Published : 09 Nov 2012, 12:40 PM
১৯৮৮-৮৯ সালের কথা। আমাদের তিতুমীর হলের কমনরুমে এক সন্ধ্যায় মহাগ্যাঞ্জাম শুরু হয়ে যায়। নাটক দেখার জন্য টিভিরুমে চেয়ার দখল করার কোনো নিয়ম নাই। কেউ একজন সামনের দিকে একটা খালি চেয়ার দেখে বসে গিয়েছিল, অপর এক লিডার গোছের ছাত্র এসে দাবি করে এটা তার চেয়ার। লিডার বলে, সে এখানে পেপার রেখে গেছে। পেপার পাওয়া যাচ্ছে না, প্রমাণও নাই, যে বসেছে সে চেয়ার ছাড়বে না। মহাগ্যাঞ্জাম। আশেপাশে কেনো খালি চেয়ারও নাই। বেশ কিছু ছেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। কারন, বিটিভিতে নতুন একটা ধারাবাহিকের প্রচার শুরু হয়েছে, নাম 'বহুব্রীহি'। পনেরো দিন পরপর প্রতি মঙ্গলবার রাত ন'টায় প্রচার হয়। পুরা একঘন্টার ধারাবাহিক, নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ। শুনলাম, 'এইসব দিন রাত্রি' থেকে এটা বেশ আলাদা। এটা খালি হাসির। দ্বিতীয় বা তৃতীয় পর্বের এক মঙ্গলবার তাড়াতাড়ি টিউশনী শেষ করে চলে আসি। কিন্তু হলে কমন রুমে কোনো অবস্থাতেই বসার মতো কোন জায়গা নাই।
আমি দেয়ালের পাশে জানালায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। এর আগের কোনো পর্বই আমি দেখিনি। নাটকের শুরুতে দেখি টাইটেল দেখানোর সময়ই ছেলেরা দল বেঁধে ঠা ঠা করে হাসতে শুরু করে দেয়। সবচেয়ে বেশী হাসলো আলী যাকেরকে দেখে। আবুল খায়ের, আবুল হায়ত, আলী যাকের, আসাদুজ্জামন নূর, এরা সবাই সিরিয়াস অভিনেতা। কিন্তু এখন দেখি টাইটেলে তাদের চেহারা আসতেই ছেলেরা হো হো করে হেসে ওঠে। এতো হাসির কী কারণ! বুঝতে পারি না।
আফজাল শরীফ নামে নতুন অভিনেতাকে দেখলাম। তাকে দেখে আরো বেশী হাসি।
নাটক দেখা শেষে কমনরুমের বাইরে আসতেই শুনি ছেলেরা নাটকের সংলাপ আওড়াচ্ছে। একজন আরেকজনকে বলছে, 'আমারে একটা ছবি তুলে দিবেন? বিলিক ইন হুয়াইট' মানুষের স্বাদ আহলাদ বলে কি কিছু নাই!' 'টেকা পয়সাই কি জীবণের সব'।
আমি এই নাটকের নিয়মিত দর্শক হয়ে যাই। আমার মঙ্গলবারের টিউশনী শিফট হয়ে যায় বুধবারে। তাতে দুই পক্ষই খুশী। আমার ছাত্রীর মায়েরও অনুরোধ, এই তারিখে তারা 'বহুব্রীহি' দেখবে। সুতরাং আমার সন্ধ্যা বহুব্রীহির জন্য উন্মুক্ত। বিকাল থেকে প্রার্থনা, কখন নটা বাজে।
বহুব্রীহি নাটকটি বড় বড় অভিনেতা অভিনেত্রীতে ভরা। বিশেষ করে নাগরিক নাট্যদলের প্রায় সবাই দেখি আছেন। আলী যাকের, আবুল হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, লাকি ইনাম এসব। এঁদের বাইরে আবুল খায়ের সাহেব ইমদাদ খোন্দকার নামক একটা বদলোকের চরিত্রে অভিনয় করছেন। বদলোক বেশীক্ষণ বদ থাকে না হুমায়ূন আহমেদের নাটকে। নিশ্চয়ই এক সময় দেখা যাবে এ নাটকের শেষে হয়তো এই বদলোকই ভালো চরিত্র পেয়ে যাবে।
কাজের বুয়া আর কাজের ছেলে বিনোদনের প্রাণ এই নাটকে। রহিমার মা বুড়ি, তার সহযোগি সৈয়দ বংশের কাজের ছেলে কাদের। কোনো 'সৈয়দ'কে নিয়ে কি হুমায়ূন আহমেদ খুব বিরক্ত? বারবার 'সৈয়দ' বংশের এই চরিত্রটিকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা হচ্ছে। একবার তাকে চোর বানিয়ে বুকের উপর 'আমি চোর' লেখা ঝুলিয়ে কানে ধরে উঠবস করিয়ে শায়েস্তা করা হয়। চোর হিসেবে অবশ্য তাকে বেশীক্ষণ রাখা হয় না। এক সময় সে ভালোমানুষে রুপান্তরিত হয়।
আমাদের সবচেয়ে প্রিয় নায়ক আফজাল হোসেনও আছেন এখানে। লুৎফুন নাহার লতার সাথে তার জুটি। হাবাগোবা ডাক্তার, এক সময় ঘরজামাই হয়ে আসেন এ বাড়িতে। আসলে ঘরজামাই করেছেন কৌশলে যেহেতু লোকেশনের ওতো বৈচিত্র দেখানোর সুযোগ বিটিভিতে নাই, সুতরাং চরিত্রকে এ বাড়িতে নিয়ে এলেই সুবিধা। বেশীদিন তাকে আর দেখা গেলো না। এক সময় তাকে বিদেশ পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমরা পত্রিকায় পড়ি, কোন একটা দৃশ্যে তার গেঞ্জি খুলে খালি গায়ে পানিতে ঝাপ দেয়ার কথা ছিলো। তিনি গেঞ্জি খুলেননি বলে প্রযোজক-নাট্যকার মিলে চরিত্রটিকে বিদায় করে দিল নাটক থেকে। আফজাল হোসেন চলে যাবার পর নাটকটির কাহিনী অন্য দিকে মোড় নিল, আফজাল হোসেনের কথা আর মনে থাকলো না। এরপর অবশ্য বাংলাদেশের বহু অভিনেতা হুমায়ূন আহমেদের নাটকে অভিনয় করেছিলেন, আফজাল করেন নি।
পুরো ৭ পর্বের ধারাবাহিকটি একটি বাড়িতে শুট করা। বিটিভির ফ্লোরে সেট পড়েছে। এখানে ২-৩টা বেডরুম, একটা বড় ড্রয়িংরুম আর খাবার ঘর, এখানেই সব দৃশ্যের আয়োজন। দু'চারটা আউটডোর সিন ছাড়া, বাদবাকী সবই ইনডোর। অনেকটা থিয়েট্রিক্যাল কম্পোজিশনে ঘরের ভেতরই সব চরিত্রকে টেনে আনা হচ্ছে, মঞ্চ নাটকের সেটের জন্য যেমন হয়ে থাকে, সেরকমই। একারনে এই দয়াবান, জনহিতৌষী, অবসরপ্রাপ্ত বিত্তবান সোবহান সাহেবের বাসায় তার একমাত্র কন্যা মিলিকে নিয়ে তার সংসার। সেই সংসারে অর্ধ প্রকৃতস্থ এক মামা থাকেন [আলী যাকের]। তাদের জন্য দুইজন কাজের লোক। এই বাড়িতে উপর তলায় আসাদুজ্জামান নুর তার বাঁদর প্রকৃতির দুই শিশু কন্যাকে নিয়ে এসে ভাড়া থাকেন। গ্রাম থেকে 'ইন্দাদ খোনকার' ও চলে আসেন তার বিবাহযোগ্য কিশোরী নাতনী পুতুলকে নিয়ে। সুতরাং সবগুলো চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটে একটি বাড়িতে এবং নানা রকম উদ্ভট ও অপ্রকৃতিস্থ ঘটনার জন্ম হতে থাকে একের পর এক। বাংলাদেশ টেলিভিশনে এর আগে কোনো নাটকে এমন হাসির দৃশ্য কেউ দেখেনি। এ নাটকে দু'টো বাচ্চা ছেলে-মেয়ের বাদরামির দৃশ্য সবাই মজা করে দেখেছি। এই ভাইবোনদের চরিত্রে ঠিক বাঁদরের মতো। এদের একজন যা করে, অন্যজন তাকে অনুসরণ করে। ছোটটা সব সময় বড়টাকে ফলো করে। বড়র কথাই ছোটর কথা। আমার মনে হয়েছে এগুলো লেখকের পরিবারের সদস্যদের চরিত্র। তাঁর মেয়ে নোভা-শিলার বয়স ৭-৯ই হবে, এ নাটকের টগর ও এশা'র বয়সও এটা। এর আগে 'এইসব দিনরাত্রি' নাটকের একান্নবর্তী পরিবরের মমতাময়ী ভাবীর চরিত্র নিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রীর থেকে, এবার দুই কন্যার চরিত্র এসেছে এখানে। তাঁর কিছু আত্মজৈবনিক লেখায় পড়েছি যে, সিলেটে থাকার সময় তাঁদের বাসায় এক মামা থাকতেন। তিনি প্রকৃতই কতটা প্রকৃতস্থ ছিলেন জানি না, কিন্তু তাঁর চরিত্রকে যেভাবে দেখানো হয়েছিল, মনে হলো এই বহুব্রীহির মামা [আলী যাকের]ই সেই চরিত্র। কিন্তু খুবই মিস্ট্রিয়াস। তাঁকে পাগল বলছে পরিবারের সবাই, অথচ নিজে পাগলের চিকিৎসক হিসেবে কনসালট্যান্সি করছেন। তার সহকারী মিস এশা [লাকী ইনাম]।
এ নাটকে এই অর্ধ প্রকৃতিস্থ মামার মুখ দিয়ে বেশ কিছু চমৎকার সংলাপ বের করে এনেছেন এর নাট্যকার। তার কয়েকটি হলের ছাত্রদের মুখে মুখে এখন। যেমন,
'কথার মাধ্যে কথা বলা আমি একদম পছন্দ করি না দুলাভাই',
'আপনি প্রতিভা চিনতে পারলেন না',
'বেশী কথা বলা আমি পছন্দ করি না',
'পাবলিকের মুখ তো আর বন্ধ করা যাবে না', এসব।
এদের মধ্যে হঠাৎ করে কাজের ছেলে কাদেরের বিলেতপ্রীতি দেখে মামা একবার বিলেত নিয়ে বলেন, 'ফাজিলের দেশ, সব বর্বর…ওরা সভ্যতা শিখলো আমাদের থেকে, এখন তারা দাবি করে বড় সভ্য দেশ' এসব।
এই নাটকে একটা বিশেষন পদকে বিশেষ্য রূপে ব্যবহার শুনলাম প্রথম। যেখানেই 'সুন্দর' শব্দের প্রয়োগ আছে, সেখানেই ডায়ালগে আসছে 'সৌন্দর্য'। যেমন – চশমাটা বড়ই সৌন্দর্য।
কাদেরকে দিয়েও কিছু মজার মজার সংলাপ আওড়ানো হয়। যেমন-
মামা : কাদের
কাদের : জ্বী স্যার
মামা : কফি
কাদের : কামিং স্যার
এই 'কামিং স্যার' মানে হচ্ছে 'কফি নিয়ে আসছি স্যার'। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে । আমাদের নেশা হয়ে যায় হাসির নাটক দেখতে। আফজাল শরীফের নামটি ঢাকা পড়ে যায় তার 'কাদের' নামের মধ্যে। রাস্তাঘাটে তাকে দেখলেই লোকজন 'কাদের' 'কাদের' বলে চিৎকার দিয়ে ডাকে।
'হে মাছ' নিয়ে মৎস্য সমস্যা সমাধানের কৌতুকময় সমাধানের ফিরিস্তি দিয়ে শুরু হয়েছিল এই ধারাবাহিক, দুই পর্ব পরে 'ক্ষুধা' সংক্রান্ত সমস্যা নিয়েও বেশ কিছু বাড়াবাড়ি রকমের কমেডি তৈরি করা হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে হঠাৎ করে নাটকটি একটা সিরিয়াস রূপ ধারণ করে যখন মুক্তিযুদ্ধ ও রাজাকারের বিষয়টি এ নাটকে চলে আসে।
নাটকটির প্রায় শেষ দুই পর্বের পুরো অংশই জুড়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধের কথা। সোবহান সাহেব [আবুল হায়াত] এর বাসায় গ্রাম থেকে আসা আশ্রিত বদলোক ইমদাদ খন্দকার মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে কুটুক্তি করার পর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে পুরো পরিবার। মামা বুদ্ধি বের করেন।
টেপ রেকর্ডারে 'তুই রাজাকার' রেকর্ড করে শোনানো হবে তিনটি টিয়া পাখীকে এবং ৭ দিনের মধ্যে তারা শিখেও ফেলবে। দু'টো পাখী মারা যায়, তৃতীয় টিয়া এক সময় বলে উঠে 'তুই রাজাকার, তুই রাজাকার'।
১৯৮৮-৮৯ সালের এ সময়টাতে এরশাদ ক্ষমতায়। টেলিভিশনে 'পাকিস্থানি হানাদার' বলা নিষিদ্ধ, শুধু হানাদার বলতে হয়। বেশ কয়েকজন কথিত রাজাকার এরশাদের মস্ত্রিসভার সদস্য। ১৯৭৫ এর পর বাংলাদেশ টেলিভিশন বা রেডিওতে রাজাকার শব্দ ব্যাবহার হয়নি। কে কেন করেননি আমরা জানিনা, কিন্তু জানি যে, এই নাটকের মাধ্যমে 'তুই রাজাকার' শব্দটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম প্রচার হলো। মজার ব্যাপার, রাজাকার শব্দটি ব্যবহার হবার পর আমরা আশা করেছিলাম যে, পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর নামও শোনা যাবে। এ নাটকে সে সুযোগও ছিলো। সোবহান সাহেবের আবেদনে সাড়া দিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমি রেশমা [শান্তা ইসলাম] আসেন। তিনি তাঁর পরিবারের যুদ্ধস্মৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন-'মিলিটারির হাতে ওকে ধরিয়ে দেয়া হয়।' ঐ মিলিটারী যে পাকিস্থানি, সে কথা কিন্তু আর বলা হলো না।
মুক্তিযুদ্ধের এ বিষয়টা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদকে অনেক জটিল পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে অতিক্রম করতে হয়েছে। তাঁর বাবাকে পাকিস্থানিরা ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল, আবার তাঁর নানাকে যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হতে হয়েছিল। এ দু'পক্ষকেই তিনি দেখেছেন।
বহুব্রীহির শেষ পর্বে মামাকে দেখা যায় ভিন্ন চরিত্রে। বেশ কিছু টাকা তার হাতে আসার ফলে তার চরিত্র থেকে পাগলামি সরে যায়। তিনি সিরিয়াস ফিল্ম মেকার হয়ে যান। 'ও আমার রসিয়া বন্ধুরে' ছবি বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি বানাতে চান, ছবির নাম দেন 'তুই রাজাকার'। এই 'তুই রাজাকার' ছবির কয়েকটি দৃশ্য ও চলে আসে নাটকের মধ্যে। একটা দৃশ্যে দেখা যায়, হাত পা বাধা কাদের বসে আছে, পাকিস্থানী মিলিটারী তাকে প্রশ্ন করছে।
– তোর নাম কি?
– সৈয়দ আব্দুল কাদের
– হুম, তুই মুক্তি বাহিনীর লোক?
– হ, আমি মুক্তিযোদ্ধা
– তুই দেশের দুশমন
– হারমজাদায় কয় কী? হালা, তোর মুখে আমি ছেপ দেই। থু…থু।
এই বলে হাত বাধা কাদের থু থু ছিটাতে থাকে মিলিটারির মুখের দিকে।
[এরপরই হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন সিনেমার চিত্রনাট্য, 'আগুনের পরশমনি'। সেটা ছিলো হুমায়ূন আহমেদের বানানো প্রথম চলচ্চিত্র। সেই ছবিতেও বদিউল আলমের এক সহযোদ্ধাকে ঠিক এ রকম একটা দৃশ্যে দেখা গিয়েছিলো।]
'হে মাছ' দিয়ে শুরু হয়েছিল সোবহান সাহেবের সমাজ সেবার চিন্তা। শেষ হয়েছিল অন্যরূপে। খারাপ লোক ইমদাদ খন্দকার ভালো হয়ে যান। ১৯৮৯ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের দিনে তাঁকে নিয়ে দুই বৃদ্ধ বেরিয়ে পড়েন গ্রামের দিকে। ৬৮ হাজার গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু দিয়ে শেষ হয় ৭ পর্বের বহুব্রীহি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে এর আগেও কিছু ধারাবাহিক নাটক রচিত হয়েছিল, পরেও হয়েছে। সিরিও কমেডি ধাঁচের এমন শক্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় হাসি ঠাট্টার মধ্যে আর কোনো নাটকে কেউ তা দেখাতে পারেনি, এমনকি হুমায়ূন আহমেদের নিজের লেখা কোনো নাটকেও না।