Published : 08 Sep 2024, 05:54 PM
[বরেণ্য মার্কিন লেখক ফিলিপ রথের উপন্যাসে বাস্তবতার গাঢ় রঙ পরিলক্ষিত হয়। জীবন ও যৌবনের উদ্দামতা ও উন্মাদনা তিনি চিত্রিত করেছেন কিছু জান্তব চরিত্রের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। রথ প্রায় ত্রিশটির মতো উপন্যাস লিখেছেন। গল্প-উপন্যাসে আত্মজীবনীমূলক চরিত্র চিত্রণে তিনি সিদ্ধহস্ত। দার্শনিক চিন্তায় ঋদ্ধ তার উপন্যাসে বাস্তব ও কল্পনার ব্যবধান প্রায়শ লুপ্ত হয়ে যায়। উপন্যাসের কাহিনিতে অনেক সময় তার বর্ণনা অতিমাত্রায় জৈবিক, কামনাবাসনাময়। কামসত্তাই হয়ে ওঠে প্রধান সত্তা, মানুষের আধ্যাত্মিক সত্তা যেন লুপ্তপ্রায়। তিনি জীবনকে দেখেছেন উল্টেপাল্টে, উজ্জ্বল সূর্যালোকে। জীবনের উদ্দাম ছুটে চলাকে জীবন্ত করে তোলেন তিনি তার উপন্যাসে। এক বর্ণময় রথের চালক ফিলিপ রথ। তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে লিখেছেন বিনয় বর্মন।]
ফিলিপ রথ (১৯৩৩-২০১৮) প্রখ্যাত মার্কিন কথাসাহিত্যিক। নিউ জার্সি প্রদেশের নিউয়ার্ক শহরে তার জন্ম ও সেখানকার উইকোয়াহিক অঞ্চলে বেড়ে ওঠা। পড়াশোনা করেছেন উইকোয়াহিক হাই স্কুলে এবং পরে নিউয়ার্কের রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয় ও পেনসিলভানিয়ার বাকনেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, যদিও স্বভাবে ছিলেন দুরন্ত ও রসিকতাপ্রিয়। ছাত্রবন্ধুরা তাকে ডাকতো কমেডিয়ান বলে। তিনি প্রায় ত্রিশটির মতো উপন্যাস লিখেছেন। গল্পউপন্যাসে আত্মজীবনীমূলক চরিত্র চিত্রণে তিনি সিদ্ধহস্ত। নিজের জীবনেরই ছায়া তিনি প্রক্ষিপ্ত করেছেন ডেভিড কেপেশ ও নাথান জুকারম্যান চরিত্রদ্বয়ের ওপর। আবার নিজের নামেই তিনি উপস্থিত হয়েছেন ‘দ্য প্লট এগেইনস্ট আমেরিকা’ এবং ‘অপারেশন শাইলক’ উপন্যাসে। দার্শনিক চিন্তায় ঋদ্ধ তার উপন্যাসে বাস্তব ও কল্পনার ব্যবধান প্রায়শ লুপ্ত হয়ে যায়, বিশেষত যেখানে চেতনাপ্রবাহ লাগামহীন ঘোড়ার মতো টগবগিয়ে ছুটতে ছুটতে আলোঅন্ধকারের মিশ্রতটে এসে হাজির হয়। ফ্ল্যাশব্যাক ও ফরোয়ার্ড মুভমেন্টের মিথস্ক্রিয়া চলে নিরস্তর ন্যারেটিভের তুমুলপ্রবাহে।
রথ চিরকাল আমেরিকান আইডেন্টিটির স্বরূপ অন্বেষণ করে গেছেন তার লেখায়। উপন্যাসের কাহিনিতে অনেক সময় তার বর্ণনা অতিমাত্রায় জৈবিক, কামনাবাসনাময়। ‘পোর্টনয়েস কমপ্লেইন্ট’ (১৯৬৯) উপন্যাসে নরনারীর সম্পর্ককে তিনি এত খোলামেলাভাবে বর্ণনা করেছেন যে তা নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। তিনি জীবনকে দেখেছেন উল্টেপাল্টে, উজ্জ্বল সূর্যালোকে। জীবনের শুভময়তা যেমন দেখেছেন, তেমনি দেখেছেন এর ক্লেদাক্ততা। মানুষের জীবনের অন্ধকারময় দিক উন্মোচিত হয় তার বিভিন্ন উপন্যাসে অত্যন্ত নগ্নভাবে। জীবনের উদ্দাম ছুটে চলায় কোন ক্লাস্তি নেই। রথের চাকা ঘোরে ঘড়ঘড়, নিরস্তর, উদ্দেশে, নিরুদ্দেশে। তার গৌরবোজ্জ্বল লেখালেখির জন্য তিনি লাভ করেছেন ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড, ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক্স সার্কেল অ্যাওয়ার্ড, আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব আর্টস অ্যান্ড লেটার্স গোল্ড মেডাল ইন ফিকশন, সোসাইটি অব আমেরিকান হিস্টরিয়ান্স প্রাইজ, ফ্রানৎস কাফকা পুরস্কার ও পুলিৎজারসহ অনেক বড় বড় সম্মান। তার সম্পর্কে সমালোচক হ্যারল্ড ব্লুমের মন্তব্য, ফকনারের পর থেকে আমাদের প্রধান ঔপন্যাসিক ফিলিপ রথ যার কমিক প্রতিভা, কল্পনার নির্ভীকতা, অস্বস্তিকর সত্য অন্বেষণে সাহস, এবং রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং যৌন গোঁড়ামির উপর তার আক্রমণ তাকে সমসাময়িক বিশ্বের অপরিহার্য লেখকদের একজন করে তুলেছে। তিনি আরো বলেন, “এক অর্থে ফিলিপ রথ বিংশ ও একুশ শতকে ইহুদি সাহিত্যের অমীমাংসিত ধাঁধার চূড়ান্ত পরিণতি। কাফকা ও ফ্রয়েডের জটিল প্রভাব এবং আমেরিকান ইহুদি জীবনের অস্বস্তি তার মধ্যে এক নতুন ধরনের সংশ্লেষণের জন্ম দিয়েছে।”
রথের সামাজিক মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা থাকলে আমাদের পক্ষে তার উপন্যাসের বিষয়বস্তু বুঝতে সুবিধা হবে। একটি বৃহৎ সমাজে বিরাজ করে নানা সম্প্রদায়, যাদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি ঐতিহ্যগতভাবে আলাদা আলাদা হয়। ইহুদী হিসেবে রথের মনের ওপর পড়েছিল ইহুদী ধর্মের নিয়মাচারের আঁচড়। কিন্তু তিনি দেখেছেন, সেই নিয়মাচার জোর কদমে চলা এগিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর বিশ শতকী মার্কিন সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ। ফলে দেখা দিয়েছে দ্বন্দ্ব— ঐতিহ্য ও আধুনিকতার দ্বন্দ্ব। এই সমাজদ্বানি্দ্বকতার মানসপুত্র ফিলিপ রথ। তার মানসগঠনে একদিকে যেমন পরিবারের শৃঙ্ক্ষলা প্রভাব বিস্তার করেছে, অন্যদিকে যুগের উত্তাল হাওয়া তাকে মাতিয়ে তুলেছে। তার মনে হয়েছে মার্কিন সমাজের কোন আধ্যাত্মিক লক্ষ্য নেই, আছে কেবল ভোগবিলাসিতায় ভেসে যাওয়া। মূলত অন্তহীন ভোগলিপ্সার কল্পদালিলিক উপস্থাপনাই তার কথাসাহিত্যসম্ভার। সমাজ ও রাষ্ট্র নির্দিষ্ট সময়কালে তার তার অস্তিত্ব ও বিকাশের জন্য বিশেষ কাঠামো নির্মাণ করে নেয়; সেটি অনেকের জন্য সুখকর আবার অনেকের জন্য দুখকর প্রতিপন্ন হয়। সামষ্টিক সংগঠন ব্যষ্টিজীবনকে বিভাবে প্রভাবিত করে সেটার নিরীক্ষাই পাওয়া যায় রথের উপন্যাসসমূহে।
রথ মূলত পশ্চিমা পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী সমাজের চিত্রই এঁকেছেন তার কথাসাহিত্যে। বিশ শতকের ত্রিশ পরবর্তী সময়ে মার্কিন সমাজ শরীরকেন্দি্রক ভোগবিলাসিতায় ভেসে গিয়েছিল। কামনাবাসনায় আকীর্ণ হয়ে উঠেছিল মানুষের মন। অর্থ উপার্জন করো, বাঁচো আর মাস্তি করো— এই যেন ছিল জীবনের আদর্শ। সিনক্লেয়ার লুইস ও এফ. স্কট ফিটজেরাল্ডের উপন্যাসে আমরা যে স্থূল জীবনের অনুশীলন লক্ষ করি, তা যেন আরেকটু চাঁছাছোলাভাবে পরিব্যক্ত হয় রথের কথাসাহিত্যে। রথের চরিত্রগুলো অধিক খোলামেলা; তারা তাদের আকাঙ্ক্ষা গোপন রাখে না। নিরন্তর আকাঙ্ক্ষার পেছনে ধাবিত হয়, শিকার হয় নানা মানসিক বৈকল্যের। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে, ঘটনার ঘূর্ণাবর্তে, এগিয়ে চলে জটিল জীবন, রচিত হয় জীবনের বিতিকিচ্ছিরি কেচ্ছাকাহিনী। যে সমস্ত নৈতিক স্খলন চরিত্রসমূহের মধ্যে দৃষ্ট হয় তা কিন্তু ভোগবাদের মাপকাঠিতে অপরাধ হিসেবে গণ্য নয়। এসব ব্যক্তিঅভিজ্ঞতা ভাষিক ক্যানভাসে উপস্থিত হয় এক ধরনের কনফেশন বা স্বীকারোক্তি হিসেবে। সেই বিবেচনায় রথের অনেক উপন্যাসই স্বীকারোক্তিমূলক। চরিত্ররা অবলীলায় বলে যায় তাদের পর্দায় আড়ালে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা, যা কখনো কখনো ছাড়িয়ে যায় শ্লীলতার সীমা, কিন্তু তাদের কোন অনুশোচনা নেই। স্থানে স্থানে রগড়তা পর্ণোগ্রাফির রূপ নেয়, মনে হয় তা যেন যৌনবিকৃতি। প্রাচ্যীয় রক্ষণশীল সমাজকাঠামোতে পাঠকের মনে এসব কেবল কালচার শকই উৎপন্ন করে।
বাস্তবের প্রতিচ্ছবি ও জীবনের উদ্দামতা:
ফিলিপ রথ দু’চোখ মেলে দেখেছেন চারপাশের পরিবেশ—প্রতিবেশ যা তার লেখায় প্রতিবিম্বিত হয়েছে। লেখক হিসেবে তিনি ছিলেন বাস্তববাদী, কল্পনাবাদী নন। সেজন্য তার কথাসাহিত্যের চরিত্রগুলো এবং ঘটনাবলি বাস্তবঘেঁষা। মূলত বাস্তব থেকেই তিনি আহরণ করেছেন তার লেখার সমস্ত উপাদান। তার আশিতম জন্মদিনে রথ যে বক্তৃতা করেন তাতেও তিনি মার্কিন সাহিত্যে বাস্তবতার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্টতার প্রতি আকর্ষণ, বস্তুবাদিতার সম্মোহন মানুষের মধ্যে থাকবেই। হারম্যান মেলভিল ও তার তিমি এবং মার্ক টোয়েন ও তার নদী প্রত্যেক মার্কিন ঔপন্যাসিকক্রে জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। চেতন বা অচেতন যাই হোক, বস্তুর দৃঢ় প্রতিনিধিত্ব এবং বাস্তবের অপরিহার্য উপস্থাপনা ছাড়া আদতে কিছুই নেই। সুনির্দিষ্টতা, বিবরণের উপর অবাধ নজর, একবচনের প্রতি আগ্রহ এবং সাধারণতার প্রতি গভীর বিদ্বেষ হচ্ছে কথাসাহিত্যের জীবনশোনিত। নির্দিষ্ট তথ্যের তুষারঝড় তথা ব্যক্তি জীবনের প্রতি অগাধ বিশ্বাস, আপোষহীন নির্দিষ্টতার শক্তি এবং তার শারীরিকতা থেকে বাস্তববাদী উপন্যাস অন্তরঙ্গতা লাভ করে। এর লক্ষ্য: মানবতাকে তার বিশেষত্বে চিত্রিত করা।
ইরোটিসিজমের উপাদান ছেয়ে আছে ফিলিপ রথের কথাসাহিত্য। তার উপন্যাসের নায়কনায়িকারা রক্তমাংসের জান্তব মানুষ। তারা উঠে আসে শহরের অলিগলি থেকে সমস্ত পঙ্কিলতা নিয়ে। নীল আকাশের নিচে রোদে-ছায়ায় প্রতিপালিত তারা। তাদের চরিত্রে ভাল দিকের সঙ্গে থাকে কিছু মন্দ দিক। চারিত্রিক দুর্বলতাকে এড়িয়ে গেলে বাস্তবতা একপেশে হয়ে যায়। একজন ঔপন্যাসিকের দায়িত্ব মানবজীবনের আলোকিত ও অন্ধকার দুই দিককেই তুলে আনা। রথ ফ্যাবল বা প্যারাবল লেখার পক্ষপাতী নন; মানুষকে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া কিংবা সমাজকে আদর্শের বাণী শোনানো তার উদ্দেশ্য নয়; তার কাজ বাস্তব ঘাঁটাঘাটি করে জীবনের গভীরতা তলিয়ে দেখা। প্রবাহের উপরতলে দেখি আমরা নানা ময়লা-আবর্জনা ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু গভীরতলে আছে জলের স্থিরতা, বিদগ্ধ আত্মার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। আমরা তার ‘লেটিং গো’ (১৯৬২), ‘হোয়েন শি ওয়াজ গুড’ (১৯৬৭), ‘পোর্টনয়েস কমপ্লেইন্ট’ (১৯৬৯), ‘সাবাথ’স থিয়েটার’ (১৯৯৫), ‘হামব্লিং’ (২০০৯) ইত্যাদি উপন্যাসে জীবনের জৈবিকতা তথা ইরোটিসিজমের স্পষ্ট আভাস পাবো। মানুষ মত্ত হয়ে আকাঙ্ক্ষার মায়াহরিণের পেছনে ছোটে, কিন্তু তার হতাশা কাটে না, ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে একসময় সে নেতিয়ে পড়ে। সমালোচক চার্লস ম্যাকগ্রাথের পর্যবেক্ষণ: “মি. রথের অন্য বড় বিষয়বস্তু ছিল যৌনতা বা পুরুষের লালসা, যা একদিকে তার বইগুলির জীবনশক্তি এবং অন্যদিকে ক্রোধ ও ব্যাধির নীতি অনুসারী।”
‘লেটিং গো’ উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে গেইব ওয়ালশের জীবনের প্রেম ও পরিচয়ের দ্বন্দ্ব। সে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র। সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া করে এবং লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। সে তার কলেজ জীবনের বান্ধরী মার্থাকে হুট করে বিয়ে করে ফেলে। তাদের একটি ছেলে সন্তান হয় এবং সংসারের নতুন দায়িত্ব তার ঘাড়ে চাপে। কাহিনী এগিয়ে গেলে দেখা যায়, গেইবের চিন্তাভাবনা পরিবর্তন ঘটেছে এবং স্বামী-পিতা হিসেবে সে তার দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন হয়ে উঠেছে। সে রেজিনার সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়। তার জীবনে লিবি আসে দ্বিতীয় স্ত্রী হয়ে। উপন্যাসে মানবমনের অস্থিরতাকে রূপায়িত করা হয়েছে গেইব চরিত্রের মাধ্যমে। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আশা-হতাশা, স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় সারা জীবন। মানবীয় সম্পর্কগুলো ঠুনকো কাচের মতো ভেঙ্গে যায়। আকাঙ্ক্ষার ম্যারাথন চলে এবং তার সঙ্গে ঘটে নানা দুর্ঘটনা। ‘লেটিং গো’ উপন্যাসে মনোবীক্ষণ ও মনোসমীক্ষণ পাঠকদিগকে চরিত্রচিত্রণের গভীরে নিয়ে যায়। স্পষ্ট হয়ে ওঠে নানারঙের ভাবনা, জাগতিক ও আত্মিক দ্বন্দ্ব, জাতিগত পরিচয়ের ভার ও মুক্তির রেখাপাত। বিস্তৃত পরিসরে গর্ভপাত, বিবাহবিচ্ছেদ, পুনর্বিবাহ এবং দত্তক গ্রহণ রথের এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু। এই উপন্যাসের চরিত্রসমূহের মধ্যে এতো অস্থিরতা যে মনে হয় তারা মানসিক রোগী। আসলে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় লালিত ভোগবাদের নিরন্তর প্রসারজনিত পীড়নেই তাদের মধ্যে মনোবিকার দেখা দেয়। বাঁচতে হবে কেবল জীবন উপভোগ করার জন্য— এই দর্শনে জীবন সীমায়িত হয়, এবং জীবন কোনো মহৎ লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। স্বার্থ ও ভোগের কানাগলিতে জীবন ঘুরপাক খায়।
১৯৪০-এর আমেরিকার মিডওয়েস্টের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘হোয়েন শি ওয়াজ গুড’ এক পারিবারিক সংঘাতের কথা তুলে ধরে। এতে আমরা লুসি নেলসন নামে এক নারী চরিত্রের সন্ধান পাই; উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সে। সে তার মদ্যপ পিতাকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সে পিতাকে জেলে পাঠিয়ে নিজে যন্ত্রণায় ভোগে। এখানে নৈতিকতা ও অনৈতিকতার দ্বন্দ্ব খুব স্পষ্ট। অন্যদিকে আর্মি—ফেরত রয় বাসার্টের সঙ্গে সে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। সে অন্তসত্তা হয় এবং তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ক্রমে তিক্ত হয়ে ওঠে। সে নিজের মতো স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে চায় কিন্তু সমাজ তাকে বাঁধাগ্রস্ত করে। সে দিন দিন মানসিক যন্ত্রনায় ক্লিষ্ট হয়ে ধ্বংসের মুখে পতিত হয়।
‘পোর্টনয়েস কমপ্লেইন্ট’ জীবনের অন্ধকার বান্তবের দিকে আলোকপাত করে। উপন্যাসটি ১৯৬০ এর দশকের যথেচ্ছ জীবনাচার এবং সামাজিক নিয়ম ও ব্যক্তিগত ইচ্ছার মধ্যে সংঘর্ষকে প্রতিফলিত করে। রিরংসা মানুষের জীবনকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, বিব্রত করে, তার বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে। এর প্রধান চরিত্র আলেকজান্ডার পোর্টনয় স্নায়বিক রোগগ্রস্ত এক ইহুদি তরুণ। সে কামুকতায় আচ্ছন্ন এবং এজন্য তার মনের মধ্যে বিরাজ করে অস্বস্তি ও অনুশোচনা, যা থেকে মুক্তির জন্য সে হাসিতামাশা করে। বইটি এমন একটি শৈলীতে লেখা যাতে মনে হয় পাঠক পোর্টনয়ের মাথার ভিতরে বসে তার সমস্ত চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতি শুনছে। উপন্যাসটি একটি মনোলোগ আকারে উপস্থাপন করা হযে়ছে যেখানে পোর্টনয় একজন থেরাপিস্টের সঙ্গে তার চিন্তাভাবনা ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করে। পুরো কাহিনী জুড়ে দেখা যায় পোর্টনয় তার রিপুবাস্তবতা থেকে পলায়ন করতে চায়। সে তার পিতামাতা এবং ইহুদি সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক প্রত্যাশার কথা ভাবে, এবং তা থেকে মুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। পোর্টনয় তার থেরাপিস্ট ড. স্পিলভোগেলের কাছে তার মানসিক বিকারের কথা বর্ণনা করে। অ্যালেক্স তার থেরাপিস্টকে বলে কিভাবে তার মা তার ওপর কর্তৃত্ব ফলায় এবং তার মৃদুভাষী বির্বিকার পিতার তাকে সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়। তার অভিযাগসমূহ অরৈখিক পথে এক স্মৃতি থেকে অন্য স্মৃতিতে চলে যায়। এই স্মৃতিগুলি প্রায়শই অস্পষ্ট যৌনাকাঙ্ক্ষা ও অবদমনজনিত কষ্টে পীড়িত। পোর্টনয়ের স্মৃতিচারণ থেকে তার শৈশবের ছবি পাওয়া যায়। কীভাবে তার বাবা দীর্ঘ সময় বাথরুমে কাটাতো এবং তার মা তার প্রতিটি গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতো। তার কৌশোরের কামতৃষ্ণা মিটানোর কোন উপায়ই ছিল না। যদিও সে স্বাভাবিক, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে চাইত, কিন্তু যৌনতাড়না তাকে বাধাগ্রস্ত করতো। তদুপরি, সে উদ্বিগ্ন ছিল এই ভেবে যে তার ইহুদি জাতিসত্তা তাকে মার্কিন সমাজে আলাদা করে তুলছিল, এবং এই উদ্বেগ তাকে চরম অস্বস্তির মধ্যে ঠেলে দেয়।
বইয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আইডেন্টিটি বা পরিচয়। পোর্টনয় ইহুদি, এবং আমেরিকান ইহুদি হওয়ার অর্থ কী তা সে হাড়ে হাড়ে টের পায়। পোর্টনযয়ের পরিবার, বিশেষ করে তার মা গল্পে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। তার মা তাকে ভালোবাসে এবং তাকে নানাভাবে সান্ত্বনা প্রদান করে, কিন্তু এতে তার মন থেকে হতাশা দূর হয় না। তার মায়ের নজরদারি ও শাসনের কারণে সে চরমভাবে বিরক্ত। তার জ্বালায় সে হনাতমৈথুনও ঠিকভাবে করতে পারে না। একবার এলাকার এক মেয়ের সঙ্গে সে যৌনসঙ্গম করে, কিন্তু তার নিজেরই চোখের ভেতর তার বীর্যপাত ঘটে। তার চোখের বাজে অবস্থা দেখে তার মা তাকে কিভাবে যে অপদস্ত করবে তা ভেবে সে শিউরে ওঠে। তার পিতামাতা তাকে ইহুদী নিয়মকানুন পালনে বাধ্য করে। ধর্মীয় কারণে তার খ্রিস্টান বান্ধবীর সঙ্গে বনিবনা হয় না এবং তাদের সম্পর্কে ছেদ ঘটে। সে হতাশ হয়ে পড়ে, তবু সে মনে মনে কোনো অইহুদি নারীকেই কামনা করে। মাঙ্কি নামক এক মেয়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। তার সঙ্গে গড়ে ওঠে অম্লমধুর সম্পর্ক। এক পতিতার সঙ্গে রাত কাটানোর পর মাঙ্কি তাকে হোটেলের ব্যালকনি থেকে নিচে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং পোর্টনয় তাকে ছেড়ে পালিয়ে বাঁচে। ইসরায়েলে বেড়াতে গিয়ে তার পরিচয় ঘটে নাওমির সঙ্গে। সে জোর করে তার সঙ্গে মিলিত হতে চাইলে নাওমি তাকে হোটেলে একা ফেলে প্রস্থান করে। এভাবে নানা অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যে পড়ে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
‘সাবাথ’স থিয়েটার’ উপন্যাসে আমরা ৬৪ বছর বয়স্ক মরিস সাবাথ নামে এক কামুক কমিক চরিত্রের সন্ধান পাই। তার লিবিডো অবসেশনটি অদ্ভুত। ভোররাতে তার লিঙ্গোত্থান ঘটলে সে ভাবে, অন্য প্রাণিদেরও কি এরকম হয়, যেমন তিমি কিংবা বাদুড়ের? একসময় সে ছিল পুতুলনাচের কারিগর যার আঙুলগুলো এখন বাতব্যথায় অচল। সে নিউ ইংল্যান্ডে মাদামাস্কা ফলসে এক কলেজে নাটকের শিক্ষক ছিল, কিন্তু এক ছাত্রীর সঙ্গে যৌন কেলেঙ্কারির কারণে তার চাকরি চলে যায়। সাবাথের প্রথম স্ত্রী নিকি তাকে ছেড়ে চলে যায় এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রী হয়ে আসে মদাসক্ত রোজিয়ানা। সে জড়িয়ে পড়ে নানা পরকীয়া প্রেমে এবং সম্মুখীন হয় নানা বিপর্যয়ের। তার প্রেমিকা ড্রেঙ্কা বালিচ, এক সরাইখানার মালিকের স্ত্রী, ওভারিয়ান ক্যান্সারে মারা গেলে সে গভীর বিষাদে ডুবে যায়। নিউ ইয়র্কে তার বন্ধুর মৃত্যুর সংবাদ পেলে সে রোজিয়ানাকে ফেলে ছুটে যায় সেখানে শেষকৃত্যানুষ্ঠানে, যার মাধ্যমে সে নিজের মৃত্যুর আয়োজনটিকে দেখে নেয়। আগে সে সাহিত্যের বই পড়তো, এখন সে মত্যু বিষয়ক বই ছাড়া আর কিছুই পড়ে না। সে নিজেকে এক ব্যর্থ মানুষ, ব্যর্থ শিল্পী হিসেবেই বিবেচনা করে। বন্ধুর শেষকৃত্যকালে সে আঠারো তলা ভবন থেকে নিচে সবুজে আবৃত সেন্ট্রাল পার্কের দিকে তাকায় এবং ভাবে, হয়তো তার এখন নিচে লাফিয়ে পড়ার সময় হয়েছে।
রথের ত্রিশতম উপন্যাস ‘হাম্বলিং’, তিনটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশে দেখা যায়, সায়মন এক্সলার, মঞ্চনাটকের অভিনেতা, অভিনয় দক্ষতা খুইয়ে বিষাদে নিমজ্জিত। সে অভিনয় ছেড়ে দেয় এবং ছাদঘরে বসে একটি শর্টগান দিয়ে নিজের জীবনের অবসান ঘটানোর চিন্তা করে। তার স্ত্রী প্রাক্তন ব্যালেরিনা নর্তকী ভিক্টরিয়া তার ডিপ্রেশনের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ক্যালিফোর্নিয়ায় ছেলের কাছে চলে যায়। এক্সলার এক ডাক্তার বন্ধুর পরামর্শে সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং সেখানে ২৬ দিন অতিবাহিত করে। সেখানে সিবিল ফন বুরেন নামে আরেক মহিলা রোগীর সঙ্গে কথা হয়। বুরেন জানায় তার দ্বিতীয় স্বামী কর্তৃক ছোট কন্যার যৌন হয়রানির কথা। মহিলা চায় এক্সলার গিয়ে তার স্বামীকে হত্যা করুক, কিন্তু তার আশঙ্কা সে হয়তো এই কাজটি ঠিকভাবে করতে পারবে না। দ্বিতীয় অংশে, পেগিন স্ট্যাপলফোর্ড নামে এক নারী, অভিনেতা—অভিনেত্রী পরিবারে যার জন্ম, এক্সলারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে। পেগিন পার্শ্ববর্তী ভেরমন্ট মহিলা কলেজে চাকরি পেয়েছে। কিন্তু এই চাকরিটি পাওয়ার জন্য তাকে প্রতিষ্ঠানের ডিন লুইস রেনারের সঙ্গে শয্যায় যেতে হয়েছে। সে তার যৌনবান্ধবীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে কারণ সে সার্জারি করে ছেলে হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পেগিন যদিও গত সতেরো বছর ধরে লেসবিয়ান হিসেবে জীবনযাপন করেছে তবু সে সায়মনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। লুইস ক্ষিপ্ত হয়ে সায়মনের সঙ্গে সম্পর্কের কথা পেগিনের পিতামাতাকে জানিয়ে দেয়। তার পিতামাতা এই সম্পর্কটি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং পেগিন হতাশা বোধ করে। উপন্যাসের তৃতীয় অংশে, এক্সলার সংবাদপত্রের খবর থেকে জানতে পারে যে সিবিল তার স্বামীকে হত্যা করেছে। সে ফোনে সিবিলের বোনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সিবিলকে সাহায্য করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। রেস্টুরেন্টে ডিনার খেতে গিয়ে তারা মাতাল তরুণী ট্রেসিকে অসহায় অবস্থায় দেখতে পেয়ে বাড়ি নিয়ে আসে। এক্সলার তার থিয়েটার নতুনভাবে শুরু করার উদ্যোগ নেয় এবং পেগিন ও তার সংসারে ভবিষ্যৎ সন্তানের কথা চিন্তা করে। সে পেগিনকে না জানিয়ে এক ফার্টিলিটি স্পেশালিস্টের কাছে যায়, কিন্তু দুই সপ্তাহ পরেই ঘটে অপ্রত্যাশিত ঘটনা। পেগিন তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যায় এবং ট্রেসির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। রাগে—দুঃখে—হতাশায় এক্সলার শর্টগান দিয়ে নিজেকে হত্যা করে। প্লটাঙ্কিত এসব ঘটনা থেকে বোঝা যায় কামনাবাসনা মানুষকে কিভাবে তাড়িত করে এবং তাদেরকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। ভোগের বাসনা যখন মানুষের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে তখন সহজেই তার পা পিছলে যায় এবং সে খাদে গিয়ে পড়ে। প্রায় নোংরা, অসুস্থ এক সমাজকে আমরা দেখি রথের লেন্স দিয়ে। নষ্টামি—ভ্রষ্টামিতে ভরা। কখনো আমাদের গা রি-রি করে, কখনো করুণার উদ্রেক হয়, কখনো হয় আফসোস।
আমেরিকান ট্রিলজি: অধ্যাপকের জীবনচরিত:
ফিলিপ রথ আমেরিকান ট্রিলজি লিখে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। এর মাধ্যমে তিনি উন্মোচন করেছেন বুদ্ধিজীবি জগতের অন্ধকারময় দিক। তিনি সৎ ও বিশ^স্ত থেকেছেন তার বর্ণনায়, এর মাধ্যমে তিনি তার বয়ানকে করে তুলেছেন বিশ্বাসযোগ্য। ডেভিড কেপেশ নামক এক অধ্যাপকের জীবনকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে এই ট্রিলজি যেখানে অন্তর্ভুক্ত ‘দ্য ব্রেস্ট’ (১৯৭২), ‘দ্য প্রফেসর অব ডিজায়ার’ (১৯৭৭) ও ‘দ্য ডায়িং এনিম্যাল’ (২০০১)। যৌনাকাঙ্ক্ষার কুয়াশাবৃত এক অসুস্থ দুনিয়ার সন্ধান মেলে এ উপন্যাসত্রয়ে। এসবের পাঠ অনেকের জন্যই সুখকর নয়, বরং বিব্রতকর। রগরগে ঘটনার বর্ণনায় সহজেই পাঠক আড়ষ্ট হয়ে ওঠতে পারেন বিতৃষ্ণায়, বিবমিষায়।
‘দ্য ব্রেস্ট’ উপন্যাসে সাহিত্যের অধ্যাপক ডেভিড কেপেশের প্রথম সাক্ষাৎ মেলে। তার বক্ষ বিশাল, ১৫৫ পাউন্ডের। তার শরীর ও মনে তীব্র যৌনাকাঙ্ক্ষা। সে নিজের সঙ্গে নিজে লড়াই করে, আকাঙ্ক্ষা অবদমন করে। সে দ্বনে্দ্ব ভোগে, শরীরের প্রেম ও মনের প্রেম নিয়ে। সে নিজেকে নিয়ে বিব্রত; তাকে মনে হয় কোনো অলীক জগতের বাসিন্দা। সে নিজেকে তুলনা করে কাফকার মেটামরফোসিসের গ্রেগরি সামসা এবং নিকোলাই গোগোলের দ্য নৌজেসের কোভালিয়ভের সঙ্গে। সারা উপন্যাস জুড়ে আছে তার যৌনচিন্তার বিচিত্র বিস্তার। যখন সে মানুষের সঙ্গে কথা বলে, বান্ধবীর সঙ্গে সময় কাটায়, অথবা যখন সে একা থাকে, তার মাথার মধ্যে কেবলই ঘুরপাক খায় যৌনতার কথা। বান্ধবী ক্লেয়ারের সঙ্গে সমুদ্রসৈকতে সময় কাটানোর ফাঁকে সে ভাবে তার যদি স্তন থাকতো। তার সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে, যদিও অন্য অনেক ইচ্ছা অপূর্ণ রয়ে গেছে। এই উপন্যাসে কাফকার অ্যাবসার্ডিটির আইডিয়াকে অনুসরণ করেছেন রথ। তিনি জীবনবাস্তবতা উপস্থাপণ করেছেন অবাস্তবতার মধ্যে দিয়ে। ঘটনা হাস্যরসে পূর্ণ, কিন্তু সেখানে জীবনের অর্থহীনতার শূন্য কলস ঠনঠন করে বাজে।
‘দ্য প্রফেসর অব ডিজায়ার’ উপন্যাসে ফিলিপ রথ কেপেশের জীবনের আরেক আখ্যান লিপিবদ্ধ করেন। কেপেশের আকাঙ্ক্ষা প্রেমে, কামে। সে আবেগগতভাবে ভারসাম্যহীন। তার ছোটবেলার স্মৃতি থেকে জানা যায়, সে পিতার হোটেলে বেড়ে ওঠেছে। সে—সময় সে শিল্পী হার্বি ব্রাটাস্কি দ্বারা প্রভাবিত হয়। ব্রাটাস্কি তার পায়াখানা-প্রস্রাব-বাতকর্মের নানা শব্দের অনুকরণের দক্ষতার প্রশংসা করতো। সে যখন কলেজে চাকরি নেয় তখন রুমমেট হিসেবে পায় অলস সমকামী হস্তমৈথুনে অভ্যস্ত একজনকে। সে নিজে আবেগের তাড়নায় অস্থির হয়ে থাকে; ছাত্রীদের পেছনে ছোঁকছোঁক করে। কেপেশ ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে লন্ডনে যায় যেখানে সে ব্রিগিতা ও এলিজাবেথ নাম্নী দুই সুইডিশ নারীর সান্নিধ্যে আসে। আমেরিকায় ফিরে এসে সে হেলেনের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করে। হেলেন হংকং ও এশিয়ার অন্যান্য জায়গায় থেকেছে এবং নানা পুরুষের সঙ্গে মিশেছে। কিন্তু কেপেশের প্রতি তার অভিযোগ, কেপেশ কেবল তার দেহের লিপ্সু, তার মধ্যে ভালবাসা নেই। কেপেশ হেলেনকে ছেড়ে নিউ ইয়র্কে পাড়ি জমায় এবং সাহিত্যের ওপর লেকচার দিয়ে বেড়ায়। সে তার আবেগগত ভারসাম্যহীনতা নিয়ে একজন সাইকোএনালিস্টের সঙ্গে কথা বলে। সে জানায়, তার আকাঙ্ক্ষা ও অভিজ্ঞতা গুস্তাভ ফ্লবেয়ার বর্ণিত মাদাম বোভারির আকাঙ্ক্ষা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুল্য। প্রাগে গিয়ে সে চিন্তা করে ফ্রানৎস কাফকার বেশ্যা প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করবে এবং তার উরুসন্ধির দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করবে কেন কাফকা এতে দীর্ঘসময় মজে ছিলেন।
‘দ্য ডায়িং এনিম্যাল’-এ কেপেশ শুভ্রকেশ, ষাটোর্ধ বয়সী টিভি অনুষ্ঠান করে সুখ্যাত, যৌনবিপ্লবের প্রচারক। নারীদের সঙ্গে মেলামেশায় তার কোনো ক্লান্তি নেই। নারীকে কেন্দ্র করেই চলে তার নন্দনচর্চা। শিক্ষক সে, কিন্তু তার নজর থাকে সুন্দরী ছাত্রীদের ওপর। উপন্যাসের শুরুর দিকে সে তার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করে এভাবে: “নারীর সৌন্দর্যের প্রতি আমার দুর্বলতা আছে। ব্যাপার হলো, সবাই কোনো না কোনো ব্যাপারে প্রতিরক্ষাহীন। আমি সৌন্দর্য অবলোকন করি এবং অন্ধ হয়ে যাই। ওরা যখন প্রথম আমার ক্লাসে আসে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝে ফেলি কোন মেয়েটি আমার জন্য।” কেপেশ তার এক কোর্সের সুন্দরী ছাত্রী কন্সুয়েলা কাস্তিয়োর প্রণায়াসক্ত। কামাসক্ত কেপেশ তার প্রেমিকার চিন্তায় সদামগ্ন, তার বক্ষযুগলের সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে থাকে। কিন্তু এর মধ্যেও কেপেশ তার প্রাক্তন প্রেমিকার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। কন্সুয়েলা কেপেশের তীব্র জৈবিক প্রেমের প্রশংসা করে। বিশেষ রোগের কারণে কন্সুয়েলার একটি স্তন অপারেশন করে কেটে ফেলার প্রয়োজন হয়। কিন্তু মাস্টেকটমির আগে সে কেপেশকে অনুরোধ করে তার একটি নগ্ন ছবি তুলে রাখতে।
এই ট্রিলজি মূলত যৌন উপাখ্যানের। আরব্য রজনীর আদিরস মথিত বহুগামী প্রেমকাহিনীর এক পশ্চিমা সংস্করণ যেন। দেহজ কামনবাসনা চরিত্রদিগকে অন্ধ করে রাখে, আর তারা ধাবিত হয় নানা বিকৃতির পথে। মানবীয় অস্তত্বের অন্ধগলিতে হাঁটাহাটি করাই ছিল রথের উদ্দেশ্য। যত অপ্রীতিকরই হোক, লেখক কিছু লুকাতে চাননি। তার বর্ণনায় পশ্চিমা আলোঝলমল সভ্যতার অন্তরালে অন্ধকারমলিন অসভ্যতা, আধ্যাত্মিক অন্তসারশূন্যতা, প্রগতি-অহংকারের ফাঁপাত্ব প্রকটভাবে ধরা পড়ে।
ইতিহাস, রাজনীত ও জাতিচিন্তা:
লেখক হিসেবে ফিলিপ রথ রাজনীতি ও ইতিহাসসচেতন ছিলেন। তিনি আজীবন রাষ্ট্রীয় পরিধির মধ্যে একজন নাগরিকের আইডেন্টিটির স্বরূপ অনুসন্ধান করেছেন। নিজস্ব প্রজ্ঞায় তিনি ক্ষমতা ও রাজনীতির কথাসাহিত্যিক ভাষ্য নির্মাণ করেছেন। ‘আওয়ার গ্যাঙ’ (১৯৭১), ‘দ্য প্লট এগেইনস্ট আমেরিকা’ (২০০৪), ‘ইনডিগনেশন’ (২০০৮) ইত্যাদি উপন্যাসে তার রাজনৈতিক ভাবনার পরিচয় মেলে। তিনি রাজনীতির আলো-অন্ধকারে ডুব দিয়ে দেখেছেন সেখানকার পরস্পরবিরোধিতা ও অবিম্রিশ্যকারিতা। তার এই ক্যাটিগরির উপন্যাসে আমরা খুঁজে পাই অ্যান্টিসেমিটিজম, ট্রমা, ক্ষমতাবান ব্যক্তিত্বের আচরণ, ঐতিহাসিক সত্যতা ও অসত্যতা ইত্যাদি বিষয়।
‘আওয়ার গ্যাঙ’ রথের একটি পলিটিক্যাল স্যাটায়ার। এটি নাটকীয় ভঙ্গিতে লেখা, ছয় অধ্যায়ে বিভক্ত। এর প্রথান চরিত্র ট্রিক ডিক্সন, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ক্যারিকেচার, যে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য ভ্রূণহত্যার চরম বিরোধী ছিল। প্রথম অধ্যায়ে দেখা যায় উইলিয়াম ক্যালির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে সে কোন এক মহিলার গর্ভপাত ঘটিয়েছে। ট্রিকি নানাভাবে যুক্তি দিয়ে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ট্রিকি এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে যেখানে সে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। এখানে দেখা পাওয়া যায় কিছু মজার চরিত্রের— মি. অ্যাসলিক, মি. ডেয়ারিং, মি. রেস্টপেক্টফুল, মি. শ্রুড, মি. প্র্যাক্টিক্যাল ও মিস চার্মিং। এখানে আমরা কিছুটা জর্জ অরওয়েলের অ্যানিম্যাল ফার্মের চরিত্রাবলির মজা পাই। এরা অনেকেই কটু প্রশ্নের মাধ্যমের ট্রিককে বিব্রত করে। মি. শ্রম্নড বলে বসে যে, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে প্রেসিডেন্ট এখনো যারা জন্মগ্রহন করেনি তাদের ভোটাধিকার দিতে পারে। এই উপন্যাসে মূলত নিক্সন ও তার ক্যাবিনেটকে (যার মধ্যে রয়েছে হেনরি কিসিঞ্জার ও স্পিরু অ্যাগনিউ) পরিহাস করা হয়েছে। ট্রিকি অস্বীকার করার চেষ্টা করে যে সে মানব-মানবীর যৌনমিলনের বিরুদ্ধে। সে ওয়াশিংটনে একদল স্কাউটকে দাঙ্গায় লেলিয়ে দেয় যার ফলে তিন নাগরিক নিহত হয়। কিন্তু এই ঘটনার দায় সে চাপিয়ে দেয় কার্ট ফ্লাড নামে এক বেসবল খেলোয়ারের ওপর। ডেনমার্ক রাষ্ট্রকেও এর জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং প্রক্রিয়াগতভাবে কোপেনহেগেনকে ধ্বংস করা হয়। ট্রিকির ওপরের ঠোঁটে ঘামগ্রন্থিতে অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু তার দিন ঘনিয়ে আসে। আততায়ীরা তাকে হত্যা করে এবং তার লাশ পাওয়া যায় পানিভরা এক বিশাল প্লাস্টিক ব্যাগে। মায়ের গর্ভে ভ্রূণ যেভাবে থাকে ব্যাগের ভিতর তার শরীর সেভাবে কুঁকড়ে ছিল। শেষদৃশ্যে দেখা যায়, ট্রিক নরকে গিয়েছে এবং সে ডেভিলের পদের জন্য শয়তানের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালাচ্ছে।
‘দ্য প্লট এগেইনস্ট আমেরিকা’তে রথ মার্কিন রাজনীতির একটি বিকল্প ইতিহাস রচনার প্রয়াস পেয়েছেন। সেখানে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট তার প্রতিদ্বন্দ্বী চার্লস লিন্ডবার্গের কাছে নির্বাচনে পরাজিত হন। সে—সময় অ্যান্টিসেমিটিক চিন্তা ও ক্রিয়াকলাপ বৃদ্ধি পায় এবং ইহুদী হিসেবে রথের পরিবার ব্যাপক হেনস্থার শিকার হয়। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ও কথক যুবক ফিলিপ রথ, যার বয়ানে উঠে আসে চরম বিশৃঙ্খলা ও আতঙ্কের কথা। লিন্ডবার্গ ছিলেন আইসোলেসনিস্ট, দেশের বাইরে কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিপক্ষে। রথের বয়ানে প্রকাশ পায়, দক্ষ বিমানচালক চার্লস লিন্ডবার্গ আমেরিকান ফাস্টর্ পার্টিতে যোগ দেন এবং দলের মুখপাত্র হিসেবে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার যোগদানের বিপক্ষে বক্তৃতা দেন। যুদ্ধে যোগদানে চাপ প্রয়োগের প্রতিক্রিয়ায় তিনি ইহুদীদেরও সমালোচনা করেন। ১৯৪০ সালে রিপাবলিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে তিনি দলের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে লড়াইয়ের মনোনয়ন পান। তিনি নির্বাচনে বিজয় লাভ করেন এবং মন্টানার সিনেটর বার্টন হুইলার হন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং হেনরি ফোর্ড হন ইন্টেরিয়র সেক্রেটারি। লিন্ডবার্গের হোয়াইট হাউসে থাকাকালীন সময়ে রথের মনে হতে থাকে তারা যেন এখানকার কেউ না, বরং বহিরাগত। লিন্ডবার্গ প্রেসিডেন্ট হয়ে দুটি চুক্তি সম্পাদন করেন; প্রথমটি— নাৎসি জার্মানির ইউরোপে সম্প্রসারণের ব্যাপারে আমেরিকা হস্তক্ষেপ করবে না; দ্বিতীয়টি— এশিয়ায় জাপানের আগ্রাসি নীতির ব্যাপারে আমেরিকা বিরোধিতা করবে না। প্রথমটি আইসল্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিং এবং দ্বিতীয়টি হাওয়াই আন্ডারস্ট্যান্ডিং নামে পরিচিত। তার সময়ে অফিস অব আমেরিকান অ্যাবজর্পশন আইন করে ইহুদীদের তুলে নিয়ে দক্ষিণ ও মধ্যপশ্চিমে পাঠিয়ে দেওয়া হয় যাতে তারা টিপিক্যাল আমেরিকান হয়ে উঠতে পারে। রথের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা স্যান্ডি এই ধারায় ধরা খেয়ে কেন্টাকিতে প্রেরিত হয়। যখন সে ফিরে আসে তখন দেখা যায় সে তার পরিবারকে ঘৃণা করছে, গাল দিচ্ছে ‘গেটো ইহুদী’ বলে। ১৮৬২ সালের হোমস্টেড আইন পুনঃপ্রবর্তিত হয় যার মাধ্যমে ইহুদীদের নতুন জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়ার তৎপরতা পাকাপোক্ত হয়। নিউআর্কে রথদের অনেক প্রতিবেশী ভয়ে কানাডায় চলে যায়। রথের স্কুলবন্ধু বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান সেলডন উইশনোকে কেন্টাকির ডেনভিলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই আইনের বিরুদ্ধে রেডিও ব্যক্তিত্ব ওয়াল্টার প্রচারণা শুরু করেন, কিন্তু তার প্রচারণায় অ্যান্টিসেমিটিক ধ্বজাধারীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং প্রকাশ্য জনসভায় তাকে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৪২ সালের অক্টোবরের ৭ তারিখ লুইসভিল থেকে বক্তৃতা দিয়ে ফেরার সময় প্রেসিডেন্ট লিন্ডবার্গের প্লেন মিসিং হয়। তার ছেলে অপহৃত হয়। এসব ইহুদীদের ষড়যন্ত্র বলে চারিদিকে প্রচার শুরু হয়। এতে ইহুদীদের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ভাইস প্রেসিডেন্ট হুইলার ও গৃহমন্ত্রী ফোর্ড মিলে নাৎসিদের সাক্ষ্যে অনেক গন্যমান্য ইহুদীকে বন্দি করে। সে-সময় ইহুদীবিরোধী রায়ট চরম আকার ধারণ করে। মূলত মার্কিন রাজনীতির চল্লিশের দশাটিকে তুলে ধরার জন্য ফিলিপ রথ এই উপন্যাসের অবতারনা করেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন আমেরিকায় জাতিবিদ্বেষ কতটা ভয়াবহ, মার্কিন সমাজ কতটা অমানবিক এবং ইহুদীদের প্রতি কতটা অসহনশীল।
ইনডিগনেশন (২০০৮) পুরোপুরি রাজনৈতিক উপন্যাস না হলেও এতে রাজনীতি ও যুদ্ধের প্রেক্ষাপট রয়েছে। পঞ্চাশের কোরিয়ান যুদ্ধকালীন সময়ে মার্কুস মেসনার নামে এক ইহুদী কলেজছাত্রের মাধ্যমে এই কাহিনি বর্ণিত হয়। সে যখন ওহাইয়োর উইনেসবার্গ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, তখন সে আত্মহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া অলিভিয়া হাটন নামে তারই এক ক্লাসমেটের প্রেমে পড়ে। আনাড়ি মার্কুস অলিভিয়ার সঙ্গে প্রথম বিছানা-অভিজ্ঞতায় মুখমেহনের মুখোমুখি হয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, যে মেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলো এমন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে মার্কুসকে তার মা নিষেধ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অব মেন হোয়েস কডওয়েলের সঙ্গে তার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে, কারণ সে চ্যাপেলের সার্ভিসে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সে জানায় যে সে একজন নাস্তিক এবং সে বাট্রর্ান্ড রাসেলের ‘হোয়াই আই অ্যাম নট অ্যা ক্রিশ্চিয়ান’ থেকে উদ্ধৃতি দেয়। মার্কুস তার জায়গায় আরেক বন্ধুকে দিয়ে চ্যাপেলের কাজ সারে। কিন্তু ডিন এর জন্য তার ওপর দ্বিগুণ শাস্তি ধার্য করে। সে এই শান্তির বিরোধিতা করলে ডিন তাকে বহিস্কার করে। এই শাস্তির ফলে সে ইউএস আর্মিতে যোগ দিতে বাধ্য হয় এবং কোরিয়ায় প্রেরিত হয়। সেখানে সে যুদ্ধে মারা যায়।
রথ তার ইহুদী পরিচয় ও জাতিসত্তা নিয়ে অনেক ভেবেছেন, এবং সেই ভাবনা সাহিত্যে লিপিবদ্ধ করেছেন। কখনো কখনো তিনি ভুগেছেন অস্তিত্বের সংকটে। আলাদা ইহুদী রাষ্টে্রর জন্মের সঙ্গেও তার চিন্তার বিরোধ পরিলক্ষিত হয়। তার ‘অপারেশন শাইলক’ (১৯৯৩) উপন্যাসের কাহিনীতে আমরা তাকে দেখি নিজ নামে আবির্ভূত হতে। তিনি ইসরাইলে গমণ করেন এবং যুদ্ধাপরাধী জন দেমজানিয়ুকের বিচার প্রত্যক্ষ করেন। সেখানে তিনি অপারেশন শাইলক নামে এক গোয়েন্দা মিশনে জড়িত হন। তিনি একই চেহারার এক লোককে খুঁজে বের করেন যার নামও ফিলিপ রথ। ব্যক্তিত্বের খ্যাতির কল্যানে সে জিয়োনিস্ট আইডিয়োলজির বিরুদ্ধে ‘ডায়াসপোরা’ আন্দোলন গড়ে তোলে যেখানে বলা হয় ইহুদীরা ইসরায়েলে নয় বরং ইউরোপের বিভিন্ন দেশেই ছড়িয়ে—ছিটিয়ে থাকবে। সেটাই তাদের জন্য ভাল।
জুকারম্যান ট্রিলজি: সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিত্র:
ফিলিপ রথ সমাজ ও শিক্ষায়তনে চলমান অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করেছেন তার জুকারম্যান ট্রিলজির মাধ্যমে। এই ট্রিলজির অন্তর্ভুক্ত উপন্যাসগুলো হলো- ‘আমেরিকান প্যাস্টোরাল’ (১৯৯৭), ‘আই ম্যারিড এ কমিউনিস্ট’ (১৯৯৮) এবং ‘দ্য হিউম্যান স্টেইন’ (২০০০)। এখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র নাথান জুকারম্যান, একজন প্রখর বুদ্ধিজীবি ও লেখক। তার বয়ানে উপস্থিত হয় নানান ঘটনা ও অপঘটনা।
‘আমেরিকান প্যাস্টরাল’ উপন্যাসে সেইমুর সুইড লেভভ নিউ জার্সিতে বসবাসরত একজন ইহুদী ব্যবসায়ী। সুন্দরী স্ত্রী ডন ডায়ারকে নিয়ে তার সুখের সংসার। ষাটের দশকে লিন্ডন জনসনের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে লেভভের উচ্চমধ্যবিত্ত পারিবারিক জীবন বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। প্রারম্ভিক আখ্যানে দেখা পাওয়া যায় রথের অল্টার ইগো নাথান জুকারম্যানের। ১৯৯৫ সালে এক হাই স্কুল পুনর্মিলনীতে জুকারম্যানের মোলাকাত হয় ক্লাসমেট জেরি লেভভের সঙ্গে। জেরি তার ভাই সেইমুর লেভভের করুণ কাহিনি বিবৃত করে জুকারম্যানের কাছে। সেইমুরের কন্যা মেরি ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্টে্রর জড়িত হওয়ার প্রতিবাদে ডাকঘরের কাছে বোমা ফাটায় যার ফলে একজন পথিকের মৃত্যু ঘটে। এরপর থেকে সে আত্মগোপন করে থাকে। এই ঘটনায় সেইমুর প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে ভেঙ্গে পড়ে এবং তার সারা জীবন কাটে ট্রমাটাইজড অবস্থায়। জুকারম্যান জেরির কাছ থেকে নানা ভিতরের খবর শোনে। জুকারম্যান জানতে পারে যে, সেইমুর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিল এবং সেই ঘরে তিনটি সন্তানও আছে। সেইমুরের জীবনের আরো ঘটনা প্রকাশ পায়। সেইমুর বুঝতে পেরেছিল তার স্ত্রী তলে তলে প্রিন্সটন—শিক্ষিত স্থপতি উইলিয়াম অর্কাটের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছিল যার জন্য সে সার্জারি করে নিজের চেহারা পরিবর্তন করেছে। তার মনে হয় ডায়ার তাকে ছেড়ে অর্কাটের কাছে চলে যাবে। সে-ও কম যায় না। স্পিচ থেরাপিস্ট শীলা শালজম্যানের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। বোমা বিস্ফোরনের পর শীলা ও তার স্বামীই তাদের ঘরে মেরিকে লুকিয়ে রেখেছিল। সেইমুরের উপলব্ধিটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে, দুজন মানুষের মধ্যে সম্মানের সম্পর্ক থাকতে পারে কিন্তু ভিতরে ভিতরে তারা দুষ্কর্মে লিপ্ত। বিশৃঙ্খলার ভিতর থেকেই তাকে সত্য আবিষ্কার করতে হয়। বাইরের আচরণ দিয়ে কাউকে বোঝা যায় না। সত্যিকার অর্থে কেউ কখনোই আরেকজনের হৃদয়ের সন্ধান পায় না।
ট্রিলজির দ্বিতীয় বই ‘আই ম্যারিড এ কমিউনিস্ট’, যেখানে জুকারম্যানের বয়ানে ইরা রিনগোল্ড তথা আয়রন রিনের উত্থান-পতনের কাহিনি বিবৃত। এখানেও যুদ্ধপরবর্তী সময়ে, ৯০-এর দশকে, নিউ জার্সির সামাজিক অবস্থা চিত্রিত। ইরা একজন কমুনিস্ট, রেডিও তারকা। ম্যাককার্থি সমর্থক রাজনীতিবিদ ও তার স্ত্রী ইভ ফ্রেমের কূটচক্রে ইরার জীবন ধ্বংস হয়ে হয়। ইরার বড় ভাই শিক্ষক মুরে রিনগোল্ড জুকারম্যানের কাছে ইরার জীবনের ঘটনাবলি তুলে ধরে। অনেক সমালোচক ইভ ফ্রেমের মধ্যে রথের নিজের স্ত্রী ক্লেয়ার ব্লুমের ছায়া দেখতে পান। ব্লুমের ঘৃণার আগুন যেমন ছারখার করে দিয়েছিল রথের জীবন, তেমনি অ্যান্টিসেমিটিক মনোভাবাপন্ন ফ্রেমের ঘৃণা জ্বালিয়ে দিয়েছে ইরার জীবন। মূলত সমাজ ও জীবনবাস্তবতাই প্রতিফলিত হয়েছে এই উপন্যাসে।
সামাজিক ও শিক্ষায়তনের হতাশার চিত্র পাওয়া যায় ‘দ্য হিউম্যান স্টেইন’ উপন্যাসে, বিষণ্ণতার অবয়বে। এখানে ৭১ বছর বয়সী কোলম্যান সিল্ক গল্পের নায়ক, তার কাহিনি বয়ান করে নাথান জুকারম্যান। কোলম্যান জাতিবিদ্বেষের অভিযোগে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে চাকরিচ্যূত হয়। সে ছিল বার্কশায়ারের এথিনা কলেজের ফ্যাকাল্টি ডিন ও ক্লাসিকসের অধ্যাপক। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলো দুই কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্র। সিল্কের দাবি, এই অভিযোগ ভিত্তিহীন, এক ধরনের উইচহান্ট। সিল্কের স্ত্রী আইরিস মানসিক চাপ সহ্য না করতে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সে জুকারম্যানকে অনুরোধ করে এই বিষয়ে একটি বই লেখার জন্য। তারা বিস্তারিত আলাপ করে, এবং তাদের আলাপ থেকে এটাও বেরিয়ে আসে যে সিল্ক কলেজের কর্মী ৩৪ বছরের মহিলা ফনিয়া ফার্লের সঙ্গে প্রণয়ে লিপ্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সিল্ক ও ফনিয়া এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায়। জুকারম্যানের ধারণা, এই দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে ফার্লের প্রাক্তন স্বামী লেস্টারের হাত, যে ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে ফিরে পোস্ট ট্রম্যাটিক স্টে্রস ডিসঅর্ডারে ভুগছিল। জুকারম্যান লেস্টারের মুখোমুখি হয় এবং তার মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে। ‘দ্য হিউম্যান স্টেইন’ যুদ্ধপরবর্তী সময়ের মার্কিন সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার রেখাচিত্র। শিক্ষালয়ে কিভাবে একজন শিক্ষক অকারণে হেনস্থা হয় তা তুলে ধরতেই মূলত এই উপন্যাসের উদ্ভব। এ উপন্যাস সম্পর্কে মিচিকো কাকুটানি মন্তব্য করেন:
এটি এমন একটি বই যা দেখায় যে কীভাবে পাবলিক জাইৎগাইস্ট একজন ব্যক্তির জীবনকে গঠন করতে পারে, আবার ধ্বংসও করতে পারে। এটি এমন একটি বই যা রথের সকল প্রিয় বিষয়গুলো যেমন পরিচয়, বিদ্রোহ, প্রজন্মের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি তুলে ধরে। সেগুলিকে নিজের সংকীর্ণ প্রিজমের মাধ্যমে নয় বরং একটি ওয়াাইড-অ্যাঙ্গেল লেন্সের মাধ্যমে প্রতিবিম্বিত করে। বেরিয়ে আসে বিশ শতকের জীবনের ফাটল ও বিচ্ছিন্নতা। ... এর জাতিগত প্রবণতাকে বাদ দিলে, রথের বইটি এমন একটি গল্পের প্রতিধ্বনি তোলে যা তিনি উপন্যাসের পর উপন্যাসে বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে, এটি নাথান জুকারম্যানের জীবনের সমান্তরালবর্তী, যেখানে সে নিউ জার্সির একজন কর্তব্যপরায়ণ, মধ্যবিত্ত ছেলে এবং যে তার পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এবং উৎপাটিত হয়েছে নিজের শিকড় থেকে। এখন সে একপ্রকার নির্বাসিত, বন্ধনহীন।
জুকারম্যানকে নিয়ে রথের আরো একটি ট্রিলজি আছে যাকে বলা হয় বাউন্ড ট্রিলজি; এই ট্রিলজির অন্তর্ভুক্ত ‘গোস্ট রাইটার’ (১৯৭৯), ‘জুকারম্যান আনবাউন্ড’ (১৯৮১) ও ‘দ্য এনাটমি লেসন’ (১৯৮৩)। এখানে আনন্দবেদনা ও মিলনবিচ্ছেদ এমনভাবে মিলেমিশে গেছে যে এই ট্রিলজি ট্রাজিকমেডির বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে।
‘গোস্ট রাইটার’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু পরিচয়সঙ্কট, লেখার দায়দায়িত্ব এবং আমেরিকায় ইহুদীদের অবস্থা। তরুণ প্রতিশ্রম্নতিশীল লেখক জুকারম্যান ই.আই. লেনফের গৃহে এক রাত্রি অতিবাহিত করে। লেনফকে মনে করা হয় বার্নার্ড মালামুড অথবা হেনরি রথের প্রতিকৃতি, অথবা তাদের দুজনের মিশ্রণ। লেনফ একজন দুর্দান্ত লেখক এবং জুকারম্যান তার ভক্ত। সেই রাতে লেনফের গৃহে এমি বেলেট নামে এক নারীর দেখা পায় জুকারম্যান। তার সঙ্গে অ্যানি ফ্রাঙ্কের অনেক মিল। অ্যানি ফ্রাঙ্ক হলোকস্ট থেকে বেঁচে গোপণে মার্কিন মুলুকে বসবাস করছিলো। অনেকে লেনফের সঙ্গে ঔপন্যাসিক আইজাক বাশেভিস সিঙ্গারের সাদৃশ্য খুঁজে পান।
‘জুকারম্যান আনবাউন্ড’ উপন্যাসে লেখক ও তার সৃষ্টির মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়েছে। এই পর্যায়ে জুকারম্যান আকাশচুম্বী খ্যাতি অর্জন করে। কিশোরী কার্নোভস্কির সঙ্গে তার সম্পর্কটি বেশ দৃষ্টিকটু হয়ে ওঠে, এবং তা নানা বিতর্কের জন্ম দেয়। এই আখ্যানে তার পিতার মৃত্যু ঘটে।
‘দ্য এনাটমি লেসন’-এ জুকারম্যান মধ্যবয়সে পৌঁছে এবং নানা রোগের লক্ষণ ফুটে ওঠে তার শরীরে। রোগযন্ত্রণার কারণে সে লেখা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। শুয়ে শুয়ে স্মৃতিচারণ করা ছাড়া তার আর কোনো কাজ থাকে না। সে ভাবে তার বিফল বিবাহের কথা, পরিবার পরিজনদের সঙ্গে অম্লমধুর সম্পর্কের কথা। জীবনের ওপর চরম বিরক্ত হয়ে সে তার নিজের বিদ্যাপীঠ শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যায় এবং স্থির করে চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করবে।
বাউন্ড ট্রিলজির সঙ্গে এপিলগ হিসেবে ‘দ্য প্রাগ অর্জি’ সংযুক্ত। এখানে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে জুকারম্যানের নোটবুকে। তার নোটবুক থেকে জানা যায় সে কীভাবে ১৯৭৬ সালে সোভিয়েত শাসিত চেকোস্লোভাকিয়ায় গমন করে এবং সেখানকার অবহেলিত শিল্পীলেখকদের কর্ম উদ্ধার করেন। এখানে একনায়ক শাসনের নানা নির্যাতনের ছবি পাওয়া যায় স্পষ্টরূপে।
পুনবার আমরা জুকারম্যানের সাক্ষাৎ পাই ‘এক্সিট গোস্ট’ (২০০৭) উপন্যাসে। এখানে দেখা যায়, নিউ ইংল্যান্ডে এগারো বছর কাটিয়ে জুকারম্যান নিউ ইয়র্কে প্রত্যাবর্তন করেছে। সে নিউ ইংল্যান্ডে গিয়েছিলো ইনকন্টিনেন্স নামক রোগের চিকিৎসা করাতে। ফিরে এসে সে বিলি ডেভিডফের স্ত্রী জেমি লোগানের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। রাতে হোটেলরুমে বসে সে তার ও লোগানের কল্পিত কথোপকথান নিয়ে একটি নাটক লেখে—অ্যান্ড শি। ডেভিডফ ও লোগানের মাধ্যমে তার পরিচয় ঘটে হার্ভার্ড স্নাতক দাম্ভিক যুবক রিচার্ড ক্লিম্যানের সঙ্গে যে লেনফ নামক এক ভদ্রলোকের জীবনি লেখার কাজে হাত দিয়েছে। জীবনিগ্রন্থের ব্যাপারে জুকারম্যানের সাহায্য প্রার্থনা করে ক্লিম্যান কিন্তু জুকারম্যান তাকে সাহায্য করতে রাজি হয় না। কারণ তাতে লেনফের চরিত্রের এমন এক দিক উন্মোচিত হবে যা খুব অস্বস্তিকর। জানা যায় লেনফ কৈশোরে তার আপন বোনের প্রতি শারীরিকভাবে আকর্ষিত হয়েছিলো। এখানে এক দৃশ্যে দেখা যায় জুকারম্যান, ডেভিডফ ও লোগান একত্রে বসে ২০০৪ সালের ভোটের ফলাফল দেখছে। জুকারম্যান নির্বাচনের ফলাফলে খুশি না হলেও বাস্তবতা হিসেবে মেনে নেয়। এখানে সমাজবিধি লঙ্ঘন করে অযাচারে লিপ্ত হওয়ার ঘটনাটি পাঠকের জন্য পীড়াদায়ক।
উন্মাদনার অপর পিঠ: জরা-ব্যাধি-মৃত্যু:
ফিলিপ রথের উপন্যাসে জীবনের উন্মাদনা যেমন আছে, তেমনি আছে জীবনের নির্জীবতা, দুর্বলতা। মানুষ অমর নয়, নয় সে চিরসুস্থ। তাকে শিকার হতে হয় নানা রোগের, ভোগান্তির, এবং সবশেষে মৃত্যুর। রৌদ্রকরোজ্জ্বল আকাশতলে দৌড়ঝাঁপ শেষ হলে তাকে ফিরতে হয় গৃহের ছায়ায়, পারিবারিক গুহায়, অন্ধকারে। শরীর জীর্ণ হয়, শীর্ণ হয়, এবং শেষ হয় দিনলিপি লেখা। আমরা রথের ‘এভরিম্যান’ (২০০৬) ও ‘নেমেসিস’ (২০১০) উপন্যাসে জীবনের এই করুণ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করি। এ সময়টা লেখক রথের জীবনেরও পড়ন্তবেলা।
‘এভরিম্যান’ শুরু হয় এর প্রধান চরিত্রের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে। জীবনের উদযাপন পরিণত হয় মৃত্যুর উদযাপনে। তার শৈশবে ফিরে যাই আমরা যখন দেখি সে ও তার বড় ভাই হাওয়ি তাদের পিতার দোকান এভরিম্যানস জুয়েলারি স্টোরে কাজ করছে। সে তিনবার বিয়ে করেছে। তার প্রথম সংসারে দুই ছেলে যারা তাদের মাকে পরিত্যাগ করার জন্য পিতাকে দোষারোপ করে। দ্বিতীয় সংসারে এক মেয়ে যে তার পিতাকে দয়ার দৃষ্টিতে দেখে। কিন্তু সেও মাকে ছেড়ে তার পিতার ২৪ বছর বয়সী এক ডেনিশ মডেলকন্যার কাছে চলে যাওয়াটা হজম করতে পারেনি। তার তৃতীয় সংসারও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বৃদ্ধাবস্থায় সে নিউ জার্সির এক রিটায়ারমেন্ট কমিউনিটিতে আশ্রয় নেয় এবং পেইন্টিং করে কোনোরকমে জীবন পার করে। শেষ বয়সে এসে জীবনের নানা ভ্রান্তি ও স্খলনের জন্য সে আক্ষেপ করে। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নাম উন্মোচিত হয়নি, কিন্তু এতে যে লেখকের নিজের জীবনের ছায়া আছে তা বেশ বোঝা যায়। এতে পঞ্চদশ শতাব্দীর মোরালিটি প্লের এভরিম্যান চরিত্রের ছায়াও বর্তমান, যেখানে খ্রিস্টীয় মূল্যবোধের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। মানুষ জীবনের উপলব্ধি আসে জীবনের শেষদিকে। যখন বয়স বাড়তে থাকে, সে একে একে প্রত্যক্ষ করে আত্মীয়—পরিচিতজনদের মৃত্যু এবং হাহাকার ও আর্তনাদের মধ্যে ধীরে ধীরে সে নিজেই এগিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। এভরিম্যানের জীবনের কাহিনী শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে সকলের জীবনের কাহিনী। বিষাদরাগিনী তখন বিকেলের ছায়ার মতো ক্রমে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে।
‘নেমেসিস’ রোগ, মৃত্যু, ভয়, যন্ত্রণা, ক্রোধ, অপরাধবোধ, বিব্রতাবস্থা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর স্থাপিত। ১৯৪৪ সালে নিউ জার্সিতে পোলিওর প্রাদুর্ভাব এবং শিশু ও অন্যান্যদের জীবনের ওপর যে বিরূপ প্রভাবে পড়েছিল তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এখানে। শিশুদের শারীরিক বিকলঙ্গতা দেখা দিচ্ছিল এবং অনেকে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছিল। এই উপন্যাসের কেন্দে্র আছে বাকি ক্যান্টর, যে একজন খেলোয়ার ও ক্রীড়াশিক্ষক। তার আক্ষেপ যে ক্ষীণদৃষ্টির কারণে সে তার বন্ধুদের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিয়ে পারেনি। ক্যান্টরের মধ্যে দেখা দেয় আধ্যাত্মিক সংকট। তার মনে প্রশ্ন: ঈশ্বর কেন নিরপরাধ শিশুদের মৃত্যু অনুমোদন করেন? তার বান্ধবী তাকে অনুরোধ করে ক্যান্টর যেন পোলিও—উপদ্রুত এলাকায় তার চাকরি ছেড়ে দিয়ে তার কাছে চলে আসে যেখানে পোলিও নেই। কিন্তু অসুস্থ শিশুদের ছেড়ে যেতে তার মন সায় দেয় না। এটি তার মধ্যে তৈরি করে এক প্রেমসংকট। এক সময় সে সামার ক্যাম্পে গিয়ে তার বান্ধবীর সঙ্গে মিলিত হয়। সামার ক্যাম্প যা এতদিন পোলিওমুক্ত ছিল, সেখানেও পোলিও হানা দেয়। সেখানে একজন মারা যায় এবং অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ক্যান্টর নিজেও পোলিওতে আক্রান্ত হয়। সামার ক্যাম্পে পোলিওর আবির্ভাবের জন্য সে নিজেকে দায়ী করে। রোগে ভুগে ক্যান্টর বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে এবং সে তার বান্ধবীকে অনুরোধ করে সে যেন তাকে ছেড়ে অন্য কোনো ছেলের কাছে চলে যায় এবং তাকে বিয়ে করে। ক্যান্টরের জীবনে আর বিয়ের বাদ্য বাজে না। এটি ফিলিপ রথের একত্রিশতম উপন্যাস এবং এরপর তিনি উপন্যাস লেখায় ইস্তফা দেন।
জীবনের শেষ দিকে ফিলিপ রথ উপন্যাসের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি এর অনুজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কল্পনা করেছেন। তার মতে, উপন্যাসের যুগ শেষে হয়ে গেছে। বর্তমান যুগে উপন্যাস পড়ার মতো সময় ও নিষ্ঠা মানুষের নেই। পাঠক এখন বিষয়ের উপরিতলে বিরাজ করে এবং সবকিছু হ্রস্বাকারে পেতে চায়। ডিজিটাল স্ক্রিন এখন তার কাছে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এটি তার প্রাত্যহিক জীবনের অপরিহার্য অংশ। সুদূর ভবিষ্যতে হয়তো উপন্যাস নামক কোনো জিনিসের অস্তিত্বই থাকবে না। এর স্থান হবে জাদুঘরে। অথবা এটি টিকে থাকবে শুধু ‘কাল্ট’ হয়ে যেখানে কেবল অল্প কিছুসংখ্যক লোক এর সঙ্গে যুক্ত থাকবে।
পরিশেষে বলা যায়, ফিলিপ রথের গৌরবোজ্জ্বল লেখালেখি বিশ্বসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে ব্যাপকভাবে। তার জীবনের বিচিত্র চিন্তা, ঘটনা ও দর্শন প্রতিফলিত তার সাহিত্যে। ইহুদী পরিবারে জন্ম হলেও তিনি ইহুদী ধর্মের রীতিনীতিতে আস্থাশীল ছিলেন না। তিনি ধর্মের বন্ধন থেকে মুক্তি চেয়েছেন, চেয়েছেন মুক্ত চিন্তার বাতাবরণ। মূলত ধর্ম থেকে দূরে সরার চিন্তাই তাকে জীবনের উদ্দামতার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। সাহিত্য সমালোচক হার্মিয়ন লী মন্তব্য করেন: ফিলিপ রথের কথাসাহিত্য ইহুদি ঐতিহ্য এবং বিধিনিষেধের বোঝা থেকে মুক্ত হওয়ার তাগিদ দেয়। ... মুক্ত ইহুদি চেতনা আমেরিকান স্বপ্নের বিচ্ছিন্নতার মধ্যে নিজেকে ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং গৃহহীন দেখতে পায়। ষাটের দশকের শেষের দিকে ইহুদি অভিবাসীরা যে স্বাধীনতা, শান্তি, নিরাপত্তা, শালীন উদার গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছিল, আমেরিকান সমাজ এবং রাজনীতি তার সঙ্গে শুধু তামাশাই করেছে। ফিলিপ রথের উপন্যাস এক উন্মাতাল সময়ের জীবনযাপনের সাক্ষী হয়ে থাকবে।