কিন্তু নারীদের সম্মাননা দেয়া তো দূরের কথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেলে না তাদের কাজের সামান্য স্বীকৃতিটুকু।
Published : 08 Mar 2025, 01:37 AM
একজন নারী কি নারী হয়ে জন্মায়? বড় হতে হতে সে নারী হয়। পুরুষের বেলায়ও তাই। জৈবিক কারণে নারী-পুরুষের গঠনগত ও শারীরবৃত্তীয় পার্থক্য থাকে। আবার, বড় হবার ধরনের মধ্যে আমরা যদি পার্থক্য করে দিই -- পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও পার্থক্য তৈরি হয়। এই যে বড় হবার ধরনের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে দেয়া এটা এসেছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কারণে। এই ব্যবস্থায় একজন পিতা কর্তৃক ছেলেমেয়েরা নিয়ন্ত্রিত হয়। পিতা ছেলে সন্তানকে এক দৃষ্টিতে এবং মেয়ে সন্তানকে আরেক দৃষ্টিতে দেখে। এই দেখার চোখটা তৈরি করে দিয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক বিধিনিষেধ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। ফলত, নারীরা হয়ে উঠছে কম সুবিধাভোগী এবং অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভরশীল।
৮ মার্চ বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। খুব সম্ভবত নারী দিবস, নারী অধিকার, নারী আন্দোলন শব্দগুলোর উদ্ভব হয়েছে বহুযুগের বহু উপেক্ষিত নারীর উপাখ্যান থেকে কিংবা বঞ্চিত নারীর প্রতিবাদের ভাষা থেকে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮ (২) ধারায় বলা হয়েছে 'রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।' আমার মনে হয়, নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন কথাটি দ্বারা বরং নারী-পুরুষ দ্বন্দ্বটিকে আরও প্রকট করা হয়। তাছাড়া 'পুরুষ' শব্দটি তো আদর্শের মাপকাঠি হতে পারে না। তাই একজন নারীকে মেয়ে মানুষ নয়, চাই মানুষ হওয়ার অধিকার। ধারায় উল্লেখিত উপরোক্ত বাক্যটি যদি একটু ঘুরিয়ে বলি 'রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সম-অধিকার লাভ করিবেন'- আমার ধারণা তাতে অযৌক্তিক কিছু হবে না বরং নারী-পুরুষের ভেদাভেদটির উপরে একটু প্রলেপ দেয়া হবে।
অনেক সময় দেখা যায়, নারী দিবস উপলক্ষে কয়েকজন নারীকে সম্মাননা প্রদান করা হয়।
শুধু নারী দিবস উপলক্ষেই কেন নারীরা সম্মাননা পাবেন? নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে যোগ্যতার বলে সম্মাননা পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু নারীদের সম্মাননা দেয়া তো দূরের কথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেলে না তাদের কাজের সামান্য স্বীকৃতিটুকু। সম্মাননার কথা বাদ দিই, নারীদের যে একটা আলাদা পরিচয় আছে, তারাও স্বপ্ন দেখে -- এই সহজ, সাধারণ সত্যকে পুরুষ অবজ্ঞা করে এসেছে চিরকাল। নারীর প্রতি পুরুষের এই অবমাননার একটি প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক ভিত্তি আছে। দুই হাজার তিনশো বছর আগে অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, 'মেয়েরা পুরুষের তুলনায় অক্ষম ও স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন।' এই কথাকে যুগের পর যুগ পুরুষেরা মহান বানী মনে করে নারীকে হেয় করে দেখেছেন। নারীদের সব পথ বন্ধ করে দিয়ে বলা হয়, নারীদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটে না।
পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে নারীরা সুষম খাবার গ্রহণের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম পুষ্টিমানের খাবার গ্রহণ করে। যার কারণে নারীরা ভয়ানক পুষ্টিহীনতার শিকার হয়। মাছের মাথা কিংবা মুরগির রান শুধু ছেলে শিশুটির পাতে নয় মেয়ে শিশুটির পাতেও দিতে হবে। এতে করে ছেলেমেয়ে উভয়েরই শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক গঠন সমান হবে।
মাঠে নেমে নারী অধিকার চাই বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার না করে নারী-পুরুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রথমত রাষ্ট্রের মস্তিষ্কের পরিবর্তন করতে হবে সংবিধানের ধারায় পরিবর্তন এনে এবং দ্বিতীয়ত এখন থেকে মেয়ে শিশুটিকে মর্যাদা ও মূল্যসহ তার মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতাগুলো ভোগ করার সুযোগ পরিবারকে দিতে হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(১) নং ধারায় রয়েছে, 'ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না'। পক্ষান্তরে, রাষ্ট্রের ব্যক্তিগত সম্পত্তির আইন অনুযায়ী নারীর সম্পত্তি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ধর্মভেদ ও লিঙ্গভেদ রয়েছে যা মূল সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ব্যক্তিগত সম্পত্তির আইন অনুযায়ী একজন মুসলমান নারী পিতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হিসেবে পায় ভাইয়ের অর্ধেক সম্পত্তি এবং একজন হিন্দু নারী পিতার সম্পত্তির কোনো উত্তরাধিকার হতে পারে না। তাই সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করে পিতার সম্পত্তি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ধর্মভেদ কিংবা লিঙ্গভেদ না করে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তাহলেই নারীদের পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের কণ্ঠ তখন সরব হবে এবং কেবল তখনই আশা করা যায় সমাজে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার ফলে দেশ এগিয়ে যাবে শোষণ-মুক্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে।
আমাদের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন না করলে এবং সে অনুযায়ী ঘরে বাইরে চর্চা করে অভ্যেসে-স্বভাবে অর্থাৎ জীবনে যুক্তি যুক্ত করতে না পারলে নারীর মুক্তি সম্ভব নয়। মানুষের মুক্তির মধ্যে নারীমুক্তি এবং নারীমুক্তির মধ্যেই মানবমুক্তি লুকিয়ে আছে।
আমাদের সংগ্রাম, আমাদের বিপ্লব হতে হবে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।
শুধু কি তাই, প্রকৃতিরও মুক্তি চাই। গাছপালা, পশুপাখি তাদেরও অধিকার আছে বেঁচে থাকার।
আসুন, আমরা মানব সমাজের প্রয়োজনেই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অগ্রসর হই। লড়াই করি এবং মনে রাখি, এই লড়াই একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ার জন্য।