মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি: জনযুদ্ধের গৌরবগাথা

‘আমার মত সামান্য একজন মানুষ নিজ অবস্থান থেকে দেশমাতৃকার জন্য যৎসামান্য অবদান রাখতে পেরেছি, এটাই আমার সারাজীবনের তৃপ্তি ও সার্থকতা।’

মোস্তাক শরীফমোস্তাক শরীফ
Published : 26 March 2024, 06:06 AM
Updated : 26 March 2024, 06:06 AM

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এদেশের মানুষ এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ কারণেই দেশের আনাচে কানাচে, এ মাটির প্রতিটি ইঞ্চিতে প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদারেরা। একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলো দেখার সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছিল তাঁরাই জানেন কত অশ্রু, রক্ত আর ঘামে ভরা ছিল সেইসব দিন। পাকিস্তানিদের মনোভাব সম্বন্ধে সামান্যতম সন্দেহও যাদের ছিল, যুদ্ধের প্রথম প্রহরেই সেই সন্দেহ উবে যেতে দেরি হয়নি। একাত্তরের কালরাতে অপারেশন সার্চলাইট নামের নরমেধযজ্ঞের শুরুতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ খ্যাত টিক্কা খান তার বাহিনীকে সদম্ভে বলেছিল, ‘এদেশের মানুষের দরকার নেই আমার। দরকার কেবল মাটি।’ টিক্কার বিশ্বস্ত সেনাপতি রাও ফরমান আলী ও জাহান্জেব আরবাবের নেতৃত্বে পাকিস্তানিরা এই বাংলাদেশে এমন নির্মম গণহত্যা চালিয়েছিল, যার তুল্য কিছু ইতিহাসে দেখা যায়নি। রাও ফরমান আলী তার দিনলিপিতে ‘পূর্ব পাকিস্তানের সবুজ মাটিকে রক্তে লাল’ করে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে বর্বর পাকিস্তানিরা সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে চেষ্টার ত্রুটি করেনি। তবু এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বীর বাঙালি ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার লাল সূর্য। পরাক্রান্ত পাকিস্তানি বাহিনীর কবর রচনা করেছিল এই বাংলার মাটিতে।

কে অংশ নেয়নি এই জনযুদ্ধে! ভূমিহীন কৃষক, সাধারণ গৃহস্থ, গৃহবধু, ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবী, দিনমজুর, ছাত্রছাত্রী সবাই ছিল যোদ্ধা। কেউ ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে, কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাবার দিয়ে, কেউ পাকিস্তানিদের গতিবিধি সম্বন্ধে তথ্য জুগিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধকে। আমাদের যাদের মুক্তিযুদ্ধের সোনাঝরা সেই দিনকে স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়নি, জনযোদ্ধাদের মুখের গল্পে বা লিখিত বয়ানে সে দিনগুলোর স্বরূপ বুঝতে শিখেছি। জেনেছি, কত অশ্রু, রক্ত, স্বপ্ন আর ঘামে ভেজা ছিল সেই দিনগুলো। টের পেয়েছি, একাত্তরের জনযোদ্ধাদের অঙ্গীকার কত খাঁটি ছিল। কী গভীরভাবেই না তাঁরা বিশ্বাস করেছিলেন, আজ হোক বা কাল, স্বাধীনতা আসবেই।

এমনই এক জনযোদ্ধা আমার প্রয়াত পিতা কাজী মোজাম্মেল হক। খাদ্য বিভাগের চাকুরে ছিলেন তিনি। পোস্টিং ছিল চট্টগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসের স্মৃতি লিখে গেছেন ডায়েরির পাতায়। পরে সেটিকে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন ‘মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ শিরোনামে। ক্ষীণ কলেবর সেই পুস্তকের পাতায় পাতায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি যেন তার অপার মহিমা নিয়ে বাঙ্ময় হয়ে আছে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের উল্লেখ দিয়ে বইয়ের সূচনা। এ নির্বাচনে তিনি সীতাকুণ্ড-সন্দ্বীপ এলাকায় প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে পাকিস্তানিদের টালবাহানা, ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ (ভাষণটি সহকর্মীদের নিয়ে সীতাকুণ্ডে বসে রেডিওতে শুনেছিলেন তিনি), এবং এরপর ২৫ মার্চের কালরাতের মর্মন্তুদ হত্যাযজ্ঞ ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনা--এ সবেরই স্মৃতি বর্ণিত হয়েছে প্রথম কয়েক পাতায়। পাকিস্তানিদের ক্র্যাকডাউন শুরু হওয়ার পর তিনি বুঝতে পারলেন, সীতাকুণ্ডে আর থাকা যাবে না। কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে নিজ জেলা ফেনীতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু যোগাযোগের সব ব্যবস্থা বন্ধ। অগত্যা সিদ্ধান্ত নিলেন, হেঁটেই বাড়ি যাবেন। তাঁর জবানীতে, ‘১৯৭১ সালের ২৮শে মার্চ সকাল ৮টায় ডাক্তার হান্নান, সমবায় অফিসার শহীদ সাহেব ও আমার গৃহপরিচারক কাদেরকে নিয়ে সীতাকুণ্ড ত্যাগ করি। কখনও রেল লাইনের ধার দিয়ে আবার কখনও পশ্চিমে মহাসড়ক ধরে হেঁটে চলেছি। কিছুদূর এগিয়ে আরো পশ্চিমে সমুদ্র কিনারা দিয়ে গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে চলেছি।’ এভাবেই প্রায় ৪২ মাইল হেঁটে একসময় ফেনীতে পৌঁছান। ততদিনে যুদ্ধের ঢেউ ফেনীতেও পৌঁছে গেছে। মহকুমা সার্কেল অফিস আক্রমণকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি সেনা ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে একদফা যুদ্ধও হয়ে গেছে। তাতে জনৈক ক্যাপ্টেন ফারুকীসহ নয় পাকিস্তানি ও ছয় মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন। ৩১ মার্চ ছাগলনাইয়ায় নিজ গ্রাম হরিপুরে চলে যান তিনি। সেখানে ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তিনি যুদ্ধের সপক্ষে প্রচারণা চালান। তাঁর ভাষ্য, ‘এ সময় আমাদের কাচারিঘরে এক গোপন বৈঠক হয়। আমার পিতা ফেনী মহকুমার প্রথিতযশা আইনজীবী কাজী ফজলুল হক এবং গণ্যমান্যদের উপস্থিতিতে আমাদের এলাকার প্রতিরক্ষার জন্য একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। আমর পিতা সেই কমিটির উপদেষ্টা মনোনীত হন। আমি আহ্বায়ক হই এবং ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কালাম উদ্দিন সহ-আহ্বায়ক হিসেবে মনোনীত হয়।’ আমার পিতার নিজস্ব লাইসেন্সকৃত ‍SBBL 12 Bore-এর একটি বন্দুক, তাঁর পিতৃব্য কাজী ফজলুর রহিমের একই ক্যালিবারে আরেকটি বন্দুক--এ দুটি আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নিকটবর্তী গতিয়া খালের চরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন।

২৩ এপ্রিল হানাদার বাহিনী ফেনী শহরে প্রবেশ করে। ৩০ এপ্রিল ছাগলনাইয়া আক্রমণ করে। এখানে হরিপুর, নিজ পানুয়া, বাঁশপাড়াসহ বিভিন্ন গ্রামের শত শত বাড়িতে তারা অগ্নিসংযোগ করে। বাবার জবানীতে ‘রেজুমিয়া থেকে ছাগলনাইয়া অবধি প্রায় তিন কিলোমিটার স্থান জুড়ে আগুনে দগ্ধিভূত বাড়িঘরের অবকাঠামো ভাঙার বিকট শব্দ আমরা বাড়িতে বসে শুনেছিলাম। প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা লাল-কালো কুণ্ডুলী পাকিয়ে ঊর্ধ্বাকাশে উঠে যাচ্ছে। বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আমরা অসহায়ের মতো সেসব মর্মান্তিক দৃশ্য অবলোকন করলাম।’ পাক সেনাদের নৃশংসতার আরেকটি বর্ণনা: ‘সবাই বাজারের দিকে ছুটে গেলাম। ভিড় ঠেলে এগিয়ে দেখি রাস্তার পাশে সাতটি মৃতদেহ পড়ে আছে। জানতে পারলাম, পাক জান্তারা বাজার থেকে ধরে এনে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। উর্দু ভাষা বুঝতে না পেরে তারা লা জওয়াব ছিল। এই ছিল তাদের অপরাধ। সবাইকে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করেছে। মৃতদের মধ্যে একজন ছিল আমাদের সবার পরিচিত রিকশাচালক তাজুল ইসলাম। এ ধরনের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড যত্রতত্র সংঘটিত হতে দেখেছি।’

১৯৭১-এর ১লা জুনের মধ্যে সকল সরকারি কর্মচারিকে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার হুকুম দেয় জান্তা। অন্যথা হলে ছিল কঠিন শাস্তির বিধান। খাদ্য মন্ত্রণালয় ছিল জরুরি বিভাগ হিসেবে বিবেচিত। কাজে যোগ না দিলে তাঁর কারণে পরিবারের সবাই হুমকির মুখে পড়বে এজন্য পিতার উপদেশে পুনরায় কাজে যোগ দেন বাবা। তবে কর্মস্থল সীতাকুণ্ডে অবস্থানের পুরোটা সময়ই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ অক্ষুন্ন রাখেন। ফেনীর বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম একজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে অনুরোধ করেন সীতাকুণ্ড থানার একটি মানচিত্র এঁকে দিতে। মানচিত্র আঁকায় বাবার দক্ষতা ছিল। তিনি আবুল কালামের অনুরোধে সীতাকুণ্ডের প্রধান স্থাপনা ও পথ ঘাট প্রদর্শন করে একটা মানচিত্র তৈরি করে আবুল কালামের কাছে পাঠিয়ে দেন।

ডিসেম্বরের শুরু থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেল, পাকিস্তানিদের পরাজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কোটি বাঙালির জন্য এ ছিল প্রবল আনন্দের মুহূর্ত। ১০ ডিসেম্বর প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে চট্টগ্রামে যান বাবা। ১২ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর সমর্থন নিয়ে সীতাকুণ্ডকে স্বাধীন করে মুক্তিবাহিনী। রাতে বিবিসির খবরে জানা যায়, ভারতীয় বিমানবাহিনীর হামলায় চট্টগ্রাম বন্দর তছনছ হয়ে গেছে। এভাবেই একসময় আসে ১৬ ডিসেম্বর বহু কাঙ্ক্ষিত সেই বিজয়ের ক্ষণ। ১৭ তারিখ সকালে চট্টগ্রাম শহরের অবস্থা দেখার জন্য বের হন তিনি ও কয়েকজন। তাঁর জবানীতে, ‘মৃত শহর যেন পুনর্জীবিত হয়েছে। নিউ মার্কেট এলাকা লোকে লোকারণ্য দেখলাম। স্টেশন রোড ধরে ট্রাক, লরি বোঝাই বিজয়ী ভারতীয় সৈনিকরা শহরে প্রবেশ করছে। বিপর্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে বীর মুক্তিযোদ্ধারা তখনও ফৌজদারহাট, কুমিরায় অবস্থান করছে। সৈন্য বোঝাই ট্রাকগুলো ধীর গতিতে একের পর এক চট্টগ্রাম সেনানিবাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চলমান ট্রাকের সৈনিকদের আমরা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে সালাম জানাই। তারা হাত উঁচিয়ে সালামের জবাব দেয়।’

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা সম্বলিত নাতিদীর্ঘ বইটি তিনি শেষ করেছেন এ ক’টি কথা দিয়ে- ‘আমার মত সামান্য একজন মানুষ নিজ অবস্থান থেকে দেশমাতৃকার জন্য যৎসামান্য অবদান রাখতে পেরেছি, এটাই আমার সারাজীবনের তৃপ্তি ও সার্থকতা।’

আমার পিতা একা নন। দেশের প্রতিটি প্রান্তে লক্ষ কোটি সাধারণ মানুষ মহান এই জনযুদ্ধে অংশগ্রহণের তৃপ্তি ও গৌরবকে সারাজীবন বুকের মধ্যে লালন করেছেন। এটিই ছিল তাঁদের নশ্বর জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।