১
আহমেদ ফারাজ। তার আসল নাম যদিও সৈয়দ আহমেদ শাহ, কিন্তু তিনি তার তাখাল্লুস অর্থাৎ লেখনি নামেই পরিচিত। ১৯৩১ সালে জন্ম তার বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়াতে। পেশা ছিল অধ্যাপনা। উর্দু ভাষার বিখ্যাত কবি তিনি। তাকে তুলনা করা হয় ইকবাল ও ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের সাথে। গজল রচনার জন্য বিখ্যাত। কবি হিসাবে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন। মুশায়েরা অর্থাৎ কবিতা পাঠের আসরে তার কণ্ঠে কবিতা শোনবার জন্যে ভীষণ ভীড় জমত। শুধু পাকিস্তানেই নয়, ভারতে এবং সারা পৃথিবীজুড়ে প্রবাসী উর্দু সাহিত্যের অনুরাগীদের মাঝে তার রচনার আকর্ষণ রয়েছে। মেহেদি হাসান, গোলাম আলি, জগজিৎ সিং, রুনা লায়লা প্রমুখ শিল্পী তার লেখা গজল গেয়েছেন বিভিন্ন চলচ্চিত্রে ও মাহফিলে। তার গজলের বিষয়বস্তু একদিকে যেমন রোমান্টিক ধরনের অন্যদিকে সমকালের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতাও তার কবিতায় ছাপ রেখেছে। উপরন্তু তিনি ছিলেন সমাজ ও রাজনীতি মনস্ক মানুষ। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের চেতনা তার রচনায় যেমন আছে তেমনি বাস্তবেও সেনাপতি জিয়াউল হকের সামরিক একনায়কতন্ত্রের সমালোচনা করে তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। উর্দু ভাষার বিপ্লবী কবিদের তালিকায় তিনি একজন উজ্জ্বল চরিত্র। ২০০৮ সালে প্রয়াত হন।
আহমেদ ফারাজ রচিত দ্বিপদী কবিতা শের ভাষান্তর করতে গিয়ে নিজেকে দুঃসাহসী মনে হলো। উর্দু, ফারসি, হিন্দি, আরবি এইসমস্ত ভাষার কোনোটাই আমি জানি না। আসলে মাতৃভাষার বাইরে কেবল ইংরেজিটাই কোনোমতে খানিকটা বুঝি। অন্যান্য ভাষার সাহিত্য হয় বাংলায় নয় ইংরেজি অনুবাদে পড়া আমার। তো ইংরেজিতে নানা অনুবাদ পড়তে পড়তে কোনো-কোনোটিকে অনুবাদের সাধ জাগে। এর কারণ দুটি। একটি কারণ হলো নিজেই ওটা ভালোভাবে পাঠ করা। অনুবাদ করতে গিয়েই লেখাটির মর্মে ভালোভাবে ঢোকা হয়ে যায়। আরেকটি বিনম্র উদ্দেশ্য হলো, এইসব সাহিত্যের রস বাংলায় খানিক পরিবেশন করবার চেষ্টা করা।
কিন্তু অনুবাদেই তো মূলের অনেকটা হারিয়ে যায়। অনুবাদের অনুবাদে দূরত্ব ঘটে আরও বেশি। তবু সাহিত্য যেহেতু মূলত ভাবের ব্যাপার তাই ভাবটুকু নিয়ে আরেকটি কবিতা পুনর্সৃজনও একদম খারাপ কিছু নয়। এই ভরসাতেই মূল ভাষা না জেনেও, যাকে অনুবাদ না বলে রূপান্তর বলি, তা করা সম্ভব হয়। কারণ ইংরেজিতে 2 + 2 = 4 এর বাংলা ২ + ২ = ৪ হলেও সাহিত্যের অনুবাদকর্ম ঠিক এই কিসিমের ঘটনা নয়। তাই ভাবটা বুঝলে ও নিজের ভাষায় সেটিকে রসময়ভাবে উপস্থাপন করলেই চলে।
কিন্তু দ্বিপদী কবিতা শের-এর বেলায় বিষয়টি অনেক সময়ই আরেকটু জটিল। কারণ এখানে অল্প কথার মধ্যে অনেক বক্তব্য, ইঙ্গিত, ব্যঞ্জনা, উল্লিখন, পরিহাস, বুদ্ধিগত রসিকতা বা উইট ইত্যাদি থাকে এবং তা অনেক সময় এর ভাষাবৈশিষ্ট্য কাজে লাগায়। সুতরাং মূল ভাষা জানা না থাকলে অনুবাদ অনেক সময় মূলের অভিপ্রায় থেকে সরে যেতে পারে।
তবু ফেরেশতারা যেখানে যেতে সাহস পায় না মূর্খেরা বীর দর্পে সেখানে চলে যায়। আমিও হাজির হয়েছি আহমেদ ফারাজের মুশায়েরা সভায়, তার কতিপয় দ্বিপদীর ভাবসম্ভার বাংলায় পরিবেশনের দুঃসাহস নিয়ে। যারা মূল পাঠটি জানেন তাদের কাছে -- বিশেষত জাভেদ হুসেন এর কাছে -- অগ্রিম মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি সম্ভাব্য ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার জন্য।
কেউ-কেউ সৌভাগ্যকে দোরগোড়ায় পেয়ে যায়,
আমার মতো কেউ-কেউ জীবনভর ঘুরে বেড়ায়।
*
জীবন সম্পর্কে আমার একটাই নালিশ আছে,
এখানে তোমার আবির্ভাব বড় দেরিতে হয়েছে।
*
যে-কাজের জন্য আজ আমি যন্ত্রণার শাস্তি পেলাম
ভবিষ্যতে সেগুলোই পাঠ্যতালিকায় থাকবে।
*
কী করে তোমাকে ওয়াদা খেলাফকারী বলি,
শেষ চিঠিতে তুমি লিখেছ 'কেবল তোমার বন্ধু।'
*
যদি আমি ছায়া হই তো কেন আমার কাছ থেকে পালাও?
যদি আমি দেয়াল হই তো কেন ভেঙে ফেলছ না?
*
আর কত প্রেম চাও তুমি, ওহে ফারাজ,
মায়েরা তাদের বাচ্চাদের নাম তোমার নামে রেখে দিয়েছে।
*
সব ইচ্ছা পূরণ হয় না,
তেমনি কিছু শের অসম্পূর্ণই থেকে যায়।
*
তোমার প্রতি আমার ভালোবাসায় যদি সামান্য গভীরতাও থাকে -- তাকে ইজ্জত করো,
কোনো একদিন এসে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে যেও।
*
অনেক দিন হয়ে গেল তুমি আমাকে চাওয়ার বেদনা থেকে বঞ্চিত রেখেছ,
এসো আবার, ওগো প্রিয়, আমাকে কাঁদিয়ে যাও।
*
এখনও আমার হৃদয় কিছুটা আশায় আশায় আছে,
তাহলে এসো, আশার শেষ মিটমিটে আলোটাও নিভিয়ে দাও।
*
দোহাই, জিজ্ঞেস করো না কত বেশি যন্ত্রণা হয়েছে;
তার সূর্য এতই উজ্জ্বল ছিল যে ছায়াগুলো পর্যন্ত জ্বলছিল।
*
জিজ্ঞেস করো না, এটা কীভাবে ঘটল;
সেও আমাকে বাঁধে নাই, আমিও নিজেকে মুক্ত করি নাই।
*
মেয়েটাকে একা দেখে মন খারাপ করছ কেন, ফারাজ?
তুমিই না বলেছ, অনন্য সে!
*
ফারাজ, আলাদা হওয়া যদি এতই সোজা হতো
শরীর ও আত্মাকে আলাদা করতে কি ফেরেশতা লাগত?
*
আমার মুখে তোমার চাইতে বেশি কুঞ্চন আছে তো কী হয়েছে?
সময় আমাকে একটু বেশি জড়িয়ে নিয়েছে তার শরীরে!
*
গতরাতে তিক্ত অশ্রু ঝরাবার পরই আমি শান্তিতে ঘুমাতে পেরেছি,
হৃদয়ের বিষ আমি কান্নাভেজা চোখ দিয়ে বের করে দিয়েছি।
*
আগের মতো আর তোমার নামে মেতে থাকি না
তোমার কথা উঠলে আমি অন্যরকম কথা বলি।
*
আমার শহরবাসীর ভালোবাসা আমি স্বীকার করি,
যে হাতেই চুমু খেয়েছি সেটাই একটা ছুরিতে পরিণত হয়েছে।
*
ঘুম হতে জেগে দেখলাম আমার সব স্বপ্ন ভেঙে খানখান হয়ে গেছে,
টুকরো কাগজের মতো বাতাসে ভাসছে তারা।
*
তোমার বিচ্ছেদ-বিরহে মরে যাওয়া কত সোজা, ওগো প্রিয়,
অথচ শেষ মাথায় পৌঁছাতে আমার সারাটা জীবন লাগল।
*
হয়তো একদিন আমি সুখ পেতে পারি,
দুঃখ তো ডাকা ছাড়াই চলে এসেছিল।
*
তাকে যা বলেছি তার প্রতিটি কথা যদি সে বুঝত,
সে আমার প্রেমে না পড়ে বরং নিজের প্রেমেই বেশি করে পড়ত।
#