এই চলচ্চিত্রায়নে পছন্দ করার মতো অনেক কিছু কি তাদের বাবা পেতেন? অবশ্যই পেতেন। হাস্যকর অনুকরণ বা প্যারোডি নয় এটি।
Published : 21 Jan 2025, 02:54 PM
ভাষান্তর: মোস্তাক শরীফ
১৯৭৪-এর এপ্রিলের গোড়ার দিকের কথা। পিয়াজ্জা নাভোনায় এক রেস্তোরাঁয় বসে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে দেখেছিলাম তাঁর উপন্যাস `সিয়েন আইনঞস দে সোলেদাদ’-এর চলচ্চিত্রে রূপায়নের কথা এমনকি ভাবার ব্যাপারেও অস্বীকৃতি জানাতে; এরপরও একাধিকবার এ অস্বীকৃতির সাক্ষী হয়েছিলাম।
গাবো-বন্ধুরা এই নামে ডাকতো তাঁকে-রোমে গিয়েছিলেন দ্বিতীয় রাসেল ট্রাইব্যুনালের সহ-সভাপতিদের একজন হিসেবে। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে মানবাধিকার ভঙ্গের নিন্দা জানাতে আয়োজিত হয়েছিল সেই ট্রাইব্যুনাল, ফলে সেই সন্ধ্যার আলোচনাগুলো ছিল মূলত রাজনৈতিক। কিন্তু শেষের দিকে বিখ্যাত ব্রাজিলীয় চিত্রপরিচালক গ্লবার রোশা বিষয়টি সামনে আনলেন। টেবিলে বসা সবাই চুপ মেরে গেল। রীতিমতো তারকাখচিত জমায়েত ছিল সেটি। আর্জেন্টিনীয় লেখক হুলিও কোর্তাসার, কিংবদন্তীর চিলীয় চিত্রশিল্পী রবের্তো মাত্তা, নির্বাসিত স্পেনীয় কবি রাফায়েল আলবের্তি ও তাঁর সাদাচুলো বউ মারিয়া তেরেসা লেওন, যে সেই সন্ধ্যাতেই শপথ করেছিল ফ্রাঙ্কো মারা গেলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে সাদা একটা ঘোড়ায় চেপে মাদ্রিদে ঢুকবে সে। সচরাচর মৃদুভাষী কলম্বীয় ঔপন্যাসিকের এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া আমরা কেউই আশা করিনি। ‘কক্ষনো না!’ বললেন গাবো। ‘বুয়েন্দিয়াদের সাত প্রজন্মের গল্পকে সংশ্লেষণ করা, যেটি আসলে আমার দেশ এবং গোটা লাতিন আমেরিকার পুরো ইতিহাস, এটা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এ ধরনের ছবি বানানোর মতো মালমশলা আছে কেবল মার্কিনিদের। এর মধ্যেই প্রস্তাব পেয়েছি, দুই থেকে তিন ঘণ্টা লম্বা বিরাট কিছু একটা বানানোর কথা বলছে তারা, তা-ও ইংরেজিতে! চার্লটন হেস্টনের কথা কল্পনা করো, মেকি একটা জঙ্গলে অচেনা, পৌরাণিক একজন কলম্বীয় হওয়ার চেষ্টা করছে যে। নি মুয়ের্তো!’ খেদের সঙ্গে যোগ করলেন তিনি।
শেষের কথাটির অনুবাদ করা যায় ‘আমার লাশের ওপর দিয়ে করতে হবে,’ যদিও আরো ভালো অনুবাদ হবে: ‘মরলেও করতে দেব না!’
হোটেলের দিকে পায়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আরেকটু জানার চেষ্টা করলাম। তিনি নিজেই যেহেতু দক্ষ চিত্রনাট্যকার, চরিত্রদের স্পেনীয় ভাষায় কথা বলার দাবিসহ ছবি তৈরির গোটা প্রক্রিয়াটি কি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না? মাথা নাড়লেন গাবো। ‘হাস্যকর একটা জিনিস হবে ওটা। বইটিতে যা সবচেয়ে মুগ্ধকর সেটিকে অন্য কোনো মাধ্যমে অনুবাদ সম্ভব নয়। মানুষ ভুলে যায়, বইটা খুব...সাহিত্যানুগ।’ এটি বলে পুরনো কথাটিরই পুনরুক্তি করলেন, ‘মরে গেলেও না!’
হায়, বন্ধু গাবো এখন একেবারেই মৃত, অনুদ্ধরণীয়ভাবে মৃত, এবং নেটফ্লিক্সে ‘শত বছরের নিঃসঙ্গতা’ সমালোকদের গদগদ প্রশংসাসহ প্রদর্শিত হচ্ছে। গাবোর বেশ কয়েকটি আপত্তি বেশ সন্তোষজনকভাবেই নিরসন করা হয়েছে। কলম্বিয়ার বিভিন্ন স্থানে সম্পূর্ণ স্পেনীয় ভাষায় চিত্রায়িত হয়েছে এটি। অভিনেতাদের অধিকাংশই অনামী, শৌখিন, চিত্রনাট্যের দাবিও প্রশংসনীয়ভাবে মিটিয়েছেন। জটিল বংশপরম্পরার মধ্য দিয়ে সাফল্যের সঙ্গেই দর্শকদের পথ দেখিয়ে নেওয়া হয়েছে, সময় ও ইতিহাসের প্রতিচ্ছেদের উন্মোচন ঘটানো হয়েছে মুন্সীয়ানার সঙ্গে। চিত্তবৈকল্যময় সিনেমাটোগ্রাফি, অসাধারণ অভিনেতা-নির্বাচন, উপন্যাসের প্রতি বিশ্বস্ত চিত্রনাট্য, চমকপ্রদ স্থান নির্বাচনের পাশাপাশি অবিস্মরণীয় কিছু দৃশ্যের জন্ম দেওয়া হয়েছে, যেন গাবোর বুনো এবং আবেগি কল্পনার গর্ভ থেকে এক লাফে সিনেমার পর্দায় চলে এসেছে সেগুলো।
তারপরও, উপন্যাসটি একবারও যিনি পড়েছেন (১৯৬৭ থেকে এ অব্দি ছয়-সাতবার পড়েছি আমি; চিলির প্রধান সংবাদ-সাময়িকী ‘আরসিলা’-র সাহিত্য সমালোচক হিসেবে বইটির প্রথম পাঠকদেরও একজন ছিলাম) তিনিই বুঝবেন, অতি অপরিহার্য একটা কিছু বাদ পড়েছে চলচ্চিত্রে। গাবোর উপন্যাস বলতে কেবল যদি বিস্তারিত আখ্যান আর অদ্ভুত সব ঘটনাই হতো তাহলে নেটফ্লিক্সের এ সিরিজকে বলা যেত বিশাল এক সাফল্য। কিন্তু উপন্যাস, শেষ বিচারে, ভাষাগত একটি কীর্তি। বৈপ্লবিক সব শিল্পকর্মের মতোই, প্রথম অবিস্মরণীয় বাক্যটি থেকে শুরু করে গোটা উপন্যাস জুড়ে যে দুনিয়াটি এখানে তৈরি করা হয়েছে সেটিকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার জন্য নেওয়া হয়েছিল অনন্য এক কৌশল, বিশ্বসাহিত্যের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল যেটি।
সেই অনন্য দৃষ্টিভঙ্গিটিই এ চলচ্চিত্রে গরহাজির।
উপন্যাসের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটির ওপর মনোযোগ দেওয়া যাক। প্রত্যন্ত জনপদ মাকোন্দো: বুয়েন্দিয়া পরিবারের সদস্য ও তাদের বন্ধুদের হাতে গড়া এক স্বর্গভূমি, মৃত্যু যেখানে মানুষের জীবনের ওপর খবরদারি করে না। সেই শহরেই এলো নিদ্রাহীনতার মহামারী। শহর ও তার বাসিন্দাদের জীবনে এ মহামারীর ধ্বংসলীলার প্রভাব দেরিতে হলেও বুঝতে পারি আমরা। ক্রমাগত ঘুমহীন রাখার মাধ্যমে তাদের স্মৃতি ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য হরণ করে এটি। মহামারীর লক্ষণ সম্বন্ধে অনেক বর্ণনার মধ্যে একটি হচ্ছে: ‘উজ্জ্বল দৃষ্টিভ্রমে আক্রান্ত অবস্থায় কেবল নিজেদের স্বপ্নের দৃশ্যগুলোই দেখল না তারা, অন্যদের স্বপ্নদৃশ্যগুলোও দেখতে সক্ষম হলো।’ চমকপ্রদ এক কল্পদৃশ্য, নেটফ্লিক্সের এ মহাকাব্যে যা নেই (মানতেই হবে, গল্পের বর্ণনার প্রবাহকে বিঘ্নিত না করে সংক্ষেপে এই জিনিসকে চিত্রায়িত করার উপায় নেই)। এর পরিবর্তে দর্শনীয় এক ঘটনা হিসেবে মহামারীকে দেখানো হলো, যার চূড়ান্ত রূপায়ণ ঘটে রাত্রিবেলার ধ্বংসযজ্ঞ আর সহিংসতার মধ্য দিয়ে, অসংখ্য ভুতুড়ে মশালের আলোয় যা আলোকিত। পালিতা কন্যা রেবেকার মধ্যে রোগলক্ষণ দেখা দেওয়া দিয়ে শুরু হওয়া সেই মহামারীর সবকিছুই ভয় ধরানো আর দুর্বোধ্য। উপন্যাসে যে মুহূর্তটিকে বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে: ‘অন্ধকারে বেড়ালের চোখের মতোই জ্বলে উঠল তার চোখ।’ চলচ্চিত্রনির্মাতারা বিড়ালের সেই চোখকে দুধসাদা ভয়ংকর নীল চোখে রূপান্তরিত করেছেন, গতানুগতিক ভৌতিক চলচ্চিত্রেই যা বেশি দেখা যায়। কারও ওপর অপদেবতা ভর করার দৃষ্টিনির্ভর দ্রুতলিখন পদ্ধতি।
আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ মনে হয় এমন বিষয়টির অবতারণা করতাম না, যদি রহস্যময় এবং ভুলক্রমে প্রায়ই জাদুকরী বলে মনে করা হয় এমন একটা ব্যাপার চলচ্চিত্রটিতে কীভাবে চিত্রায়িত হয়েছে তা এর মাধ্যমে বোঝা না যেত। মামুলি বিষয় নয় এটি, যেহেতু নান্দনিকতার বিচারে উপন্যাসটির সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর একটি হচ্ছে, সাধারণ ও অতিপ্রাকৃতিক-এ দুটো বিষয় বিরামহীনভাবে এবং অনায়াসে পাশাপাশি স্থাপিত হয়েছে এখানে। নিদ্রাহীনতার মহামারীকে এমন সাধারণভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যেন বৃক্ষ রোপণ বা শিশুর আঙ্গুল চোষার কথা বলা হচ্ছে। বুয়েন্দিয়ারা মোটেই বিস্মিত হয় না যখন ভূতেরা এসে হাজির হয় বা আউরেলিয়ানো ভবিষ্যৎ বলে দেয় বা মরণাপন্ন এক আইবুড়ো মহিলা মৃত আত্মীয়স্বজনকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য শহরের বাসিন্দাদের কাছ থেকে চিঠি সংগ্রহ করে। মাকোন্দোর অধিবাসীদের কাছে অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য হচ্ছে বিজ্ঞানের সেসব উদ্ভাব যা বস্তুবিশ্বের চেহারা বদলে দেয়, যেমন বরফ, আলোকচিত্র, কম্পাস এবং তাদের জীবনে আধুনিক দুনিয়ার মানুষের অনধিকার প্রবেশ, এতোদিন যে জীবন ছিল শিশুসুলভ অনন্ত এক নিষ্পাপতায় ভরা।
এই স্বপ্নাবিভাবকে গাবো ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন কারণ যে জনসমাজের মধ্যে আমাদের প্রোথিত করেছিলেন তাদের পরিপ্রেক্ষিতকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পেরেছিলেন তিনি। তাদের ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস ও মতাদর্শ-নিজেদের শরীরের মতোই তাদের কাছে যা সত্য, সেই প্রেক্ষিতেই বলেছেন গল্পটি। চলচ্চিত্রে ভয় ধরানো বাজনা বাজিয়ে অতিপ্রাকৃতের ঘোষণা দেওয়া বা বিষন্ন, অন্ধকার পরিবেশ দেখিয়ে অস্বাভাবিক ঘটনাকে বোঝানো উপন্যাসের তুলনায় ঠিক উল্টো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। চলচ্চিত্রটি আমাদের বানিয়ে তোলে এমন মানুষ যারা লুকিয়ে অদ্ভুতুড়ে ও অপার্থিব সব ঘটনা দেখছে। পরিচিত সব রূপক আমাদের আরাম দেয়। বাস্তবতা আসলে কী-বইয়ের মতো করে এ প্রশ্নটি করার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় না আমাদের দিকে।
যৌনতার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। আনন্দময় সঙ্গমের উৎসাহী অনুরাগী ছিলেন গার্সিয়া মার্কেজ, যা একইসঙ্গে নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি এবং আমরা প্রত্যেকে যে কতো নিঃসঙ্গ, শরীরের ক্ষণস্থায়ী যুক্ততাও যে মৃত্যুকে পরাস্ত করতে পারে না এবং প্রত্যেককেই নিজের মতো করে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়-এ সত্য অনুধাবনেরও এক উপায়। পর্দায় সঙ্গমের রগরগে দৃশ্যায়ন, ফর্মুলাবদ্ধ গোঙানি, শরীরী আলোড়ন আর ক্লান্তিকর রাগমোচনের যথেচ্ছ বিস্তার রেটিংকে ঊর্ধ্বমুখী করতে পারে, তবে ধ্বংস আর মৃত্যুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোর অভিযাত্রায় চরিত্রগুলোর সঙ্গী হতে পারবে না।
‘শত বছরের নিঃসঙ্গতা’ যে কতোটা সাহিত্যময়, কাফকা ও বোর্হেস, ফকনার ও র্যাবেলেই, ডেকামেরন ও আরব্যরজনীর কাছে কতোটা ঋণী, কতোটা প্রবলভাবে এটি সার্ভেন্তেসের পৌত্র সেটি নেটফ্লিক্সের এই সিরিজ দেখলে বুঝতে পারবে না কেউ। এই চলচ্চিত্রের দর্শকরাও অনুমান করতে পারবেন না, বুয়েন্দিয়া বংশ এবং যে উপনিবেশায়িত বৃহত্তর মহাদেশকে তারা রূপকভাবে প্রতিনিধিত্ব করে, সেটি অজাচার, খুন, গৃহযুদ্ধ, গণহত্যা আর সাম্রাজ্যবাদী কর্মকাণ্ডে পরিপূর্ণ হলেও, মূল উপন্যাসটি নিরন্তরভাবে কৌতুকপ্রদ। সংস্কারবদ্ধ চিন্তা ও বোকামোর জালে গোঁয়ারের মতো আটকা পড়ে থাকে গাবোর চরিত্রগুলো, নিজেদের এবং ইতিহাসের যূপকাষ্ঠের দিকে টলমলে পায়ে-প্রায়শই হাস্যকর ভঙ্গিতে-এগিয়ে যায়, এই ভাবগম্ভীর চলচ্চিত্রায়িত সংস্করণে যা অনুপস্থিত। সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, পর্দায় যা দেখছি সেটি যে বিধ্বংসী, গল্প বলার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত এবং ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে বহু দূরে জন্ম নেওয়ার অর্থ আসলে কী-এ বোধটিই চলচ্চিত্রে পাওয়া যায় না।
সম্প্রতি ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস রিভিউ অব বুকস’-এ গার্সিয়া মার্কেজের পুত্র ও উত্তরাধিকারীদের মার্কেজের ঘোষিত ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ‘আনটিল অগাস্ট’ উপন্যাসের মরণোত্তর প্রকাশের পক্ষে কলম ধরেছিলাম। চলচ্চিত্রটির ক্ষেত্রে অতটা নরম হতে পারছি না। এই চলচ্চিত্রায়নে পছন্দ করার মতো অনেক কিছু কি তাদের বাবা পেতেন? অবশ্যই পেতেন। হাস্যকর অনুকরণ বা প্যারোডি নয় এটি। তাঁর প্রিয়, নানা দুর্বলতায় আক্রান্ত বুয়েন্দিয়াদের যে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে তা দেখে খুশি হতেন। মানবজাতির সমস্যাসঙ্কুল, বেপরোয়া এক অংশ থেকে এমন অসাধারণ উপহার আরো লক্ষ কোটি মানুষকে আকর্ষণ করবে। আমার স্রেফ বিশ্বাস করতে হবে যে, বইয়ে যে যুগান্তকারী কল্পনা ও দর্শন আছে তা দুনিয়াজুড়ে পর্দায় ঝড় তুলে বেড়ানো চোখ ধাঁধানো তবে সীমাবদ্ধ সংস্করণটির মধ্যে আটকা না পড়ে বরং উজ্জ্বল হয়ে প্রকাশিত হবে।