আর তুমিও সমান হতচকিত হয়েছো বলে মনে হয়েছিলো, কারণ তুমি ছিটকে পেছনে সরে গিয়েছিলে, কিন্তু তারপর তার গালে ছোট্ট করে একটা ঝটিকা চুমু দিয়েছিলে, যেন বলছিলে তুমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছো।
Published : 23 Apr 2025, 09:47 PM
এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হান কাঙের মোট আটটি উপন্যাসের মধ্যে এটি পঞ্চম, তবে ইংরেজিতে প্রকাশের হিশেবে চতুর্থ। ২০১১ সালে কোরীয় ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার পরে ২০২৩ সালে এর ইংরেজি অনুবাদ আত্মপ্রকাশ করে। এই প্রথমবার হান কাঙের একাকী ইংরেজি অনুবাদক ডেবোরা স্মিথ তরুণ এক কোরীয় অনুবাদক এমিলি ইয়ে ওয়ানের সাথে যুগলবন্দি রচনা করেছেন, যা, আশা করা যায়, তাঁর অনুবাদের মর্মগ্রাহিতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে, অনুবাদে মূল পাঠের সাংস্কৃতিক দ্যোতনা যেন আরও নিপুণ অক্ষরে ফুটে ওঠে তা নিশ্চিত করেছে, এবং অনুবাদকের স্বভাবসুলভ বিচ্যুতিপ্রবণতা থেকে অনূদিত পাঠটিকে আরও সজাগ ও-সুযোগ্যভাবে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। বাংলা অনুবাদটি যেহেতু এই ইংরেজি অনুবাদের মারফত মূল কোরীয় উপন্যাসটির রূপ-রস- ও গন্ধ বাংলাভাষী পাঠকের সংবেদনশক্তির নিকট নিবেদন করছে তাই এ-তথ্যটুকু উৎসাহব্যঞ্জক, সন্দেহ নেই। আজ প্রকাশিত হলো উপন্যাসটির চতুর্থ কিস্তি।
৪
μὴ ἐρώτησης μηδέν αὐτόν
তাকে কিছু জিগেস কোরো না।
μὴ ἄλλως ποιήσης
কাজটা অন্য কোনোভাবে কোরো না।
পাঠরত ছাত্রছাত্রীদের চড়া গুড়ুগুড়ু আওয়াজের মধ্যে সে নির্বাক হয়ে বসে আছে। গ্রিক প্রভাষক তার নীরবতাকে আর সমস্যা হিশেবে দেখছেন না। ছাত্রছাত্রীদের দিকে কোনাকুনি এক পাশ ফিরিয়ে, বাহুর বিস্তৃত একেকটি টানে মোছামুছির নরম ন্যাকড়া ঘষেঘষে তিনি ব্ল্যাকবোর্ড থেকে বাক্য দু’টো মুছে ফেলেন।
তাঁর এই কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা চুপচাপ থাকে। থামের আড়ালে বসে থাকা রোগা মধ্যবয়সি লোকটি পিঠ টান টান করে আর শিরদাঁড়ার কশেরুকাগুলোয় একটা কিল বসায়। দর্শনের ছাত্রটি ডেস্কের ওপরে তার পাশে রাখা স্মার্টফোনের পর্দায় তর্জনী বোলায়। ব্ল্যাকবোর্ড থেকে যে-বাক্যগুলো সজোরে মোছা হচ্ছে স্নাতকোত্তরটি তাকিয়ে থাকে সেগুলোর দিকে। বিপুল বপুর সাথে বিসদৃশ তার পাতলা ঠোঁট দু’টো ফাঁক হয়, এবং সে শ্রুতির অগোচরে মনে মনে বিলীয়মান শব্দগুলি আওড়ায়।
“জুন মাস থেকে, আমরা প্লেটো পড়বো,” এখন পরিষ্কার হয়ে যাওয়া ব্ল্যাকবোর্ডে ঊর্ধ্বাঙ্গ হেলিয়ে দিয়ে গ্রিক প্রভাষক জানান দেন। “পাশাপাশি ব্যাকরণ পড়াটা তো অবশ্যই চালিয়ে যাবো।” ডান হাতে খড়ি ধরে আছেন বলে বাঁ-হাত কাজে লাগিয়ে চশমাটাকে ঠেলে নাকের আরেকটু ওপরে উঠিয়ে দেন।
“মানুষ একবার যখন নিঃশব্দে আর আহ-আহ, উহ-উহের মতো কেবল কণ্ঠনিঃসৃত অবিখণ্ডিত ধ্বনিমালা মারফত যোগাযোগ করা ছেড়ে প্রথম ক’টি শব্দ সৃষ্টির দিকে গিয়েছিলো, ভাষা তখনই পর্যায়ক্রমে একটি ব্যবস্থার রূপ অর্জন করেছিলো। এই ব্যবস্থা তার সুবিন্দুতে পৌঁছতে পৌঁছতে ভাষা পেয়ে গিয়েছিলো সুবিস্তৃত ও জটিল সব নিয়মকানুন।”
তিনি খড়ি দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে একটি অধিবৃত্ত আঁকেন। বক্ররেখাটি বাঁ-দিক থেকে খাড়া চড়াই শুরু করে, একপর্যায়ে ঢালু হয়ে ডান দিকে দীর্ঘ, মৃদু পতন ঘটে তার। তর্জনী দিয়ে বক্ররেখাটির শীর্ষবিন্দুতে টোকা মেরে তিনি বক্তৃতা চালিয়ে যান।
“যে-মুহূর্তে ভাষা সুবিন্দুতে পৌঁছে, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে সেটি একটি মৃদু-মন্থর বক্ররেখাংশ ধরে চলে, এমন সব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, যা তাকে আরেকটু ব্যবহারোপযোগী করে তোলে। কোনো কোনো অর্থে, এ হচ্ছে পতন, এ হচ্ছে অবক্ষয়, তবে কিছু কিছু দিক থেকে একে বলা যেতে পারে প্রগতি। আজকের ইউরোপীয় ভাষাগুলি সেই দীর্ঘ প্রক্রিয়া অতিক্রম করেছে, হয়ে উঠেছে আগের চাইতে কম কানুনকঠোর, কম সুবিস্তৃত, কম জটিলতাপূর্ণ। যে-কেউ প্লেটো পড়ার সময় বহু সহস্রাব্দ আগে যে-প্রাচীন ভাষা বিকাশের শিখরে পৌঁছেছিলো তার সৌন্দর্যের তারিফ করতে পারবে।”
নিজের চিন্তাধারার খেই তিনি তৎক্ষণাৎই ধরতে পারেন না, বরং নীরব হন। থামের পেছনকার মধ্যবয়সি লোকটি নিজের মুঠো দিয়ে মুখ ঢেকে নিচু গলায় একটুখানি কাশি দেয়। আবার যখন সে গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠে, এবারে একটু বেশিক্ষণ জুড়ে, তখন তরুণ দর্শনের ছাত্রটি তার দিকে একটা আড়াআড়ি চাউনি হানে।
“এভাবে বলা যায় যে, প্লেটো যে-গ্রিক ব্যবহার করেছিলেন তা ছিলো গাছ থেকে মাটিতে পড়তে উন্মুখ টসটসে পাকা ফল। তাঁর পরবর্তী প্রজন্মদের মুখে যে-মধ্যযুগীয় গ্রিক ছিলো তাতে দ্রুতই নেমে এসেছিলো অমানিশা। আর, তাদের ভাষার সাথে সাথে গ্রিক রাষ্ট্রগুলোও ধ্বংসের মুখে পড়েছিলো। আর তাই প্লেটোকে এমন একজন ব্যক্তি ধরা যেতে পারে যিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন কী করে শুধু ভাষারই নয়, বরং তাঁর চারপাশের সবকিছুর ওপরেই নেমে আসছে রাতের আঁধার।”
সে মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করে, কিন্তু প্রতিটি শব্দের প্রতি মনঃসংযোগ করতে পারে না। ওই একটি বাক্য তার কানে বিঁধে থাকে, টুকরো টুকরো করা লম্বা একটি মাছের মতো, এর অনুসর্গ ও শব্দান্তগুলো আঁশের মতো এখনো চেঁছে ফেলা হয়নি। নিঃশব্দে। কণ্ঠনিঃসৃত অবিখণ্ডিত ধ্বনিমালা। আহ-আহ, উহ-উহ। প্রথম ক’টি শব্দ।
শব্দদেরকে হারানোর আগে, যখনও তার শব্দ দিয়ে লেখার ক্ষমতা ছিলো, তখন কখনো-কখনো সে আকাঙ্ক্ষা করতো যে, তার ধ্বনিমালা যেন আরো নিবিড়ভাবে হয়ে ওঠে অবাঙময় : গোঙানি বা অনুচ্চ আর্তনাদ। রুদ্ধশ্বাস যাতনার ধ্বনি। ক্রুদ্ধ গরগরানি। একটি শিশুকে শান্ত করতে আধো-ঘুমে গুনগুনানি। দমচাপা হাসি। দু’জন মানুষের ঠোঁট পরস্পরে চেপে বসবার, পরস্পরকে ছেড়ে যাবার ধ্বনি।
কখনো-কখনো এমন হয়েছিলো যে, ধীরেসুস্থে ঠোঁট মেলে সদ্য-লেখা শব্দগুলো উচ্চারণ করার আগে সে একপলক দেখে নিয়েছে তাদের আদল। মাটিতে-চেপে-ধরা ক’টি দেহ-সদৃশ কতোগুলো চ্যাপটানো অবয়ব আর তাদেরকে স্বকণ্ঠে ফুটিয়ে তোলার তার যে বিলম্বিত প্রয়াস এর মধ্যের অসামঞ্জস্য তক্ষুনি সে টের পেয়েছিলো। এমন হলে সে পড়া থামিয়ে ঢোক গিলতো, গলা তার শুকনো। যে-কয় বার রক্তপাত রোধ করার জন্যে তাকে অবিলম্বে ক্ষত চেপে ধরতে হয়েছিলো অথবা, উলটো ক্ষেত্রে, রক্তপ্রবাহে জীবাণুর প্রবেশ ঠেকানোর জন্যে তাকে প্রাণপণে টিপে টিপে রক্ত বের করতে হয়েছিলো সে-ক’বারের মতোই।
৫
কণ্ঠস্বর
তুমি যদি এখন চিঠিটা পড়তে থাকো – ওটা যদি না-খোলা অবস্থায় আমার কাছে ফেরত পাঠানো না হয়ে থাকে – তাহলে তোমার পরিবার নিশ্চয়ই এখনো জার্মানির সেই হাসপাতালের একতলায় বসবাস করছে।
পাথরের ভবনটা, কথিত আছে যেটা অষ্টাদশ শতাব্দিতে ছাপাখানা হিশেবে তৈরি হয়েছিলো, ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই ফিকে-রঙা আইভি লতায় ঢাকা পড়ে গেছে। আঙিনার দিকে যাওয়ার শৈল ধাপগুলোর মধ্যে মধ্যে থাকা ফাটলে নিশ্চয়ই খুদে খুদে ভায়োলেট ফুল ফুটেছে আর বিবর্ণ হয়েছে। সিংহদন্তীগুলো নিশ্চয়ই শুকিয়ে মরে গেছে, শুধু রেখে গেছে মলিন ভূতুড়ে কতোগুলো বীজের একটি মুকুট। বুনো পিঁপড়ের দল নিশ্চয়ই সুশৃঙ্খল সারি বেঁধে সিঁড়ি বেয়ে কুচকাওয়াজ করে ওঠানামা করছে, দেখে মনে হচ্ছে কতকগুলো স্থূল আকারের যতিচিহ্ন।
তোমার মা কি এখনো তেমনই সুন্দরী আছেন, এখনো ওই জমকালো নকশার শাড়িগুলো পরছেন, আমি তাঁকে সবসময় যেগুলো পরে থাকতে দেখতাম, একেক দিন একেক রঙের? আর আজ বৃদ্ধ তোমার বাবা, যাঁর শীতল, ধূসর চোখ দু’টো আমার চোখ পরীক্ষা করতো, এখনো কি চক্ষুরোগবিশেষজ্ঞ হিশেবে কাজ করছেন? আর তোমার কন্যা, তার বয়স এখন কতো? এই চিঠিটা পড়ছো যখন, তুমি কি তোমার বাবা-মায়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছো, তাঁদেরকে ক’টা দিন নাতনিকে আদর-সোহাগ করার সুযোগ দিচ্ছো? ছোটবেলায় তোমার যে-উত্তরমুখী ঘরটা ছিলো তুমি কি সেখানেই থাকছো, প্রাম ঠেলতে ঠেলতে নদীর ধারে হাঁটতে বেরোচ্ছো? তোমার সেই সবসময়কার প্রিয় বেঞ্চিটাতে বসেই বিশ্রাম করো কি, পুরনো সেতুটির সামনে যেটা, যেসব ফোটো নেগেটিভ তুমি সবসময় পকেটে নিয়ে ঘুরতে সেগুলো বের করে সূর্যের আলোয় উঁচিয়ে ধরো কি?
*
প্রথম যে-বার আমি তোমার সাথে বসেছিলাম, সেতুর সামনেকার সেই বেঞ্চিটাতে পাশাপাশি, তুমি তোমার জিন্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে এনেছিলে দু’টো নেগেটিভ, মনে পড়ে? তুমি তোমার ছিপছিপে, শ্যামলা বাহু দু’টি উঁচিয়ে চোখের সামনে ধরেছিলে ফিল্মটাকে এবং সূর্যের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিলে।
আমার হৃদপিণ্ড অসহনীয়ভাবে ধুকপুকিয়ে উঠেছিলো – কেননা এর আগেও আমি তোমাকে ওই একই ভঙ্গিমায় দেখেছিলাম।
তোমার বাবার সাথে প্রথম চিকিৎসা-সাক্ষাতের দিন ছিলো সেটি, জুলাই মাসের প্রথম দিককার এক বিকেল। থোকায় থোকায় লাইলাক ফুটে ছিলো যেখানে সেই হাসপাতাল প্রাঙ্গণের একটি ধাতব বেঞ্চিতে তুমি বসেছিলো আর ক’টুকরো ফিল্মের ভেতর দিয়ে তাকিয়েছিলে সূর্যের দিকে, তোমার ছেড়ে রাখা কালো চুল গড়িয়ে পড়ছিলো তোমার কাঁধে। তোমার পাশে বসে থাকা কাঠখোট্টা হাবভাবের পরিষেবকটি তোমাকে ইশারা করে তার হাতে ওগুলোর একটা দেওয়ার জন্যে বলেছিলো। দু’জন পূর্ণবয়স্ক মানুষ পাশাপাশি বসে প্রত্যেকে একটা ফিল্মের ভেতর দিয়ে চোখ কুঁচকে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে এ-দৃশ্যের মধ্যে বিনোদনদায়ক কিছু-একটা ছিলো।
অস্বচ্ছ কাচের দরজার পেছনে লুকানো ছিলাম বলে আমার উপস্থিতি টের না-পাওয়া লোকটি ফিল্ম থেকে নজর সরিয়ে তোমাকে দুয়েকটা কথা বলেছিলো। তুমি চেহারায় গভীর মনোযোগ নিয়ে তার ঠোঁট দু’টোর নড়াচড়া দেখছিলে। ঠিক তখুনি, সে সামনে ঝুঁকে তোমার মুখে একটা ত্বরিত, বেখাপ্পা চুমু বসিয়ে দিলো। এ আমাকে আশ্চর্য করেছিলো, কারণ তোমরা যে ঘনিষ্ঠ ছিলে না, তা যে-কোনো গা-ছাড়া পর্যবেক্ষকের কাছেও সুস্পষ্ট ছিলো। আর তুমিও সমান হতচকিত হয়েছো বলে মনে হয়েছিলো, কারণ তুমি ছিটকে পেছনে সরে গিয়েছিলে, কিন্তু তারপর তার গালে ছোট্ট করে একটা ঝটিকা চুমু দিয়েছিলে, যেন বলছিলে তুমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছো। যেন সেটা ছিলো একসাথে বসে সূর্য দেখার ফলে তোমাদের মধ্যে আচানক গড়ে ওঠা বন্ধুত্বের যে উদার শিষ্টাচার তারই অংশ। তুমি আলগোছে উঠে দাঁড়িয়ে লোকটির হাত থেকে ফিল্মটা নিয়ে নিয়েছিলে। সে হেসেছিলো অস্বস্তি ভরে, তার চেহারা জ্বলছিলো। তুমিও হেসেছিলে। তুমি যখন একটি কথাও না বলে ঘুরে গিয়ে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছিলে তখনো সে বিব্রত চেহারা নিয়ে বসে থেকে একদৃষ্টে তোমার পেছন-পেছন তাকিয়ে ছিলো।
নির্ভুল নিশ্চলতার ওই কয়টি মিনিট আমার সতেরো বছর বয়সী ব্যক্তিসত্তায় কী যে গভীর রেখাপাত করেছিলো তা তো কিছুতেই তোমার জানার কথা নয়। এরপর বেশি দিন না-যেতেই, আমি জানতে পেরেছিলাম যে, তুমি ছিলে হাসপাতালটির মালিকের মেয়ে, যে, নবজাতক থাকতে তুমি কোনো-এক জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলে আর হারিয়েছিলে শ্রবণশক্তি, যে, বিশেষ শিক্ষার বিদ্যালয় থেকে দুই বছর আগে পড়াশোনা শেষ করে তুমি এখন হাসপাতালের পেছন দিকে একটা কারুশালায় কাঠের আসবাবপত্র তৈরি করে সময় কাটাচ্ছো। কিন্তু ওই ক্ষণিক দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে আমি যে শিহরন অনুভব করেছিলাম এই তথ্যমালা সেটাকে পুরোপুরি খোলাসা করতে পারেনি।
এরপরে, প্রতিবারই যখন চিকিৎসা-সাক্ষাৎ থাকলে হাসপাতালের সদর দরজায় আমি পা রাখতাম, প্রতিবারই যখন তোমার কারুশালা থেকে আসা বৈদ্যুতিক করাতের গুঞ্জন শুনতে পেতাম, প্রতিবারই যখন দূর থেকে তোমাকে কারুশালার পোশাকে নদীর ধার দিয়ে আপনমনে হেঁটে বেড়াতে দেখতাম, আমার মাথা একেবারে ফাঁকা হয়ে যেতো যেন হঠাৎ করেই শ্বাসের সাথে লাইলাকের সুরভি টেনে নিয়েছি ভেতরে। আমার যে-ঠোঁট জোড়া তখনো অপর কোনো ঠোঁটের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেনি সেই তাদের মধ্য দিয়ে কম্পন বয়ে যেতো, মৃদু বৈদ্যুতিক ঝাঁকুনির মতো।
দেখতে তুমি তোমার মায়ের মতো হয়েছিলে।
তোমার গাঢ় বাদামি ত্বক আর সাধারণত যে-কালো চুল তুমি খোঁপায় বেঁধে রাখতে, দু’টিই আকর্ষণীয় ছিলো, তবে তোমার সবচেয়ে সুন্দর জিনিশ ছিলো তোমার দুই চোখ। একাকী পরিশ্রমে অভ্যস্ত একজনার চোখ। যে-চোখ ছিলো অমায়িকতা ও দুরন্তপনা, উষ্ণতা ও বেদনার কোমল মিশ্রণ। যে-দু’টি কালো চোখ সততই অনায়াসে দৃষ্টিগোচর বস্তুতে আলতোভাবে নজর বুলিয়ে যেতো, যা-দেখতো তার ভালোমন্দের হঠকারী বিচারে না-গিয়ে আগে হদয়ঙ্গম করতো।
তোমার কাঁধে একটি হাত রেখে তোমার কাছ থেকে একটা নেগেটিভ চেয়ে নেওয়ার এখনই হতো মোক্ষম মুহূর্ত, কিন্তু আমার দ্বারা সেটা হয়ে উঠলো না। ফিল্ম থেকে তুমি কখন চোখ সরাবে এই অপেক্ষায় থেকে, আমি চেয়ে চেয়ে তোমার গোলাটে কপাল, তোমার ত্বকে সেঁটে থাকা কোঁকড়া চুলের ক’টি গুচ্ছ, ছোট্ট একখানি মণি-গয়নার অভাব থাকা তোমার নাকের খাড়া রেখা, আর সেখানে জমে ওঠা বিন্দু বিন্দু গোলাকার ঘাম দেখেই নিজেকে সন্তুষ্ট রেখেছিলাম।
“কী দেখতে পাচ্ছো?”
আমি প্রশ্নটা যখন জিগেস করছি, তুমি নিবিড়ভাবে আমার ঠোঁট দু’টি লক্ষ করেছিলে। সেই মুহূর্তেই টের পেলাম, কঠিন চেহারার ওই পরিষেবকটিকে আমি বুঝতে পারছি। জানতাম, তুমি শুধুই আমার ঠোঁট পড়তে চেষ্টা করছিলে, কিন্তু তারপরেও তোমাকে চুমু খাওয়ার একটি আকস্মিক তাড়না আমায় ভর করেছিলো। তুমি তোমার ঢিলেঢালা কারুশালার পোশাকের সামনের পকেট থেকে একটি নোটবই বের করে বলপয়েন্ট কলম দিয়ে ওতে লিখলে।
নিজেই দেখে নাও।
সে-সময়ে আমার দৃষ্টিশক্তি এমনিতেই ছিলো ক্ষীয়মাণ। চিকিৎসক হিশেবে তোমার বাবা তাঁর এ-অভিমত বুঝিয়ে বলেছিলেন যে, অকাল অস্ত্রোপচার বরঞ্চ অন্ধত্বকে আরো ত্বরান্বিত করবে; তিনি ধীরেসুস্থে ও সাবধানে কথা বলেছিলেন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে চেহারাটিকে ভাবলেশহীন রেখেছিলেন, চাননি কোনো শস্তা সহানুভূতি প্রকাশ পাক।
তীব্র আলো যে ক্ষতিকর, তখনো সেরকম কোনো প্রমাণ পাওয়া না-গেলেও তিনি সতর্ক থাকারই পরামর্শ দিয়েছিলেন, এ-কথায় জোর দিয়েছিলেন যে, সর্বাবস্থায় সাবধানে চলা-ই শ্রেয়। দিনে সূর্যের আলোকরশ্মি যখন সবচাইতে তীব্র থাকে তখন তিনি আমাকে রোদচশমা পরে থাকার আর রাতে শুধু টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। নামকরা কোনো ব্যক্তির মতো সারাক্ষণ কালো রোদচশমা পরে ঘুরে বেড়ালে নিজেকে নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগতাম, তাই আমি রোজ ব্যবহারের জন্যে হালকা সবুজ পরকলার একটি চশমা পছন্দ করেছিলাম। এমন অবস্থায় ফিল্মকে যতোই মাধ্যম হিশেবে রাখি না কেন, সূর্যের দিকে সরাসরি তাকানোর কথা আমি ভাবতেই পারিনি।
আমার দ্বিধা টের পেয়ে, তুমি আবার নোটবইয়ে লিখেছিলে : পরে। তোমার হাতের লেখা ছিলো নিপুণ ও নিখুঁত; খুব সম্ভব, তুমি লিখিত সংলাপে বেশ অভ্যস্ত ছিলে। কিছুই দেখতে পাচ্ছো না এমন পর্যায়ে যাওয়ার ঠিক আগে।
তখুনি কেবল আমি টের পেয়েছিলাম যে, আমার অসুখের গতিবিধি সম্পর্কে তুমি সবই জানতে। তোমার পরিবার ডিনার টেবিলে বসে আমার অসুস্থতা নিয়ে কথাবার্তা বলছে এই দৃশ্যকল্পটি আমাকে গভীরভাবে আহত করেছিলো, যদিও সেটির অস্তিত্ব ছিলো শুধুই আমার কল্পনায়।
আমি নিশ্চুপ ছিলাম। উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করায় ক্ষান্ত দিয়ে তুমি নোটবইটি বন্ধ করে আবার পকেটে রেখে দিয়েছিলে।
আমরা নদী দেখলাম।
যেন ওইটিরই যা অনুমতি ছিলো।
অচেনা এক বেদনাবোধ আমাকে গ্রাস করলো, যার কারণ যে মাত্রই-পাওয়া আঘাত নয় কিংবা অপমানিত হওয়ার অনুভূতিও নয়, তা আমি সঙ্গেসঙ্গেই বুঝতে পেরেছিলাম। সামনের দিনগুলোয় আমার কী হবে তা নিয়ে শঙ্কা বা বিমর্ষতার কারণে তো নয়ই। যে-সময়ে আমি চোখে আর কিছুই দেখতে পাবো না সেসময়টা তখনো ছিলো দূরবর্তী ভবিষ্যতে। এই তিক্তমধুর বেদনাবোধের উৎস ছিলো ওই মুহূর্তে আমার মুখের অবিশ্বাস্য রকমের কাছাকাছি থাকা তোমার অমায়িক মুখের পাশখানি; ছিলো প্রায় ইন্দ্রিয়অগ্রাহ্য এক বিদ্যুৎপ্রবাহ ধরে রাখা তোমার দু’টি ঠোঁট; ছিলো তোমার কালো দু’টি আঁখিতারা, সে কী স্বচ্ছ।
জুলাই রৌদ্রে নদীর পানি যখন মস্ত একটি মাছের আঁশের মতো ঝিলমিল করছিলো, তুমি যখন হঠাৎ আমার বাহুতে তোমার হাত রেখেছিলে, তোমার হাতের উলটো পিঠ দিয়ে উঁচু হয়ে চলে যাওয়া কালচে নীল শিরাগুলো ছুঁতে গিয়ে আমি যখন কেঁপে উঠেছিলাম, ভয়ে-ভয়ে অবশেষে যখন আমার ঠোঁট দু’টিকে আমি তোমার দুই ঠোঁটের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেই তখনকার মুহূর্তটি কি তোমার ভেতরে এখন বিলীন হয়ে গেছে? ওই পুরনো সেতুখানার সামনে, তোমার কন্যা কি প্রাম থেকে বাইরে উঁকি দিয়ে বলে ওঠে, “আম্মু,” আর তুমি কি ফিল্মের টুকরোটি ফের পকেটে ঢুকিয়ে রেখে আস্তে উঠে দাঁড়াও?
বিশ বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে, কিন্তু সেই মুহূর্তটির কতোগুলো ব্যাপার আমার ভেতর থেকে চলে যায়নি। শুধু সেই মুহূর্তটিই নয়, বরং একসাথে আমরা কাটিয়েছিলাম যতোগুলি মুহূর্ত – হ্যাঁ, সবচাইতে বিচ্ছিরি মুহূর্তটিও –আমার কাছে একদম জীবন্ত। আমার আত্ম-দোষারোপ, আমার আক্ষেপ, এসবের চাইতেও যা আমাকে বেশি বেদনার্ত করে তা তোমার মুখ। ওই মুখ, অশ্রুর এক মুখোশ। কাঠ নাড়াচাড়া করে করে পুরুষের মুঠোর চেয়েও শক্ত হয়ে ওঠা সেই মুষ্টি, আছড়ে পড়েছিলো যা আমার মুখে।
তুমি কি আমায় ক্ষমা করবে?
আর যদি ক্ষমা না-ই করতে পারো, অন্তত এটুকু কি মনে রাখবে যে, আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী?