‘মঙ্গল‘ শব্দটির মধ্যে তারা ইসলাম বিরোধিতা দেখতে পায়! তাই মঙ্গল শব্দটি বদলে পুনরায় আনন্দ ফিরিয়ে এনে বিতর্কের সৃষ্ট করেছে! আনন্দ আর মঙ্গলে কী বিরোধ আমি জানি না!
Published : 14 Apr 2025, 12:55 PM
বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের কাছে বর্ষ-পরিক্রমা মানেই বাংলা সনের পরিক্রমা। এ দেশের শতকরা আশি জন মানুষের অর্থনীতি নির্ভরশীল কৃষির ওপর। কৃষিজীবীরা বীজ বোনা থেকে শুরু করে ফসল ফলানোর প্রতিটি পর্যায়ে তাদের করণীয় কাজসমূহ সম্পাদন করেন বাংলা সনের পঞ্জিকা দেখে। কিন্তু দুই শত বছরের বৃটিশ শাসনের ফলে সৃষ্ট কেরানিকুল এবং নগরবাসীগণের জীবনে দীর্ঘকাল ধরে বাংলা সনের বর্ষ পরিক্রমার তেমন প্রভাব না থাকলেও বর্ষবরণের জাঁকজমকে অংশ নেয়। বর্ষবরণের অনুষঙ্গে ধর্ম নেই আছে ইহজাগতিক জীবন যাপনে মঙ্গল কামনার সঙ্গে প্রতীকী সম্পর্ক। ধর্মবাদী সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি আনন্দের উদযাপনকে রুদ্ধ করতে চায়। এই রুদ্ধতা থেকে মুক্তির মাধ্যম হিসাবে সকলের জীবনের অনুকূল প্রাসঙ্গিকতায় বাংলা নববর্ষ পালন উৎসবও একই কারণে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে জাতীয় উৎসব হিসেবে।
বাঙালির আবহমান কালের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুশীলন সম্পর্কে নানা প্রশ্ন তুলে চলেছে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে তৎকালীন পাকিস্তানি সরকারের সমর্থক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। যে কটি মৌলিক অনুষঙ্গ বাঙালীর জাতীয় সংস্কৃতির প্রতিভূ সেই বিষয়গুলো সম্পর্কে ক্রমাগত নেতিবাচক প্রশ্ন তুলে বাঙালি সংস্কৃতির সুস্থ বিকাশের পথ রুদ্ধ করার লক্ষ্যেই ক্ষমতাসীন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ক্রমাগত প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিল এবং যাচ্ছে। এই ক্রমাগত অবদমনের প্রতিবাদ হিসেবে দেখা যাচ্ছে সর্বস্তরের জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন জাতীয় উৎসবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতিকে তার রদ্ধপ্রাণ অবস্থা থেকে মুক্তি দিচ্ছেন।
বাঙালির বিভিন্ন বড় ধর্মীয় উৎসব রয়েছে। কিন্তু কোনো ধর্মীয় উৎসবই বাঙালির সকলের উৎসব নয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় উৎসবগুলোতে অন্যধর্মীয়রা আমন্ত্রিত হলেও এই অংশগ্রহণ খুব একটা স্বতঃস্ফূর্ত নয়। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মক্তিযুদ্ধে বাঙালির হাতে এনে দিয়েছে আরো দুটি সর্বলোকের জাতীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই দুই অনুষ্ঠানের সূচনা সাম্প্রতিক কালের। কিন্তু একমাত্র বাংলা বর্ষবরণ উৎসবই যুগ যুগ ধরে বাঙালির সর্বজনীন উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। সব ধর্মের বাঙালির অংশ গ্রহণেও উদ্দীপ্ত বাংলা নববর্ষবরণ উৎসব তাই বাঙালির জাতীয় উৎসব। ফলে এর প্রতি বাঙালির টান অপরিসীম।
বাংলা বর্ষের পয়লা বৈশাখ বাংলাদেশ সবসময়ই ছিল উৎসবমুখর। নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়ে চলেছে বর্ষবরণ উৎসব। ষাটের দশকে ছায়ানটের যে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের শুরু সেই অনুষ্ঠান এখন রূপলাভ করেছে জাতীয় অনুষ্ঠানে। ছায়ানটের অনুষ্ঠানে উপস্থিত জনসংখ্যার বিশালত্ব রমনা প্রাঙ্গণ আজ তিল ধারণে অক্ষম।
পয়লা বৈশাখে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয় বান্নির মেলা। গ্রামের জনসাধারণের কাছে এই বান্নির মেলা বিশেষ আনন্দমেলা হিসেবেই পরিচিত। ঢাকার নাগরিক জীবনে এই মেলার স্বাদ আস্বাদন করানোর জন্যে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটীর শিল্প সংস্থা বৈশাখী মেলার আয়োজন করে আসছেন। ক্ষুদ্র ও কুটীর শিল্প সংস্থার উদ্যোগে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়।
বাংলাদেশের বর্ষবরণ উৎসবের সঙ্গে ১৩৯৬ সাল থেকে ঢাকায় বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদের উদ্যোগে 'আনন্দ শোভাযাত্রা' নামে শুরু হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। ১৩৯৭ সালের শোভাযাত্রা নিয়ে সুন্দরম পত্রিকায় লিখেছিলাম। সেবারের শোভাযাত্রাটিতে প্রধান হয়ে ছিল চারুশিল্পী সংসদের শিল্পীদের দ্বারা নির্মিত বিশাল আকারের একটি বর্ণময় হাতি এবং দুটি বাঘ। এই দুই প্রতীক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে শুরু করে শোভাযাত্রাটি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারদিকের রাস্তা দিয়ে ঘুরে এসে শহীদ মিনারের সামনের পথ দিয়ে ঘুরে টি. এস. সি.-র সামনে দিয়ে এগিয়ে আবার চারকলা ইনস্টিটিউটের সামনে এসে শেষ হয়।
শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা ব্যান্ড পার্টির বিভিন্ন বাদ্যের তালে নৃত্যরত অবস্থায় তাদের পথ-পরিক্রমা সম্পন্ন করে। অংশগ্রহণকারীদের অনেকের মাথায় ছিল বর্ণিল মুকুট; আবার কারো কারো মুখে বিচিত্র মুখোশ। কপালে বাঁধা আলপনাপত্র। শোভাযাত্রাটি শুরু হয়েছিল যতজন অংশগ্রহণকারীর সমন্বয়ে, শেষ হয় তার কয়েক গুণ বেশি জনসংখ্যায় সমৃদ্ধ হয়ে। পথের দুপাশ থেকে এসে অনেকেই এই শোভাযাত্রার অংশ নিয়েছেন; অনেকে দুপাশে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে স্বাগত জানিয়েছেন শোভাযাত্রাকে। শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের পরনেও ছিল বিচিত্র পোশাক। কারো পরনে ধুতি-ফতুয়া, আবার কারো পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, কারো পরনে আরবীয় পোশাক। কিছু কিছু মেয়েদের পরনে ছিল লালপেড়ে সাদা শাড়ি। বাঙালি সংস্কৃতির বিচিত্র ও বিমিশ্র রূপ ফুটে উঠেছিল সেই শোভাযাত্রায়। সেই লেখায় আশা প্রকাশ করেছিলাম ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মতোই এই আয়োজনটিও একটি ঐতিহ্য লাভ করতে যাচ্ছে।
ষাটের দশকে বাঙালী সংস্কৃতির ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অবদমন আরোপের প্রতিবাদ হিসেবে যেমন সসূচনা হয়েছিল ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, তেমনি সাম্প্রতিক কালের সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সংস্কৃতি বিষয়ক নানারকম অপব্যাখ্যার প্রতিবাদে শুরু হয়েছিল এই ‘আনন্দ শোভাযাত্রা'র।
এই আনন্দ শোভাযাত্রার ধারণাটি প্রথমে আসে যশোরের ‘চারুপীঠ’ নামে একটি শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কাছ থেকে। বাঙালি লোকজীবনে আবহমান কালের ঐতিহ্যকে অর্থাৎ চিত্র, ভাস্কর্য, নৃত্য, বাদ্য ও উল্লাসকে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে চারুপীঠের সদস্যরা ১৩৯৩ সালের নববর্ষ উদযাপনেরন জন্য এই শোভাযাত্রার আয়োজন করেন। উৎসবের এক মাস আগে থেকেই শুরু, হয়েছিল উৎসবের উপকরণ নির্মাণ ও নৃত্যগীত শিক্ষা। ১৩৯৩ সাল থেকে যশোরের চারুপীঠের সদস্যরা প্রতি বৈশাখে এই শোভাযাত্রার আয়োজন করে থাকেন। এই 'আনন্দ শোভাযাত্রা' বাঙালির বর্ষবরণ উৎসবকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। সেই সঙ্গে বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাস্থ্যকে করে তুলছে বলিষ্ঠ থেকে বলিষ্ঠতর।
যতদূর মনে পড়ে যশোরের শিশুদের চারুকলা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান চারুপীঠের প্রতিষ্ঠাতা মাহবুব জামাল শামিম ছিলেন ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র। চারুপীঠের উদ্যোক্তা ও শিল্পী এস এম সুলতানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবেই তাঁকে আমি চিনতাম। আমি তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নেতৃস্থানীয় একজন কর্মী। যে বছর যশোরে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রার শুরু হয়েছিল তখনই ঢাকাতেও বেশ আলোচিত হয়েছিল উদ্যোগটি। ভাস্কর মাহবুব জামাল শামিমের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হয়েছি ১৩৯৩ সালে (১৯৮৬) সালে চারুপীঠ এই আয়োজন শুরু করে। পরে তিনি যখন চারুকলা ইনস্টিটিউটে স্নাতকোত্তর করতে আসেন তখন ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে ১৩৯৬ সালে (১৯৮৯) শোভাযাত্রা শুরু করেন। তখন এর নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। আয়োজনটি শুরুর সাত বছর পরে, ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম লাভ করে। এই নামকরণ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ঘটেছিল। এর মধ্যে ধর্মের কথা মনেই আসেনি। বর্তমান সরকার ধর্মবাদী নানা গ্রুপের চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছে। যদিও প্রকাশ্যে তা স্বীকার করছে না! ‘মঙ্গল‘ শব্দটির মধ্যে তারা ইসলাম বিরোধিতা দেখতে পায়! তাই মঙ্গল শব্দটি বদলে পুনরায় আনন্দ ফিরিয়ে এনে বিতর্কের সৃষ্ট করেছে! আনন্দ আর মঙ্গলে কী বিরোধ আমি জানি না! ইয়োনেস্কো হেরিটেজ ঘোষণা করেছিল ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে। আমার কাছে ‘আনন্দ’ ও ‘মঙ্গল’ ওতোপ্রতো বিষয়! তাই বাংলা ১৪৩২-র মঙ্গল কামনা করি সকলের জন্য!