এম এন রায়: মেক্সিকো-প্রবাসের স্মৃতি-১০

মেয়েটির কন্ঠ আমাকে মুগ্ধ করেছে বুঝতে পেরে চার্লি ঘোষণা করল প্রথমে এলিনরের আগে তার গলার আওয়াজের প্রেমে পড়েছিল।

প্রিসিলা রাজপ্রিসিলা রাজ
Published : 19 March 2024, 03:23 PM
Updated : 19 March 2024, 03:23 PM

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার আরবেলিয়া গ্রামে শাক্ত ব্রাহ্মণ ভট্টাচার্য পরিবারে ১৮৮৭ সালে জন্ম নরেন্দ্রনাথের যিনি পরে এম এন রায় হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামী, কমিউনিস্ট বিপ্লবী ও তাত্ত্বিক মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সমধিক পরিচিতি উদার মানবতাবাদের (radical humanism) তাত্ত্বিক ও প্রবক্তা হিসেবে। বিপ্লবী জীবনে তাঁকে বহু ছদ্মনাম নিতে হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি প্রয়াত হন এই মনিষী।

মেক্সিকো সফর তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। এক অর্থে তার রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেও মানবেন্দ্রনাথের মেক্সিকো-সফর বড় ধরনের বাঁক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ইংরেজিতে লিখিত তাঁর স্মৃতিকথা Memoirs ১৯৬৪ সালে দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয়। ৬২৮ পৃষ্ঠার এই দীর্ঘ স্মৃতিকথার শতাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে মেক্সিকো বাসের রোমাঞ্চকর ও ঘটনাবহুল স্মৃতি। মূল গ্রন্থের ৫ম অধ্যায় থেকে ২৯ অধ্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত সেই স্মৃতিচারণ। স্মৃতিকথার এই নির্বাচিত অংশ কলামিস্ট অনুবাদক প্রিসিলা রাজ-এর অনুবাদে ধারাবাহিকভাবে বাংলা ভাষায় প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আজ থাকছে মেক্সিকো সফরের দশম পর্ব। এই অনুবাদে মূল বইয়ের পর্ব-বিন্যাস অনুসরণ ও উল্লেখ করা হয়েছে।

১৪

মেক্সিকোয় মার্কিন র‌্যাডিকেলরা

আমার অনুপস্থিতির সময়টায় আমেরিকা থেকে কয়েকজন ভারতীয় বিপ্লবী মেক্সিকোয় এসে হাজির হয়েছিলেন। বোঝা গেল তরুণ যে ভদ্রলোক আমার থেকে কয়েক হাজার ডলার নিয়ে চম্পট দিয়েছিলেন এবং প্রতিদান হিসেবে আমেরিকায় ফিরে আমার স্বরূপ উন্মোচন করবেন বলে হুমকি দিয়েছিলেন তিনিই এনাদের কানে আমার সোনার খনির খোঁজ পাওয়ার খবরটা পৌঁছে দিয়েছিলেন। সদ্য আগত অতিথিরা জার্মান কনস্যুলেটে গিয়ে নিজেদের আগমন সম্পর্কে জানান দিলেন। দুর্ভাগ্যবশত কনস্যুলেট এ ব্যাপারে কিছু করতে অপারগ ছিল। অভিযান থেকে ফিরে এসে আমাকে কতিপয় উত্তপ্ত বিপ্লবীর মুখোমুখি হতে হলো। লুটের মাল নিয়ে একাই চম্পট দিয়ে তাঁদের সঙ্গে বিষম প্রতারণা করেছি বলে মনে করছিলেন তাঁরা। তাঁদের উষ্মা প্রশমনে প্রত্যেককে সপ্তাহে কয়েকটি করে সোনার ইঁট দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হলো। কুড়ি পেসোর একেকটি মুদ্রাকে আমরা নিজেদের মধ্যে সোনার ইঁট বলে ডাকতাম।

এদের মধ্যে একজন আবার লুটের মালের এইটুকু বখরায় খুশি ছিলেন না। ইনি একটা সময় আমেরিকা ও দূরপ্রাচ্যে বার্লিন বিপ্লবী কমিটির প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি জাপানে পাড়ি দিতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। সেখানে প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে যোগাযোগ আছে জানিয়ে বললেন, একবার সেখানে পৌঁছালে চীনে প্রয়োজনীয় যে-কোনো কাজ করা সম্ভব হবে। আমাকে ডিঙিয়ে জার্মানদের কাছে প্রস্তাবটা পাড়লেন তিনি। তারা আবার আমার কাছেই পরামর্শ নিতে বলল কারণ ততদিনে এ ব্যাপারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলে মেক্সিকো থেকে চলে গেছেন। লোকটির যেখানে-সেখানে নাক গলানো বন্ধ করতে এবং নিজের অতীতের সঙ্গে বাকি যোগাযোগে ইতি টানার জন্য তাঁর জাপান যাওয়ায় সম্মতি দিলাম। কত টাকা লাগবে? ওটাই সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন। তা, উনি একটা অবিশ্বাস্য পরিমাণ টাকা হেঁকে বসলেন। আমি দশ হাজার ডলার দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বললাম জাপান পৌঁছালে আরো দেব। জাপানযাত্রার জন্য দশ হাজার ডলারের চেয়ে অনেক কম অর্থ লাগবে। এই প্রস্তাবে রাজী না হয়ে লোকটির উপায় ছিল না। তাঁর পরিকল্পনা ছিল আমেরিকা হয়ে জাপানে যাত্রা করবেন কারণ সেখানে তাঁকে সাহায্য করার মতো লোকজন আছে। উনি মেক্সিকো ছাড়ার কয়েক হপ্তার মধ্যে একটা চিঠি পেলাম। তাতে উনি লিখেছেন উনি আবার মেক্সিকো ফিরে এসেছেন এবং জার্মানদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে আমি তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছি। কে কার সঙ্গে প্রতারণা করছে! যাই হোক, আমার সব জার্মান বন্ধুরা ততদিনে মেক্সিকো ছেড়েছেন। আমার পক্ষে আর কাউকে প্রতারণা করা সম্ভব নয়। আমারও কারো দ্বারা প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই।

মেক্সিকোয় আগত ভারতীয়দের মধ্যে একটি ভারী মিষ্টি লোক ছিল। পেশাদার বিপ্লবী ছিল না সে, তবে এদের সঙ্গে সামাজিক মেলামেশায় জড়িয়ে গিয়েছিল। চৌকস মিস্ত্রি ছিল সে। ফোর্ডের কারখানায় মোটা বেতনের চাকরি করত। রাজনীতিতে বলতে গেলে কোনো আগ্রহই ছিল না তার। মেক্সিকানদের মাথামোটার দল বলে মনে করত। আমার নতুন ভাবনাচিন্তার ব্যাপারেও তেমন শ্রদ্ধা ছিল না ছেলেটির। দিনে পাঁচ ডলার উপার্জন করে যে মিস্ত্রি তার সমাজতন্ত্র নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। সে ছিল অলস প্রকৃতির। ডেট্রয়েটের ফ্যাক্টরির লোভনীয় চাকরিতে ফিরে যাওয়ার নাম করত না। এমন একটা অরাজনৈতিক লোককে দিয়ে আমার কোনো কাজ হবে না। কিন্তু তারপরও সে থেকেই গেল আর আমিও তাকে প্রতি সপ্তাহে স্বর্ণইষ্টক দিয়ে যেতে থাকলাম। সে আরামসে ছুটি কাটাতে আসা ব্যবসায়ীর ভূমিকায় অভিনয় করে যেতে লাগল।

যে লক্ষ্য নিয়ে আড়াই বছর আগে ভারত ছেড়েছিলাম এই অভিযান ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাতে ইতি ঘটল। এর ফলে আমার রাজনৈতিক জীবনের সেই অংশটিরও যবনিকা পড়ল। ভারতের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে অদূর ভবিষ্যতে আমার দ্বারা খুব একটা কিছু করে ওঠা সম্ভব হবে না সেটা বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম। তাই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের নতুন ক্ষেত্রগুলোয় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করব বলে স্থির করলাম। এর মধ্য দিয়ে সাফল্য হয়তো সহসা ধরা দেবে না, তবে এক ধরনের তৃপ্তি তো হবে।

এরপর এখানকার সমাজতান্ত্রিক নেতাদের সঙ্গে মেক্সিকোর সংবিধানে জাতীয়করণ সম্পর্কিত নির্দেশনার কারণে আমেরিকান আগ্রাসনের হুমকির ব্যাপারে যে আলোচনা হয়েছিল এবং সেখানে তাঁদের যে দৃষ্টিভঙ্গী বেরিয়ে এসেছিল সে বিষয়ে মনোযোগ নিবদ্ধ করলাম। আমার কাজ শুরু হবে এই বিষয়টাকে ধরেই। এর মধ্য দিয়ে একদিকে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শকে কার্যকর রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত করা সম্ভব হবে, অন্যদিকে সম্ভাব্য যে-কোনো বিদেশী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিরোধ সংগ্রামের শক্তি বৃদ্ধি করা হবে। আরো এগিয়ে যদি ভাবা যায়, দক্ষিণ আমেরিকার একেকটি দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে ক্রিয়াশীল সম্পর্কের বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে লাতিন আমেরিকান ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব হবে। একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হবে এই মঞ্চ। সম্পৃক্ত দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার সেতুবন্ধন রচনা করবে; অপরদিকে উত্তরের মহাশক্তিধর চাপকেও মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে।

পুনঃপুনঃ বিপ্লব এবং বিরামহীন গৃহযুদ্ধ লাতিন আমেরিকার সবগুলো দেশের জন্য বাস্তবিক একটা অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছিল। এসব বিপ্লব-বিদ্রোহ মূলত প্রতিষ্ঠিত সরকারগুলোর বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর দ্বারা পরিচালিত। তাদের মদদ যোগাত এসব দেশের অর্থনীতিতে গেঁড়ে বসা বিদেশী শক্তিগুলো যারা প্রতিষ্ঠিত সরকারগুলোকে পছন্দ করত না। বেসামরিক জনতা স্বাভাবিকভাবেই কৃত্রিমভাবে ঘনিয়ে তোলা এসব বিপ্লব-বিদ্রোহের অনুগামী হতো। কিন্তু যেহেতু সত্যিকার অর্থে কোনো রাজনৈতিক নীতি বা সামাজিক কর্মসূচির প্রশ্ন এসব বিপ্লবের সঙ্গে জড়িত ছিল না, সেহেতু এতে জড়িত সাধারণ মানুষ একটা সময় ডাকাতির মতো ছিঁচকে কাজে জড়িয়ে পড়ত। পেশাদার সামরিক লোক ও হাতে গোণা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রীর পক্ষেই কেবলমাত্র এ ধরনের ধ্বংসাত্মক অভিযানে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অংশগ্রহণ করা সম্ভব। সম্পদশিকারী এই গোষ্ঠীর হয়ে লড়ার জন্য ও প্রতিদ্বদ্বী গোষ্ঠীর কামানের মুখে পড়ার জন্য চাই ভাড়াটে সৈন্যের দল। সেই সৈন্যের ধারাবাহিক সরবরাহ হতো অজ্ঞতা, দারিদ্র্য ও তীব্র অভাবের মধ্যে পড়ে থাকা পল্লীবাসীদের মধ্য থেকে।

ওদিকে চলমান এই পরিস্থিতিতে বীতশ্রদ্ধ শিক্ষা ও উচ্চতর সংস্কৃতির অধিকারী শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি সামরিক বিদ্রোহ ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ঘনঘটা থেকে দূরে থাকতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করত। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশের তুলনামূলক স্বল্প সংখ্যক শিল্পশ্রমিকদের অংশটি নৈরাজ্য-সিন্ডিকেটবাদের প্রভাবে জারিত হয়ে রাজনীতি ও রাজনীতিকদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। এরই প্রভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখাই তাদের দস্তুর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে জোরালো সামাজিক দায়িত্ববোধ ও শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে বৃহত্তর বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গী একটি সুস্থ জাতীয় জীবনের জন্য অনিবার্য পূর্বশর্ত। বৈদেশিক শক্তির আগ্রাসী মনোভাবকে প্রতিহত করার জন্যও একই শর্ত প্রযোজ্য। এমন এক ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে আমি মেক্সিকোতে গিয়ে পড়েছিলাম যেখানে দাঁড়িয়ে সেদেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করার মতো অবস্থা আমার ছিল।

কাজের নতুন ক্ষেত্র বেছে নেওয়ার পর এবং এর বিন্যাসটা মনের ভেতরে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলে পরে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। পেছনে ফেলে আসা ব্যর্থ অভিযানগুলোর জন্য, নিষ্ফলা অতীতের জন্য মনের ভেতর কোনো খেদ রাখব না বলেও ঠিক করলাম। দেশের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব দেখা করতে হবে। আমার সাম্প্রতিক অভিযান সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন শুধু না, তাঁর সরকার প্রচ্ছন্নভাবে আমাকে সুরক্ষার ব্যবস্থাও করেছিল। ফলে আমার ফিরে আসার খবরটিও তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। তবে এখন তাঁর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য সেই জার্মান মধ্যস্থতাকারীকে পাওয়ার উপায় নেই। সুতরাং রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য নিজেকেই এগোতে হবে। এক্ষেত্রে লা মুহের মদের্না আমাকে সাহায্য করতে পারবে হয়তো। এল পুয়েবলোর সম্পাদক মশাইও সাহায্য করতে পারেন। ইতিমধ্যে এখানকার সমাজতন্ত্রী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগগুলো আবার শুরু করতে হবে। তাঁদের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতিতে সামাজিক বিপ্লবের পন্থা সম্পর্কে জরুরি আলোচনা আছে। এসব ভেবে সান্তিবানঞেস-এর সঙ্গে দেখা করতে চললাম। সেখানে দেখা হলো কতিপয় তরুণ মার্কিন র‌্যাডিকেলের সঙ্গে।

যুদ্ধ (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ) শুরু হওয়ার পরপর যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। সেটা এড়াতে শ’য়ে শ’য়ে শান্তিবাদী, নৈরাজ্য-সিন্ডিকেটবাদী ও নানা রঙের সমাজতন্ত্রী মেক্সিকোতে ভীড় জমিয়েছিল। এদেরকে “কুঁড়েরর দল” বলে ডাকা হতো। নিজ নিজ আগ্রহ এবং প্রবণতার জায়গা থেকে এদের কেউ সাপাতিস্তাদের সঙ্গে যোগ দিতে চাইছিল, কারো ইচ্ছা ইউকাতানের এল দোরাদোতে যাওয়ার। বাকিরা যে-কোনো জায়গায় ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখতে চায়। কিন্তু এসব শরণার্থীর অধিকাংশ শেষমেশ রাজধানীতেই এসে ভীড় জমাল।

রাজনৈতিক-সামাজিক আদর্শের দিক থেকে এসব শরণার্থী কাছাকাছি ধারার ছিল। পাশাপাশি মার্কিনদেশের বামপন্থী সাংবাদিকতা, শিল্প ও সাহিত্যেরও মোটামুটি সব ধারার লোকজনের সমাহার ঘটেছিল এদের মধ্যে। দলটির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবি ও কার্টুনিস্ট মরিস বেকার, ঔপন্যাসিক আরউইন গ্রিনউইচ (পরে মাইকেল গোল্ড নামে খ্যাত), চিত্রকর ও কার্টুনিস্ট হেনরি গেনটেনক্যাম্প, সাংবাদিক কার্ল বিল্স্ যিনি পরবর্তীকালে মেক্সিকো ও স্পেনের ওপর বই লিখে নাম করেছিলেন। প্রথম তিনজন ম্যাক্স ইস্টম্যান সম্পাদিত সাহিত্য ও শিল্প বিষয়ক উদারনৈতিক জার্নাল দ্য মাসেস-এর নিয়মিত লেখক ছিলেন। আবার এদের সকলেই নিউইয়র্কের বোহেমিয়া হিসেবে খ্যাত গ্রিনউইচ ভিলেজ গ্রুপের সদস্য।

এই দলের দু’জনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল সমাজতন্ত্রী নেতার বাসায়। একজন চার্লি ফিলিপস যে সম্প্রতি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শান্তিবাদী প্রতিবাদ সভা আয়োজন করে কুখ্যাতির ভাগীদার হয়েছে। সহপাঠী এক মেয়ের সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিল চার্লি। মেয়েটার বাবা ছিলেন একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক। ওরা দু’জনে পালিয়ে মেক্সিকো চলে আসে। নিরাপদে পৌঁছানোর পর বিশাল উত্তেজনার মাঝে দু’জনে বিয়েও করে ফেলে। চার্লি ছিল মহাফুর্তিবাজ এক ছেলে। ওর খ্যাতিও জুটেছিল সেজন্য। নিউইয়র্কে থাকতেই আমার সম্পর্কে শুনেছিল। মেক্সিকোতে আমার সঙ্গে দেখা হয়ে যারপরনাই পুলকিত হয়ে উঠল। আমার অবশ্যই অন্যদের সঙ্গেও দেখা করা উচিত, বিশেষ করে এলিনরের সঙ্গে, মতামত জানায় চার্লি। চার্লি ও আমি অচিরেই বন্ধু হয়ে উঠলাম। শিগগিরি শান্তিবাদ থেকে বেরিয়ে এসে শ্রেণী সংগ্রামের বিপুল সমর্থক হয়ে উঠল ও। তবে রাজনৈতিক এই বিবর্তন প্রক্রিয়ায় এলিনরকে হারাতে হলো। চার্লির মতে দৈহিক দিক থেকে বিচ্ছেদ ঘটলেও এলিনরের সঙ্গে তার স্নেহমধুর সম্পর্ক রয়ে গেছে। হয়তো চার্লির আহত হৃদয়ের সান্তনা ছিল সেটা। মেক্সিকোর প্রতিনিধি হিসেবে আমার সঙ্গে সে-ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় বিশ্বসম্মেলনে যোগ দিয়েছিল। এরপরে মানুয়েল গোমেস যখন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইউএসএ’র প্রভাবশালী সদস্য হয়ে উঠেছিলেন তখন চার্লিও যোগ দিয়েছিল।

সেই সন্ধ্যায় চার্লির দাওয়াতে এক রেস্টুরেন্টে উপস্থিত হলাম। সেখানে আরো তিনজনের সঙ্গে দেখা হলো। এরা হচ্ছে, আরউইন গ্র্যানউইচ, মরিস বেকার ও হেনরি গ্লিনটেনক্যাম্প। এছাড়া নিমন্ত্রণকর্ত্রী হিসেবে এলিনর তো ছিলই। চার্লির কলেজ ক্যাম্পাসসুলভ আমুদে ভাব অশ্লীলতার দিকে বাঁক নিল একপর্যায়ে। তাতে আমার তখনও ঝেড়ে ফেলতে না পারা পিউরিটান মূল্যবোধে বেশ ঘা লাগছিল। আমাদের নিমন্ত্রণকর্ত্রীর চোখে পড়ার মতো ব্যক্তিত্বে তার গভীর খাদের মতো কণ্ঠস্বর বিশেষ মাত্রা যোগ করেছিল। মেয়েটির কন্ঠ আমাকে মুগ্ধ করেছে বুঝতে পেরে চার্লি ঘোষণা করল প্রথমে এলিনরের আগে তার গলার আওয়াজের প্রেমে পড়েছিল। এমন গলার স্বরের কারণে এলিনরের প্রতি যে কেউ আকৃষ্ট হবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে আরো কারণ ছিল। মেয়েটি ছিল শান্ত ও সংস্কৃত। রাজনীতির প্রতি খুব বেশি যে আগ্রহী তা নয়। চার্লি তার মনোযোগের বিষয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সে তার উপযুক্ত ছিল না। অচিরেই চার্লিকে ত্যাগ করেছিল মেয়েটি। অত্যন্ত কড়াভাবেই ত্যাগ করেছিল। তবে পরে যাকে বেছে নিয়েছিল সে-ও খুব উপযুক্ত ছিল না তার।

আমেরিকান র‌্যাডিক্যালদের সঙ্গে প্রথম সন্ধ্যার বৈঠকে আরউইন গ্র্যানউইচ বিশেষ করে আকর্ষণ করেছিল আমাকে। গরিব ইহুদী পরিবারের সন্তান আরউইন বড় হয়েছিল পূর্ব নিউইয়র্কের ঘেটোতে। প্রথম জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাকে নৈরাজ্য-সিন্ডিকেটবাদীদের ধ্বংসাত্মক পথের দিকে চালিত করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই মতবাদের প্রতিনিধি আইডব্লিউডব্লিউ (ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড, যাদেরকে “ওবলিজ” বলে ডাকা হতো)। মধ্যপঁচিশের এই যুবক বিপ্লবী ঔপন্যাসিক হিসেবে এরই মধ্যে কিছু নাম কুড়িয়েছে। তার স্বপ্ন গোর্কির “নৈশনিবাস”-এর মতো কালজয়ী উপন্যাস লেখা যার উপজীব্য হবে নিউইয়র্কের বস্তির জীবন। তবে আরউইনের তিক্ততা ও সিনিসিজম মূলত ওপর-ওপর; আদতে সহিষ্ণু স্বভাবের ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের যুবক সে। সাক্ষাতের প্রথম দিন থেকেই আমি তাকে অসম্ভব পছন্দ করে ফেলি আর সে নিজেও তাতে সাড়া দেয়। আমাদের মধ্যে এত দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে যায় যে আমি তাকে ভারতে থাকাকালে আমার প্রথম যৌবণের একটা পর্বের গল্প শুনিয়ে ফেলি। সে আবার তার ওপর ভিত্তি করে একটা ছোট গল্পও লিখে ফেলে যেটা পরে আমেরিকান এক সাহিত্য পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল।

মরিস বেকারও ছিল একইরকম পছন্দ করার মতো মানুষ। চিন্তাভাবনায় বোহেমীয় ধরনের অস্পষ্টতা সত্ত্বেও তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা বামধারার সমাজতন্ত্রের অনুকূল ছিল। “কুঁড়ের দলের” মধ্যে গ্লিনটেনক্যাম্পই একমাত্র অ-ইহুদী। তাদের অধিকাংশেরই বাবা-মা ইউরোপীয় ইহুদীদের উত্তরপুরুষ। গ্লিনটেনক্যাম্পের গোড়া যে ওলন্দাজ তা নাম দেখেই বোঝা যায়। সে কারণেই অ-ইহুদী সাধারণজনের রক্ত তার শরীরে বইছে না।

সেই সান্ধ্য পার্টিতে মূলত এলিনরের সঙ্গে খাতির জমাতে ব্যস্ত ছিল গ্লিনটেনক্যাম্প। এলিনরও তার মতো অ-ইহুদী। তারুণ্যউচ্ছ্বল প্রেমের চেয়ে রক্তেরই জিত হয় শেষে। এলিনর চার্লিকে ত্যাগ করে হেনরি গ্লিনটেনক্যাম্পের সঙ্গে জুটি বাঁধে। তবে শুরুতে তার কারণ ছিল যৌনতা বিষয়ক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আগ্রহ যা অত্যন্ত ইতিবাচক রূপে প্রতিভাত হয়েছিল। একটা ইতালীয় রেস্টুরেন্টে মিলিত হয়েছিলাম আমরা। খাদ্য ছিল দারুণ উপাদেয়। তবে আমি যখন আঁটোসাঁটো খড়ের জ্যাকেটে মোড়া পেটমোটা বোতল থেকে ঢালা গাঢ় লাল রঙের পানীয়টি ফিরিয়ে দিলাম ওরা যারপরনাই অবাক হলো। অতীব দুঃখের সহিত আরউইন আমার ভাগের পানীয় সাবাড় করে দিয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। তারপর দিলখুশ মেজাজে নেশা হওয়া ও মাতলামো যে এক নয় বিশদ ব্যাখ্যায় তা বোঝাতে লেগে গেল। তার কথায় যুক্তি আছে মেনে নিলাম। ফলে নিজের রক্ষণশীলতার শেষ মোড়কও আমার খসে পড়ল। খুব জোরেশোরে ভেঙে পড়ল তা নয়। নিঃশব্দেই পড়ল। সেদিন আর পান করলাম না। তবে অচিরেই এই সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসব সেই কথা দিলাম।

আড্ডা শেষ হওয়ার আগে চার্লি একটা খবর দিলো। কোনো এক মেক্সিকান জেনারেল (নামটা ও বলতে পারল না) একটা দৈনিক বের করার পরিকল্পনা করছেন। পত্রিকার নাকি একটা ইংরেজি বিভাগ থাকবে যার জন্য একজন সম্পাদক খুঁজছেন উনি। কোনো দৈনিকের ইংরেজি বিভাগ সম্পাদনার জন্য মেক্সিকান কাউকে খুঁজে বের করা একটু কঠিনই বলতে হবে। আবার কোনো মার্কিন বা বিলাতীর পক্ষেও কাজটা নেওয়া সম্ভব নয়। তাতে নেটিভের অধীনে কাজ করতে হবে আর তাতে তার আঁতে ঘা লাগবে। ওরা কাজটা তাই চার্লিকে অফার করেছে। চার্লির কি কাজটা নেওয়া উচিত? অর্থকড়ির দিক থেকে ব্যাপারটা লাভজনক। টাকার অভাবে কুঁড়েদের দলটির প্রায় অনহারের দশা হয়েছে। পেট ভরানোর জন্য বিশ্বাসের সাথে আপোস করা ঠিক হবে না বলে জানালাম। ওরা সেটা করতেও রাজী নয়। ঠিক হলো, কে দৈনিকটা বের করতে চাচ্ছে এবং কী উদ্দেশ্যে সেটা আগে জানতে হবে।

আমাদের পরবর্তী সাক্ষাতের আগে কয়েকটা দিন কেটে গেল। সেই কয়েক দিনে এ বিষয়ে নানা তথ্য যোগাড় করা হলো। জানা গেল পত্রিকাটা শুরু করতে চান জেনারেল আলবারাদো। দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাঁর। ইউকাতানে তাঁর কার্যক্রম তাঁর সমর্থনের ভিত্তিমূল হিসেবে ধরা হয়েছে। ফলে প্রকাশিতব্য কাগজের সুর হবে সমাজতান্ত্রিক। তবে যেহেতু মেক্সিকোর রাজনৈতিক আবহাওয়ায় মার্কিন প্রভাবের নিয়ামক ভূমিকা আছে সেহেতেু নিজের আকাঙ্ক্ষা পূরণে জেনারেল আলবারাদো মার্কিনী সমর্থন পাওয়ার ব্যাপারে ব্যগ্র ছিলেন। মেক্সিকো সম্পর্কে মার্কিন জনমতের ওপর এখানে বসবাসরত মার্কিনীদের বিপুল প্রভাব আছে। মেক্সিকোয় বসবাসরত মার্কিনিদের সহানুভূতি ও মনোযোগ আকর্ষণ করার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পদে জেনারেল আলবারাদোর প্রার্থিতার সপক্ষে তাদের মধ্যে জনমত গঠন ছিল প্রস্তাবিত দৈনিকের ইংরেজি সংস্করণের উদ্দেশ্য। চার্লি ও তার সঙ্গীদের মধ্যে সাধারণ মতামতটা ছিল, এ ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকাশিত একটি পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব মার্কিনি গণতন্ত্রের বিরোধী র‌্যাডিকেলদের আদর্শের সঙ্গে যায় না। তবে একটা বিষয় বিবেচনায় নিতে বললাম তাদেরকে, যেটা হলো, এর ইংরেজি সংস্করণটি পত্রিকার সমাজতন্ত্রী সুরের বিরুদ্ধে যেতে পারবে না। ফলে ইংরেজি বিভাগের সম্পাদকের একটা স্বাধীনতা থাকবে। এতে করে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই সেনাপতি প্রকৃতপক্ষে কী চাচ্ছেন তা বোঝার সুযোগ করে দেবে। সেটা ঠিক করার দায়িত্ব নিলাম আমি। চার্লি কাজটা নেবে বলে ঠিক হলো। তবে কথা থাকল আমিসহ র‌্যাডিকেলদের ছোট এক দল যৌথভাবে কাজটা সম্পন্ন করবে।

সমরমন্ত্রীর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের কিছু পরই জেনারেল আলবারাদো রাজধানীতে এসে উপস্থিত হলেন এবং তাঁর সঙ্গে আমার দেখাও হলো। ড. জর্ডান আমার পরিচয় উল্লেখপূর্বক যে চিঠি তাঁকে দিয়েছিলেন তা যুদ্ধমন্ত্রীর হাতে দেওয়ার পর তিনি আর ফেরত দেননি সেকথা আলবারাদোকে জানালে তিনি বেশ আমুদে হাসি হাসলেন। কমান্ডার-ইন-চিফ অধীনস্থ জেনারেল আলবারাদোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক জানতে কৌতূহলী ছিলেন এবং চিঠিতে কোনো গুরুতর তথ্য না থাকায় সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। অন্যদিকে চিঠিটাতে জেনারেল আলবারাদো ও আমার পরস্পর পরিচয়মূলক সুপারিশও ছিল। শান্তিবাদী এই দলটির রাজনৈতিক বিশ্বাস অনুযায়ী মেক্সিকোয় মার্কিন হস্তক্ষেপে তাদের সমর্থন ছিল না। তাদের দাবি ছিল যুক্তরাষ্ট্রকে মেক্সিকোর মিত্র হতে হবে। পরবর্তীকালে জানতে পেরেছিলাম কাররান্সা সরকারের প্রতি জেনারেল আলবারাদোর বিশ্বস্ততা নিয়ে সন্দেহ আগে থেকেই ছিল, কারণ তাঁর রাষ্ট্রপতি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা কারো অজানা ছিল না। মেক্সিকোয় রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র নিয়ে খোলাখুলি কথা হতো।

ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতি পদে আরো একজন প্রতিদ্বদ্বীর উদয় হয়েছিল। ইনি জেনারেল অব্রেগন। তাঁর ব্যাপারে মার্কিনদের সমর্থন ছিল আরো একটা ওপেন সিক্রেট। তিনি আবার ছিলেন মিত্রবাহিনীবান্ধব। এদিক থেকে দেশটির অন্যান্য মেক্সিকান রাজনীতিবিদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ইনি। অব্রেগন আবার ১৯২০ সালে সশস্ত্র অভ্যুত্থান করে কাররান্সা সরকারকে উৎখাত করেন। সুতরাং আলবারাদো তাঁকে প্রতিদ্বদ্বী মনে করতেন। সংবাদপত্র বের করার উদ্দেশ্য আলবারাদোকে পরাভূত করা। পত্রিকার আক্রমণ কৌশল হবে সামরিক শাসনের বিরোধিতা এবং যত দ্রুত সম্ভব বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে মতামত প্রচার। অন্য কথায়, এল এরাল্দো দে মেহিকো উদার গণতান্ত্রিক মতামতের অনুকূলে একটি প্রচারযন্ত্র। এল পুয়েবলোর সম্পাদকের কাছ থেকে এইটুকুই উদ্ধার করা গেল। তিনি এটুকু পর্যন্ত ইঙ্গিতও দিলেন যে জেনারেল অব্রেগনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পত্রিকাটির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকেও সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা হবে। তাঁর পরামর্শ নতুন দৈনিকের ইংরেজি বিভাগের মার্কিন পাঠক যেন মেক্সিকোর সমস্যার প্রকৃত চরিত্রটি বুঝতে পারে।

বিষয়টা এখন বেশ পরিষ্কার হয়ে গেল। আমার প্রতিবেদন ও সুপারিশের ভিত্তিতে উদারতাবাদী কুঁড়ের দল পত্রিকার ইংরেজি বিভাগের সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারে চার্লিকে পূর্ণ অনুমোদন দিয়ে দিলো। “মনরো ডকট্রিনের” ওপর একগুচ্ছ উপসম্পাদকীয় লেখার দায়িত্ব নিলাম আমি। একদল মেধাবী মানুষের যৌথ কাজ হওয়ার ফলে এল এরাল্দোর ইংরেজি বিভাগ প্রকাশের শুরু থেকেই পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে ফেলল। এতে প্রকাশিত চিত্তাকর্ষক কার্টুন, কবিতা ও ছোট গল্পের আকর্ষণ ছিল সাধারণ পাঠকের কাছে। পাশাপাশি সম্পাদকীয়গুলোর সুর প্রথমদিকে শান্তিবাদী থেকে ক্রমশ র‌্যাডিক্যাল হয়ে উঠছিল। বস্তুত এগুলো দিয়ে চিনিতে জারানো তেতো বটিকা গেলানোর ব্যবস্থা করেছিলাম আমরা।

এদিকে চার্লির অতিমাত্রার খোলামেলা ব্যক্তিত্ব পত্রিকার প্রধান সম্পাদকের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠল। জেনারেলের বিশ্বাসভাজন ছিলেন ইনি। প্রধান সম্পাদকমশাই শুরুতে গুরুগম্ভীর ও জমকালো আনুষ্ঠানিক ভাব ধরেছিলেন। কিন্তু শিগগিরি ইংরেজি বিভাগই দৈনিকের মূল সুরটা স্থির করে দিলো। অচিরেই এল এরাল্দো র‌্যাডিক্যাল রাজনৈতিক মতামত প্রচারের যন্ত্র হয়ে উঠল।

পাদটীকা

১. নৈরাজ্য-সিন্ডিকেটবাদ। Anarcho-syndicalism. নৈরাজ্যবাদী দর্শনের একটি ধারা নৈরাজ্য-সিন্ডিকেটবাদ। এই ধারাটি বিপ্লবী শিল্প ইউনিয়ন, যার আরেক নাম সিন্ডিকেটবাদ, তার দর্শনকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অর্থনীতি তথা বৃহত্তর সমাজের ওপর অধিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কৌশল বলে বিশ্বাস করে। সিন্ডিকেটবাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য মজুরি প্রথার বিলোপ কেননা একে তাঁরা মজুরিদাসত্ব বলে বিশ্বাস করেন। সুতরাং নৈরাজ্য-সিন্ডিকেটবাদীরা সাধারণভাবে শ্রমিক আন্দোলনের ওপর মূল জোর দিয়ে থাকেন। নৈরাজ্য-সিন্ডিকেটবাদীদের মূল কর্মকৌশলগুলো হচ্ছে - ঐক্য, ডাইরেক্ট অ্যাকশন (রাজনৈতিক দল বা অন্য কোনো তৃতীয়পক্ষের হস্তক্ষেপ ব্যাতিরেকে) এবং প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র অর্থাৎ শ্রমিকদের স্বব্যবস্থাপনা। নৈরাজ্য-সিন্ডিকেটবাদ প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর স্বউদ্যোগে কর্মকাণ্ড এবং গণতান্ত্রিক চর্চায় পরিচালিত বিকল্প ধারার সমবায় ব্যবস্থাপনার চর্চাকে উৎসাহিত করে। নৈরাজ্য-সিন্ডিকেটবাদীরা ১৯১০ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত স্পেনের কাতালান, ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে শক্তিশালী অবস্থান নেয়। কিন্তু ১৯২০-এর দশকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদী সরকার ক্ষমতায় এলে এই ধারার নেতাদের ধরপাকড় শুরু হয়। অনেককে হত্যা করা হয়। এভাবে ইউরোপে নৈরাজ্য-সিন্ডিকেটবাদের মেরুদণ্ড অনেকটাই ভেঙে পড়ে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইউরোপে এসব সংগঠনের পুনর্জাগরণ ঘটলেও আগের শক্তি আর ফিরে পায়নি নৈরাজ্য-সিন্ডিকেটবাদীরা। স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে নৈরাজ্য-সিন্ডিকেটবাদীদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের বড় ধরনের বিরোধও ঘটে। হিউবার্ট লাগারডেল, পিয়েরে-যোসেফ প্রুধোঁ, স্যাম মেইনওয়ারিং, রুডলফ রকার, আলেকজান্ডার শাপিরো, বাকুনিন, লুসি পারসনস, উইলিয়াম জে ট্রাউটম্যান প্রমুখ নৈরাজ্য-সিন্ডিকেটবাদের তত্ত্ব, ইতিহাস ও আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় নাম।

সূত্র: https://en.wikipedia.org/wiki/Anarcho-syndicalism, https://www.britannica.com/topic/syndicalism

চলবে