Published : 25 Oct 2016, 07:08 PM
এক
কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। ষাটের দশকে যে কয়জন কাব্যকারুকৃত বাংলাদেশের তথা বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বৈচিত্র্য নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তাঁদের ভেতর মুহম্মদ নূরুল হুদা অন্যতম। কিন্তু উপরোক্ত কথাগুলোকে আমরা কি নির্দ্বিধায় মেনে নিতে সম্মত আছি? আমি অন্তত মেনে নিতে সম্মত নই। তাই ব্যক্তিগত পরিচয়কে অগ্রাহ্য করে এবং তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের প্রতি নির্মোহ থেকে তাঁর কবিতার একটা তুলনামূলক পাঠের নিরপেক্ষ প্রয়াস এই আলোচনা। যদিও স্বল্প পরিসরে এটা দুঃসাহসিকতার সামিল এবং অবশ্যই একটি দুরূহ-সাধ্য কাজ।
ইতালির রেনেসাঁ, আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম, ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব মানুষের চিন্তা-চেতনা-ভাব-প্রেম-মূল্যবোধে এক ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত করেছিল কিন্তু মাত্র একশ বছর বা তার কিছু সময়ের মধ্যেই এই পরিবর্তন বাঁক নিলো এক বীভৎস ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার দিকে। বুর্জোয়াতন্ত্রের যথেচ্ছাচারের বিকাশে আজ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য পরিণত হয়েছে আত্মপরতন্ত্রে। বিগত একশো বছরে পৃথিবী স্বাদ গ্রহণ করেছে দু- দুটি বিশ্বযুদ্ধের, যার ধারাবাহিকতায় সংযুক্ত হয়েছে ধর্মীয় উগ্রবাদের মত তারুণ্য-দীপ্ত মেধার জঘন্য অপচয়। আজ পৃথিবী হাঁটছে এক ঘোরতর স্রোতহীন নদীর দিকে। যুগে যুগে এ ধরনের নিমজ্জমান সময় থেকে বর্তমানকে আকর্ষণীয় আলোক-দৃশ্য-মঞ্চে উত্তোলন করার জন্য আবির্ভূত হন কবি সাহিত্যিকগণ। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলা সাহিত্যে আগমন ঘটে কবি মুহম্মদ নুরুল হুদার। কিন্তু কী এমন নবীনতা তাঁর প্রকাশরীতি বা উচ্চারণে? অথবা তিনি কবিতার ভাষা নির্মাণে কতটা পরিবর্তনকামী? প্রকৃতার্থে প্রত্যেক কবি নিজেই এক একজন স্রষ্টা। সে তাঁর সৃষ্টিকে যুগে যুগে টিকিয়ে রাখার জন্য সচেষ্ট থাকেন সর্বদা।
'নগর বাহিরিরে ডোম্বি তোহারি কুড়িআ
ছোই ছোই যাই সো ব্রাক্ষ্ণ নাড়িআ ।। ধ্রু।।
(১০ সংখ্যক পদ। রাগ। দেশাখ, চর্যাপদ)
নগর বাহিরে, ওরে ডোমনী তোর কুঁড়ে
তোকে ছুঁইয়া ছুঁইয়া যায় সেই বিজ্ঞ বামুন।'
(অনুবাদ- সুকুমার সেন)
উপরোক্ত পঙক্তিগুলো চর্যাপদ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। অন্যদিকে নূরুল হুদা তাঁর শুক্লা শকুন্তলা কাব্যগ্রন্থের সর্বশেষ (৩২) কবিতায় বলেছেন-
'শুক্লা এবার উঠি, কালিদাস, আপনি থাকুন
আপনার পাত্রপাত্রী অবশেষে সুখের দম্পতি
আমরা আরেক কালে, আমাদের নেই ভীমরতি…'
-(শুক্লা শকুন্তলা)
পৃথিবী সৃষ্টির পর প্রথম চেতন উচ্চারণটিই একটি কবিতা। উচ্চারণের ধারাবাহিকতায় যুগে যুগে বিভিন্ন নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে এগিয়েছে ভাষা তথা কবিতা। বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদ থেকে এই উদ্ধৃতি দেবার উদ্দেশ্য অন্য কিছু নয় বরং এখানে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে কবি নূরুল হুদা তাঁর নিজস্ব কাব্যভাষা নির্মাণে কতটা অগ্রসরকামী অথবা তিনি কতটা সচেষ্ট স্বাতন্ত্রধর্মী কাব্যধারার বিনির্মাণে। নিঃসন্দেহে কবি নূরুল হুদা আধুনিককালের আধুনিকতম কবি। কোথাও কোন সাযুজ্য না থাকলেও চর্যাপদ-এর পঙক্তিগুলোর সাথে যেন হুদার কবিতা ভাববিনিময় ঘটিয়েছে সংগোপনে, হয়তো অবচেতন মনেই, কিন্তু উৎকর্ষের জায়গাটি হল দেখার ভিন্নতা। কবি নূরুল হুদা আধুনিকতম চিন্তার বিচিত্র-মুখী প্রকাশের মধ্য দিয়ে নতুনত্বর দিকে পাঠককে আহ্বান করেন- পাঠককে উপেক্ষা করার সুযোগ না দিয়েই।
ভার্জিনিয়া উলফ আধুনিকতার স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়ে বলেছেন- 'সময় আমাদের হাতে মানব-চরিত্র ও মানবিক সম্পর্কগুলো পুনর্বিবেচনার একটা ঐতিহাসিক সুযোগ এনে দিয়েছে। এই অর্থে মানব-ইতিহাসের যে কোন পর্বেই আধুনিক চেতনার সার্বিক প্রকাশ অসম্ভব। সে কারণে আধুনিকতা সময়-সাপেক্ষ ও সময়-নির্ভর।'
চর্যাপদ থেকে বাংলা কবিতা আধুনিকতার পথে হাঁটে মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী-র হাত ধরে। মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী বাংলাসাহিত্যের অন্যতম শুদ্ধতার প্রকাশ। কয়েকশ বছরব্যাপী সুলিখিত এই পদাবলী বাংলা কবিতায় একটা মৌলিক পরিবর্তন সাধন করে। বৈষ্ণব কবিরা বাংলা কবিতাকে কামভাবের প্রাধান্য থেকে প্রেমাবেগে উত্তীর্ণ করেন। রাধা-কৃষ্ণের প্রেম বৈষ্ণব পদাবলীর মূল উপজীব্য। দ্বিজ চণ্ডীদাস রাধার প্রেমকে দেখেছেন এভাবে-
'কি মোহিনী জানো বঁধু, কি মোহিনী জানো।
অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন।
ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর।
পর কৈনু আপন, আপন কৈনু পর।
রাতি কৈনু দিবস, দিবস কৈনু রাতি।
বুঝিতে নারিনু বঁধু তোমার পিরীতি।'
আধুনিককালের কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা তাঁর 'বার বছর' কবিতা-য় প্রেম এবং বিরহের অনুপম প্রকাশ ঘটিয়েছেন এভাবে-
'মধ্যযুগে চণ্ডিদাস ও রজকিনী ছিলেন
দুজন মিলে গঙ্গা-জলে কলঙ্ক-ভাগ নিলেন;
নিজের দুয়ার বন্ধ যখন অন্য দুয়ার খোলা
বিশ শতকের কবিও, দেখো, কেমন আত্মভোলা;
কবির কাছে কোনো নারীর হয়নি কভু হার
কোন জনমে নারীর দোষে নীড় ভেঙেছে কার?'
এক ভিন্ন ধরনের দ্যোতনার ভেতর পাঠককে প্রবেশ করাতে সক্ষম হয়েছেন কবি। মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীর কবি দ্বিজ চণ্ডীদাসের সঙ্গে নিজের কাব্য ভাবনার এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটিয়ে দেখালেন কবিতায় তার নিজস্ব কাব্যরীতি এবং ভাবনার সংশ্লেষণের মাধ্যমে। চণ্ডীদাসের ভাষায় রাধা বলছেন, কী এক জাদুমন্ত্র তুমি জানো যার জন্য রাধা ঘরকে করেছে বাহির, বাহিরকে ঘর। পরকে সনে, আপনকে করেছে পর। একইভাবে রাতকে দিন এবং দিনকে করেছে রাত। অন্যদিকে বিংশশতাব্দীর কবি নুরুল হুদা তাঁর পূর্বসূরি চণ্ডীদাসের সূরকে নতুনভাবে পুনরুত্থান ঘটিয়ে উল্লেখ করে বলেছেন যে, কবিরা সব সময়ই আত্মভোলা। কবিরা নারীর কাছে বার বার পরাজিত হয় সে কথাও তাঁর কবিতায় উচ্চারণের ভেতর দিয়ে তিনি একটা যোগসূত্র আঁকতে সমর্থ হয়েছেন।
বাংলা কবিতার উত্তরণের আরেক পুরোধা-পুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। মধ্যযুগে রচিত বৈষ্ণব পদাবলী থেকে বাংলা কবিতাকে আধুনিক যুগে প্রবেশের সাঁকো হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হয়ত এই কারণে তিনি 'যুগসন্ধিক্ষণের কবি' হিসেবে আলাদা একটা মর্যাদার আসনে আসীন হয়ে আছেন। বাংলা কবিতাকে এক উত্থানভূমিতে নিয়ে দাড় করিয়েছিলেন কবি এবং তিনিই ছিলেন তাঁর সময়ের একচ্ছত্র কবিতা-নায়ক। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত 'বাঙালির মেয়ে' কবিতায় লিখেছেনঃ
'কপালে যা লেখা আছে,
তার ফল তো হবেই হবে,
(এরা) এ-বি পড়ে বিবি সেজে,
বিলিতি বোল কবেই কবে!
(এরা)পর্দা তুলে ঘোমটা খুলে,
সেজেগুজে সভায় যাবে।'
তৎকালীন সময়ে বাঙালি মেয়েদের চলাফেরায় যে পরিবর্তন এসেছিলো তার প্রতি ইঙ্গিত করে কবি উপরোক্ত কয়েকটি পঙক্তি রচনা করেছিলেন, বাঙালি নারীরা কিছু ইংরেজি বুলি আওড়িয়ে এখানে সেখানে যাবে সেটা হয়ত সে প্রেক্ষাপটে কবি মেনে নিতে পারেননি। অন্যদিকে 'আড়ালকুমারী' কবিতায় কবি নূরুল হুদা বলছেন,
'কোথায় যে থাকে, কি তার চেহারা, কত দ্রুত তার রূপবদল!
মুহূর্তেই ত্রিভুবন ঘুরে আসার তার যে কুহক কুশল!
বলুন! আমার মত নশ্বর ভস্ম তার নাগাল পাই কি করে?'
– (আড়ালকুমারী)
দুই যুগের দুই কবির হাত ধরে কবিতার এই বদল প্রবণতা আমাদের বিস্মিত করে। কবিতা দুটি ভাব-ভাষার বহুমাত্রিক আকরণ নিয়ে আমাদের সম্মুখে উপনীত হয়েছে। চর্যাপদ বা মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন ধাঁচের ভাষা প্রয়োগ করে পাঠক মনে একধরণের দ্বান্দিক অবস্থা তৈরি করেছিলেন কবি ঈশ্বরগুপ্ত। কবি নূরুল হুদা তাঁর কবিতায় অত্যন্ত শিল্পিতভাবে স্বতন্ত্র্য এক ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে পাঠকের কাছে তার কবিতার প্রতি নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ দাবী করেছেন। সেটা তিনি পেয়েও গেছেন এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
দুই
১৯৮৩ সালে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা-র কাব্যগ্রন্থ শুক্লা শকুন্তলা প্রকাশ পায়। শকুন্তলা ছিলেন হিন্দু পুরাণে বর্ণিত দুষ্মন্তের স্ত্রী ও সম্রাট ভরতের মা। তাঁর উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে 'মহাভারত মহাকাব্যে। কালিদাস তাঁর 'অভিজ্ঞানশকুন্তলম্' নাটকে এই কাহিনীটি নাট্যায়িত করেছিলেন। কালিদাসের ভাষায় রচিত এই কাহিনী মোটেও সহজবোধ্য ছিলো না। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা সেই কাহিনীকে অবলম্বন করে রচনা করেন শুক্লা শকুন্তলা। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের কবি নূরুল হুদা তাঁর শুক্লা শকুন্তলা কাব্যগ্রন্থে সরল ও অনাড়ম্বর ভঙ্গিমায় অনায়াসলব্ধ এক নতুন কাব্যভাষা নির্মাণ করেছেন যা পাঠকের কাছে খুব সহজেই গ্রহণযোগ্য। আধুনিক বাংলা কবিতায় শুক্লা শকুন্তলা এক অনন্য সংযোজন। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো শিরোনামহীন চতুর্দশপদী সনেট। শুক্লা শকুন্তলার সনেটগুলো পাঠককে এক অদ্ভুত ঘোরের ভেতর প্রবেশ করাতে সক্ষম হয়। মুহম্মদ নূরুল হুদা বলছেন,
ক)
'অনসূয়া, প্রিয়ংবদা বাঁচাও, বাঁচাও
অহেতু উত্যক্ত করে দুর্বৃত্ত মধুপ;
এই হুলে বড় জ্বালা, হুল নয় ধুপ;
যুগলে বাঁচাও, সখি, নয় মাথা খাও।'
(৫, শুক্লা শকুন্তলা)
কবি নূরুল হুদা চেতন পরীক্ষা-সমীক্ষারত। তার কবিতা সুগ্রথিত, ভারসাম্যময়। শুক্লা শকুন্তলা পড়তে গিয়ে আমাদের মনে পড়ে যায় আধুনিক বাংলা কবিতার জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত-র কথা। মাইকেল মধুসূদন দত্ত 'রামায়ণ'-কে বাঙালি পাঠকের জন্য সহজ সরল কাহিনীতে রূপান্তরিত করেছিলেন, করে তুলেছিলেন মানবিক, বাল্মীকির রামায়ণকে তিনি মধুসূদনের সহজবোধ্য রামায়ণে পরিণত করেছিলেন।
বাঙলা ভাষার প্রধানতম সংস্কারক হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর হাত ধরে বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ একাধারে ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, গীতিকার, সুরকার, নৃত্যপরিকল্পক, চিত্রশিল্পী, ভাষাতাত্বিক, রাজনীতিবিদ, জমিদার। কিন্তু কবি হিসেবে? কবি হিসেবে তিনি ছিলেন অন্য মানুষ। তাঁর কবিতা মৌলিক ভাবনায় নিমগ্ন। কবিতা হচ্ছে ধারাবাহিক সমকালের নিরপেক্ষ বয়ান। একেক সময় একেক কবি এসেছেন, বিবৃত করেছেন নিজের কথা নিজস্ব উচ্চারণে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'এবার ফিরাও মোরে'- কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেন-
'সংসার সবাই যবে সারাক্ষণ শত কর্মে রত,
তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো
মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষণ্ণ তরুচ্ছায়ে
দূরবনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্তবায়ে
সারাদিন বাজাইলি বাঁশি। ওরে তুই ওঠ আজি।
আগুন লেগেছে কোথা? কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি
জাগাতে জগৎ- জনে?'
(এবার ফিরাও মোরে, চিত্রা)
পঙক্তি যখন নিজেই আকর্ষক হয়ে ওঠে তখন সে নির্বিঘ্নে বহুভাষিকতার দিকে এগুতে থাকে। এটি সংস্কৃতির একটি স্বাভাবিক প্রবণতা, আকস্মিকতা নয়। এরই ধারাবাহিকতায় কাব্যভাষা পাল্টেছে। তাই আমরা যুক্তিসঙ্গত ভাবে দেখি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ধ্রুপদী আঙ্গিক ব্যবহার করে বাংলা কবিতাকে আধুনিক যুগে প্রবেশ করাতে সক্ষম হয়েছেন অন্য দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেদ- উপনিষদ, পুরাণ, বৈষ্ণব পদাবলী সুফি-সন্তদের কাছে ফিরে ফিরে গেছেন, আর অপেক্ষাকৃত তরুণ কবিরা মাইকেল মধুসূদন দত্ত বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে খুব দূরে সরে না গেলেও ভাষার বহিরঙ্গকে পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন কাব্যভাষা নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছেন। বাংলা কবিতার এই ক্রমবিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আধুনিককালের দক্ষ কাব্যশিল্পী কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা তাই অসাধারণ কাব্যশৈলী রচনার মাধ্যমে বলে উঠতে পারেন-
ক)
'প্রসারী রশ্মির মতো
পিতা তাই সন্ততির হৃৎপিণ্ডমূলে
মেতে ওঠে কারুকার্যে, ভাস্করের মোহন ক্রীড়ায়-
নিপুণ রশ্মির ভ্রূণে
যেন-বা প্রত্যাশী আজ পিতৃত্বের বিপুল বিভব;
ক্রমে বাড়ে রশ্মি-বৃত্ত, বাড়ে তার লাল আবরণী
ক্ষুধিত সিংহের ডাকে বুঝি তারো বৃত্তচ্যুতি ঘটে;
শোনে সে-ও বজ্রধ্বনি
ক্ষুধিত আকাশ শোনে উন্মীলিত জঠরের ডাক।'
(সুসন্তান)
খ)
'ভয়শূন্য জয়শূন্য জীবনের গূঢ়তম অর্থশূন্য তুমি তো বিষাদ
গুরুভার উরু মেলে নিরাসক্ত শুয়ে থাকো তুমি স্বর্ণনিভ
আমিতো অস্থির অস্থি, ঘানিক্লান্ত, জীবনের বিবর্ণ বলদ
মহাকাল স্তব্ধ হলে তুমি কি সন্তুষ্ট হও, হে অতীত বিমূঢ় অতীত?'
(১১, শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি)
উপরোক্ত কবিতাংশ দুটিতে কবি হুদা পাঠককে এক ব্যতিক্রমী কাব্য-মূর্ছনায় আবিষ্ট করে তোলেন। এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। পাঠকের পুরো মনোযোগ তিনি নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিতে পারেন অনায়াসে, পাঠককে এক মোহাচ্ছন্ন আবেগের দিকে হাঁটতে বাধ্য করেন।
তিন
বিজ্ঞানের চূড়ান্ত অগ্রগামিতার এই যুগে পৃথিবী ভূ-ভাগ মানচিত্রের নকশায় আটকে থাকলেও মানুষের জীবনযাপন প্রণালী, কৃষ্টি, ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য সর্বদা চলমান। প্রতিনিয়ত বহমান স্রোতের মত এক দেশের মানুষ অন্য দেশে যাচ্ছে। যাবার সময় সে কোন কিছু সঙ্গে না নিলেও ভাষাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে এবং তাঁর ভাষাকে কোনভাবেই সে ত্যাগ করছে না। বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে বা সামাজিক প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে বাংলা ভাগ হলেও বাংলা-ভাষাভাষী মানুষ বেড়েছে। আজ পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে বাংলা-ভাষাভাষী মানুষ ছড়িয়ে পড়েছে, এরই সুবাদে বাংলা ভাষাও ছড়িয়ে গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তরে। হাজার হাজার বছর ধরে এই ভূ-অঞ্চলের মানুষ মাতৃভাষা কথা বলে এসেছে। কিন্তু সে ভাষা কেড়ে নেবার জন্য চক্রান্ত কম হয়নি। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা- এ ছাড়াও বরাকর অঞ্চলে একষট্টি সালে বাংলা ভাষার জন্য তীব্র আন্দোলন হয়েছিল। এই ক্ষেত্রে এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিয়নে- দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলা ভাষা। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে বাংলা ভাষার উপর আঘাত এসেছে। সেই আঘাত সহ্য করে আজও টিকে আছে বাংলা ভাষা। ছড়িয়ে গেছে পৃথিবীর প্রান্তরে প্রান্তরে।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা আত্মগরিমায় উচ্ছ্বসিত হয়ে চিৎকার করে ঘোষণা করেন তার ভাষা এবং দেশের শ্রেষ্ঠত্বের এবং কবিতার মাধ্যমে ওঠেন, 'যত দূর বাংলা ভাষা তত দূর এই বাংলাদেশ'। আমার মনে হয় বাংলাভাষার কবিতা চর্চার ইতিহাসে এতো বলিষ্ঠ ইশতেহার এর আগে এমনভাবে কেউ কখনও উচ্চারণ করেন নি। এই ইশতেহারের মাধ্যমে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন বাংলা ভাষা আজ আর নির্দিষ্ট কোন জাতি বা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ভেতর সীমাবদ্ধ নেই।
বাংলা সাহিত্য তথা বাংলা কবিতা রবীন্দ্রনাথকে ভিত্তি করে উঠে দাঁড়িয়েছে এ কথা স্বীকার করে নিলে এও অনস্বীকার্য যে বাংলা কবিতাকে হাঁটতে শিখিয়েছে রবীন্দ্র-পরবর্তী তিরিশের কবিরা। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজস্ব সুর সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা তাঁর আপন ভাষা-ভুবন তৈরির মাধ্যমে বাংলা কবিতাকে দিয়েছেন অন্য এক উচ্চতা। মুহম্মদ নূরুল হুদার ক্ষেত্রে তাঁর কবিতা রবীন্দনাথ থেকে সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত একথাও বলা যাবে না, আবার এ কথা কোনভাবেই স্বীকার করা যাবে না যে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা 'রবীন্দ্রানুসারী' কবি। তিনি আপন স্বকীয়তায় উজ্জ্বল, তিনি দরিয়া পাড়ের কবি, তিনি বাঙালির জাতিসত্তার কবি, মুহম্মদ নূরুল হুদা।