ভালোবাসার ঋণ ভালোবাসার কবিতা দিয়ে শোধ করব: রুদ্র গোস্বামী

বইয়ের বাণিজ্য কম হলেও এবার একুশে বইমেলায় বইপ্রেমিদের ভিড় আশাবাদী করছে কবি-ঔপন্যাসিক রুদ্র গোস্বামীকে।

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Feb 2023, 06:50 AM
Updated : 28 Feb 2023, 06:50 AM

এ সময়ের জনপ্রিয় কবি-ঔপন্যাসিক রুদ্র গোস্বামী মনে করেন, মানুষ যে ভাষায় বলে, সেটাই তার সাহিত্যের ভাষা হওয়া উচিত। আর বাংলাদেশের মত পশ্চিমবঙ্গেও সাহিত্যের ভাষায় পরিবর্তনের সেই ধারা চলছে।

পাঠকের ভালোবাসার টানে প্রায় বছরই অমর একুশে বইমেলা চলাকালে ঢাকায় আসেন কলকাতার এ কবি। বইমেলায় তিনি মুখোমুখি হলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের; বললেন নিজের লেখা, ভাবনা ও নানা বিষয় নিয়ে।

প্রশ্ন: এবারের অমর একুশে বইমেলা কেমন দেখলেন?

রুদ্র গোস্বামী: প্রত্যেকবার মেলায় যেমন চালচিত্র থাকে এবারও সেরকম আছে। এবার ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক দিক থেকে কিছু খারাপ হলেও মানুষ এসেছে; এটা আশার কথা। মানুষ পরিবার নিয়ে এসেছে, বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে। কারণ, আমরা কয়েক বছর আগেও দেখেছি বাচ্চা বা স্কুলের শিক্ষার্থীরা খুব একটা আসত না। সেই বাধা ভেঙে নতুন করে বইমেলামুখী একটা স্রোত নেমেছে। যা আমাকে সত্যি সত্যি তৃপ্ত করছে। ঢাকাতে যেমন দেখছি, কলকাতাতেও তেমনই দেখেছি। বাণিজ্যিক মন্দা কাটিয়ে বইমেলা নিজের মেরুদণ্ড সোজা করে নতুনভাবে দাঁড়াবে। বইমেলাকেন্দ্রিক বাণিজ্যের সঙ্গে যারা আছে তাদের মুখে হাসি ফুটবে। আমি আশাবাদী।

এবার ঢাকা বইমেলায় আপনার কী বই এসেছে?    

রুদ্র গোস্বামী: এবার আমার একটি উপন্যাস এসেছে। নাম, ‘অন্তবর্তী তদন্তের পরে’। একটি নিপাট প্রেমের গল্প দিয়ে উপন্যাসটি শুরু। চারটি চরিত্রের চারটি আলাদা গল্প আছে। প্রত্যেকের প্রেম, প্রেমের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন ঘটনা; এমন তো হয়, একজন প্রেমিকা তার প্রেমের মধ্যে নিজেকে খুঁজতে থাকে; অথচ পায় না। অথবা একজন প্রেমিকা তার সামনে থাকা প্রিয়তমকে চিনতে পেরেও ধরতে পারে না; যে সেই মানুষ। আসলে মানুষ মানেই তো সেই অমোঘ রহস্যের পাহাড়। সেই রহস্য ভালোবাসার মধ্যেও আছে।
বইটির প্রথম পর্ব এই ভালোবাসার রহস্য উম্মোচন করতে করতে; ক্রমশ ঢুকে পড়ে অপরাধের রক্ত। ক্রমশ শহরে শুরু হয় সিরিয়াল কিলিং। তার সঙ্গে নায়ক নায়িকারা নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। কীভাবে সেই রহস্যের সমাধান হয়, জীবনমুখী যেসব প্রশ্ন, যে যন্ত্রণাগুলো থাকে মানুষের, সেগুলোই বা কতটা একে অপরকে ছুঁয়ে যায়; মূলত এটাই উপন্যাসের বিষয়। ‘অন্তবর্তী তদন্তের পরে’ উপন্যাসে ছয়টি চিঠি আমি ব্যবহার করেছি। চিঠিগুলো নায়ক নায়িকারা আলাদাভাবে একটি জায়গায় পাঠাত। তারা জানত না একই জায়জায় চিঠি পাঠাচ্ছে। একটি গাছের কোটরকে কেন্দ্র করে পাঠাত ভালোবাসার গন্ধযুক্ত চিঠি। এই গাছের কোটরে কেন তারা চিঠি পাঠাত, এই কোটরটি কী, সেসব জানা যাবে উপন্যাসটিতে।    

বাংলাদেশ থেকে আপনার কবিতার বইও বের হয়েছে, নতুন উপন্যাস ও পুরনো কবিতার বই; কোনটা কেমন বিক্রি হচ্ছে?

রুদ্র গোস্বামী: আমার নতুন বই যেমন যায়, পুরনো বইও তেমন যায়। তবে নতুন বই একটু বেশি যায়; যেহেতু এটা প্রথম আসছে। সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পুরনো বইও বিক্রি হয়। যেমন এই বইমেলায় করোনার আগে প্রকাশিত ‘অভিযোগ নেই’ নামের একটি কবিতার বইয়ের নতুন মুদ্রণ এল। এরকম আমার পুরনো বইগুলোর মুদ্রণ হতেই থাকে।


প্রশ্ন: আপনি কতটা কবি, কতটা ঔপন্যাসিক?

রুদ্র গোস্বামী: আমি কবিতায় যা বলি, সে কথাগুলো এক রকম; উপন্যাসে যা বলি, সেগুলো অন্যরকম। আসলে কবিতায় যা বলা যায় উপন্যাসে তা বলা যায় না। আবার উপন্যাসে যত বিস্তারিত বলা যায়, কবিতায় তা বলা যায় না। এ কারণেই আমার উপন্যাস লেখা। মনের ভাব আরও বিস্তারিত আরও প্রসারিত করে লেখার জন্য। মানুষের চরিত্র আরও কাছে থেকে দেখার জন্য, তাদের বুকের ভেতরের ভাষা জানার জন্য, তাদের কৌতুহলকে বোঝার জন্য আমার উপন্যাস লেখা।

কোন বৈশিষ্ট্যগুলো আপনার কবিতাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে? কবি হিসেবে নিজের মূল্যায়ন কী?

রুদ্র গোস্বামী: মূলত আমি প্রেমের কবিতা লিখি। প্রথম দুটি উপন্যাস লিখতে গিয়ে দেখেছি ভেতরের প্রেমিক তথা কবি মানুষটাই বেশি। আসলে প্রেমের কবিতা লিখি বলে কবি হলাম, তা নয়। আমার কবিতাগুলোকে বোধ বলি। কারণ, আমার কাছে মনে হয় কবিতা খুব কঠিন একটা বিষয়। ছোটবেলা থেকে যাদের কবিতা পড়েছি তাদের কবিতা পড়লে একটা তৃপ্তি হত, আবিষ্কার করতে পারতাম, একটা একটা করে লাইনের অর্থ বের করার অমোঘ আনন্দ ছিল। আমার কবিতায় সেই আনন্দটা নেই। আমার কবিতা চট করে বোঝা যায়। আমার বোধটা খুব সহজেই বোঝা যায়। আমার কবিতা গতিমান, হাঁটতে হাঁটতে মানুষ পড়তে পারে, তার সঙ্গে যায় বন্ধুর মত। ফলে আমি এগুলোকে বোধ বলি, কবিতা বলি না।
মূল্যায়ণ বলতে, অনেক পাঠক রয়েছেন, যারা আমার চেয়ে অনেক বেশি দীক্ষিত। শেষ পর্যন্ত বিচারক তারা। আমার আয়না তারা। আয়নায় নিজেকে দেখে যেমন চিনতে পারি, পাঠকদের মূল্যায়ন শুনে বুঝতে পারি আমি কোথায় কাঁচা রয়ে গেলাম। তারা আমার শিক্ষকও বটে।    

যারা প্রেমের কবিতা লেখেন, কিংবা যাদের সাহিত্য পড়ে সহজে বোঝা যায়, তাদের হালকা ধাঁচের সাহিত্যিক হিসেবে গণ্য করা হয়। এমন কোনো ট্যাগ আপনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কি না, হলে তা কীভাবে সামলান?
   
রুদ্র গোস্বামী: এখন পর্যন্ত আমার উপর এমন কোনো ট্যাগ পড়েনি। জানি না কেন, মানুষ হয়ত একটু বেশিই ভালোবাসা দিয়েছেন; হয়ত এতটা ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার নেই আমার। আমি জানি না, কেমনভাবে যেন ম্যাজিকের মত বিষয়টা হয়ে গেল। মানুষ পাশে না দাঁড়ালে, আমার বন্ধুরা পাশে না দাঁড়ালে রুদ্র গোস্বামী হয়ে ওঠা হত না।

থাকে না, কিছু খারাপ ছেলে, কিছু ভালো ছেলে। সবাই বলে, ওদের সঙ্গে মিশবি না, খারাপ হয়ে যাবি। এদের সঙ্গে মিশলে অনেক কিছু শিখতে পারবি। আমি কীভাবে যেন সেই ভালোমানুষদের সঙ্গে মিশে গেছি। যে মানুষগুলো বাজে মন্তব্য করেনি। সবসময় আমাকে এগিয়ে দিতে চেয়েছেন, এখনো চাইছেন।

বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট লক্ষ্য করা যায়। পুস্তকীয় ভাষা থেকে বের হয়ে জনজীবনের ভাষায় রচনার একটা প্রভাব অনেকের মধ্যে আছে। সেই জায়গা থেকে পশ্চিমবঙ্গে সাহিত্যের ভাষাটাকে একটি কঠিন করে রাখার একটা চেষ্টা...

রুদ্র গোস্বামী: না না না, সবসময় তা নয়। এখন যারা লিখছেন তারা ভাষাকে গতি দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গেও ভাষা পরিবর্তনের ধারা চলমান। আসলে মানুষ যে ভাষায় বলছে, সেই ভাষায়ই তো সাহিত্য হওয়া উচিত। এর শুরুটা অনেক আগেই হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র যে ভাষায় লিখেছেন, টেকচাঁদ ঠাকুর সেই ঘরানাটা ভেঙেছেন। তারপর শরৎচন্দ্র কত সহজবোধ্য ভাষায় ছড়িয়ে গেলেন মানুষের ঘরে। বঙ্কিমচন্দ্রও রইলেন, শরৎচন্দ্রও রইলেন। বঙ্কিম রইলেন বোদ্ধা ও ভাবুক মানুষদের ঘরে; শরৎচন্দ্র ছড়িয়ে গেলেন আপামর জন সাধারণের ঘরে।    

বাংলাদেশে আপনার লেখা জনপ্রিয়তা পাওয়ার পেছনে ভাষা কি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে?

রুদ্র গোস্বামী: অবশ্যই, প্রথমেই বলেছি, আমার কবিতা মানুষকে গতি দিয়েছে, তাদের চলার সঙ্গী হয়ে গেছে। এজন্যই এপারের মানুষ আমার কবিতাকে সাদরে গ্রহণ করেছে।

ঢাকা না কলকাতা, কোথায় আপনার পাঠক বেশি?

রুদ্র গোস্বামী: একই রকম। ঢাকায় আমার যেমন পাঠক, কলকাতাতেও তেমন পাঠক। এজন্যই আমাকে বলা হয় দুই বাংলার জনপ্রিয়তম কবি।  

বাংলাদেশের পাঠকদের উদ্দেশে যদি কিছু বলার থাকে?

রুদ্র গোস্বামী: আমার বইবন্ধু বা পাঠক যারা আছেন, তাদের বলার কিছু নেই। তারাই আমাকে তৈরি করেছেন। তারা অনেক দীক্ষিত ও শিক্ষিত করেছেন বলে আমি মনে করি। তাদের থেকে প্রতিনিয়ত শিখি। আশা করি তারা প্রত্যেকে যেমন সাহস জুগিয়েছেন আমাকে, আগামীতেও সাহস যোগাবেন এবং পাশে থাকবেন, লেখার গতি বাড়াতে সাহায্য করবেন। তাদের সবার কাছে আমার ভালোবাসার ঋণ রইল, যা আমি ভালোবাসার কবিতা দিয়ে শোধ করার চেষ্টা করব।