সততার রোল প্লে

চিত্তরঞ্জন মারা গেছেন। খবর পৌঁছুল ঠাকুরের কাছে। রবীন্দ্রনাথ তার প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত ছিলেন। 'এই চিত্তরঞ্জন কোনোদিন আমাকে শ্রদ্ধা করতে পারে নি'—এমন একটা খেদোক্তিও আছে তার।

সোহেল হাসান গালিবসোহেল হাসান গালিব
Published : 22 April 2023, 06:39 AM
Updated : 22 April 2023, 06:39 AM

‌‘(ও মন) রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ' গানটা সবচেয়ে ভালো গেয়েছেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। আব্বাসউদ্দীন বা তার ছেলের কণ্ঠে, আনফরচুনেটলি, গানটা আমার ভালো লাগে না। আব্বাসেরটা সম্ভবত পুরোনো রেকর্ডিংয়ের জন্য, আর মোস্তফা জামানেরটা তার বিশ্রী গায়কীর জন্য।

একজন হিন্দুর কণ্ঠে ইসলামি গান সবচেয়ে মধুর হয়ে উঠল কী করে? উল্টোটাও আছে। 'কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন'—শুনে দেখা যেতে পারে খায়রুল আনাম শাকিলের কণ্ঠে।

এখানে একটা ভক্তির ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সে ভক্তি যতটা না দেবতা বা খোদার প্রতি, তার চেয়ে বেশি মনে হয় শিল্পবোধের সুসাম্যে। যাকে বলা যায় 'অন্তর্গত ফাইন টিউনিং'।

 ব্যাপারটা বোঝার জন্য ১৯২৫ সালের একটা ঘটনার দিকে মন ফেরানো যাক। চিত্তরঞ্জন মারা গেছেন। খবর পৌঁছুল ঠাকুরের কাছে। রবীন্দ্রনাথ তার প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত ছিলেন। 'এই চিত্তরঞ্জন কোনোদিন আমাকে শ্রদ্ধা করতে পারে নি'—এমন একটা খেদোক্তিও আছে তার। যদিও আমরা দেখতে পাব চিত্তরঞ্জনের কাব্যপ্রয়াস রবীন্দ্রনাথের 'মানসী'-কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছিল একদিন।

যেমন :

 আছিলে গোপনে মোর মন-অন্তঃপুরে

আমারি বাসনা, মোর এ পঞ্জর জুড়ে।

যেমনি বাজানু বাঁশি, সলাজ চরণে

বাহিরিলে—দাঁড়াইলে—অপূর্ব ধরণে—

(স্বর্গের স্বপন/ চিত্তরঞ্জন)

 যাই হোক, এত বড় দেশনেতা, তার মৃত্যুতে ঠাকুরকে বাণী দিতেই হবে। তো ঠাকুর লিখলেন—

এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ,

মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।

 বাস্তবতার নিরিখে এটা একটা ছল বা চাতুরী। কিন্তু শিল্পে তথাকথিত সততার জায়গা খুব সামান্যই। সততা সেখানে একটা ভান মাত্র। শিল্প নিজে সৎ নয়, তবে সততার রোল প্লে করে—এভাবে বলাটাই ভালো। রোল প্লে করে, কারণ তাকে সততা-শাসিত সমাজে গ্রাহ্য হতে হয়।

 রবীন্দ্রনাথ দায়বদ্ধ ছিলেন শিল্পের কাছে। শিল্পিত আকাঙ্ক্ষার কাছে। কিন্তু কোনোভাবেই চিত্তরঞ্জনের কাছে নয়। এখানে নৈর্বক্তিকতার দোহাই দিয়ে বেশি দূর যাওয়া যাবে না। তার সঙ্গে পারঙ্গমতার প্রশ্নটাও জড়িত।

 কথা শুরু হয়েছিল আর্টের সুমিতি বা সুসাম্য নিয়ে। শিল্প শেষ-বিচারে দক্ষতারই বিষয়। ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা অবিশ্বাস তাকে খুব একটা দূষিত করে না। পবিত্রও করে না। গানের মেশিন নজরুলের দিকে চেয়ে কথাগুলি মনে হলো।

হিন্দু বা মুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নজরুলের সম্পর্কটা আশলে কেমন ছিল, এই প্রশ্ন মনে জাগে। তিনিই সেই উজ্জ্বল ব্যতিক্রম, বলা ভালো একমাত্র, যিনি এই দুই জনগোষ্ঠীরই কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। অনেকে বলে থাকেন, গ্রামোফোন কোম্পানিতে চাকরিসূত্রে অনেকটা কর্তৃপক্ষের ফরমায়েশে শ্যামাসংগীত ও ইসলামি গজল রচনা করেছেন তিনি। এই বক্তব্য আমরা হেসে উড়িয়ে দেব না। এটুকু আমরা অনুমান করতে পারি, কমার্শিয়াল একটা ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু গ্রামোফোন কোম্পানিতে ঢোকার দশ বছর আগে থেকেই নজরুলের কবিতায় ও গানে ইসলামি মিথ ও হিন্দুপুরাণ যুগপৎ জায়গা দখল করে আছে। ইসলামি গান রচনার ক্ষেত্রে আব্বাসউদ্দীনের মধুরতম উস্কানির কথাও আমরা শুনতে পাই। নজরুলেরও নিজস্ব দায় ছিল মুসলমান ধার্মিকচিত্ত জয় করার। কেননা কাফের ফতোয়া মাথায় নিয়ে তিনি যে খুব স্বস্তিতে ছিলেন তা নয়। অন্যদিকে হিন্দুদের তরফে তাকে যবন ও মৌলানা বলার জন্যও ক্ষুব্ধ ছিলেন তিনি।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এই দ্বৈত পরিচয়কে পলিটিক্যালি এনকাউন্টার করার ব্যাপারে কবি নজরুল যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনাচরণে এই দুই ধর্মগোষ্ঠীর সঙ্গে তার আধ্যাত্মিক সংযোগ ছিল কিনা, সে প্রশ্নটা তোলা দরকার। নজরুলের বিবাহটাই ছিল একটি বিশেষ ফতোয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রমীলার সঙ্গে তার বিয়ে আইনি ফয়সালায় রেজেস্ট্রির মাধ্যমে হয় নি, হয়েছিল সম্পূর্ণ ধর্মীয় বিধানে। যে বিধানের মূল কথা হচ্ছে, কোনো মুসলমান পুরুষ আসমানি কিতাবধারী যেকোনো নারীকে ধর্মান্তরিত না করেই বিয়ে করতে পারবে। নজরুলের ব্যাখ্যা ছিল এমন যে, যেহেতু কোরআনে বলা হচ্ছে, আল্লাহ প্রত্যেক জাতির কাছে পয়গম্বর পাঠিয়েছেন এবং কোনো জাতিকে তিনি শাস্তি দেন না সতর্কতাকারী প্রেরণব্যতীত, অতএব ভারতবাসীর কাছেও পয়গম্বর এসেছে, সেই হিশেবে তারাও আহলে কিতাব বা কিতাবধারী। আর তাই বিয়ের জন্য প্রমীলা দেবীর ধর্মান্তরিত হবার প্রয়োজনই নেই।

কেবল বিধান নয়, অনুধ্যানে প্রবেশের পথে নজরুলের একটা গান স্মরণীয় : ‘কাবার জিয়ারতে তুমি কে যাও মদিনায়’। কাবার জিয়ারতে কেন মদিনায় যাওয়ার প্রশ্ন উঠছে? কাবা তো মক্কায়, এটা কি জানতেন না নজরুল? তাহলে কথাটা কি ‘কবর জিয়ারত’ হবে? ‘কাবা’ হলেইবা কী সমস্যা? কারণ সুফিদের একটা গোষ্ঠী এটা মনে করেন, হযরত মুহম্মদ কাবারও কাবা। কিভাবে? মক্কা বিজয়ের দিন যখন কাবার ওপর উঠে হযরত বেলাল আজান দেবেন, তখন তিনি দ্বিধায় পড়ে গেলেন, কোন দিকে মুখ করে আজানটা দেবেন? রাসুল তখন বললেন, আমার দিকে তাকিয়ে আজান দাও। তার মানে হলো কাবারও কেবলা হলো স্বয়ং মুহম্মদ। অর্থাৎ আশল কেবলা তিনি। সুতরাং আশল কেবলা অর্থাৎ মূল কাবার জিয়ারত করতে হলে তো মদীনাতেই যেতে হবে।

এইসব বলার উদ্দেশ্য একটাই, নজরুল ধর্মটাকে কেবল আউটসাইডার হিশেবে ডিল করেন নাই। ইনসাইট ভিউ তার ছিল। কালীর ব্যাপারেও একই বক্তব্য। প্রমীলার সুস্থতার জন্য তিনি রীতিমতো কালী-উপাসনা করতেন। সেই পরিস্থিতিতে তাকে একজন খাঁটি কালীভক্ত মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

স্প্লিট পার্সোনালিটি বললে হয়তো এই দ্বিচারিতাকে ইউরোপীয় কায়দায় সহজেই ব্যাখ্যা করা যেত। কিন্তু আচরণটাকে ব্যক্তির ভিতরে অনুসন্ধান না করে খানিকটা সমষ্টির ভেতর সন্ধান করা যাক। বাঙালি জাতটার মধ্যেই মোটা দাগে আছে এই দ্বৈততা, দ্বিমাত্রিকতা, দ্বিরূপতা—ডাইমোরফিজম। বাঙালি মানেই হরগৌরীর যুগলবন্দির মতো, অর্ধনারীশ্বরের মতো হিন্দুমুসলমান। এটা নজরুলের চেয়ে গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারেন নি কোনো বাঙালি কবি। এই অনুধাবন পাঠ-অভিজ্ঞতা নয় শুধু, জীবনের ভেতর উদযাপন করে তাকে সত্য করে তোলা। যাকে আমরা পূর্বে বলেছি অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা।

তিনি বলেন বটে ‘তাজী বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার হিম্মদ-হ্রেষা হেঁকে চলে’, কিন্তু এই জাক্সটাপজিশন কাব্যে যতটা সহজ, জীবনে ততটা নয়। এইখানে জীবনের সঙ্গে শিল্পের একটা স্যাপারেশন ঘটে। শিল্প নৈর্ব্যক্তিকতা লাভ করে। এই নৈর্ব্যক্তিকতারই অন্য নাম ‘রোল প্লে’।

নজরুলের কাব্যে, গানে তার আর্টের এক্সপ্রেশন তাই মুসলমানের অধিক মুসলমানির, হিন্দুর অধিক হিন্দুয়ানির রোল প্লে করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা যে উভয়েরই কাছে গ্রাহ্য হয়, তার মূল কারণ কবিত্ব।