চীনের সাহিত্যসম্পদ অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সেটা হবে নাই বা কেন। পাঁচ হাজার বছরের একটি সভ্যতার সাহিত্যসম্পদ সমৃদ্ধ হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। চীনের ক্ল্যাসিকাল সাহিত্য বা চিরায়ত সাহিত্য আমার অত্যন্ত প্রিয়। বিশেষ করে চীনা কবিতার মধ্যে যে বাক-সংযম, আবেগের সংহত প্রকাশ দেখা যায় সেটা আমাকে মুগ্ধ করে।
চীনা সাহিত্যের একজন অমর কবি লু ইয়ু। এই কবির মধ্যে একাধারে প্রেম ও দেশপ্রেমের যে প্রকাশ দেখা গেছে সেটা বিশ্বসাহিত্যে বিরল। তার জীবন কাহিনীই যেন একটি গীতিকাব্য বা ব্যালাডের উপকরণ।
চীনের দক্ষিণ সুং রাজবংশের সময়ের একজন বিখ্যাত কবি, সমরবিদ, যোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক হলেন লু ইয়ু। বিষাদময় প্রেমের কাব্যের জন্যও তার খ্যাতি রয়েছে।
১১২৫ সালের ১৭ অক্টোবর লু ইয়ুর জন্ম হয় ওয়েই নদীতে। তার মা ও পরিবারের সবাই তখন নৌকায় ছিলেন। তিনি অভিজাত পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন কিন্তু তার দেশের অবস্থা তখন বিধ্বস্ত। দক্ষিণ সুং রাজবংশ তখন পতনের মুখে। উত্তর দিকের চিন রাজবংশের আক্রমণ ঘটে তার জন্মভূমিতে। লু’র জন্মের পরপরই তাকে নিয়ে পরিবারের সবাই পালিয়ে আসেন দক্ষিণে। সেখানে বেশ ভালো শিক্ষাদীক্ষায় বেড়ে ওঠেন তিনি।
তিনি ছোটবেলা থেকেই দেশকে আবার ঐক্যবদ্ধ করে শক্তিশালী করার স্বপ্ন দেখতেন। লু ইয়ু শৈশব কাটান তার সমবয়সী সুন্দরী কাজিন থাং ওয়ানের সঙ্গে। দুজনেই বই পড়তে ভালোবাসতেন। দুজনেই কবিতা লিখতেন। থাং ছিলেন শান্ত স্বভাবের। তার প্রকৃতি ছিল গভীর অনুভবে পূর্ণ। দক্ষিণ পূর্ব চীনের প্রকৃতির মতোই সুন্দর ও স্নিগ্ধ শৈশব কাটান লু এবং থাং।
তারুণ্যে তারা পরষ্পরের গভীর প্রেমে পড়েন এবং পরিবারের অমতে বিয়ে করেন। লু’র বয়স তখন মাত্র বিশ বছর। এই তরুণ যুগল অত্যন্ত সুখে ছিলেন। তাদের কোন সন্তান হয়নি। কিন্তু লু’র মা পুত্রবধূকে একদম পছন্দ করতেন না। এই বিয়েটাকেই তিনি স্বীকার করেননি। সেযুগে চীনের অভিজাত পরিবারগুলোতে পারিবারিক বন্ধন ছিল ভীষণ সুদৃঢ়। বিশেষ করে তরুণ তরুণীরা অভিভাবকদের সিদ্ধান্তের বাইরে চলতে পারতেন না। লু ছিলেন মায়ের বাধ্য সন্তান। থাংও তাই। দুই পরিবারের অভিভাবকরা মিলে সিদ্ধান্ত নেন এই বিয়ে বাতিল করতে হবে। এর পিছনের কারণ হলো, লু’র মা বলেন যে, এত অল্প বয়সে বিয়ে করে সংসারে প্রবেশ করলে তার উচ্চশিক্ষা বাধাগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে লুকে তার পরিবার ভবিষ্যতে সামরিক শিক্ষা দিয়ে দেশ স্বাধীন করার বা সুং সাম্রাজ্যের পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনার একজন নেতা হিসেবে তৈরি করার কথা ভাবছিলেন। পারিবারিক এই উচ্চাশার বলি হন লু ও থাং।
লু ইয়ু মায়ের নির্দেশে অনেক কষ্ট সত্ত্বেও থাং ওয়ানকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হন। থাং ওয়ানের অন্যত্র বিয়ে হয়। থাং এর নতুন স্বামী ছিলেন একজন অভিজাত ব্যক্তি। তার নাম ছিল চাও শিছাং। পরে লু ইয়ুও অন্য নারীকে বিয়ে করেন পরিবারের আদেশে। লু এরপর যুদ্ধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন। পাশাপাশি তার কবিতা লেখাও চলতে থাকে।
ডিভোর্সের আটবছর পরে শেনের বাগান নামে একটি প্রাসাদ সংলগ্ন উদ্যানে দুজনের দেখা হয়। থাং তখন স্বামীর অনুমতি নিয়ে লুর সঙ্গে এক মিনিট কথা বলেন, তার কুশল জিজ্ঞাসা করেন এবং তাকে একপাত্র পানীয় দেন। লু দেখতে পান থাংয়ের চোখ কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে। অনেক কষ্টে সে নিজেকে উচ্চস্বরে কান্না থেকে থামিয়ে রেখেছে পাছে স্বামী তার কান্নার শব্দ শুনে ফেলেন। স্বামী দূর থেকে তাদের দিকে লক্ষ্য করছিলেন। থাং এজন্য চোখের জল গোপন করতে একটু পাশ ফিরে দাঁড়ান এবং নিজের রেশমী পোশাকের ঝালরে দ্রুত কান্না মুছে ফেলেন। লুর চোখ দিয়েও অবিরল ধারায় জল ঝরতে থাকে। সেই অশ্রু আড়াল করতে তিনি প্রার্থনা ও ধন্যবাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে সেই তিক্ত পানীয় পুরোটা পান করেন। পানপাত্র দিয়ে তিনি নিজের মুখ আড়াল করেন। থাং তার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে খোঁপা থেকে একটি সোনালি (বা সোনার তৈরি) কাঁটা গোপনে খুলে ফেলে দেন। লু সেটি কুড়িয়ে নেন।
থাং ফিরে যান তার স্বামীর কাছে।
এই ঘটনার পর সেখানে বসেই লু ফনিক্স হেয়ারপিন (ছাই থোও ফং)নামে কবিতা লেখেন। সেটি তিনি শেন উদ্যানের দেয়ালে লিখে রাখেন। এই কবিতাটি চিরায়ত চীনা সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ। অনেক বছর পর এই ঘটনার স্মরণে তিনি শেনের উদ্যান নামে আরেকটি কবিতা লেখেন। সেটিও বিখ্যাত।
এরপর তিনি চলে যান উত্তরে যুদ্ধক্ষেত্রে। সেখানে চিনরাজবংশের সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন।
বেশ কয়েক বছর পর যখন থাং ওয়ান সেই কবিতাটি পড়েন তখন এর জবাবে নিজেও একটি কবিতা লেখেন। লু এবং ওয়ানের প্রেম কাহিনী চীনা লোকগাঁথায় বিখ্যাত।
তাদের প্রেম কাহিনী নিয়ে অনেক চীনা অপেরা লেখা হয়েছে। এখনও ঐতিহ্যবাহী চীনা অপেরায় এই প্রেমকাহিনী প্রতিফলিত হয়।
লু ইয়ু প্রায় এগারো হাজার কবিতা লিখেছিলেন যা চীনা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তিনি রাজ দরবারে চাকরি পেয়েছিলেন। সেনাবাহিনীতেও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ছিলেন বীর ও দেশপ্রেমিক হিসেবে বিখ্যাত। তার কবিতায় দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশিত হয়েছে।
মূলত তার দেশপ্রেমের কবিতাগুলো চীনা কাব্যরীতিতে একটা বিশেষ রীতির কবিতার অন্তর্গত হয়েছে।
এখানে জানিয়ে রাখি কাব্যের ধারাবিকাশে চীনে অনেক রকম কাব্যরীতি গড়ে উঠেছে। চীনে সংক্ষিপ্ত কবিতা লেখার রীতি আছে। আবার মহাকাব্যিক ধারার কবিতা, প্রকৃতি বর্ণনামূলক কবিতা, কারও বিদায় উপলক্ষে কবিতা, প্রেমের কবিতা, চার পংক্তির কবিতা, বর্গাকার কবিতা ইত্যাদি আছে।
চীনাভাষায় কবিতাকে বলা হয় শি, মহাকাব্যকে বলা হয় শি ফিয়ান, গীতিকবিতাকে বলা হয় ছু জি-- এধরনের কবিতা সুর দিয়ে গাওয়া হয়। কারও বিদায় উপলক্ষে যে কবিতা লেখা হয় তাকে বলা হয় লিউ পিয়ে। ক্ল্যাসিকাল বা চিরায়ত বা প্রাচীন কবিতাকে বলা হয় কু শি। থাং যুগের কবিতাকে বলা হয় থাং শি। দীর্ঘ কবিতাকে বলা হয় ছাং শি। হাসির কবিতাকে বলে তা ইয়ু শি। প্রেমের কবিতাকে বলে ছিং শি। গদ্য কবিতাকে বলা হয় সান ওয়েন শি। বর্ণনা মূলক কবিতাকে বলে সু শি শি ইত্যাদি।
লু তার দীর্ঘ জীবনে বিভিন্ন ধরনের কবিতা লিখেছেন। তবে প্রেমের ও দেশপ্রেমের কবিতায় তার একটা নিজস্ব স্টাইল তাকে বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।
১১৯০ সালে লু অবসর গ্রহণ করেন এবং নিজের হোমটাউন শাওসিংয়ে ফিরে আসেন। এটি বর্তমান চেচিয়াং প্রদেশে অবস্থিত।
শেষ বয়সে পৌঁছে লু-এর কবিতাগুলোতে এক ধরনের হতাশা দেখা যায়। সেখানে তিনি নিজেকে একজন ব্যর্থ মানুষ বলে ভাবতে থাকেন। তার মনে হতে থাকে তিনি দেশ ও প্রেয়সী কারও প্রতিই নিজের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারেননি। না তিনি প্রেমকে মর্যাদা দিতে পেরেছেন, না তিনি দেশকে একতাবদ্ধ করার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন।
১২০৯ সালে লু মৃত্যু বরণ করেন ৮৬ বছর বয়সে। তার এক বছর আগে ওয়ানের মৃত্যু হয়। ওয়ানের মৃত্যুসংবাদ শুনেও তীব্র শোকের কবিতা লিখেছেন লু। তার অধিকাংশ প্রেমের কবিতাতেই থাং ওয়ানের ছায়া রয়েছে।
লু ইয়ু চীনা সাহিত্যের দেশপ্রেমিক কবি হিসেবে অমর স্থান অধিকার করে আছেন।
কবি লু ইয়ুর বিখ্যাত ফনিক্স হেয়ারপিন কবিতাটির অনুবাদ করেছি। যদিও চীনাভাষার যে বিশেষ ছন্দ ও অন্ত্যমিল রয়েছে তা বাংলায় হুবহু অনুবাদ করা সম্ভব নয়।
চিরন্তন খোঁপার কাঁটা
গোলাপী নরম হাত, হলুদ কম্পিত মদিরা
শহরে ভরা বসন্ত, প্রাসাদ প্রাচীরে উইলো গাছের খেলা
পুবালী বাতাসের ছোঁয়া লাগছে, হারিয়ে যাচ্ছে সুখ
হৃদয় ভরেছে বেদনায়, এত বছরের বিচ্ছেদ।
ভুল ভুল ভুল।
বসন্ত আগের মতোই আছে, শুধু মানুষটি হয়ে পড়েছে শূন্য ও কৃশ
রেশমের পোশাকে রয়েছে অশ্রুর চিহ্ন
ঝরে পড়ছে ফুটন্ত পিচফুল, জমে যাচ্ছে পুকুরের জল
বিশাল শপথের পাহাড় কাঁধে, ব্রোকেডের বইটি ধরে রাখা কঠিন হয়ে উঠছে।
রেখো না, রেখো না রেখো না।
এই কবিতায় পুবালী বাতাস নারীর বা প্রেমের প্রতীক। ব্রোকেডের বই প্রেমের ইতিহাস। এধরনের উপমার ব্যবহার চিরায়ত চীনা কবিতায় বেশ প্রচলিত। এই কবিতায় যে বিচ্ছেদ যন্ত্রণা, হারানো প্রেমের জন্য দুঃখবোধ, কঠোর কর্তব্য পালনের বোঝায় ক্লান্ত মানব আত্মার আকুতি রয়েছে সেটাই কবিতাটিকে অমরত্ব দিয়েছে।