Published : 12 Oct 2024, 04:15 PM
(এ বছর সাহিত্যে নোবেল পেলেন দক্ষিন কোরিয়ার লেখক হান কাং। নোবেল কমিটির সাইটেশনে বলা হয়, তাকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে “অনুভূতিশীল কাব্যিক গদ্যের জন্য যা ঐতিহাসিক মনোঘাতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানবজীবনের ভঙ্গুরতাকে তুলে ধরে।” তিনি ২০১৬ সালে তার ভেজিটেরিয়ান উপন্যাসের জন্য ম্যান বুকার পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তার অন্যান্য বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- দ্য হোয়াইট বুক, হিউম্যান অ্যাক্টস, গ্রীক লেসনস, আই ডু নট বিড ফেয়ারওয়েল, এবং স্কার্স। এখানে দ্য হোয়াইট বুক থেকে প্রথম কয়েকটি পৃষ্ঠা অনূদিত হয়েছে। ম্যান বুকার প্রাইজের জন্য শর্ট-লিস্টেড এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৬ সালে, এবং এর ইংরেজি অনুবাদ বের হয় ২০১৭ সালে। বইটিতে “সাদা” নিয়ে লেখকের অভিজ্ঞতাজাত নানা বিষয় ও চিন্তা মনোজ্ঞ ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন বিনয় বর্মন।)
দ্য হোয়াইট বুক থেকে
দরজা
অনেকদিন আগের ঘটনা।
অ্যাপার্টমেন্টটি লিজ নেওয়ার জন্য চুক্তিপত্রে সই করার আগে আমি সেটি আবার দেখতে গেলাম।
এর ধাতব দরজা একসময় সাদা ছিল, কিন্তু কালক্রমে এর উজ্জ্বলতা হ্রাস পেয়েছে। সবকিছুর বাজে অবস্থা, রঙের চলটা উঠে জং ধরে গেছে, কেবল অতটুকু হলে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু আমার খারাপ লেগেছে দরজার ওপর ৩০১ নম্বরটি যেভাবে লাগানো হয়েছে তা দেখে।
সম্ভবত প্রাক্তন কোনো ভাড়াটে ড্রিল ম্যাশিন দিয়ে ছিদ্র করে নম্বরগুলো বসিয়েছে। আঘাতের চিহ্নগুলো স্পষ্ট বোঝা যায়। ৩ সবার ওপরে; ০ আকারে ছোট, কয়েকবার নষ্ট হয়েছে এবং ঠিক করা হয়েছে; লম্বাটে আকারের ১-কে গভীর খাত করে শক্তভাবে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ-সকল সোজা-বাঁকা ক্ষতের মাঝখানে মরিচা ধরেছে। সহিংসতার অবশেষ, শুকিয়ে যাওয়া রক্তের মতো, শক্ত, লালচে-কালো। আমি কিছুই ধরে রাখি না প্রিয়। আমার থাকার জায়গা কিংবা আসা-যাওয়ার দরজা, এমনকি আমার জীবনও নয়। সংখ্যাগুলো দাঁত খিঁচিয়ে কটমট করে আমার দিকে তাকিয়েছিল।
এই হলো অ্যাপার্টমেন্ট। এটিই আমি শীতের সময় কিনতে চেয়েছি। এখানেই আমি দিনযাপন করবো ভেবেছি।
মাল-সামান সব তোলার পর আমি এক কৌটা রঙ এবং একটি পেইন্টব্রাশ কিনে আনলাম। রান্নাঘর কিংবা শোবার ঘর কোনোটিতেই বহুদিন রঙের আঁচড় পড়েনি; দেয়ালগুলো ছোটবড় কালি-দাগে আকীর্ণ হয়ে আছে। ইলেকট্রিক সুইচের আশেপাশে এমন কালো দাগ বেশি। আমার পরনে হালকা বাদামি রঙের ট্র্যাকসুট ও পুরনো সাদা সোয়েটার, ফলে রঙ ছিটকালে উৎকটভাবে দেখা যাবে না। রঙ করা শুরুর আগে কর্ম সম্পাদনের ব্যাপারে আমার কোনোপ্রকার দুঃশ্চিন্তা ছিল না। আমার ধারণা ছিল দাগগুলোর ওপরে রঙের পোঁচ দিলেই হবে। সাদা রঙের নিচে কালো দাগ ঢাকা পড়লে ভালো লাগবে। আমি ছাদের দেয়ালে যেখানে কোনোকালে বৃষ্টির পানি চুঁইয়েছিল সেখানে ব্রাশ চালালাম বড় কালো দাগ বরাবর। কালচে ভাব দূর হয়ে যাচ্ছে। সিঙ্কের গামলাটা ন্যাকড়া দিয়ে ঘষে সাদা রঙে উজ্জ্বল করে দিলাম। মনে আছে এর ভিত্তিটা ছিল বাদামি।
সবশেষে, করিডোরে গেলাম সামনের দরজা রঙ করতে। ব্রাশের প্রতিটি পোঁচে কালিমাখা খুঁতগুলো দূর হতে লাগলো। গভীরভাবে বসানো নম্বরগুলো হারিয়ে গেলো, মরচের রক্তদাগগুলো অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমি কাজে বিরতি দিয়ে শরীর উষ্ণ করতে ঘরের ভেতরে গেলাম। ঘন্টাখানেক পরে যখন আবার সেখানে ফিরলাম, দেখলাম রঙ গড়িয়ে পড়েছে। দেখতে খারাপ লাগছে। রোলারের বদলে ব্রাশ ব্যবহার করার কারণেই বোধ হয় এমনটা হয়েছে। আমি আবার রঙের ওপর রঙ লাগালাম। এবার আর দাগগুলো দেখা যাচ্ছে না। আমি ভিতরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এক ঘণ্টা পর কম্বল ছেড়ে বেরিয়ে আসলাম। বাইরে তুষার পড়তে শুরু করেছে। গলির ভেতর অন্ধকার নেমে এসেছে, যদিও স্ট্রিটলাইটগুলো এখনো জ্বলে ওঠেনি। আমার এক হাতে রঙের কৌটা, অন্য হাতে ব্রাশ। আমি নীরব দর্শকের মতো স্থির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তুষারপাত দেখতে লাগলাম, শত শত সাদা পালক ঝরে পড়ছে আলতোভাবে।
সাদা কাপড়
সদ্যজাত শিশুটির গায়ে তুষারশুভ্র সাদা কাপড় জড়িয়ে দেওয়া হয়। মায়ের গর্ভ কতো আরামের। নার্স শিশুটির শরীর আঁটসাঁট করে বাঁধে, যাতে সীমাহীনতার মধ্যে হঠাৎ প্রক্ষিপ্ত হওয়ার সময় আঘাত না পায়।
এইমাত্র সে শ্বাস নেওয়া শুরু করেছে, জীবনে প্রথমবার ফুসফুসে বাতাসে ঢুকেছে। সে জানে না সে কে, সে কোথায়, সবেমাত্র কী শুরু হলো। প্রাণিকুলের সমস্ত নবজাতকের মধ্যে সবচেয়ে অসহায়, একটি মুরগিছানার চেয়েও অধিক প্রতিরক্ষাহীন।
রক্ত ঝরার কারণে শিশুটির মা ফ্যাকাসে। তিনি ক্রন্দনরত শিশুটির দিকে তাকান। আবেগাপ্লুত হয়ে কাপড়ে জড়ানো শিশুটিকে তার বাহুতে তুলে নেন। তিনি জানেন না কিভাবে এর কান্না থামাতে হবে। কিছুক্ষণ আগেও তিনি প্রচণ্ড প্রসবযন্ত্রণায় ভুগছিলেন। অপ্রত্যাশিতভাবে, শিশুটির কান্না থেমে যায়। কোনো গন্ধ পেয়ে হয়তো। অথবা তারা পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত, এ কারণেও হতে পারে। যা এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্য দেখেনি সেই কালো দুটো চোখের দৃষ্টি মহিলার কণ্ঠ অনুসরণ করে তার মুখমণ্ডলে এসে পড়ে। দুজনে এখনো বাঁধা, কী ঘটছে জানে না তারা। নীরবতার মধ্যে রক্তের গন্ধ। দুজনকে স্পর্শ করে আছে গা-জড়ানো সাদা কাপড়।
নতুন জামা
শুনেছি জন্মানোর দু'ঘণ্টার মধ্যেই মায়ের প্রথম সন্তান মারা গিয়েছিল।
শুনেছি সেই মারা যাওয়া সন্তানটি ছিল মেয়ে। তার মুখ ছিল অর্ধচন্দ্রাকৃতি চালের পিঠার মতো সাদা। যদিও এতটুকুন, সময়ের চেয়ে দু'মাস আগেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, তথাপি তার আকার-আকৃতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। মা আমাকে যা বলেছিল তা কখনো ভুলবো না, নবজাতক তার কালো দুটি চোখ মেলে মায়ের দিকে তাকিয়েছিল।
সে-সময় বাবা-মা গ্রামের দিকে বিচ্ছিন্ন একটি বাড়িতে থাকতেন। বাড়িটি ছিল একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে যেখানে বাবা শিক্ষকতা করতেন। মায়ের সন্তান জন্মদানের তারিখ ছিল অনেক পরে, কাজেই তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। হঠাৎ একদিন সকালে তার স্রাব আরম্ভ হলো। আশেপাশে কেউ ছিল না। গ্রামের একমাত্র টেলিফোনটি ছিল বিশ মিনিট দূরের বাসস্ট্যান্ডে একটি ছোট দোকানে। বাবার কাজ থেকে ফিরতে তখনো ছয় ঘণ্টা বাকি।
শীতের শুরু, বছরের প্রথম তুষারপাত হচ্ছে। আমার বাইশ বছর বয়সী মা হামাগুড়ি দিয়ে রান্নাঘরে গেলেন এবং একটি কাঁচি জীবাণুমুক্ত করতে গরম পানিতে সিদ্ধ করলেন। সেলাইয়ের বাক্স ঘেঁটে একটি সাদা কাপড় বের করলেন যা নবজাতকের গায়ে জড়ানো যাবে। শরীরের কাঁপুনি ও ভয়ের মধ্যে তিনি কাপড়টি সেলাই করতে লাগলেন। একটি ছোট জামা তৈরি করে ফেললেন। একটুকরো পাতলা কম্বল এর সঙ্গে জুড়ে দিলেন। তার ব্যথা বেড়ে গেলে তিনি দাঁতে দাঁত চাপলেন, জোর থেকে জোরে।
অবশেষে, বাচ্চা বের হলো। একা একাই তিনি নাড়ি কাটলেন। এইমাত্র বানানো জামাটি পরিয়ে দিলেন রক্তমাখা ছোট শরীরে। দু'হাতে তুলে নিলেন কোলে। মৃদুস্বরে বললেন, ঈশ্বরের দিব্যি, মরে যেও না। মন্ত্রের মতো বারবার উচ্চারণ করলেন কথাটি। এক ঘণ্টা অতিবাহিত হয়েছে। শিশুর শক্তভাবে লেগে থাকা চোখের পাতা হঠাৎ খুলে গেলো। মা চোখদূটোর দিকে তাকালেন এবং তার ঠোঁট কুঞ্চিত হলো। ঈশ্বরের দিব্যি, মরে যেও না। এর এক ঘণ্টা পর শিশুটি মারা গেলো। তারা রান্নাঘরের মেঝেতে পড়ে থাকলো। মা একদিকে কাত হওয়া, তার বুকে লেপ্টে থাকা শিশু। শীতল অনুভূতি মাংস ভেদ করে হাড়ে ঢুকে যাচ্ছে। আর কোনো কান্না নেই।