Published : 16 May 2024, 04:45 PM
গত ১৩ই মে মৃত্যুবরণ করলেন কানাডার একমাত্র নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক এলিস মুনরো। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। দীর্ঘজীবনই তিনি পেয়েছিলেন, ২০১৩ সালে তিনি যখন নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তখন তার বয়স ৮২ বছর। পুরস্কার পাবার জন্য যথেষ্ট অগ্রগামী বয়স হলেও তিনি যে সাহিত্যের সর্বোচ্চ স্বীকৃতিটি পেয়েছিলেন তা ছিল বিশ্বসাহিত্যের বোদ্ধাদের কাছে স্বস্তিকর। কেননা মুনরোকে বলা হয় ছোটগল্পের ওস্তাদ। তাঁর ছোটগল্পের ভাষা উচ্চকিত নয় বরং মৃদু, তারা রাজপথে মিছিল করে না, ঘনিষ্ঠস্বরে কথা বলে।
মুনরোর ছোটগল্পের ভেতর, কখনো অতীতে কখনো ভবিষ্যতে, সময়ের এমন একটি চলাচল রয়েছে যা ছোটগল্প নির্মাণের কাঠামোকে আমূল বদলে দিয়েছে, এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। গল্পবুননে তাকে তুলনা করা হয় ছোটগল্পের মহান শিল্পী আন্তন শেখভের সাথে, কারণ মানব মনের ও মানব জীবনের জটিলতাকে তিনি একটি অজটিল ভাষায় ও রীতিতে দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করেছেন।
আবির্ভাবেই চমক সৃষ্টি করেছিলেন এলিস মুনরো। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ 'ডান্স অব দ্য হ্যাপি শেডস' কানাডার সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার গভর্নর জেনারেল'স এওয়ার্ড জয় করে নেয়। এর দশ বছর পর গল্পগ্রন্থ 'হু ডু ইউ থিঙ্ক ইউ আর', এলিস মুনরোকে দ্বিতীয়বারের মতো গভর্নর জেনারেল'স সাহিত্য পুরস্কার এনে দেয়। এ পুরস্কারটি তিনি জিতেছেন আরো একবার।
মুনরোর বেশিরভাগ গল্পের প্রেক্ষাপট কানাডার অন্টারিও প্রদেশের হুরন কাউন্টি, যেখানে তিনি দীর্ঘকাল বাস করেছেন। গ্রামীণ ও মফস্বলীয় জীবনের একটি সুবাতাস তার গল্পের ভিতর সতত প্রবহমান। মুনরোর গল্পরচনার একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো দক্ষিণের একটি বিশেষ অঞ্চলের প্রতি গভীর আলোকপাত। এ প্রসঙ্গে নোবেল পুরস্কার পাবার পর তাকে একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন যে একটি ছোট্ট কানাডিয়ান শহরের জীবনযাপনে এত কী আকর্ষণীয় থাকতে পারে যা সাহিত্যে বর্ণনা করা যায়? মুনরো এর সহজ উত্তর দিয়েছিলেন, 'সেটা বুঝতে হলে আপনাকে সেখানে বসবাস করতে হবে।' বিন্দুর ভিতর সিন্ধু খুঁজে পাওয়া মহত্তম সাহিত্যিকদের বৈশিষ্ট্য, আমরা জানি, মুনরো ব্যতিক্রম নন। গ্রামীণ প্রকৃতিতে স্থাপিত ছোট শহরকে প্রেক্ষাপটে রেখে লেখা মুনরোর গল্পগুলো মনে পরিয়ে দেয় উইলিয়াম ফকনার এবং ফ্লানারি ও'কনোর-এর ফিকশনের কথা। মুনরোর গল্পের চরিত্রগুলো প্রায়শই সমাজের মর্মমূলে প্রোথিত প্রচলিত রীতিনীতি ও প্রথার মুখোমুখি হয়, তবে সেসবের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া দক্ষিণের ওই কথাসাহিত্যিকদের চরিত্রদের থেকে কম তীব্র।
তাঁর প্রথমদিককার গল্পে প্রায়শই দেখা যায় এমন একটি নারী চরিত্র যে বয়োঃপ্রাপ্ত হয়ে তার পরিবার ও যে ছোট্ট শহরে তার বাড়ি সে শহরের পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবার চেষ্টা করছে। পরবর্তী রচনাসমূহে তাঁর মনোযোগ সরে যায় মধ্যবয়সী ও বয়স্ক নারীদের দিকে, যে নারীরা মূলত নিঃসঙ্গ। তাঁর চরিত্ররা প্রায়শই এমন সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় যা তাদের জীবন উপলব্ধিতে আলো ফেলে এবং জীবনের একটি অর্থময়তা দাঁড় করায়। আন্তন শেখভের গল্পেও আমরা একেকটি নাটকীয় মুহূর্তের উদ্ভাস দেখি, গল্প এমন এক বিন্দুতে পৌঁছায় যা হতচকিত করে দেয় পাঠককে, এক জীবনের অভিজ্ঞান এসে ধরা পড়ে একটি বাক্যে।
মুনরোর লেখালেখির আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো তিনি গল্পকে ক্রমাগত পরিমার্জনা করতে থাকেন, একই গল্পকে অনেকগুলো রূপ দান করেন, কিছুটা ভিন্নরূপে একই গল্প একাধিক বইয়ে প্রকাশ করেছেন এবং আশ্চর্য যে কোন কোন গল্পের রূপান্তরের মধ্যকার সময়ের ব্যবধান ৩০ বছর। বস্তুত তিনি একজন পারফেকশনিস্ট, তিনি কখনোই পরিতৃপ্ত হন না, তার গল্প বলাও শেষ হয় না।
নোবেল কমিটি পুরস্কার প্রদানের সময় বলেছিলেন এলিস মুনরোকে "সাম্প্রতিক ছোট গল্পের ওস্তাদ" বলে অভিহিত করেছিলেন এবং এলিস মুনরো ছিলেন তাই। এক জীবদ্দশায় তাঁর গল্পগ্রন্থের সংখ্যা ১৪টি আর নির্বাচিত সংকলনের সংখ্যা আট। তিনি কখনো উপন্যাস লেখেননি কিন্তু ছোটগল্পের সীমিত পরিসরের ভেতর তিনি উপন্যাসের বৃহৎ পটভূমি ধারণ করতে পারতেন। এটা এক আশ্চর্য শক্তি। এক জীবনের অভিজ্ঞতাকেই তিনি সাহিত্যে রূপায়িত করেছেন। এমন এক গদ্য যা সংক্ষিপ্ত আকারে, মৃদু স্বরে জীবনের গভীর উপলব্ধি জাগায়। রচনাকর্মকে কানাডার 'জাতীয় সম্পদ' হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সাহিত্যিক হিসেবে মুনরোর উচ্চতা কতখানি - তা এতে বোঝা যায়। এর কারণ তার রচিত গল্পগুলো অঞ্চলের মধ্য দিয়ে বিশ্বের কথা বলে, বিশেষকে করেছিল সর্বজনীন, কানাডার প্রেক্ষাপটে রচিত গল্পকে করে তোলেন সারা বিশ্বের, দূর-দূরান্তের পাঠকের গল্প।
জীবনে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত এলিস মুনরোর আরেকটি উল্লেখযোগ্য পুরস্কার হল ম্যান বুকার পুরস্কার যা তিনি লাভ করেন ২০০৯ সালে। এ পুরস্কার প্রদানের সময় মুনরোর গল্পের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে গিয়ে বলেন 'এলিস মুনরো তার প্রতিটি ছোটগল্পে এতখানি গভীরতা প্রজ্ঞা ও সূক্ষ্মতা ধারণ করেন যা ঔপন্যাসিকেরা তাদের সমগ্র জীবনের উপন্যাসে ধারণ করার চেষ্টা চালান।' এই একটি মূল্যায়নেই এলিস মুনরোর গল্পের বিশালত্ব বোঝা যায়। তাঁর গল্প বহু বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং তাঁর লেখা কাহিনীর আশ্রয় করে বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
এলিস মুনরো জন্মগ্রহণ করেছিলেন কানাডার অন্টারিও প্রদেশের উইঙ্গহ্যামে ১৯৩১ সালে। তার বাবা ছিলেন একজন কৃষক আর মা স্কুল শিক্ষিকা। স্কটিশ কবি জেমস হগের এক উত্তর পুরুষ ছিলেন তার বাবা। ফলে এ কথা অনুমান করতে কষ্ট হয় না, এলিস মুনরোর জিনে সাহিত্য রয়েছে। ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অন্টারিওতে ইংরেজি সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় পড়াশোনার সময়ে তিনি সহপাঠী জেমস মুনরোকে বিয়ে করেন। এটা ১৯৫১ সাল। প্রথমে ভ্যানকুভার, পরে মুনরো দম্পতি ভিক্টোরিয়ায় বসবাস করতে শুরু করেন এবং 'মুনরো'স বুক' বলে একটি বইয়ের দোকান খোলেন, যে বইয়ের দোকানটি এখনো চালু আছে। মুনরো দম্পতির ঘরে জন্ম নেয় তিন মেয়ে। ১৯৭২ সালে তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। বিবাহ বিচ্ছেদের পর এলিস মুনরো অন্টারিওতে ফিরে আসেন এবং চার বছর পর জেরাল্ড ফ্রেমলিন নামের একজন জিওগ্রাফারকে বিয়ে করেন।
এলিস মুনরো যে বছর সাহিত্য নোবেল পুরস্কার পান সেই ২০১৩ সালে তার দ্বিতীয় স্বামী মৃত্যুবরণ করেন। অনেক বছর ধরেই তারা অন্টারিও প্রদেশের ক্লিনটন শহরের বাইরে এক কৃষি খামারে বাস করেছিলেন। আজীবন লেখালেখি করলেও পড়ন্ত বয়স ও ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে ২০১৩ সালের পর এলিস মুনরো আর লেখালেখি করেননি। তিনি জনসমক্ষেও কম আসতেন। তাঁর মৃত্যুতে বিশ্বসাহিত্য একজন উঁচু মানের কথাসাহিত্যিককে হারালো। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।