব্যাপারটা মনে মনে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো যে, কিভাবে অধ্যায়গুলো সাজানো উচিত আমার, এবং ২০১৩ সালের মার্চ মাসে আমি উপন্যাসটাই শুরু করতে পেরেছিলাম। একবার ঠিকঠাক শুরু করার পরে, আমি শীঘ্রই যেটা উপলব্ধি করেছিলাম সেটা হচ্ছে, এই বইয়ে আমি নিজে ছিলাম অগুরুত্বপূর্ণ। আশ্চর্যরকমের সহজাত কেতায় আমার আত্মসচেতনতা উধাও হয়েছিলো। আমি চেয়েছিলাম আমার অনুভূতি, আমার শরীর, আমার জীবন তাদেরকে বিলিয়ে দিতে।
দ্য ওয়াইট রিভিউ: ‘কারখানার মেয়ে’ অধ্যায়টি স্মৃতি, স্বপ্ন ও বর্তমানের এক জটিল বুনট। শ্রমিকদের মূল সমিতি ছেড়ে বেরিয়ে আসা নারীদের একটি দলভাঙা প্র-দলে অংশ নেওয়ায় কালোতালিকাভুক্ত ও নির্যাতিত হওয়া প্রাক্তন কারখানা-কর্মী লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিদ্যাজীবীর গবেষণামূলক প্রবন্ধের জন্যে জবানবন্দি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সমাপনী অধ্যায়ের ‘লেখক’, অর্থাৎ আপনার কাছে প্রামাণিকীকরণের সাথে লেখালেখির কাজ কিভাবে জড়িত বলে মনে হয়?
হান কাং: ঐ অধ্যায়টা, পঞ্চম অধ্যায়, লেখা আমার জন্যে ছিলো অবিশ্বাস্য রকমের দুরূহ। যদিও প্রথম দিকে ভেবেছিলাম আমি আমার অনুভূতি, আমার শরীর, আমার জীবন ‘তাদের’কে বিলিয়ে দিতে চেয়েছি, কিন্তু প্রাণে-বেঁচে-যাওয়া নির্যাতিতা লিম সউন-জুর জীবন নিয়ে লিখতে গিয়ে আমার আবার এমন কিছু ব্যাপারের অভিজ্ঞতা হয়েছিলো যেসব সেই মেয়েটির মতো আমার সহ্য করতে হোক তা মনে হয় আমি চাই নি। আর তাই, প্রথমে অধ্যায়টায় ছিলো ২০০২ সালের অগাস্টের এক রাতে সউন-জুকে অনেকটা দূর থেকে লক্ষ করার সুর। আমি তখন উপলব্ধি করেছিলাম যে, এর কারণ হচ্ছে ওর থেকে নিজেকে আমি দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে আসছি, আর তাই আমি একেবারে গোড়া থেকে গোটা অধ্যায়টি আবার লিখেছিলাম। ডিক্টাফোনের বোতাম চাপতে ওর অক্ষমতার যে অনুভূতি সেটা যথাযথভাবে লিখতে আমার বেগ পেতে হয়েছিলো। আর সেই অধ্যায়ের শেষ বাক্যটা, ‘দয়া করে মারা যেয়ো না’ আমি লিখেছিলাম সউন-জুর কণ্ঠস্বরে। মারা যেয়ো না; এই কথাটা আমি বলতে চেয়েছিলাম ওকে, জীবিত সকলকে, আমাদেরকে।
যদিও অধ্যায়টা লেখা কঠিন ছিলো, তবে সউন-জুর জবানবন্দির যে-বেদনা সেটিকে লেখকের অনুভূত বেদনার সাথে একই কাতারে কিছুতেই রাখা চলে না। কেননা লেখক যদিও একটি জবানবন্দি নির্মাণ করার সময় চরিত্রদের কাছে নিজের অনুভূতি ও জীবনকে বিলিয়ে দিতে গিয়ে বেদনা অনুভব করেন, তবুও বই লেখার পরে এই লেখকই শেষতক বেঁচে থাকেন। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরেও আজকাল আমার মনে হয় জীবিত মানুষের অপরাধ-চেতনা বিলুপ্ত হওয়ার নয়।
দ্য ওয়াইট রিভিউ: মানুষের কর্মকাণ্ড-কে ঐতিহাসিক উপন্যাস আখ্যা দেওয়া ভুল হবে কারণ এর ঐতিহাসিক অতীতের অবসান সুনিষ্পন্ন হয় নি, সেইসব স্মৃতি ও ক্ষতচিহ্ন এখনো অতীত চুইয়ে চলে আসে বর্তমানে। আজ, সেই হত্যাযজ্ঞের অস্তিত্ব জীবন্ত স্মৃতি ও নথিপত্রে। তো, গবেষণা ও পরিকল্পনার বেলায় আপনার প্রক্রিয়াটি কী ছিলো? গবেষণার সময় আপনি কি ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ কাজে লাগিয়েছিলেন?
হান কাং: বইটি লেখার সময় আমি গুয়াংজুর ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত সাবধানে নিরীক্ষণ করার চেষ্টা করেছিলাম। অর্থাৎ, ১৯৮০ সালের মে মাসটি আচম্বিতে গজিয়ে উঠেছে এমন বর্ণনার বদলে আমি দেখাতে চেয়েছিলাম কী করে সত্তরের দশকে সামরিক সরকারের মানবাধিকার নিষ্পেষণ, আর শ্রমিক আন্দোলন হয়ে উঠেছিলো এর ইন্ধন।
আমি যদি নব্বইয়ের দশকে উপন্যাসটি লিখতে যেতাম, তাহলে নথিপত্র জোগাড় করাই হয়ে দাঁড়াতো বিরাট মুসিবতের কাজ। কিন্তু ২০১২ সালের শীতকালে লেখা শুরু করায় ৫.১৮ গবেষণা কেন্দ্র ও ৫.১৮ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রভূত উপকরণ জোগাড় করতে পেরেছিলাম। কাজেই আসল যে-মুসিবতের সামনে পড়েছিলাম সেটা হচ্ছে কেমন করে এমন পর্বত-প্রমাণ উপকরণের স্তূপ ঠেলে কাজ সমাধা করবো। বিশেষত, সেখানে ছিলো শত শত মানুষের লিখিত জবানবন্দি, যার কলেবর ছিলো দুই হাজার পৃষ্ঠা জোড়া; এগুলো সযত্নে পড়া আমার কাছে ছিলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সবশেষে উপন্যাসটি দালিলিকতার কাজে লাগুক তা আমি চাই নি, বরং চেয়েছিলাম সেটি মানবীয়তায় পরিকীর্ণ একটি সাহিত্যকর্ম হোক।
দ্য ওয়াইট রিভিউ: আপনি কি কারো সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন?
হান কাং: হতাহতদের পরিবারেরা ইতোমধ্যেই একাধিক বার তাঁদের জবানবন্দি দিয়েছেন দেখে আমি আরো একটি সাক্ষাৎকারের ক্লেশ তাঁদেরকে দিতে চাই নি। আমার মনে হয়েছিলো ওটা সমীচীন হবে না। তার বদলে আমি আমার পরিচিত সাধারণ মানুষজনের সাথে দেখা করতে গিয়ে তাদেরকে গুয়াংজুর ব্যাপারে জিগেস করতাম। ঐ ব্যাপারে তারা প্রথম কবে জানতে পারলেন? এই জানার ফলে তাঁদের জীবন কতোটা বদলে গিয়েছিলো? আর সর্ব ধরনের বিষয়াশয়ে আমি অযাচিত সাহায্যও পেয়েছিলাম। মূল্যবান যে-দলিলপত্রের অস্তিত্ব নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলো না সেসবের তথ্য থেকে শুরু ক’রে; আশির দশকের প্রথম দিককার বিশ্ববিদ্যালয়-পরিমণ্ডলের বর্ণনা, সে-সময়ে ছোটো ছিলাম বলে যে-ব্যাপারে নিজের কোনো অভিজ্ঞতাই আমার ছিলো না; তৎকালীন বিবাচন-দপ্তরের হালচালের মতোন ব্যাপার-স্যাপার। একদম ঐসমস্ত খুঁটিনাটিই আমার দরকার ছিলো। যাঁরা আমার কাছে নিজেদের হৃদয় এমন উজাড় করে দিয়েছেন আমি তাঁদের প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ।
দ্য ওয়াইট রিভিউ: মানুষের কর্মকাণ্ড জুড়ে আনাগোনা রয়েছে ভ্রাম্যমাণ ভূতেদের—হত্যাযজ্ঞের শিকার মানুষদের। কোরীয় সাহিত্যে ও লোকসংস্কৃতিতে ভূতের ঐতিহ্য নিয়ে কিছু বলতে পারেন? মানুষের কর্মকাণ্ড-তে এদের আবির্ভাবের সাথে ত্বরিত শিল্পায়ন আর ঐতিহ্যবাহী কোরীয় বিশ্বাস-তন্ত্রের মধ্যে ঘটা বিচ্ছেদের কোনো সম্পর্ক আছে কি?
হান কাং: এইসব ভ্রাম্যমাণ সত্তা ঐতিহ্যবাহী কোরীয় বিশ্বাস-তন্ত্রের সঙ্গে তেমন সম্পর্কিত নয়। খোদ কোরিয়াতেই এই ‘হন’ নামক চরিত্রটি (ভূত বা আত্মা বলতে যা বোঝানো হয় তার কোনোটাই নয়) অস্বাভাবিক হিশেবেই পঠিত হয়েছিলো, আর প্রায়ই আমার কাছে এ নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে যে, যারা হন তারা কেউ মারা গিয়েছে কি যায় নি তা জানতে পারে, তবে কারো পরিচয় জানে না, এবং একে অপরের উপস্থিতিকে মিহি ও পেলব রূপে অনুভব করে। পঞ্চম অধ্যায়ে সউন-জু যখন আগুয়ান থুং-হোর হন -এর মৃদু পদধ্বনি কল্পনা করে, তখন হন-এর এমনই একটা ধারণা মাথায় ছিলো তার।
এমনকি মানুষের কর্মকাণ্ড লেখার আগেও যখনই আমি হন-কে নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবতাম, সবসময়ই তখন তাদেরকে এমনটাই ভাবতাম, এমনই কোমল, মলিন সত্তা। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চাইতে প্রবীণ এক শিক্ষার্থী, যিনি কবিতা লিখতেন, আমাকে একবার বলেছিলেন:‘আত্মা বলে যদি কিছু থাকতো তাহলে কেউ প্রেমে পড়লে তার হৃদয়ের ভেতরে যে-চেহারাটি মিটমিট করে জ্বলতে থাকে হয়তো সেরকমই কিছু-একটা হতো সেটি’। আমার নিজের ভাবনা তেমনই। হন-কে মনে হয় মিহি, বেপথু একটা-কিছু, ছায়ার মতোন।
মানুষের কর্মকাণ্ড-তে মৃত্যুর পরের জগতে খোদাও নেই, মসিহও নেই। নিজেদের মরদেহের ওপরে সীমাহীন মিহি ছায়া হয়ে টিমটিম করে জ্বলতে থাকে হন, নিজেদের জীবন ও মৃত্যুর কথা মনে পড়ে তাদের। ঠিক এ-কারণেই আমাদের, অর্থাৎ জীবিতদের ওপরে একরকম দায়িত্বের বোঝা রয়েছে।
দ্য ওয়াইট রিভিউ: সমসাময়িক ‘জাতীয়’ কোরীয় সাহিত্য বলে কি কিছু আছে, আর যদি থাকে তাহলে কোন কোন উপজীব্যের বেলায় এর সাথে মানুষের কর্মকাণ্ড -এর মিল আছে অথবা এর মধ্যকার কোন কোন উপজীব্য প্রতিক্রিয়া এ-উপন্যাসে আছে বলে আপনি মনে করেন?
হান কাং: ‘জাতীয়’ বা ‘সাহিত্য’-এর একটিও প্রত্যয় আমি দেখি না। বরঞ্চ, আমি সবসময়ই ভাষা দিয়ে মোহাবিষ্ট ছিলাম। যে-সংস্কৃতিতে অন্তর্নিবিষ্ট রয়েছে একটি ভাষা তার পরত-সমূহের অগাধ গভীরতা, জটিলতা ও সৌকর্য-সূক্ষ্মতা নিয়ে নিবিড় চিন্তা করার ব্যাপারটা আমি উপভোগ করি। কোরীয় ভাষায় লেখা কবিতা ও কল্পকাহিনির কাছে আমি অনেক ঋণী, কারণ বয়ঃসন্ধিকালটা এসবে নিমগ্ন হয়ে থেকেই কাটিয়েছিলাম।
লিন চউল-হুর শতবর্ষী সরাইখানা-র উপজীব্যের সাথে মানুষের কর্মকাণ্ড-এর উপজীব্যগুলো মিলে যায়। তরুণ বয়সে লিন সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন গুয়াংজু অভ্যুত্থানে, আর লেখক-রূপে তিনি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন গুয়াংজুর প্রামাণ্যতার বিষয়াশয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার ক’রে। যে-বসন্ত দিন-কে বলা যেতে পারে তাঁর প্রতিনিধিত্বশীল রচনা সেটি হচ্ছে পাঁচ খণ্ডের এমন একখানা উপন্যাস যা গুয়াংজুর দশ দিনের বেসামরিক সরকারকে পুনর্নিমাণ করে। তাঁর পরবর্তী প্রকাশনা, শতবর্ষী সরাইখানা হচ্ছে একটি অদ্ভুত রকমের সুচারু রচনা, যেটি বসন্ত দিন -এর চাইতে বিস্তর ছোটোখাটো হলেও শুধু গুয়াংজু নিয়ে নয়, বরং কোরিয়ার সমগ্র বিশ শতক নিয়েই শোক প্রকাশ করে। তা সত্ত্বেও, আমি অবশ্য এমনটা নিশ্চিত নই যে, একে ‘জাতীয় সাহিত্য’ বলা চলে।
দ্য ওয়াইট রিভিউ: পরিশেষে, এরপরের বইটির জন্যে কী নিয়ে কাজ করছেন তা কি আমাদেরকে বলা যাবে?
হান কাং: কিছুদিন আগেই আমি ছোট্ট একটি বই লিখেছি যেটিকে কোনো শ্রেণিতে ফেলা মুশকিল, একরকম প্রবন্ধ আবার গদ্যকবিতা। জুন মাসে দক্ষিণ কোরিয়ায় এ-বইটির প্রকাশিত হওয়ার কথা রয়েছে। একজন শিল্পী আছেন যিনি আলোকচিত্র ও চলচ্ছবি ব্যবহার ক’রে সংস্থাপন-শিল্প তৈরি করেন, যিনি পুস্তিকাটিকে কেন্দ্র ক’রে ইদানীং একটি শিল্পকর্ম প্রস্তুত করছেন, যার দরুন এর প্রকাশনা যে-দিন সেই একই দিনে সউলে একটি প্রদর্শনীও হবে।
আমার পরবর্তী পূর্ণ উপন্যাস হিশেবে, আমি আরেকটি ত্রিধাবিভক্ত রচনায় হাত দিয়েছি। নিরামিষভোজী-র মতো, এটি হবে উপন্যাসরূপে একত্রে গ্রন্থিত তিনটি স্বকীয় উপন্যাসিকা; ইতোমধ্যেই আমি প্রথম উপন্যাসিকাটি লিখে শেষ করেছি এবং দ্বিতীয়টি এখন লিখছি।