যারা ইতিহাস চর্চা করেন তারা প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরের মানুষ তাই তাদের পরিসরে সমাজ তেমন জায়গা পায় নিI
Published : 16 Dec 2023, 08:33 AM
দেশের বেশির ভাগ মানুষ, সম্ভবত সবাই, মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা দ্বারা কোন না কোনভাবে প্রভাবিত হয়েছে, তার জীবনের ওপর ছাপ পড়েছে I কিন্তু সেই সব ঘটনার স্মরণ -প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে - করার বা মনে রাখার প্রক্রিয়াটি ভিন্ন ভিন্ন যা নির্ভর করে তার অবস্থান, সুযোগ এবং রাষ্ট্র বা সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ওপর I অর্থাৎ সমষ্টিগতভাবে, ব্যক্তিগতভাবে বা জাতীয়ভাবে যা ঘটেছে এবং আমরা যা মনে করি ঘটেছে বা জনপরিসরে স্মরণ করি তার মধ্যে ব্যবধান আছে I আর সবার কথা আমরা মনে রাখি না হয়তো জানার আগ্রহ নাই তেমন I
২
এটি সম্ভবত অনিবার্যভাবে ঘটেছে কারণ আমাদের দেশ মুক্তিযুদ্ধ একটা হলেও ইতিহাস এক নয় I মানে এই ঘটনাসমূহ রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিকে একই ভাবে আসর করেনিI মোটামুটি তিনটি পরিসর লক্ষ্য করা যায়I অনেকে অবশ্য এটাকে আড়াইটা বলেনI যাই হোক এইভাবে দেখা যাকI একটি হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক বা সরকারী যুদ্ধ এবং অন্যটি হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক বা সামাজিক পরিসরের জনযুদ্ধ I দুটি প্রায়শই একত্রিত হয় তবে একে অপরের থেকে আলাদাও থাকে গোটা ইতিহাসেI এখনো আছে।
৩
রাষ্ট্র সবার এই কথাটি বলার পর কথা থাকে সমাজেরI অর্থাৎ রাষ্ট্র প্রাতিষ্ঠানিক, লিখিত নিয়মে চলে I অন্যদিকে রয়েছে সমাজ যা চলে ট্রেডিশানের ওপর ভিত্তি করেI তাদের মধ্যে আদান প্রদান হয়, কিন্তু কোনো কিছু প্রয়োগ করার ক্ষমতা কেবল রাষ্ট্র/সকারের আছেI কিন্তু এই রাষ্ট্রের প্রয়োগ ক্ষমতা আবার সীমিতI অর্থাৎ দুইটি পরিসরই উপস্থিত এবং অনেকটাই আলাদা ধারায় চলেI এটা সকল দেশের ক্ষেত্রে বাস্তবI সেই দিক থেকে বোঝার বা বাস্তবতার খাতিরে এটাও বলা যায় যে দেশের মধ্যে রাষ্ট্রিক ও সামাজিক ইতিহাস রয়েছে এই মুক্তিযুদ্ধেরI সম্পর্কিত কিন্তু ভিন্নI
৪
প্রাতিষ্ঠানিক, সরকারী/ রাষ্ট্রিক ঐতিহাসিক অংশটি মূলত মুজিবনগরে অবস্থিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব দ্বারা চালিত ছিল। এটি ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের বাইরে ছিল। অন্য অংশটি ছিল সামাজিক এবং অনানুষ্ঠানিক, এবং এটি বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত এবং কোন আনুষ্ঠানিক সরকারী বা লিখিত প্রটোকল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল নাI
৫
ভারত থেকে আসা যোদ্ধারা দেশের ভেতর অপারেশন চালায় এবং তারপর ভারতে ফিরে যায়I অথবা যারা বাড়িতে ট্রেনিং নিয়ে গ্রাম ফিরে এসে থেকে যায় এবং সেখানেই থাকা যোদ্ধা ছিল তাদেরকে উপ-আনুষ্ঠানিক বলা যায় যেহেতু তাদের দুই পরিসরের সাথে যোগাযোগ ছিলI সেই দিক থেকে তারা ছিল এক সংযোগ।
কিন্তু আরো যোদ্ধাকুল ছিল যারা ভারতে যায়নি প্রশিক্ষণ নিতে, দেশের ভেতরে থেকে তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেছেI কিছু মানুষ অংশগ্রহণ করে প্রশিক্ষণ ছাড়াইI কেউ কেউ যুদ্ধের পক্ষে নিরস্ত্র ও কখনো সশস্ত্র ভূমিকা পালন করেI কিন্তু তাদের মধ্যেও সরল সমীকরণ সম্ভব নয়I যেমন কাদেরিয়া বাহিনী ছিল মুজিবনগর সরকারপন্থী আবার বামরা ছিল বিরোধীI কিন্তু বৃহত্তম অংশের কোন রাজনৈতিক দলের আনুগত্য ছিল না কিন্তু সরকারবিরোধী ছিল না I
৬
কিন্তু এছাড়াও ছিল শরণার্থীরা যারা দেশত্যাগী, অন্য দেশের বাস্তবতায় বসবাসকারীI তারা না ছিল এদিকে, না ছিল ওদিকে পৃথিবীর সকল রিফুজিদের মতোI আমাদের ইতিহাস চর্চায় তারা একেবারেই উপেক্ষিত, তারা দেশের সমাজ, সরকার বা রাষ্ট্রের সাথে যুক্ত ছিল না বিধায়I তবে এই যুদ্ধকালীন বাস্তবতার সাথে আমাদের ইতিহাস চর্চার সম্পর্ক দুর্বলI আমাদের সনাতনী চোখ দিয়ে তাদের আমরা সজ্ঞায়িত করতে পারি নাইI তাদের কেবল চলে যাওয়া মানুষ ভাবিI অথচ আন্তর্জাতিক পরিসরে তারাই ছিল সবচেয়ে সবল বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টির পক্ষেI এইজন্য দেশ, রাষ্ট্র, সরকারের বিষয়টি বেশি প্রভাবিত করেছে ইতিহাসের প্রতক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকার চেয়েI বিশেষভাবে একটি নির্যাতিত জনগোষ্ঠী আমাদের ইতিহাসে কিছুটা হলেও উপেক্ষিত আমাদের নিজস্ব ধারণার কারণেI
৭
সরকার ও সমাজের মধ্যে যোগাযোগ সংযোগকারী অন্য বাস্তবতা হচ্ছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এটি দুটি অংশের মধ্যে সেতু ছিল, ভারতে অবস্থিত রাষ্ট্রিক প্রতিষ্ঠান মুজিবনগর সরকার এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী জনগণের মধ্যে। রাষ্ট্রিক বা প্রাতিষ্ঠানিক ব্রান্ডের প্রচারের একটি অসাধারণ উদাহরণI দেশের ভেতরে থাকা লোকেরাও উদ্বাস্তু হয় যেমনটি অনেকে হয়েছিলI যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক দিকের মধ্যে এই বিভাজন ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের ধারণাকেও প্রভাবিত করেছে।
৮
নানা কারণে একটি পরিসরের চর্চা হয়েছে অধিকI রাষ্ট্রিক ইতিহাস চর্চা সুবিধা এনে দিতে পারে সেটা আর্থিক হোক বা পরিচিতরI অনেক ক্ষেত্রে এটা কাজের অংশই, আবার এই ইতিহাসের কিছু দলিল পাওয়া যায় কিন্তু সামাজিক ইতিহাসের দলিল নাই, পুরাটাই স্মৃতিনির্ভরI অতএব যে যুদ্ধ হয়েছে তার যে ইতিহাস আমরা পাই তার একটা ধারাবাহিকতা আছে, সেটা রাজনৈতিক হোক অথবা অন্য ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর হোকI এটা অবধারিত তাই ইতিহাস চর্চা আনুষ্ঠানিক পরিসরে সীমাবদ্ধ হয় কিছুটাI এছাড়া সমাজের ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ অনেক কঠিন ও সময়সাপেক্ষ, কারণ সমাজের মানুষের স্মৃতিচারণ ইতিহাস চর্চাকারীর কাছে পৌঁছাবার কোন পথ নাই তেমন, তাই অজানাই রয়ে যায়I আর এখন জানার সুযোগ ও সময় কোনটাই প্রায় নাইI
৮
যেহেতু একই যুদ্ধের একাধিক পরিসর ছিল তাই সম্পূর্ণ বা সামগ্রিক ইতিহাস থাকা প্রয়োজনI এখন পর্যন্ত তা নেইI এর অন্যতম কারণ যারা ইতিহাস চর্চা করেন তারা প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরের মানুষ তাই তাদের পরিসরে সমাজ তেমন জায়গা পায় নিI তার ফলে আমরা রাজনৈতিক বা সশস্ত্র যুদ্ধের বয়ান শুনি বেশি, সবার কথা নয়I সরকারি যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছে, সামাজিক যুদ্ধ নয়I শহীদের বিষয়টি উল্লেখ করেই বলছিI যদি ধরি ৩০ লক্ষ শহীদ তাহলে তাদের তালিকা প্রয়োজন, তাদের নাম প্রয়োজন, ইতিহাস থাকা দরকারI কারণ তারা শহীদ, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানI কিন্তু আমরা তাদের সম্পর্কে এই সংখ্যার বাইরে কমই জানিI যাদের সম্পর্কে জানি তারা কয়জন হবে এই বিশাল শহীদি সংখ্যার? এটাই আমাদের ইতিহাস চর্চার প্রধান সঙ্কট যা বোধহয় মোচন করা সম্ভব নয় আরI
৯
আমাদের ১৯৭১-এর যুদ্ধের একাধিক পরিসর ও বিবিধতা ছিলI কিন্তু ইতিহাস চর্চা যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক, তাই সমাজের ইতিহাস জানা হয়ে ওঠেনিI আমাদের ইতিহাস চর্চায় কেবল প্রাতিষ্ঠানিকতার পদচিহ্ন, সমাজের ইতিহাস দুর্বলভাবে উপস্থিত, যদি একান্তই হয়I