সমুদ্র বিশাল বটে, কিন্তু তার মধ্যে উন্মাদনা বেশি; শান্তি কম। নদী ছোট হলেও তার বুকে এক মমতা, এক নিরব আরাম লুকিয়ে থাকে। নদী আমাকে প্রশান্তি দেয়, সমুদ্র কেবল বিশালতার অহংকার নিয়ে আমার দিকে তাকায়।
Published : 22 Apr 2025, 01:47 PM
নাড়ি ও নদীর শেকড় মানুষ কখনো পুরোপুরি উপড়ে ফেলতে পারে না—এই কথাটির প্রতি আমার এক গভীর, অটুট বিশ্বাস আছে। মানুষ হয়তো সময় ও পরিস্থিতির প্রয়োজনে নিজের অবস্থান বদলায়। কেউ গ্রাম ছেড়ে শহরে যায়, কেউ শহর পেরিয়ে প্রবাসে। দেখে ফেলে আকাশচুম্বী অট্টালিকা, চোখ ধাঁধানো শহর, দুর্দান্ত প্রকৃতি। কিন্তু নাড়ির টান? সেটা থেকে রেহাই নেই। সুখ-দুঃখে, ক্লান্ত মুহূর্তে, অনির্বচনীয় কোন শূন্যতায় হৃদয় শুধায়—"মা কোথায়?" মা মানে যিনি জন্ম দিয়েছেন, আবার মা মানে সেই মাটিও—যেখান থেকে উঠে এসেছি আমরা।
আমাদের নদীমাতৃক দেশের নদীগুলোও একেকটি মায়ের মতো। আমাদের শৈশব আগলে রাখা, বেড়ে ওঠার নীরব সাক্ষী। এই মমতাময় জলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যায় না। হয়তো দূরে যাওয়া যায়, কিন্তু ভুলে যাওয়া যায় না। কারণ, মানুষ মায়ায় বাঁচে। কিংবা বলা যায়, মায়া না থাকলে বাঁচাটাই অর্থহীন হয়ে পড়ে।
নাগরিক জীবনের ক্লান্তি যখন গা ছাপিয়ে যায়, তখন আমি স্বপ্ন দেখি—মেঘনার বুকে ভেসে যাচ্ছে ছোট্ট এক লঞ্চ, আর সেই লঞ্চে আমিও আছি। আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মাটির খুব কাছাকাছি, আমার শিকড়ের দিকে। কর্দমাক্ত পথ, আলপথের পাশের ঝোপঝাড়, গাছের নিচে শুয়ে থাকা শান্ত দুপুর—সবকিছু যেন জেগে ওঠে। ওখানে সাপ-কেঁচোর ভয় নেই, আছে মাটির গন্ধ, মায়ার গভীরতা।
মেঘনা শুধু নদী নয়, আমার শৈশব-যৌবনের সাথী। আমার প্রথম প্রেমের সাক্ষী, প্রথম হৃদয়ভাঙার গোপন দর্শক। তবু সে কখনো আমাকে ছাড়েনি। রোদে, বৃষ্টিতে, অভিমানে কিংবা বিষাদে, সে আমাকে আগলে রেখেছে। ঠিক মায়ের মতো। সন্ধ্যার সময় মেঘনার বুকে যখন সূর্যের আলো লাল আভায় ঢেকে দেয় চারদিক, তখন মনে হয়, কোনো এক প্রাচীন দেবী নেমে এসেছেন নদীর রূপ ধরে। শরীর-মনে দোলা দিয়ে যায় এক ধরনের অদ্ভুত প্রশান্তি।
মনের ভেতরে তখন কবির কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—
“তোমার রূপে অঞ্জলি দেওয়ার সাধ্য আমার নাই,
আমায় ক্ষমা কোরো, ক্ষমা কোরো।”
এই নদী, এই মেঘনা, এই শেকড়—সব মিলে যে জায়গাটি আমার সবচেয়ে আপন, তার নাম চাঁদপুর। মেঘনা, ডাকাতিয়া আর ধনাগোদা নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই সবুজ ভূখণ্ডে আমার নাড়ি গাঁথা। চাঁদপুর জেলার সিকিরচর নামের ছোট্ট এক গ্রামের ছোট্ট একটা বাড়িই- আমার পৃথিবী। সেখানকার প্রতিটি গাছ, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি ধানের গন্ধ আমাকে বারবার টেনে নেয়। নদীর ঢেউ যেমন একবার এসে ফিরে যায়, তেমনি আমি শহরের কোলাহলে হারিয়ে গিয়েও এক সময় আবার ফিরে আসি, ঘরমুখী হই। আমার মনে হয় সেখানে ধুলোমাখা রাস্তায় পড়ে থাকা কীটও আমার অপেক্ষা করে। আমাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা।
সালবাদর দালির চিত্রকর্ম
দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছি। পাহাড়, ঝর্ণা, সমুদ্র—সব দেখেছি। কিন্তু নদীর মতো আপন, নদীর মতো শান্তি কোথাও খুঁজে পাইনি। সমুদ্র বিশাল বটে, কিন্তু তার মধ্যে উন্মাদনা বেশি; শান্তি কম। নদী ছোট হলেও তার বুকে এক মমতা, এক নিরব আরাম লুকিয়ে থাকে। নদী আমাকে প্রশান্তি দেয়, সমুদ্র কেবল বিশালতার অহংকার নিয়ে আমার দিকে তাকায়।
মেঘনা কন্যা চাঁদপুরকে বলা হয় "ইলিশের দেশ চাঁদপুর"। চাঁদপুরের সবচেয়ে বিখ্যাত ও বৈশিষ্ট্যময় স্থান হলো ত্রিনদীর মোহনা—যেখানে পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া একসাথে মিলিত হয়েছে। এই মিলনস্থল 'মোলহেড' নামেও পরিচিত। এখানে প্রকৃতি এক অদ্ভুত খেলায় মেতে ওঠে। নদীর জলরাশিতে প্রতিফলিত সূর্যাস্ত—টকটকে লাল আলো যখন তিনটি নদীর জলে মিশে যায়, তখন তা শুধু চোখে দেখা নয়, হৃদয়ে অনুভব করার দৃশ্য হয়ে ওঠে।
তবে এই মোহনা শুধু সৌন্দর্য নয়, বহন করে অনেক বেদনার ইতিহাসও। বর্ষাকালে এখানে তৈরি হয় বিপজ্জনক ঘূর্ণি। নদীর বুকে একেকটা ঢেউ আছড়ে পড়ে বিশাল বিকট শব্দে। তবুও মানুষ আসে—ভয়কে উপেক্ষা করে। কারণ মানুষ সৌন্দর্য পিপাসু। কেউ কেউ হয়তো জানে না শেষ পরিণতি কী, তবুও হৃদয় তাকে টেনে নিয়ে আসে। কেননা মানুষ পরিণতি না ভেবেই ভালোবাসতে ভালোবাসে। কিংবা পূর্বসূরির অভ্যস্ততায় ভালোবাসে।
চাঁদপুর শুধু মোহনা বা বড় শহর নয়, আছে আরও শান্ত গ্রাম। বিপজ্জনক জায়গা এড়িয়েও কিন্তু সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। যেমন মতলব উত্তরের এখলাছপুর। মেঘনার তীরঘেঁষা এই গ্রামের প্রকৃতি, মানুষ আর নদী মিলিয়ে তৈরি করে এক স্বপ্নিল চিত্রপট। এখানকার জেলেরা, কৃষকেরা, শিশুরা—সবাই যেন প্রকৃতিরই অংশ। তাদের হাসি, সরলতা, আতিথেয়তা মনের সব জীর্ণতা ধুয়ে দেয়। মিলিয়ে দেয় মন ও প্রাণের সকল হতাশা
আমি হয়তো হাজারটা কারণ খুঁজে পেতে পারি নদীকে ভালোবাসার। কিন্তু তার একটাও না থাকলেও আমার ভালোবাসা অটুট থাকবে। কারণ, এই ভালোবাসা যুক্তির নয়, অস্তিত্বের। নদী, মাটি, নাড়ি—এই তিনটি একসূত্রে বাঁধা। একটিকে হারালে বাকি দুটোও জড়ায়।
নাড়ি যেমন আমার পরিচয়, নদীও তেমনি আমার আত্মার আশ্রয়।
এই আশ্রয়ের টান থেকেই আমি বারবার ফিরে আসি চাঁদপুর। আমার নদীর কাছে, আমার নাড়ির কাছে।