সম্পদে-সংকটে: অর্থনীতির ইতিহাস, চর্চা ও প্রয়োগ

ফয়জুল ইসলামফয়জুল ইসলাম
Published : 5 June 2023, 06:03 AM
Updated : 5 June 2023, 06:03 AM

সম্পদে-সংকটে: অর্থনীতির ইতিহাস, চর্চা ও প্রয়োগ

সনৎকুমার সাহা

কথাপ্রকাশ

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৩

পৃষ্ঠা: ১২৮

মূল্য: টাকা ৩০০                                    

 

সম্পদে-সংকটে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান বঙ্গবন্ধু-চেয়ার অধ্যাপক ও ঐ একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ভূতপূর্ব শিক্ষক অধ্যাপক সনৎকুমার সাহার নতুন বই। আমরা জানি, অধ্যাপক সাহা দীর্ঘ দিন ধরেই অর্থনীতি, ইতিহাস ও সাহিত্য নিয়ে প্রবন্ধ লিখছেন। বর্তমান গ্রন্থটি নিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম পুরোধা এই অর্থনীতিবিদ ও সাহিত্যিকের কুড়িটি প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হলো। সাহিত্য-সমাজ ভাবনার বিষয়ে তার প্রবন্ধ বরাবরই আমাদেরকে ঋদ্ধ করেছে। বাংলা সাহিত্যের প্রবন্ধ-শাখাকে নতুন মাত্রা দেবার জন্য তিনি নানানভাবে প্রশংসিতও হয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রবন্ধে বিশেষ অবদান রাখবার জন্য তিনি ২০১২ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন এবং ২০১৫ সালে তিনি ভূষিত হয়েছেন একুশে পদকে। কৃতী এই মণিষীর বর্তমান প্রবন্ধ-সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে মোট আটটি প্রবন্ধ। অর্থনৈতিক উন্নয়েনের তত্ত্ব, তত্ত্বের চর্চা ও ইতিহাসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে এবারের প্রবন্ধগুলো।

গ্রন্থটিতে অধ্যাপক সনৎকুমার সাহার প্রথম প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘বাংলাদেশ: অর্থনৈতিক পটভূমি’। এপ্রিল ১৯৭২-এ বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের পত্রিকা ‘ইতিহাস’-এর ষষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যাতে প্রকাশিত হয়েছিল প্রবন্ধটি। এই প্রবন্ধটিতে অধ্যাপক সাহা ঐতিহাসিক বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা প্রত্যক্ষ করেছেন যেখানে সময়ের প্রেক্ষিতে অভিঘাত ফেলেছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, দানা পাকিয়ে উঠেছে পাকিস্তান-সৃষ্টির আন্দোলন এবং তারপরে এসেছে বাংলাদেশের জন্ম। তিনি মনে করেন, বর্তমানের অর্থনীতিকে বুঝতে পারাটা জরুরি এবং সেই মতো ভবিষ্যতের পথ খুঁজবার জন্য পেছনের ইতিহাস উলটে পালটে না দেখলে চলে না কেননা তার যুক্তিতে ‘বাস্তব পরিস্থিতিতে ইতিহাস-নিয়ন্ত্রিত পথে সৃজনশীল ক্ষমতার উৎস খুঁজে তার সার্থক প্রকাশ ঘটালে তবেই প্রগতির সন্ধান মেলে। অন্যথায়, বিভ্রান্তির পাঁকে ঘুরে মরাই সার হয়। পূর্ণ দৃষ্টিতে ইতিহাসের সবটুকু দেখতে পেলে প্রগতির পথ খুঁজে পাওয়া আর তেমন কঠিন কাজ থাকে না।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলছেন, বাংলাদেশের মানুষজনের একটি বড় অংশ পাকিস্তান-সৃষ্টির আন্দোলনকে সমর্থন দিলেও ১৯৪৭-এর পরপরই তাদের মোহভঙ্গ ঘটে যায় এবং নতুন আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালে জন্ম হয় বাংলাদেশ নামের স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের। তাই তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘অনুমান করি, আমাদের ইতিহাসচর্চার কোথাও কোনো অপূর্ণতা থেকে গেছে; যার ফলে একদিনের সত্য অন্যদিনের ভ্রান্তিতে পরিণত হয়।’ পিছিয়ে গিয়ে তিনি দেখান, নবাবি আমলে এ ভূখণ্ডে ইংরেজ বণিকেরা একচেটিয়া কারবারে নেমেছিল এবং তখন তাদেরকে সহায়তা দিয়েছিল এ দেশের দালাল-বেনিয়া-মুৎসুদ্দির দল। বণিকতন্ত্রের মূল ক্রীড়নক এবং তাদের সহায়ক দেশিয় দালালরাই উৎপাদন থেকে উদ্ভূত খাজনা ভাগাভাগি করে নিয়েছে, এ দেশের দরিদ্র কৃষকেরা তাদের ন্যায্য হিস্যা পায়নি। এর ফলাফল হলো এই যে নবাবি আমলের শেষপাদে ‘এদেশের গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙেচুরে তছনছ’ হয়ে যায় যা কিনা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রকৃতির অর্থনীতিই ছিল। অধ্যাপক সাহা দেখিয়েছেন, বণিকতন্ত্রের পরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তও শোষণের আরেকটি মাধ্যম হয় ওঠে যেখানে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতির কৃষকদের জমির ব্যবস্থাপনার ভার দেয়া হয়েছিল জমিদারকে এবং সেই আইনের বলে ভুঁইফোর জমিদাররা জমি থেকে নিঙড়ে নিয়েছে অতিরিক্ত উৎপাদন; জমি থেকে যে খাজনার সৃষ্টি হচ্ছে সেই উদ্ভূত খাজনার বড় অংশটি তারা ভাগজোগ করে নিয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দুঃখজনক ফলাফল হিসেবে অধ্যাপক সাহা প্রত্যক্ষণ করছেন, ‘জমিকে খোলাবাজারে পণ্য হিসেবে আনা হল সত্য, কিন্তু কোম্পানির সাহেবদের একচেটিয়া কারবারের ও জুলুমবাজির অধিকার মোটামুটি বজায় থাকল। দেওয়ান, বেনিয়ান, মুৎসুদ্দি ছাড়াও এখন তাদের সহায় হলো নতুন গড়ে ওঠা জমিদার গোষ্ঠী।’ এভাবে জমি থেকে যে ফসল উদ্বৃত্ত হিসেবে এলো তা’তে করে তা থেকে সঞ্চয় হলো না, জমিতে বা শিল্পে বিনিয়োগ ঘটল না; পরিণামে, ‘...না শ্রীবৃদ্ধি হলো কৃষকদের, না উন্নতি হলো জমিদার গোষ্ঠীর, না উদ্ভব হলো শল্পের।’ অথচ খোদ ইংল্যান্ডে কৃষিখাত থেকে তুলে আনা খাজনা শিল্পায়নে বিনিয়োগ করা সম্ভব হয়েছিল, সরকারের সুনীতির কারণেই। এদিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরিণামে সমাজে গড়ে উঠল ভূমিভিত্তিক উৎপাদন কর্মকাণ্ডের সাথে সর্ম্পকহীন এক ‘নব্যশিক্ষিত ভদ্রলোক সম্প্রদায়’ যারা আক্ষরিক অর্থেই গ্রামীণ শ্রমের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকল, পরিপুষ্টও হলো, কিন্তু অপরদিকে, কৃষির উন্নতি ঘটল না এতটুকুও। অর্থাৎ অধ্যাপক সাহার সাথে সুর মিলিয়ে আমাদেরকে বলতে হয়, নবাবি আমলের বাণিকতন্ত্র এবং কোম্পানি আমলের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত∑ এ দুইই বাংলাদেশের কৃষি বা শিল্পের উন্নয়নের বেলাতে কোনও কাজেও আসেনি। মাঝখান থেকে এদেশের কৃষিনির্ভর সিংহভাগ মানুষজন ‘তাদের অন্তর্নিহিত সৃজনীশক্তি বিকাশের কোন সঠিক পথ খুঁজে পেল না।’

অধ্যাপক সাহা মনে করেন, এই বণিকতন্ত্র ও ভূমির ‍চিরস্থায়ী ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতির কাঠামো ভেঙে পড়ল এবং তার ফলে উন্মূল মানুষ শহুরে পরগাছাতে পরিণত হলো। পাকিস্তান-প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পেছনে এদেশের সিংহভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্পৃহার পেছনে এই উণ্মূল হয়ে পড়বার ব্যাপারটির মস্তবড় ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের এই গ্রামীণ মুসলিম জনগোষ্ঠীই জনসংখ্যার দিক থেকে সিংহ ভাগ, এরাই বাংলার সেই বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। অধ্যাপক সাহা বলছেন, ‘তাঁরা একদিকে অক্ষম জমিদারের কাছে খাজনা দেওয়ার গ্লানি থেকে মুক্তি চেয়েছেন, অন্যদিকে চেয়েছেন শহুরে ভদ্রলোক হয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি আসবার সুযোগ...এক সুবিধাপায়ী পরশ্রমজীবী জনসমষ্টিকে তাঁরা বিতারিত করতে চেয়েছেন নিজেরা ওই সুযোগ গ্রহণ করবেন বলে। যে ঔপনিবেশিক কাঠামো দেশে বর্তমান ছিল, তার কোনো মৌলিক পরিবর্তন সাধন তাঁদের লক্ষ্যের ভেতর ছিল না।’ এই প্রেক্ষিতে অধ্যাপক সাহা আরও লক্ষ করছেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পরে নয়া দেশটির পূর্বপ্রান্তের কৃষিন্নোয়নে কোনও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবার রীতিই গ্রহণ করেনি তৎকালীন নতুন সরকার এবং সে কারণেই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মাঝে হতাশা বৃদ্ধি পেয়েছে; দ্বিতীয়ত, দেশটির পূর্বপ্রান্তের শহুরে মধ্যবিত্ত চাইলেও পাকিস্তানের রাজকার্জ ও বিভিন্ন পেশাতে প্রবেশও করতে পারেনি। অধ্যাপক সাহা যুক্তি দেন, এই সর্বৈব হতাশার ভেতরেই নিহিত ছিল পাকিস্তানের ভাঙনের বীজ। তাই তিনি মন্তব্য করছেন, ‘এটা বিশেষ করে মনে রাখা প্রয়োজন যে ঔপনিবেশিক কাঠামোয় প্রত্যাশা পূর্ণ না হওয়ায় দেশের মানুষ তার আশু চরিতার্থতা খুঁজবেন এই স্বাধীন বাংলাদেশে।’ তাই তিনি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করবার জন্য ‘এক ব্যাপক সামাজিক রূপান্তর’-এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমাদেরকে সজাগ থাকতে বলেছিলেন সেই সুদূর ১৯৭২ সালেই।

উন্নয়ন-দর্শনকে কেন্দ্র করে অধ্যাপক সনৎকুমার সাহার দ্বিতীয় প্রবন্ধের শিরোনাম ‘উন্নয়নের কথা ও কাহিনী’। ধ্রুপদী বাজার-অর্থনীতি, মিশ্র অর্থনীতি ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মডেল বিষয়ক আলোচনায় সমৃদ্ধ প্রবন্ধখানার মূল সুর হলো-- কালের মাপে একটি অর্থনীতির সমৃদ্ধিই সবটুকু নয়, সেটা নিশ্চয় একটি পরিবর্তন, তবে তাকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলা চলে না। অধ্যাপক সাহার ভাষাতে-- ‘উন্নয়নের জায়গা দখল করেছে এখন ‘শ্রীবৃদ্ধি’। দুটো যে এক নয়, এটা মাথায় রাখা জরুরি। মাথাপিছু আয় বাড়া অবশ্যই উন্নয়নের একটি শর্ত। কিন্তু একমাত্র নয়। ইহজগতের সীমাশর্ত মেনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানব সন্তানের সমান মর্যাদা এই প্রত্যয়ে সর্বান্তঃকরণে স্থির থাকতে পারাটাও উন্নয়নকাণ্ডে প্রাথমিকতা দাবি করে। শুধুই বাজারের পেছনে ছোটায় উন্নয়নের ধ্যানধারণা পুরোপুরি ফোটে না। অনেক মানুষী দায়-দায়িত্ব আড়ালে চলে যায়...।’ অধ্যাপক সাহা বলছেন, তবুও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য বাজার-ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে-- উৎপাদন-প্রক্রিয়াতে, আয়বণ্টনে। কাজেই পরিকল্পিত অর্থনীতির, এমনকি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতেও বাজার-ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করা কেবল নির্বুদ্ধিতাই নয়, অন্যায়ও বটে। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে বাজার-ব্যবস্থায় উৎপাদন ও বন্টন প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় হবেই। আর তাই নানান নীতি-কৌশল দিয়ে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। অধ্যাপক সাহার ভাষাতে বলি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন-- ‘কোনো অঞ্চলে মানব সমুদয়ের ধারাবাহিক বাস্তবতায় সচেতন পথনির্দেশ ও পথচলার পরিণাম। সবাই একসঙ্গে বসে এসব ঠিক করে তা নয়। তেমন বাস্তবসম্মতও নয়। কিন্তু সমাজ-রাষ্ট্র পরিচালনার প্রচলিত পদ্ধতিগত বিধি-বিধানের অনুমোদনে সর্বাঙ্গীন কর্মকলায় তা আকার পেতে থাকে। বাঁচার ও আরও ভালোভাবে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা তাতে মেলে। তা সম্মিলিত, যদিও অসংখ্য ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কন্টকাকীর্ণ, ও পরিবর্তনযোগ্য। মোটেই স্বতঃস্ফূর্ত নয়। লক্ষ্য ও অভিজ্ঞতা সম্বল করে পথচলা। হতে পারে তা আঁকাবাঁকা-- দ্বন্দ্বমুখর। একক কোনো কালবিন্দুতে মোটা দাগে হিসাব-নিকাশে তার প্রাণস্রোত ধরা পড়ে না। অবশ্য অতীতে নিজের, এবং অন্যের, জ্ঞানচর্চা ও জীবনযাত্রা প্রেরণার উদাহরণ হতে পারে। হতে পারে আত্নগ্লানিরও।’

উন্নয়ন-দর্শন নিয়ে আলোচনার শুরুতেই অধ্যাপক সাহা ইউরোপে চার্চের প্রভুত্বের ব্যর্থতাকে তুলে ধরেন। আমরা জানি, হাজার দুয়েক বছর আগে ইউরোপে এই যাজকতন্ত্র জমির মালিকানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেছে। এ ব্যবস্থাতে গণমানুষের আয়-উন্নতি যদি কিছু ঘটে থাকে তা ঘটেছে, অধ্যাপক সাহার মতে, আকস্মিকভাবেই-- পরিকল্পিত পথে নয়। তাই অধ্যপক সাহা লক্ষ করেছেন, এ অনঢ় চার্চপ্রথাতে গণমানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অপ্রাসঙ্গিক একটি বিষয় হয়েই ছিল। একইভাবে ভূগোলের একটা বড় অংশ যে মোঙ্গল, তাতার ও তুর্কিরা দখল করে নিয়েছিল সেখানেও অধ্যাপক সাহা কোনও সচেতন উন্নয়নকাণ্ডের কোনও সচেতন স্পর্শ দেখেননি। লুন্ঠনের পরেও তখন কোনও কোনও দেশে যে সম্পদের প্রাচুর্য ঘটেনি একেবারেই সেটা বলা যাবে না। তিনি বলছেন, ‘তার কারণ ওই সব অঞ্চলে মানুষের কৃৎকৌশল ততটা নয়, যতটা সেসবে প্রকৃতির আনুকূল্য। শুধু এই কারণে কোথাও সমৃদ্ধির দেখা মিললেও তাকে ‘উন্নয়ন’ বলা যায় না।’ ঠিক এই যুক্তিতেই তিনি বলছেন, গেল পাঁচশ বছর ধরে ইউরোপে আমরা যে ‘চোখ-ধাঁধানো সমৃদ্ধি’ দেখেছি তাকেও উন্নয়নের নিদর্শন হিসেবে দাবি করাটা সঙ্গত নয়। এরপর অধ্যাপক সাহার পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা জানছি, প্রোটেস্টান্ট মূল্যবোধ বস্তুগত সমৃদ্ধির পথ সুগম করলেও তা সচেতন উন্নয়ন প্রচেষ্টার জোয়ার বয়ে নিয়ে আসেনি। প্রোটেস্টান্ট মূল্যবোধের প্রয়োগের কারণেই ইউরোপের দেশগুলো বরংচ আমেরিকা মহাদেশে নগ্নভাবে উপনিবেশ গড়েছে। এতে করে ইউরোপ থেকে পুঁজি ও প্রযুক্তি প্রবাহিত হয়েছে ইউরোপ-অধিকৃত উপনিবেশগুলোতে; মানুষের সচলতা ও দক্ষতাও বেড়েছে তা’তে করে। এসব শুভ দিকগুলোকে ‘উন্নয়ন’ নামে নামাঙ্কিত করতে চান না অধ্যাপক সাহা কেননা শেষতক তা বিস্তীর্ণ ভূগোলে আঞ্চলিক বৈষম্যই তৈরি করেছে বরংচ।

এবার ফেরা যাক অ্যাডাম স্মিথের ‘দ্যা ওয়েলথ অফ নেশানস’-এর দিকে যেখানে অধ্যাপক সাহা দু’টো জরুরি বিষয়ের অবতারণা করেছেন: প্রথমত, আন্তর্জাতিক শ্রম-বিভাজনই শিল্পোন্নয়ণের পেছনে কাজ করে থাকে যে কারণে ‘বিশ্বজুড়ে চাহিদা ও যোগানে পরিপূরকতার সৃষ্টি হয়। সবাই আপন আপন লক্ষ্য পূরণে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে, এটা আর অবশ্যক থাকে না। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রত্যেকে তুলনায় কম দামে বেশি সুবিধায় বহু বিচিত্র চাহিদা মিটিয়ে নিজেদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে’। দ্বিতীয়ত, এই পুরো প্রক্রিয়াতে এক জন ব্যক্তি স্বাধীনভাবে মুক্তবাজারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নেয় এবং বাজারের চালিকাশক্তিকে একটি রাষ্ট্র মোটেই নিয়ন্ত্রণ করতে যায় না। বাজারের চালিকাশক্তির এই অদৃশ্য কর্মকাণ্ডে সরকার তার নাক গলাবে না-- সরকারের কাজ হবে কেবল বাজারে ব্যক্তির অংশগ্রহণের পরিবেশটুকু সৃষ্টি করে দেয়া এবং চাহিদা ও জোগানের মাঝে ভারসাম্য রক্ষার কাজের তদারকিটুকুই করা। অ্যাডাম স্মিথের এই কালজয়ী উন্নয়ন-ভাবনাকেও অর্থনৈতিক উন্নয়ণের সহায়ক বলে মনে করেন না অধ্যাপক সাহা কেননা তিনি বলেন, অ্যাডাম স্মিথ ‘কিন্তু সচেতন উদ্যোগে ব্যাক্তি ও সমষ্টির ধারাবাহিক সমৃদ্ধির প্রয়োজনে পুঁজি ও কর্মক্ষমতায় রূপান্তর ঘটাতে বিবিধ আয়োজনের সমন্বয় ও গতিশীলতার পথ খোঁজেননি’। অন্যদিকে, থমাস ম্যালথাসের তত্ত্ব নিয়েও সমালোচনা তুলেছেন অধ্যাপক সাহা। তিনি বলছেন, থমাস ম্যালথাস শ্রমবাজারে শ্রমের চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে মজুরির চক্রাবর্তকে আয়বৈষম্যের একটি উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ম্যালথাস অবশ্য অ্যাডাম স্মিথের মতো করে সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপরে কোনও আলোকপাত করেননি। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারের সম্ভাবনার উপরে জোর দিয়ে মানুষের উদ্ভাবনীশক্তি, প্রযুক্তির যথাযোগ্য ব্যবহার ও দু’টো দেশের মাঝের তুলানামূলক ব্যয়-সুবিধার ভিত্তিকেই জরুরি বলে মনে করেছেন ডেভিড রিকার্ডো।

তবে বলতেই হবে, অ্যাডাম স্মিথ, থমাস ম্যালথাস ও ডেভিড রিকার্ডোর উন্নয়নতত্ত্ব কেবল একটি দেশের সমৃদ্ধির কথা বলেছে-- গণমানুষের সর্বৈব উন্নয়নের প্রসঙ্গটি আসলে গৌণই থেকে গেছে সেখানে। বরং কার্ল মার্কসের উন্নয়ন-ভাবনা এই সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিকভাবে নির্দিষ্ট পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় কার্ল মার্কস যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তা অধ্যাপক সাহার ভাষ্যে এমন, ‘পুঁজির অধিকার যেখানে কলকারখানায় উৎপাদনে নিয়ন্তার ভূমিকায়, বিপরীতে, তাঁর দৃষ্টিতে, শ্রমই যেখানে মূল্যসৃষ্টির প্রকৃত কারক হওয়া সত্ত্বেও ওই পুঁজিপতিদের হাতে শোষণের শিকার-- তাদের ঠকিয়ে উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে পুনরুৎপাদনে বিনিয়োগ করে পুঁজিপতিরা, পাশাপাশি, বৃহৎ পুঁজি গ্রাস করে, অথবা অধীনস্থ রাখে, ক্ষুদ্র পুঁজির কারবারকে--  সেখানে সমাজ ভাগ হয়ে যায় শোষক ও শোষিত এই দুই শ্রেণিতে।’ তবে শর্ত এই যে পুঁজিবাদি উৎপাদন-ব্যবস্থা ইতিহাস-নির্ধারিত পথে ভেঙে পড়বার আগে সেখানে ক্রমাগত বাড়তে থাকবে শ্রমের উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা। এভাবে চূড়ান্ত বিকাশের পর্যায়ে পৌঁছুবে পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থা। পুঁজিবাদি ও শ্রমিকশ্রেণীর মাঝের চিরায়ত দ্বন্দ্বের নিরসনের ভেতর দিয়ে শোষণহীন সমাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটবে, একসময় যার উত্তরণ ঘটবে সাম্যবাদে। বাস্তবতার প্রেক্ষিতে অধ্যাপক সাহা মনে করেন, পুঁজিবাদি ও শ্রমিকশ্রেণীর মাঝের এই দ্বন্দ্বকে আপাতদৃষ্টিতে যত সরল বলেই মনে হোক না কেন আদতে তা এতটা সরল নয়, স্বয়ংক্রিয়ও নয়। এ জন্যই ভেরলেন জোর দিয়েছিলেন নিরপেক্ষ ও সচল প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবার ওপরে। এদিক থেকে সবচাইতে বেশি প্রভাব ফেলেছিল জন মেইনার্ড কেইনসের উন্নয়ন-ভাবনা যা কিনা গড়ে উঠেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মন্দার অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে। বাজারের কার্যকর চাহিদা বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্র বা এমন কোনও প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের ওপরে জোর দিয়েছিলেন তিনি। তিনি মনে করেছিলেন, এভাবে বিনিয়োগ অর্থনীতিতে ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে এবং সেই সাথে বেড়ে যাবে অর্থনীতির কার্যকর চাহিদা; ফলে অর্থনীতিতে ঘটবে নতুন নতুন সব কর্মসংস্থানের সুযোগ। অধ্যাপক সাহা তাই মন্তব্য করেছেন, ‘সৃষ্টিশীল বিনিয়োগের পথ খোলা না থাকলে উৎপাদনে স্থবিরতা অনিবার্য। প্রভাবশালী চক্রের ফটকাবাজি গোটা প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে।’ এ কারণেই ভারতসহ ঔপনিবেশিকদের হাত থেকে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া দেশগুলোতে একদা মিশ্র অর্থনীতির চর্চা চলেছে যেখানে বাজারের অদৃশ্য শক্তিই কেবল সবটুকু নয়, রাষ্ট্রের সুচিন্তিত বিনিয়োগও উন্নয়নের প্রয়োজনীয় উৎপাদক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এ মিশ্র অর্থনৈতিক দর্শণ এখনও অনুসরণ করে চলেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে, পরিকল্পিত উন্নয়নের নির্দেশনামূলক ছক ধরে হেঁটেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। গণচীনের উন্নয়ন-পথটি ছিল ভিন্ন-- কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণে খোলাবাজারের কায়দাতে সেখানে চলেছে ছোট-বড় সব বিনিয়োগ-উদ্যোগের আসর। আমরা দেখেছি, সদিচ্ছা থাকার পরেও ব্যক্তি-বিনিয়োগের প্রণোদনার অভাবে এবং পার্টির অত্যধিক নিয়ন্ত্রণের কারণে ভেতর থেকে ভেঙে পড়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন; অন্যদিকে, গণচিনে মাথাপিছু আয় বাড়লেও বাজারের শক্তিকে অস্বীকার কারবার কারণেই তীব্রতর হয়েছে আয়বৈষম্য।

পরিকল্পিত অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গে অধ্যাপক সনৎকুমার সাহা লিউইস মডেল এবং রানিস-ফেই মডেল নিয়েও আলোচনা করেছেন। আর্থার লিউইস যুক্তি দিয়েছিলেন, কৃষিখাতে নিয়োজিত উদ্বৃত্ত ও সস্তা শ্রম শিল্পখাতে ব্যবহার করা যেতে পারে। ফলে শিল্পকারখানাগুলোতে কমে আসবে উৎপাদন-ব্যয় এবং বাড়বে মুনাফা, মুনাফা ব্যবহৃত হবে পুনরুৎপাদনের কাজে। অন্যদিকে রানিস-ফেই যুক্ত দিয়েছিলেন, শিল্পখাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি আমরা যদি কৃষিখাতে আধুনিকায়ন নিয়ে আসি এবং কৃষিজোতের আয়তন বাড়াই তবে কৃষকেরাও তাদের সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে পারবে। অধ্যাপক সাহা মন্তব্য করেছেন, ‘পরিণামে কৃষি ও শিল্প, উভয়ই প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা সমতায় পৌঁছে সার্বিক প্রবৃদ্ধির স্বয়ংক্রিয়তায় প্রাথমিক ভারসাম্য রচনা করবে।’ বাস্তবতার নিরিখে অধ্যাপক সাহা লক্ষ্য করেছেন, সত্তর দশকে পেট্রোলিয়ামের দাম বেড়ে যাওয়াতে খোদ মুক্তবাজার মডেল, মিশ্র অর্থনীতির মডেল ও সমাজতান্ত্রিক উন্নয়ন-মডেল-- এই তিনটি মডেলের কার্যকারিতাই প্রশ্নের সম্মুখিন হয়ে দাঁড়ায় এবং একযোগে দেখা দেয় অর্থনৈতিক মন্দা ও মূল্যস্ফীতি; ছড়িয়ে পড়ে অস্থিরতা। পেট্রোলিয়মের দাম বেড়ে যাওয়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য কেইনিসীয় কায়দাতে গণবিনিয়োগের বিস্তারের জরুরি কাজ ফেলে ফিরে গেছে মুক্তবাজার অর্থনীতির সূত্রগুলো বাস্তবায়নের দিকে। এমন খোলাবাজার নীতির গুণগানই গেয়েছে বিশ্বব্যাংক; এখনও গাইছে। অধ্যাপক সাহার বিরোধটি এখানেই। সব উন্নয়ন-মডেল যখন অকার্যকর বলে মনে হয় তখন অধ্যাপক সাহা মন্তব্য করেন, ‘প্রশ্নটা গিয়ে দাঁড়ায় আলাদা আলাদা রাষ্ট্রে সম্পদ-ব্যবহারে সততা, দক্ষতা ও কর্মনিষ্ঠার যথাযথ ব্যবহারে। যে কোনো পরিস্থিতিতেই এরা প্রাথমিকতা দাবি করে। কিন্তু ওই পরিস্থিতি কী ও কেন এটা বিচারের প্রয়োজন যদি তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়; এবং শুধু কলকাঠি নেড়ে বাস্তবকে সচল রাখার বিদ্যাটুকুই যথেষ্ট বলে যদি কেউ দাবি করেন, তবে তাকে প্রত্যাখ্যান করার নৈতিক জায়গাটুকু হারিয়ে যায় ।’ অধ্যাপক সাহা লক্ষ করছেন, বিশ্বায়নের যুগে অর্থনৈতিক উন্নয়নের এসব নানান নিদান নির্দিষ্ট একটি ভূখন্ডের প্রেক্ষাপটের ওপরে নির্ভর করতে পারে। তাই তা যে এক জায়গাতে থেমে থাকবেই সেটা বলা শক্ত। তবে তিনি মন্তব্য করছেন, ‘আজকের প্রযুক্তি বিপ্লবে এবং মানুষে মানুষে সংযোগ ও সম্পর্কের বিস্তারে ওই এককগুলোর সীমা কিন্তু সব গলে যাচ্ছে। ফলে উন্নয়নের এককগুলো আর স্থির থাকছে না। এদের কর্ম বা অপকর্ম অন্যকেও চঞ্চল করছে। জাতি-রাষ্ট্র-ভূগোলের সীমা সেখানে অনেক জায়গায় অসহায় ও অবান্তর।’ পরিবেশ ও জলবায়ু দূষণ এ সমস্যাটির প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তাই অধ্যাপক সাহা পরিশেষে মন্তব্য করেছেন, ‘উন্নয়নের লক্ষ্য কিন্তু বহুবচনে। এবং সমগ্রে তা আজ বিশ্বজোড়া মানব বস্তবতায় সার্থক সমন্বয় প্রত্যাশী∑ যেন কুশল ও কল্যাণ সর্বত্রগ্রামী হয়, ব্যক্তিজীবনে মৃত্যু অনিবার্য হলেও সব মানুষের ধারা যেন অর্থবহ জাগতিক অর্জনের আশা নিয়ে ক্রমাগত সামনে অগ্রসর হয়।’

তৃতীয় প্রবন্ধে অধ্যাপক সনৎকুমার সাহা অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী এসথার ডুফলো ও অভিজিৎ ব্যানার্জির Poor Economics (২০১১) এবং Good Economics for Hard Times (২০১৪)-- এ দু’টো বই নিয়ে আলোচনা করেছেন। বলে রাখা প্রয়োজন, দারিদ্র দূরীকরণের নীতিমালার প্রয়োগ বিষয়ক নানান নীতি কৌশল নিয়ে এ দু’জন অর্থনীতিবিদ ৪০ টি দেশে ২৪০ টিরও বেশি সমীক্ষা চালিয়েছেন । তাদের গবেষণার পদ্ধতিখানা খুবই নতুন যাকে আমরা Rardomized Control Trials (RCTS) নামে জানি। একটু পিছিয়ে গিয়ে অধ্যাপক সাহা বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র দূরীকরণের কৌশল নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেছেন যেখানে প্রধানত দু’টো কৌশল গ্রহণের জন্য পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে-- প্রথমত, একটি দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়লে আয়-রোজগারের সুযোগ বাড়বে; এবং দ্বিতীয়ত, শিক্ষাসেবা, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সামাজিক সেবার ব্যবস্হা করতে হবে যাতে করে দরিদ্ররা আয়বর্দ্ধনের সুযোগগু্লো গ্রহণ করতে পারে। অধ্যাপক সাহা বলছেন, বিশ্বব্যাংকের এই সরবরাহমুখী ব্যবস্হাপত্র যে কোনও দেশে দারিদ্র দূর করেছে বা আয়বৈষম্য কমাতে পেরেছে এমনটা বলা যাবে না। বিশ্বব্যাংকের এমন ব্যবস্হাপত্রের সাথে তাত্ত্বিকভাবে ডুফলো-ব্যানার্জির কোনও ফারাক নেই, ফারাকটি হচ্ছে বাস্তবায়নের কায়দাতে – পরিপার্শ্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে দারিদ্র্য দূর করবার জন্য মানুষের ভেতরে আচরণগত পরিবর্তন আনবে এমন সব ছোট ছোট পদক্ষেপের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন তারা। তাদের পরামর্শগুলো বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্হাপত্রের মতো কেবলমাত্র মোটা দাগের কোনও সরবরাহমুখী কৌশলের দিকেই ধাবিত হয়নি; সেখানে উন্নয়নের চাহিদামুখী বাস্তবায়নেরও ভূমিকা রয়েছে। ডুফলো ও ব্যানার্জির কাজকে সাধুবাদ জানাতে গিয়ে অধ্যাপক সাহা বলেছেন, ‘স্হানীয় দারিদ্র্যকে পুঁজি করে দেশি-বিদেশি কায়েমি স্বার্থের আগ্রাসন বা কারসাজির সুযোগ না রেখে গরিব মানুষের জীবনযাপনে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে তাদের ভেতর থেকে বিভিন্ন অভ্যাসের বা কর্মকাণ্ডের গতিমুখ একার এবং সবার একত্রে বদলে দেওয়ার ওপর তাঁরা জোর দেন। আপাতদৃষ্টিতে হয়তো মনে হয়, তুচ্ছ কিন্তু দরিদ্র মানব সমুদয়ের চাওয়া-পাওয়ার জগৎটায় প্রায় অদৃশ্য পালা-বদলের এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া চালু করা হয়তো অসম্ভব থাকে না। বাস্তবে কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়। তারপরেও আশাবাদী হওয়ার মতো তথ্য-উপাত্ত তাঁরা তুলে ধরেন।’ তবে মজার ব্যাপার এই যে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরবার জন্য গবেষণালব্ধ ফলাফলের বাইরে ডুফলো-ব্যানার্জি মোটেই যাননি। এবাদে এই যুগল উন্নয়ন-অর্থনীতির প্রচলিত ধ্যান-ধারণার প্রয়োগ নিয়ে কথা বলেছেন। তবে তারা দারিদ্র্য হ্রাসের জন্য বিশ্বব্যাংক-অনুসৃত একান্তই সরবরাহমুখী নীতি ও কর্মসূচীর বিপরীতে দাঁড়িয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদামুখী কৌশলের ওপরেই জোরটা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সাহার প্রশংসার জায়গাটা এমন-- ‘অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এমনভাবে পরিচালনা করা যাতে গরিব মানুষ সার্বিক উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ফলপ্রসু কাজ পায়, নৈরাজ্য যেন  ঘোচে, পোড়া কপালের অজুহাত দিয়ে যেন হাত-পা গুটিয়ে না থাকে।’ তবে অধ্যাপক সাহা লক্ষ করেছেন, ডুফলো-ব্যানার্জি মূলত কর্মসৃজন ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির ওপরে জোর দিলেও তারা মূলত জ্ঞানপ্রযুক্তি ও সংগঠনের মাধ্যমে বহুমাত্রিক সরবরাহের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করেননি। এ কারণেই তাদের দৃষ্টিতে অপুষ্টি ও অশিক্ষা দূর করা এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন, বাজারব্যবস্থাকে সব রোগের নিদান বেলে মেনে না নিয়ে তারা বলছেন, অপুষ্টির চক্রাবর্ত থেকে দরিদ্র মানুষকে বের করবার জন্য প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ প্রয়োজনীয় নয় বলে যুক্তি খাড়া করা হলেও আমরা জানি, দীর্ঘমেয়াদে কিন্তু এমন বিনিয়োগের প্রতিদান ফেরত আসবে বহুগুণে; দরিদ্রঘরের সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষার ব্যায় বহন করতে পারবে রাষ্ট্র বা বিকেন্দ্রিত কোনও গণমুখী প্রতিষ্ঠান-- পরিণামে পরিবারের আয় বাড়বে; এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে পরিবার পরিকল্পনার উপকরণসমূহের সরবরাহের পাশাপাশি সেসব ব্যবহার করবার জন্য দরিদ্রদের সচেতনতা বৃদ্ধি করবারও প্রয়োজন রয়েছে। অপুষ্টির নিদানের বেলাতে অধ্যাপক সাহা লক্ষ করেন, এ ক্ষেত্রে গণস্বাস্থপ্রযত্ন কর্মসূচীর বাস্তবায়ন জরুরী এবং তার জন্য চাই সুচিন্তা, বিস্তার, সক্ষমতা ও দক্ষতা। শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের প্রসঙ্গে অধ্যাপক সাহা আমাদেরকে স্বরণ করিয়ে দেন, সাক্ষরতা ও পড়াশোনার সঙ্গে কর্মক্ষমতার ও পছন্দ-অপছন্দের পরিসর বিস্তৃত হবার একটি ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে, রয়েছে রোজগার বাড়বার সঙ্গেও। তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, পরিবার পরিকল্পনার উপকরণ কেবল দরিদ্র মানুষের কাছে সহজলোভ্য করাটাই শেষ কথা নয় কেননা মানুষের দারিদ্র্য বেশি সন্তান গ্রহণ করতে দরিদ্র মানুষদেরকে প্রলুদ্ধ করে থাকে। এ কারণেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে দারিদ্র্যকে সার্বিকভাবে মোকাবেলার পরামর্শই বেশি যৌক্তিক বলে মনে করে অধ্যাপক সাহা।

এবাদে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য যে প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন রয়েছে তা দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলেছেন ডুফলো-ব্যানার্জি। সামাজিক নিরাপত্তার জাল অতটা বিস্তৃত নয় বলে বাংলাদেশের মতো দেশে অতি দারিদ্র্য-ঝুঁকিতে থাকা মানুষজন ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো থেকে ঋণ গ্রহণ করছে। তারা দেখাচ্ছেন, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের ভোগব্যায় অ-ঋণগ্রহীতাদের তুলনায় বেড়েছে শতকরা বড়জোর দশ ভাগ বেশি। অধ্যাপক সাহা মন্তব্য করেছেন, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নেবার ফলে হতদরিদ্র পরিবারগুলোর প্রান্তিক উপকার নিশ্চয় ঘটছে তবে-- ‘... গ্রামীণ ব্যাংকের অনুকূলে তারা যে স্বাধীন উদ্যোক্তা হয়ে ওঠে, অথবা দারিদ্র্য-ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এসে সচ্ছলতার মুখ দেখে, এমন দাবির পক্ষে উল্লেখযোগ্য কোনো উদাহরণ মেলে না।’ আরেকটু এগিয়ে অধ্যাপক সাহা যুক্তি দেন, ‘গরিবরা শুধু টিকে থাকার জন্য যে আপন আপন বাস্তবতায় নানা কৌশলের আশ্রয় নেয়, এ থেকে তাদের স্বভাবজাত উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতিভা আছে বলে প্রচার যথার্থ নয়।’ গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচীর চাইতে ব্র্যাকের নির্দিষ্ট কর্মকাণ্ডভিত্তিক ঋণ সহযোগিতার কৌশল বেশি কার্যকর বলে ডুফলো-ব্যানার্জি যুক্তি দিয়েছেন। অধ্যাপক সাহার ভাষাতে-- ‘তাঁরা মনে করেন, গরিবদের জীবনযাপনের সঙ্গে মিলিয়ে তাদের কৃৎকৌশল ব্যবহারের উপযোগী লক্ষ্যবস্তু স্থির করে ঋণ সহযোগিতা বেশি কাজে আসে।’ অর্থাৎ ডুফলো-ব্যানার্জি ঋণ-প্রকল্পগুলোর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যকারিতার উপরে জোর দিয়েছেন।

দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ডুফলো-ব্যানার্জি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বের ব্যাপারটা স্বীকার করে নিচ্ছেন বটে, কিন্তু তারা প্রতিষ্ঠান গড়বার জন্য রাজনৈতিক পরিবর্তন বা কাঠামোগত রদবদলকে প্রয়োজনীয় শর্ত বলে মনে করছেন না। উদাহরণ হিসেবে তারা বলছেন, স্বৈরশাসনের সময়েও ইন্দোনেশিয়াতে স্কুলশিক্ষা ও সুস্বাস্থ্যনীতির সফল বাস্তবায়ন  হয়েছে। এ যুক্তি মানতে নারাজ অধ্যাপক সাহা কেননা প্রথমত, উন্নয়ন ও গণকল্যাণের বিষয়কে শতভাগে ভাগ করে বিচার করাটা ফলদায়ক নাও হতে পারে; এবং দ্বিতীয়ত, স্বৈরশাসন কোনও বিরোধিতা মানে না বলে আপাতদৃষ্টিতে এসব সামাজিক কর্মকাণ্ড চোখ ধাঁধিয়ে দিলেও, সফল বলে মনে হলেও, দীর্ঘমেয়াদে তা মানবকল্যাণ বয়ে না নিয়েও আসতে পারে।  ‍পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন এ সমস্যাটির প্রকৃষ্ট উদাহরণ বলে অধ্যাপক সাহা মনে করেন। এবাদে ডুফলো-ব্যানার্জির যুক্তির সাথে আরও ক’টা জায়গাতে দ্বিমত পোষণ করেছেন অধ্যাপক সাহা। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, অপুষ্টিজনিত অক্ষমতাই যদি কেবল মানুষের সক্ষমতার নিয়ামক হবে তবে ভারতবর্ষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা মেঘনাদ সাহা বা আব্দুল কালামের মতো প্রতিভার দেখা পেত না কখনও। তিনি আরও বলেন, শিক্ষার প্রসার অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি নিয়ামক-- এতে কোনও সন্দেহ নেই, তবে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা এবং সদ্‌-অর্থক শিক্ষানীতির প্রণয়ন ও দক্ষ বাস্তবায়নের কোনও বিকল্প নেই। ডুফলো-ব্যানার্জি দারিদ্র্য বিমোচনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে এনজিও-কে গুরুত্ব দিয়েছেন সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করেন অধ্যাপক সাহা। তার যুক্তিতে কোনও এনজিওর কর্মকাণ্ডের সাথে বিশ্বায়িত অর্থনীতির কোনও না কোনও ‘প্রতাপশালী কায়েমি স্বার্থ’-এর যোগ থাকতেই পারে! এছাড়া তিনি প্রশ্ন তুলেছেন-- ‘একটি উন্নয়নশীল দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের মতো অন্যান্য এনজিও-র অর্থায়নও কোথায় কীভাবে ঘটে সেটা হিসাবে নেওয়া কি শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও জরুরি নয়?’

অধ্যাপক সনৎকুমার সাহার চতুর্থ প্রবন্ধ আবর্তিত হয়েছে ড: মোস্তফা কামাল মুজেরী ও নিয়াজ মুজেরী বিরচিত বই Bangladesh at Fifty: Moving Beyond Development Traps-কে ঘিরে। বইটিতে এ দু’জন লেখক স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিবাচক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাকে চিহ্নিত করেছেন। পদ্ধতিগত নৈর্ব্যক্তিকতা নিয়েই কাজটা করেছেন তারা। এ কাজ করতে গিয়ে তারা অনুসরণ করেছেন অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের প্রচলিত কাঠামোটিকেই। অর্থনীতির ইতিবাচক রূপান্তরের পেছনে লেখকদ্বয় মোটা দাগে যেসব বিষয়ের অবদান খুঁজে পেয়েছেন তার একটি তালিকা তৈরি করেছেন অধ্যাপক সাহা। তালিকাটি নিম্নরূপ: নারীর ক্ষমতায়ন, তৈরি পোশাকশিল্পের উত্থান, রেমিটেন্স-আয় এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য। লেখকদ্বয় বলছেন, প্রথম তিনটি নিয়ামকের বেলাতেই এদেশের দরিদ্র ও নিম্ন-আয়ের নারীদের অবদানই মুখ্য হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সাহা মনে করেন, এমন চারটি কারণ হয়তো খুব একটা সুচিন্তিত ও সুনিয়ন্ত্রিত নীতির ফল নয়। গেল পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই চারটি নিয়ামকের ভূমিকা সম্পর্কে অধ্যাপক সাহা বলছেন, ‘প্রতিটি বাস্তবের মুখোমুখি মানব-মানবীর টিকে থাকার বিরতিহীন সংগ্রামই তাদের এভাবে পরিচালিত করেছে। জীবনের অনুশীলনে তাদের অন্তর্গত বিবেচনা-প্রতিভার কার্যকর বিকাশ  ও সংযোগ এখানে বলা যায়, ইতিবাচক ফল দিয়েছে। এই বই তারই এক নির্মোহ পাঠ।’ তবে এখানে নিজের ভিন্নমতও ব্যক্ত করেছেন অধ্যাপক সাহা। তিনি বলছেন, বাস্তব কখনও আমাদেরকে একমুখে ধাবিত করে না-- বাস্তব অজস্র সম্ভাবনার জন্ম দেয়। এমন একটি অনিশ্চিত অবস্হাতে যে বাংলাদেশের উন্নয়ন ইতিবাচক দিকে এগিয়েছে সেটাই তৃপ্তির, যথার্থও।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বেলাতে আমরা যে চারটি নিয়ামকের কথা ইতোমধ্যেই উল্লেখ করেছি, সেসব সম্পর্কে অধ্যাপক সাহার নিজস্ব মতামত আমাদেরকে চমৎকৃত করে। তিনি বলছেন, আজকের নারীর ক্ষমতায়নের পেছনে কেবল এনজিওদের ক্ষুদ্র ঋণের কারবারই নয়, আরও রয়েছে স্বাধীন দেশের সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগের নিঃশব্দ ভূমিকা। কাজেই বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী ক্ষুদ্রঋণের প্রসারই যে এখানে মূল ভূমিকা রেখেছে তা মোটেই বলা সঙ্গত হবে না। আমরা জানি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করবার পর রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির বাস্তবায়ন মুখ থুবড়ে পড়ে এবং তখন ‍বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে অর্থনৈতিক ব্যবস্হাপনায় মুখ্য হয়ে ওঠে তথাকথিত বাজার-অর্থনীতির দর্শন। এরই ধারাবাহিকতায় আশির দশকে এসে আমরা দেখি, দারিদ্র্য দূরীকরণের দাওয়াই হিসেবে ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসা ‘চর চর করে’ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সূত্রে অধ্যাপক সাহা প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মোশাররফ হোসেন পরিচালিত ছ’টি গ্রামভিত্তিক সমীক্ষার ফলাফল উল্লেখ্য করছেন। সেই আশির দশকেই পরিচালিত সমীক্ষাটি দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকার কোনও লক্ষণই খুঁজে পাননি অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন। এদিকে, ১৯৯৫-৯৬ সালে, অধ্যাপক খুরশিদ জাহান যে সমীক্ষা পরিচালনা করেছিলেন তা বলছে, যেসব এলাকাতে ক্ষুদ্রঋণ-প্রকল্প বেশি হারে বাস্তবায়িত হয়েছে সেখানেই খাদ্যপ্রাণের বিপুল ঘাটতি লক্ষণীয়। এখন প্রশ্ন এসে যাচ্ছে, গ্রামের দুস্থ নারীরা কেন বেশি হারে ক্ষুদ্রঋণ গহণ করেছেন। এর পেছনে অধ্যাপক সাহা গ্রামীণ পরিবারগুলোর সীমাহীন দারিদ্র্যকেই কারণ বলে মনে করেন। দ্বিতীয়ত, সাপ্তাহিক কিস্তিতে ঋণবাবদ সুদের অর্থ ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে নারীদের উপরে সহজেই জুলুম করা গেছে কেননা অধ্যাপক সাহা বলছেন-- ‘ঘরসংসার ফেলে নারীদের পালাবার পথ নেই, তাই তাদের ঋণের জালে বেঁধে রাখার কৌশল।’ সুদ-আদায়ের হার প্রায় শতকরা একশ ভাগে উঠে যাওয়াতে লাভ হয়েছে এটাই যে অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিনিয়োগের প্রত্যর্পণ সহজেই ফেরত পাবার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে। এভাবে অধ্যাপক সাহা মনে করেন, অনিচ্ছাতে হলেও এদেশের দরিদ্রঘরের নারীরাই টিকিয়ে রেখেছে ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসাকে। আমরা স্মরণ করতে পারব, দেশবিভাগের পরে কুমিল্লাতে এই ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছিল, আইয়ুব খানের জামানাতে। কাজেই ক্ষুদ্রঋণের কারবারের পেছনে স্বৈরতন্ত্রের গূঢ় উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের খুব একটা সন্দেহ থাকে না। একইভাবে তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিক হিসেবে ও মধ্যপ্রাচ্যে অনিয়মিত অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যাবার বেলাতেও আমরা গ্রামের দরিদ্র্যঘরের নারীদেরকেই এগিয়ে আসতে দেখছি। অধ্যাপক সাহা এ দু’টোর একটিতেও আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন না কেননা এসব শ্রমে নিজেকে নিয়োগের সিদ্ধান্তটি আসলে নারীদের প্রবল দারিদ্র্যেরই জ্বলজ্যান্ত প্রতিচ্ছবি ছাড়া আর কিছুই নয়। অধ্যাপক সাহা লক্ষ করছেন, ‘এখন আমাদের রপ্তানি আয়ের মূলস্তম্ভ একটি তৈরি পোশাক, অন্যটি বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমের অর্জিত আয় স্বদেশে প্রেরণ...এদের সিংহভাগ শ্রম দেয় অশিক্ষিত নারীরা...এই নারীরাই কিন্তু সস্তা শ্রম দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পোশাকের মান বাড়াচ্ছে। একই রকম মধ্যপ্রাচ্যে অস্হায়ী গৃহকর্মী হিসেবে কাজের মেয়াদ শেষে দেশে ফেরার ধারায় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এক নিয়মিত উৎস তৈরি। তারা শিক্ষিত হলে এসব কাজ করত না; উল্টো দিকে, বিবেচনাতেও আসত না।’ এখানে এসে অধ্যাপক সাহা তাই পরিতাপের সাথে আমাদেরকে বলেন, একটি দেশে শিক্ষার হার বাড়লে, বৈষয়িক উন্নতি হলে, নিশ্চয় আমরা দেখতে পেতাম যে বাংলাদেশের নারীরা উচ্চপর্যায়ের, উচ্চ দক্ষতার দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনের সাথে জড়িত হচ্ছে অথবা বিভিন্ন দেশে তারা দক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যাচ্ছে। কাজেই এই যে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে বলে আমরা দাবি করছি তার পেছনে দরিদ্র্যঘরের অশিক্ষিত নারীদের সৃজনশীলতাকেই মুখ্য বলে মনে করেন অধ্যাপক সাহা। এদিকে দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। এ ব্যাপারটিও নিশ্চয় দরিদ্র পরিবারগুলোর টিকে থাকবার সংগ্রামেরই পরিচায়ক। তবু এই ভাল যে কৃষি-উৎপাদনের ক্ষেত্রে উচ্চফলনশীল ধানের বৈচিত্র্য এসেছে! অধ্যাপক সাহা বলছেন, নিঃসন্দেহে গেল পঞ্চাশ বছরে এটি বাংলাদেশের মুখ্য অর্জনগুলোর ভেতরে অন্যতম বলে বিবেচিত হতেই পারে। অধ্যাপক সাহা এ-ও লক্ষ করছেন, এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যালয়গুলোতে ঝরে পড়ছে শিশুরা। প্রশ্ন উঠতেই পারে, তবে কোন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করছে তারা? নাকি বেকারই থেকে যাচ্ছে? এখানে আমাদেরকে আশ্চর্য হতে হয় কেননা আমরা দেখছি, এসব বালক-বালিকারা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিভিন্ন  কর্মকাণ্ডে নিজেদের পথ খুঁজে নিচ্ছে। এটাকেও বিবিধ প্রতিকুলতার সাথে দরিদ্র-পরিবারগুলোর টিকে থাকবার সংগ্রামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন বলেই মনে করেন অধ্যাপক সাহা। কাজেই অধ্যাপক সাহার সুরে আমাদেরকে উপসংহার টানতে হয়, আজকে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পেছনে কেবল সরকারি নীতি ও কৌশল বা বিশ্বব্যাংকের পরামর্শই সবটুকু নয়, দরিদ্র মানুষদের সৃষ্টিশীলতারও জোরদার ভূমিকা রয়েছে। এভাবেই গেল পঞ্চাশ বছরে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ যা প্রত্যক্ষ করে এবার গরিমা নিয়েই অধ্যাপক সাহা বলেন, ‘আমরা সমৃদ্ধ হচ্ছি, এ কথা ডেকে ডেকে সবাইকে বলতে ইচ্ছে করে।’

‘নারীর অর্থনীতি, অর্থনীতির নারী’ শীর্ষক প্রবন্ধে অধ্যাপক সনৎকুমার সাহা সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নারীর অবস্হান এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর ভূমিকাকে উন্মোচন করেছেন। আমরা জানি, পুরুষশাসিত এ সমাজব্যবস্হাতে নারী মূল্যহীন, তারা শোষণের শিকার, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের অবদান দুঃখজনকভাবে স্বীকৃতিশূন্য। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক সাহা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এশিয়া, আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে সংসার সামলাবার পাশাপাশি এই নারীরাই খরপোষের কৃষি-উৎপাদন ও কুটিরশিল্পে অংশ নিয়েছে, পুরুষশাসিত সামাজে নিগড়ের মাঝেই। পরিবারের আয়-উন্নতি বাড়াবার জন্যই তারা এত সব ভার বহন করেছে, মাঝখান থেকে সচল হয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা। কিন্তু এটি দুঃখজনক যে তারা ঘরে বা বাইরে স্বাধীনভাবে নিজেদের ইচ্ছে প্রকাশ করতে পারেনি, তারা বাজার-ব্যবস্থাতে তাদের শ্রম নিয়োজন বাবদ প্রকৃত হিস্যাও বুঝে পায়নি কখনও, তারা অর্থনীতিতে যতটুকু অবদান রেখেছে তা মোট দেশজ উৎপাদনের হিসেব-নিকেষে স্বীকৃতিও পায়নি। অধ্যাপক সাহা এ-ও লক্ষ করেছেন, ‘সেসবে যথার্থ দাম না মিললেও সাংসারিক কল্যাণের সম্ভাবনার কথা ভেবে ওই তারা বেশির ভাগ মেনে নেয়। এবং ওই কল্যাণের কথা ভেবেই আজকের বাস্তবতায় অনেক সময় তারা নিজেরাও অন্দরমহল পেরিয়ে বাইরে পা রাখার ঝুঁকি নেয়।’ আমরা মনে করতে পারব, ঘর থেকে বৃহৎ জগতে বেরিয়ে পড়া এই নারীরাই একদা বিভিন্ন উপনিবেশে ভাগ্য গড়তে গেছে, বাসাবাড়িতে সহায়কের ভূমিকাতে অবতীর্ণ হয়েছে এরাই, এই নারীরাই এখন ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণ করে সংসারের ভাগ্য পরিবর্তন করবার চেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে, তারাই তৈরি পোশাকশিল্পে তাদের নিজেদের সস্তা শ্রম বিক্রি করেছে, অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কাজও করতে যাচ্ছে। অধ্যাপক সাহা যুক্তি দিচ্ছেন, এসবই একজন নারী করেছে নানান প্রতিকূলতার ভেতরে টিকে থাকবার কৌশল হিসেবেই। এই নারীকে পৃথক কোনও সত্তা হিসেবে না দেখে তাকে সামাজের সমগ্রতাতে বসিয়েছেন অধ্যাপক সাহা যেখানে মানব ও মানবীর মাঝে কেবল পারস্পরিক দ্বন্দ্বই নয় সেখানে সহযোগিতার ক্ষেত্রও খোলা থাকে। তাই অধ্যাপক সাহা মন্তব্য করছেন, ‘মানব-মানবীর পরিচয় যদি অতীতে আরোপিত বিশ্বাসের ও প্রথাযুগ জীবনযাত্রার মান থেকে মুক্তি পায় ও তাদের পছন্দ-অপছন্দ শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থতাড়িত না হয়ে পরিপার্শ্বের ভালো-মন্দ বিচারেও প্রসারিত হয় তবেই হয়তো নারীর সক্ষমতা ও কল্যাণের অনাবিল স্বপ্ন কোনো উজ্জ্বল পথ অনুসরণ করতে পারে।’ অধ্যাপক সাহা এ-ও লক্ষ করছেন, মার্কস বা এঙ্গেলসের তাত্ত্বিক কাঠামোতে নারীর অবদানকে গুরুত্বের সাথে স্বীকার করা হয়নি কেননা তারা মনে করেছেন, নারী বা শিশুশ্রম শেষপর্যন্ত পুরুষের মজুরিকে টেনে নিচে নামিয়ে ফেলতে পারে। সে যাইই হোক, তবে এদিক থেকে প্রচলিত বাজার-ব্যবস্থাই বরং সুফল বয়ে নিয়ে আসতে পারে যেখানে সমাজে পিছিয়ে পড়া, বঞ্চিত অংশ হিসেবে নারীকে আলাদা করে মর্যাদা দেয়া সম্ভব। সমাজের নারীর অবস্থান ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তার ভূমিকা বিষয়ক এই ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে অধ্যাপক সাহা আলোচ্য প্রবন্ধে স্বস্তি মিত্র ও শীলা রোবোথামের দু’টো বই এবং আবহার রুখ হোসেনের একটি বইয়ের উপরে আলোচনা করেছেন। স্বস্তি মিত্র ও শীলা রোবোথামের কাজে আমরা তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর আন্তর্জাতিক শ্রমবিভাজনের পরিচয় পাচ্ছি যেখানে পৃথিবীর যে কোনও কোণে বসে নারীরাও ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোন উৎপাদনের মতো কোনও পুরো প্রক্রিয়ার খণ্ডাংশে নিজেদেরকে নিয়োজিত করতে পারছে। অধ্যাপক সাহা মন্তব্য করেছেন, ‘শ্রম বিভাজনের নতুন মানচিত্রে উন্নত-অনুন্নত সব দেশেরই নারী শ্রমিকদের ভাগ্য এক সূত্রে গাঁথা হতে থাকে।’ এসব ঠিকেদারি-আধাঠিকেদারি উৎপাদন পদ্ধতি লিঙ্গনিরপেক্ষ বলে এখানে নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেবার বেলাতে অন্তত সাম্যের একটি জায়গা তৈরি হয়েছে যায়-- আর যাইই হোক, নারী বলে সমাজে তাকে কেউ প্রভেদ করতে যাচ্ছে না-- উৎপাদনের নির্দিষ্ট খণ্ডাংশটি কেবল সমাধা করলেই হলো। তবে এখানেও নারীর অধিকার সমুন্নত রাখবার জরুরি প্রশ্নটা এসেই পড়ে বলে অধ্যাপক সাহা মনে করেন। আমরা জানি, সনাতন বাজারব্যবস্থাতে কলকারখানাগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উৎপাদন-প্রক্রিয়াতে নিয়োজিত কর্মীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ট্রেড ইউনিয়নের ভূমিকা রয়েই যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, অধ্যাপক সাহা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসে নারীরা যখন কোনও সামগ্রীর খণ্ডাংশ তৈরির কাজ করছে তখন সেই সাইবার স্পেস বা দূরবর্তী কোনও স্হানে বসে নিজের অধিকার সমুন্নত রাখা বা আদায় করে নেবার মতো কোনও সুযোগ নারীদের বেলাতে আর থাকছে না। এতে করে সমস্যা যেটা হতে পারে, খণ্ডাংশের উৎপাদনকারী নারীদেরকে সামগ্রীর মূল উৎপাদক খুবই অল্প দামে চুক্তিতে নিয়োগ করতে পারছে। এর কারণ একটাই-- আন্তর্জাতিক শ্রমবিভাজনের প্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট কোনও কলকারখানার বাস্তব পরিধির বাইরে কোনও ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও পরিচালনা করবার আর প্রয়োজনীয়তা থাকছে না। আর তা’তে করে বাজারে মজুরির পরিমাণ ও বিবিধ অধিকার আদায়ের জন্য নারীর দরকষাকষি করবার সুযোগ হয় কমে যাচ্ছে বা পুরোপুরিই অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছে। এটুকু আশঙ্কার কথা যদি বাদ দেই তবে আমরা দেখছি, অধ্যাপক সাহা তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর এই আন্তর্জাতিক শ্রমবিভাজনে শ্রম নিয়োজন করবার ক্ষেত্রে নারীর পছন্দ-অপছন্দ করবার স্বাধীনতাকে সাধুবাদই জানিয়েছেন। তার ভাষ্যে আমরা জানছি, ‘নতুন প্রযুক্তি যে বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগের বিবিধ সম্ভাবনার বাস্তবায়ন ঘটাচ্ছে, তাতে আশঙ্কার দিক যা-ই থাক, অদক্ষ নারী শ্রমিকরা কোনো প্রতিরক্ষা বিধি চালু থাকার অভাবে যত ঝুঁকিতেই পড়ুক, কাজ বাছার ও রোজগারের বিকল্প একাধিক সুযোগ তাদের সামনে খুলে যাচ্ছে।’ তিনি আবারও বলছেন, জনসংখ্যার চাপ ও সংসারের নানান দায়-দায়িত্ব বা অভাব-অভিযোগ মেটাবার তাগিদই নারীদেরকে আজ ঘরের বার করে দিয়েছে। এটা তার দারিদ্র্যপীড়িত সংসার নিয়ে ক্রুর পৃথিবীতে টিকে থাকবার সৃজনশীল একটা কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়।

এদিকে আবহার রুখ হোসেনের গ্রন্থে উঠে এসেছে মধ্যপ্রাচ্যে অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে অনিয়মিতভাবে কাজ করতে যাওয়া বাংলাদেশি নারীদের সংগ্রামের কিছু গল্প। লেখক লক্ষ করছেন, দারিদ্র্যের কষাঘাতে আজ সংসারের প্রান্তিক অবস্থাতে নেমে গেছে নারীর ভূমিকা যে কারণে তাকে ঘর থেকে বেরিয়ে কাজের জন্য ছুটতে হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। অধ্যাপক সাহা দেখছেন, দেশ ছেড়ে নারীদের এই দূরদেশে চলে যাবার পেছনে সমাজের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয় রয়েছে বটে, আবার নিরুপায় সম্মতিও রয়েছে অন্যত্র। তথ্য-উপাত্ত বলেছে, চুক্তিভিত্তিক গৃহপরিচারিকার মতো অদক্ষ কাজের ক্ষেত্রে বরং নানান রকমের পেশানির্ভর ঝুঁকি রয়েছে, শারিরীক নির্যাতন পর্যন্ত। দ্বিতীয়ত, অধ্যাপক সাহা লক্ষ করছেন, এসব ঝুঁকির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে নারীরা তাদের পরিবারে যে রেমিটেন্স-আয় পাঠাচ্ছে তার জন্য কিন্তু তাদের ওপর থেকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কর্তৃত্বটুকু একেবারেই অপসৃত হচ্ছে না! সেদিক থেকে আমাদের কাছে এসব কর্মীনারীকে অর্থ রোজগারের একটি যন্ত্র বলেই মনে হয়। আরেকটা কথা এখানে বলবার আছে-- এই যে তারা তাদের শ্রমের বিপরীতে মজুরি পাচ্ছে তা কতটুকু বাজারের সূত্রকে মেনে চলছে? মজুরির পরিমাণের সাথে কি মুদ্রাস্ফীতির বিরূপ প্রতিক্রিয়া সংযুক্ত? কে নির্ধারণ করে দিচ্ছে এই মজুরির পরিমাণ? অবশ্য এসব ভবিষ্যত-গবেষণার বিষয় হয়েই থাকবে। আপাতত আমরা কেবল নারীর অদম্য সংগ্রামের গুণগানটুকুই গাইতে পারি।

অধ্যাপক সনৎকুমার সাহার পরের দু’টো প্রবন্ধের শিরোনাম ‘এইসময়ে কার্ল মার্কস’ ও ‘এবং এঙ্গেলস’। কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫)-এর তত্ত্বকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে এ দু’টো প্রবন্ধ। মার্কসের তত্ত্বের ওপরে নির্ভর করে এঙ্গেলস দর্শন, রাজনৈতিক অর্থনীতি, সমাজতন্ত্র, পরিবার, ব্যক্তিসম্পদ ও রাষ্ট্রের চেহারা বিষয়ক বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। আমারা জানি, এ দু’জনেই ছিলেন দার্শনিক হেগেল (১৭৭০-১৮৩১)-এর অনুসারী। হেগেলের তত্ত্বের দ্বান্দ্বিক চৈতন্যবাদের ধারণার ওপরে রঙ চড়িয়েছিলেন তারা। হেগেল তার দ্বান্দ্বিক চৈতন্যবাদে দেখিয়ে ছিলেন যে বস্তুতেই সুপ্ত অবস্থায় যে চৈতন্য থাকে তাকে অবলম্বন করে চেতনা উর্দ্বমুখী হতে চায়। দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় এখানেই। নেতির সূত্রে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াতে বস্তুর সম্ভাবনা বিকশিত হতে হতে এক সময়ে পূর্ণতা পায় এবং চেতনার বিকাশ পৌঁছে যায় শীর্ষবিন্দুতে। এভাবেই অবসান ঘটে এই দ্বন্দ্বের। হেগেলীয় চৈতন্যবাদের ওপরে ভিত্তি করেই মার্কস ও এঙ্গেলস তাদের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের তত্ত্ব হাজির করেছিলেন যা বিস্তৃত হয়েছে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ভেতরে দ্বন্দ্ব নিরসনের মধ্য দিয়ে: দ্বন্দ্বটা শুরু হয় শ্রমিকশ্রেণীর ও পুঁজিপতির মাঝে, দ্বন্দ্ব পূর্ণতা পায়, শ্রমিকশ্রেণীর স্বরাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নিরসন ঘটে এই দ্বন্দ্বের। তারা তাদের এই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ মানবসভ্যতার ঐতিহাসিক বিকাশের ধারার ব্যাখ্যাতেও কাজে লাগিয়েছেন যেটাকে আমরা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ নামে চিনি। অধ্যাপক সাহা মার্কসের দ্বান্দ্বিক তত্ত্বটিকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে-- ‘...প্রত্যয়ভূমিতে অগ্রাধিকার মানব শ্রমের। শ্রমের প্রয়োগ সিদ্ধির বিবিধ প্রক্রিয়া থেকে চেতনার উন্মেষ। শ্রম ও চেতনার সংযোগের পরিণামে মানুষের উৎপাদন ক্রিয়ার সূচনা, যা প্রাকউৎপাদন পর্বের প্রকৃতির ওপর পূর্ণ নির্ভরতা থেকে ধারাবাহিক মুক্তি দিয়ে চলে। এখানেই কিন্তু দ্বন্দ্বের শুরু। উৎপাদনে প্রকৃতির অবদান স্থির। অতএব তার মূল্যের বাকি অংশ সবটাই শ্রম-প্রসূত। এর উপর প্রভুত্ব খাটাতে সমাজে দেখা দেয় দ্বান্দ্বিক বিভাজন।’ মার্কসের এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী আদিম সাম্যবাদী সমাজে এমন কোনও দ্বন্দ্ব ছিল না, দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটেছে শ্রেণীবিভাজিত সামাজব্যবস্হায়-- দাসপ্রথায় মালিক ও দাসের ভেতরে, সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ভূস্বামী ও রায়তদের ভেতরে, পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতি ও শ্রমিকদের ভেতরে। মার্কস মনে করেছেন, সর্বাত্বক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে পুঁজিপতি ও শ্রমিকদের মাঝের দ্বন্দ্বের নিরসন ঘটবে, তার পরে পুঁজিবাদের কঙ্কালের ওপরে দাঁড়িয়ে উদ্ভব ঘটবে সমাজতন্ত্রের এবং সমাজতন্ত্রের বিকাশের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি ঘটবে। অর্থাৎ, মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সমাজের বিকাশের ক্ষেত্রে আমাদেরকে একটি ঐতিহাসিক নির্দিষ্টতা দিচ্ছে। শ্রম থেকেই যেহেতু উদ্বৃত্তমূল্যের সৃষ্টি হচ্ছে কাজেই শ্রমিকশ্রেণীর চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমেই কলকারখানার মালিক ও শ্রমিকের ভেতরের দ্বন্দ্ব নিরসিত হবে বলে মার্কস সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। অধ্যপক সাহার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এখানেই হেগেলের দ্বান্দ্বিক চৈতন্যবাদ ও মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মাঝে পার্থক্য সূচিত হয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি, এই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রেক্ষিতে কোনও রকমে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকার মজুরি দিয়ে জীবন চালানো শ্রমিকদের শ্রেণীসংগ্রামকে তীব্রতর করাকে পথ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মার্কস ও এঙ্গেলস। এ জন্যই ১৮৮৪ সালে তাদের বিখ্যাত কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর ঘোষণা দিয়েছিলেন তারা।

এতক্ষণ পর্যন্ত মার্কস ও এঙ্গেলসের তাত্ত্বিক কাঠামো নিয়ে যে আলোচনা আমরা করলাম অধ্যাপক সাহা সেখানেই থেমে থাকেননি। তাদের তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগের ওপরেও তিনি আলোকপাত করেছেন যেখানে আমরা দেখছি, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের তত্ত্ব কার্যত সমাজ বদলের বেলাতে পুরোপুরি নির্দিষ্টতা দেয়নি। বরংচ দেখা যাচ্ছে, পুঁজিবাদী বিশ্বে সময়ে সময়ে তার অন্তর্গত দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ ও কৌশল প্রয়োগে নানান অভিযোজন ও সমন্বয় করে নিয়েছে, ছাড়ও দিয়েছে। উদাহারণ হিসেবে অধ্যাপক সাহা দেখিয়েছেন, কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো ঘোষিত হবার আগ দিয়ে যুক্তরাজ্যে ঘটে যাওয়া চার্টিস্ট আন্দোলনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার পরেও রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে ভোটে জিততে পারেনি শ্রমিকরা, তাদের অধিকার আদায় করা যায়নি; কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো ঘোষিত হবার পর দিয়ে ফ্রান্সের লুই বোনাপার্টের স্বৈরশাসন সূচিত হয়েছে; এদিকে জার্মানির একীভূতকরণ বা ইতালির গণতান্ত্রিক আন্দোলন বা ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সময়ে ঐতিহাসিক নির্দিষ্টতার প্রেক্ষিতে শ্রমিকশ্রেণীর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত না হয়ে বরং ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাই জোরদার হয়েছে। অধ্যাপক সাহা এ-ও দেখান যে জার্মানির সোসাল ডেমোক্রেসি বা ব্রিটেনের লেবার পার্টির যে বিকাশ ঘটেছে তা কিন্তু ঘটেছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর ওপরেই নির্ভর করে-- শ্রেণীসংগ্রামের ওপরে ভিত্তি করে নয়। এমনকি ঔপনিবেশিক যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে স্বাধীনতা-সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল তার পরিণতি ইতিহাস-নির্দিষ্ট পথে সমাজতন্ত্রে পর্যবসিত হয়নি, জাপানের শিল্পখাত-নির্ভর উত্থানের পরেও সেখানে সমাজতন্ত্রের দেখা মেলেনি। দ্বিতীয়ত, নানান অভিযোজনের মাঝ দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও গণচীনে যে সমাজতান্ত্রিক নীতির বাস্তবায়ন ঘটেছে সেখানেও খুব একটা ভরসার জায়গা দেখেননি অধ্যাপক সাহা। ভরসা না পাবার সপক্ষে তিনি বলছেন, ‘...সফল সামাজতান্ত্রিক বিপ্লব বাস্তবে ঘটলেও প্রত্যাশায় ঐক্য বিধান একটা সমস্যাই থেকে যায়। এখানে সামাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় অধিকাংশ বা সব কার্যনির্বাহী সদস্যের অনুমোদন সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটা প্রক্রিয়া অবশ্যই। কিন্তু সেইটিই যে যথার্থ এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সর্বহারাদের একনায়কত্ব শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণকেই দীর্ঘকাল প্রশ্রয় দিয়ে চলতে পারে। তাতে বৈষম্যের অবসান বা জনগণের প্রকৃত কল্যাণের সার্থকতা, কোনোটিই ঘটা প্রশ্নের মুখে দাঁড়ায়। ফ্যাসিবাদের সঙ্গে এর তফাত এইখানে যে সামাজতন্ত্রে কল্যাণ বিচ্যুতি ঘটতে পারে শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্যে নেতৃত্বের দোহাই দিয়ে ...।’ তৃতীয়ত, মার্কস যুক্তি দিয়েছেন যে শ্রেণীহীন সমাজে উৎপাদনের পরে সমবন্টনের নীতি অনুসরণ করা হবে-- একজন ব্যক্তি উৎপাদন থেকে যতটুকুই অংশ নিক না কেন সে তার প্রয়োজন অনুযায়ী বন্টনের অংশ পাবে। এখানেই বন্টন-ব্যবস্থার মার্কসীয় প্রস্তাবটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অধ্যাপক সাহা, ‘.... প্রত্যেকের উৎপাদনশীলতার ধরন, কর্মদক্ষতা ও নানাভাবে সামাজিক দায়-- এসবই বন্টন ব্যবস্থায় সমভাবে বিবেচনার যোগ্য।’ তিনি স্বীকার করে নেন, বন্টনের ক্ষেত্রে ব্যক্তির অবদান তো বটেই, ব্যক্তির প্রয়োজনকেও আমলে নেয়াটা যুক্তিযুক্ত। চতুর্থত, অধ্যাপক সাহা বলছেন, নীতির ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো নিরন্তর অভিযোজন অনুসরণ করে চলেছে, যেমন, মেধা ও কর্ম-- উভয়ের বিকাশে নানান উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে যাতে করে হতদরিদ্র মানুষ ও দারিদ্র্যরেখার নিচে পড়ে যাবার ঝুঁকিতে থাকা মানুষজনও কোনও রকমে খেয়েপড়ে টিকে থাকতে পারে। অধ্যাপক সাহা লক্ষ করছেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এসব অভিযোজনের মুখে কিন্তু কোথাও শ্রমিকদের শ্রেণীসংগ্রাম পূর্ণতা পায়নি! পঞ্চমত, অধ্যপক সাহা এ-ও লক্ষ করছেন, পুঁজি সংহতির কালে মার্কস ও এঙ্গেলস দু’জনই নারী ও শিশুশ্রমকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেননি কেননা তারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মূল্যবোধের প্রেক্ষিতেই মনে করেছেন যে নারী ও শিশুদের বাজারসঙ্গত মজুরি অনুসরণ উল্টো পুরুষ শ্রমিকদের মজুরিকে টেনে নিচে নামিয়ে দিতে পারে।  ষষ্ঠত, অধ্যাপক সাহার আরেকটি সমালোচনার জায়গা এই যে মার্কসের সূত্র এবং ভবিষ্যদ্বাণীর ভিত্তি হলো গিয়ে ইউরোপের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাকেন্দ্রিক। কিন্তু এশিয় দেশগুলোর বাস্তবতা যে আলাদা মনোযোগ দাবি করে তা এতে পরিস্কার হয় না। সপ্তমত, অধ্যাপক সাহা বলছেন, মার্কসের ও এঙ্গেলসের দ্বান্দ্বিকতা বাইনারি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে-- হয় এটা, নয়তো ওটা। তার মতে, বাস্তবতা এমন সরল নয়-- শূন্য ও একের মাঝে সেখানে অজস্র সম্ভাবনার প্রাচুর্য্য রয়েই যায়। কাজেই এ তত্ত্বকে অতি সরল বলতেই হচ্ছে। অধ্যাপক সাহা তাই মন্তব্য করেছেন, ‘এখানে বহুর মিলন-সমন্বয় ঘটে চলে’। মার্কস ও এঙ্গেলসের দ্বান্দিকতার সূত্রের এই সীমাবদ্ধতাটি সম্পর্কে অধ্যাপক সাহা মন্তব্য করেছেন, সম্ভবত ‘তারা এরিস্টটলীয় বিভাজন পদ্ধতিতেই আটকে ছিলেন। কার্টেসীয় ... গানিতিক বিন্যাসেও যদি নজর দিতেন, তবে বহুমাত্রিক বহুমুখী সম্পর্ক-সমন্ধে সামঞ্জস্য-অসামঞ্জস্যের সম্ভাবনা ও সমস্থিতির প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার কথা ভাবতে পারতেন। আজ অবশ্য ক্ষেত্রতত্ত্ব আরও জটিল মিশ্র বাস্তবতায় সমস্থিতি বা গতিময়তার বিচার-বিশ্লেষণের পথ খুঁজতে পারে। এখানে বলবার শুধু এইটুকু, তাঁদের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ভিত্তি যথেষ্ট সবল নয়। অর্থবহ হলেও তাতে, অর্থসিদ্ধি ঘটে না।’

মার্কস ও এঙ্গেলসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অবশ্যম্ভাবিতার সূত্রগুলোর সঙ্গত সমালোচনাই করেছেন অধ্যাপক সাহা। এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। তিনি লক্ষ করেছেন,  সোভিয়েত ইউনিয়ন ও গণচীনের প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াতে কাজ করেছে মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সূত্র-- পূর্ব ইউরোপ, কিউবা, ভিয়েতনাম ও উত্তর কোরিয়ার মতো অন্যান্য দেশে তা অসাম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের জাগরণকে নির্মোহভাবে ভরসা দিয়েছে, শক্তি জুগিয়েছে। অধ্যাপক সাহা তাই বলছেন, ‘রাশিয়া ও চীন গোটা পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রের উদাহরণ হয়ে ওঠে। এই আশা দিক-দিগন্তরে ছড়ায়, মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের যৌক্তিক পরিণাম শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা অদূর ভাবিষ্যতে সর্বত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। জনগণের নিঃশর্ত মুক্তি ঘটবে। এবং তা এই পার্থিব জগতেই। মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ অবলুপ্ত হবে। মর্ত্য বাস্তবই জীবনের প্রথম ও শেষ আশ্রয়। এবং সেখানে শোষণহীন সমাজ বাস্তবতায় সব মানুষই এক মানুষ। চৈতন্যের পূর্ণতা এই বাস্তবতার প্রতিষ্ঠাতে।’ অধ্যাপক সাহা এ প্রেক্ষিতে লক্ষ করেছেন, একমাত্র উত্তর কোরিয়া ছাড়া আর কোথাও মার্কসের দ্বান্দ্বিক সূত্রগুলো আর টিকে নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে; গণচীনে কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণের ভেতরেই উৎপাদন ও বন্টনের বাজারব্যবস্হা ও ব্যক্তিপুঁজির সংহতকরণের সুবিধে দেয়া হয়েছে, সেখানে তীব্রতরও হচ্ছে আয়-বৈষম্য। এতে করে সন্দেহ জাগে যে সমাজবাদী ব্যবস্থার মানবসূচকগুলো আসলে কতটুকু কার্যকর। সময়ের সাথে বাস্তবতাও বদলে যাচ্ছে-- পেনিসিলিনের আবিষ্কার মানুষের গড় আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তি ভেঙে দিয়েছে শ্রমনিয়োজনের ঘর-বাহির। এ থেকে হতাশ হননি অধ্যাপক সাহা। নিশ্চয় তিনি আশাবাদী হয়েছেন-- একদিন সাম্য ও সমতাভিত্তিক পৃথিবী তৈরী হবে, তখন হয়ত উৎপাদন ও বন্টনে পূর্ণ অধিকার পাবে প্রকৃত উৎপাদক, তখন হয়ত মার্কস নির্দেশিত ঐতিহাসিক পথেই এগুবে পৃথিবী। তাই পরিশেষে অধ্যাপক সাহা বলছেন, ‘মার্কসকে প্রণাম জানিয়ে তাঁকে অতিক্রম করে তাই সামনে যাত্রাপথের নিশানা।’ আসলে শেষ বলে তো কিছু নেই কেননা ভবিষ্যৎ তো এক জায়গাতে আটকে থাকে না আর দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ তো বলেই যে নির্দিষ্ট একটি বাস্তবতায় দ্বন্দ্ব নিরসিত হলেও সেখানে দেখা দিতে পারে নতুন নতুন দ্বন্দ্ব কেননা আমরা জানি, দ্বন্দ্ব একটি গতিময় প্রক্রিয়া। আশাবাদী হয়ে অধ্যাপক সাহা এ-ও বলছেন, ‘বাস্তব অনিবার্যত পরিবর্তনশীল। কোনো এক কালখণ্ডে যদি কেউ তাদের অবদানে মানব যাত্রায় মুল্য সংযোজন করেন এবং তার রেশ যদি থেকে যায় আরও কিছু দূর-- তবে তাতেই তাঁরা সার্থকতার ভাবমূর্তি রেখে যেতে পারেন। ভবিষ্যতের প্রেরণাও। যদিও ভিবিষ্যৎও অনিবার্যত পরিবর্তনশীল। কালের চলমানতার অপেক্ষিকতায় একই বিন্দুতে স্থির থাকা সম্ভব।’

এই বইয়ের শেষ প্রবন্ধ ‘অর্থনীতিবিদ মুশাররফ হোসেন তাঁর কাজ ও একটি আক্ষেপ’-এ অধ্যাপক সনৎকুমার সাহা তাঁর প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন (১৯৩০-২০১৩)-এর প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছেন। আমরা জানি, অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন তার পেশাগত জীবনের প্রথম দিকে ‘পাকিস্তান ট্যাক্সেশন ইনক্যুয়ারি কমিশন’-এর সদস্য পদে কাজ করেছেন। তিনি রাজাশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকতার কাজেও নিয়োজিত ছিলেন। আমরা আরও জানি, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পেছনে তাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করবার কাজে ওৎপ্রতভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। শুধু তাইই নয়-- মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের অন্যতম এক জন সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন অধ্যাপক হোসেন। সেখানে তাঁরই নেতৃত্বে একদা কাজ করেছেন অধ্যাপক সাহা। এ কাজেরই ধারবাহিকতায় আমরা দেখি, দেশ স্বাধীন হবার পরে বঙ্গুবন্ধুর ডাকে অধ্যাপক হোসেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন এবং সেই সময়ে যে যুগান্তকারী প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণীত হয় তা’তে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। অধ্যাপক হোসেনের পড়াশোনা, গবেষণা ও চর্চার পরিধির নিরিখে আমরা দেখি, তার বিশেষায়ণ দু’টো ক্ষেত্রকে ঘিরে-- রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি এবং দারিদ্র-বিশ্লেষণ। রাষ্টীয় অর্থনীতিতে তার বিশেষায়নের উদাহরণ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দলিলে ইতোমধ্যেই প্রত্যক্ষ করেছি।

অধ্যাপক হোসেন বাংলাদেশের দারিদ্র-পরিস্থিতি বিশ্লেষণে যে ভূমিকা রেখেছিলেন বর্তমান প্রবন্ধে তা তুলে ধরেছেন অধ্যাপক সাহা। প্রথমেই আমরা দেখি, ষাটের দশকের গোড়ার দিকে অধ্যাপক হোসেনের উদ্যোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে উঠেছিল ‘সোসিও ইকোনমিক সার্ভে বোর্ড’। রাজশাহীর পুঠিয়ার গ্রামগুলোতে তখন অধ্যাপক হোসেন গ্রামীণ জীবনের নানান বিষয় নিয়ে এক বছর ধরে প্রশ্নমালাভিত্তিক তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করেছিলেন। এ কাজের জন্য যে গবেষণা-পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন অধ্যাপক হোসেন তাতে অধ্যাপক সাহা নৈর্ব্যক্তিকতাই লক্ষ করেছেন। অধ্যাপক হোসেনের গবেষণার ফলাফল নিয়েই ‘স্যোসিও ইকোনমিক সার্ভে বোর্ড’ থেকে ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তার বই The Pattern  of a Peasant Economy: Puthia, A Case Study। এই বইটি বাংলাদেশের গ্রামসমীক্ষার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তরকারী বই হিসেবে সমাদৃত হয়ে আসছে। আমরা দেখেছি, স্বাধীনতা-উত্তর কালে বাংলাদেশে গ্রামসমীক্ষার ব্যাপারে অনেক গবেষককেই উৎসাহিত করেছে এই সমীক্ষাটি। অধ্যাপক সাহা জানাচ্ছেন, এরপরেও অধ্যাপক হোসেনের কাছ থেকে আমরা গ্রামসমীক্ষার আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ পেয়েছি। আমরা জানি, ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের পরে অধ্যাপক হোসেন অক্সফোর্ডে চলে যান। ১৯৭৯ সালে দেশে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন তিনি। তখন অনেকগুলো গ্রাম নিয়ে সমীক্ষা পরিচালনা করেছিলেন তিনি। আমরা এ-ও জানি, ১৯৭৫ সালের পরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির বাস্তবায়ন রুদ্ধ হয়ে যায় এবং তখন মুখ্য হয়ে ওঠে বেসরকারি খাতের প্রাধান্য। এমন উল্লম্ফনের নীতির বাস্তবায়ন মানুষের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির ওপরে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে তা দেখাই ছিল এ সমীক্ষার উদ্দেশ্য। তখনকার বাস্তবতার পেছনের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো আমাদের জানা-- ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিতে বঙ্গবন্ধু-সূচিত রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগকে আর উৎসাহ দেয়া হয়নি, সেখানে মুখ্য হয়ে উঠেছে বেসরকারি বিনিয়োগের ধারণা। অধ্যাপক সাহা লক্ষ করছেন, ‘সরকার হাত গুটিয়ে নিলে গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নতুন করে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। একে বলা হয় ‘Structural Adjustment’ বা কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস। জোর পড়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে উৎসাহ দেওয়ার ওপর। সরকারি দায়-দায়িত্ব লাটে ওঠে...মুশাররফ হোসেনের কাছে কিন্তু মনে হয় গোটা ব্যাপারটার আড়ালে কাজ করে একটা হাত সাফাইয়ের খেলা। অনুন্নত দেশগুলোয় এর ফলে চালাক-চতুর-ফড়ে-মুৎসুদ্দি বাজারনির্ভর একটা প্রভাববলয় হয়তো তৈরি হয়। কিন্তু প্রকৃত দারিদ্র দূর হয় না।’ এমন একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতি গ্রামীণ বাস্তবতার ওপরে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে দু’টো গ্রামসমীক্ষায় হাত দেন অধ্যাপক হোসেন। তার সমীক্ষার ফলাফল  The Assault that Failed: A Profile of Absolute Poverty in Six Villages of Bangladesh শীর্ষক একটি বইতে তিনি ১৯৮৭ সালে লিপিবদ্ধ করেন। ‘ইউনাইটেড নেশনস রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট’ প্রকাশ করে এই বইখানা। এখানেই অধ্যাপক সাহার আক্ষেপ-- বিশ্বব্যাংক বা ডুফলো-ব্যানার্জির কাজও অধ্যাপক হোসেনের গ্রামসমীক্ষার ফলাফলকে পাশ কাটিয়ে গেছে। অধ্যাপক সাহা মনে করেন, এভাবে গ্রামীণ দারিদ্র্য ও তার সমাধান নিয়ে অধ্যাপক হোসেনের ধারাবাহিক কাজগুলো যদি আমরা বিস্মৃত না হতাম তবে হয়তবা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ও দারিদ্র বিমোচনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রথাগত নীতির পরিবর্তন ঘটতে পারত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক খুরশিদ জাহানের সাথে ‘Nature and Extent of Malnutrition in Bangladesh: Bangladesh Nutrition Survey 1995-96’ নামে এমনই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন অধ্যাপক হোসেন। এই যৌথ সমীক্ষা দেখিয়েছে যে খাদ্যপ্রাণের বেলাতে বিপুল ঘাটতি ঘটেছে এবং তা ঘটেছে বিশেষ করে সেসব এলাকাতে যেখানে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের নিবীড়তা বেশি। এবার আমরা দেখছি, ডুফলো-ব্যানার্জিও আরও অরেক পরে এসে লক্ষ করেছেন ব্যাপারটি।

এবাদে আমরা দেখছি ২০০৪ সালে ‘Survival Strategy of Rural Poor in Bangladesh’ শীর্ষক বড় একটি সমীক্ষা প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন অধ্যাপক হোসেন যেখানে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের কৃষিতে বিকল্প একটি শস্যচক্র বাস্তবায়ন করা সম্ভব কিনা। অধ্যাপক সাহার আরেকটি আক্ষেপ এই যে এই সুবিশাল সমীক্ষা শেষ করতে পারেননি অধ্যাপক হোসেন এবং সমীক্ষার তথ্যগুলো যে কোথায় সে সম্পর্কেও কারও ধারণা নেই।  

পরিশেষে আমরা অধ্যাপক সাহার চূড়ান্ত একটি আক্ষেপ লক্ষ করি। অধ্যাপক হোসেন বাংলাদেশের দারিদ্র্য-বিশ্লেষণের যে কাজ নিরলসভাবে করে গেছেন সে সম্পর্কে অধ্যাপক সাহা মন্তব্য করেছেন,‘ তাঁর মেধার চর্চা পথের একপাশে পড়ে থাকে...যা বিশেষ করে মনে দাগ কাটে, তা হলো এবার নোবেলজয়ীদের (ডুফলো, ব্যানার্জি ও ক্রেমার, ২০১৯) কাজ বৈশ্বিক দারিদ্র নিয়ে। স্যারেরও তাই। তবে তাঁর নৈতিক দায়বদ্ধতা ছিল মূলত এই বাংলার দারিদ্রের গতি-প্রকৃতি নিয়ে। এবং দৃষ্টি প্রসারিত ছিল সমাজবাস্তবতার সবটুকুসমেত আরও গভীরে।’ আমরা দেখছি, দারিদ্র্যের গতি-প্রকৃতি নিয়ে অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন সেই ষাট দশকের শুরু থেকেই কাজ শুরু করেছিলেন যখন অনেক অর্থনীতিবিদই মগ্ন ছিলেন নব্য ধ্রুপদী অর্থনীতির চর্চা নিয়ে। অধ্যাপক সাহা মনে করেন, তাঁর চিন্তা-ভাবনা প্রথাগত নব্য ধ্রুপদী অর্থনৈতির প্রয়োগকে চ্যালেঞ্জ করেছে বলেই নিশ্চয় তা আর সমাদৃত হয়নি। এক জন আন্তরিক, দেশপ্রেমী অর্থনীতিবিদ হিসেবে অধ্যাপক হোসেনকে নিয়ে এখানে আমাদেরও আক্ষেপ, এখানেই তাকে ঘিরে আমাদের সু-উচ্চ গৌরবও বটে।

এতক্ষণ আমরা অধ্যাপক সনৎকুমার সাহার সম্পদে-সংকটে নামের প্রবন্ধ-গন্থ নিয়ে যে আলোচনা করলাম তা থেকে অধ্যাপক সাহার উন্নয়ন-ভাবনার পরিচয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি যথার্থই মনে করেন, উন্নয়নের ধারাবাহিক ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন কেননা তা’তে করে আমরা নিজেদের সাফল্য বা ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারি। তার সাথে সুর মিলিয়ে আমাদেরকে বলতেই হয়, আমরা যে মুক্তবাজারের গুণগান গাইছি তা’তে আসলে কোনও অদৃশ্য হাত নেই। তাই যথাযথ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার জন্য একটি রাষ্ট্রকে মাঠে নামতেই হয় মুখ্য কিছু কারণে-- দ্রব্যসামগ্রী ও সেবার চাহিদা ও সরবরাহের মাঝে ভারসাম্য বিধানের জন্য রাষ্ট্রকে সৃষ্টি করে দিতে হয় উপযুক্ত পরিবেশ; উৎপাদনে, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধাদির বিস্তারের জন্য রাষ্ট্রকে সরাসরি বিনিয়োগ করতে হয়; এবং উৎপাদন থেকে উদ্ভূত খাজনার বন্টনে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যও উদ্যোগ নিতে হয় একটি রাষ্ট্রকে। তার অর্থ এই নয় যে বাজার-ব্যবস্থাতে বেসরকারি খাত অংশ নেবে না-- অবশ্যই নেবে, তবে উৎপাদন ও বন্টনে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে কেটেছেটে ফেলা মোটেই ঠিক হবে না। একটি রাষ্ট্রকে এই ভূমিকা নিতেই হয় কেননা প্রচলিত বাজারব্যবস্থাতে উৎপাদন ও বন্টন মোটেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে না বলে অর্থনীতিতে তৈরি হয় নানান অমিলের, অদক্ষতার। তাই কেবল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার বেলাতে ব্রিটন উডস্ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সরবরাহমুখিতার উদ্যোগই যথেষ্ট নয়, অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির বেলাতে বিনিয়োগ ও প্রযত্নের প্রয়োজন রয়েছে। অধ্যাপক সাহা আরও বলছেন, এই যে আজ ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলেছে আমাদের বাংলাদেশ, তার পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে রাষ্ট্রের নিরন্তর উদ্যোগ এবং বিবিধ প্রতিকূলতার মাঝে টিকে থাকবার বেলাতে নারী-পুরুষের অনিঃশেষ অভিযোজন-প্রক্রিয়া, সৃষ্টিশীলতা। তিনি মনে করেন, গর্বের জায়গাটি এখানেই। বাংলাদেশের এই ধারাবাহিক উন্নয়নে অ-সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষূদ্রঋণের ভূমিকা সেখানে সামান্যই, বরং অ-সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে লক্ষ্যভিত্তিক কর্মসূচি পরিচালনা করছে তার অবদানই ক্ষূদ্রঋণ কর্মসূচির প্রতিতুলনাতে অনেক বেশি বলেই অধ্যাপক সাহা যুক্তি দিয়েছেন।