ভিন্নমতাবলম্বী বা প্রথা অনুসারী, কারো পতাকা নিয়েই হাঁটিনি কখনও
Published : 04 Jul 2024, 05:31 PM
প্রশ্ন: জনাব কাদারে, আপনি আলবেনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত লেখক। আলবেনিয়ার সাহিত্য আপনার মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে স্থান পেয়েছে। আপনার ও আলবেনিয়ার জন্য এই অর্জনের তাৎপর্য কী?
ইসমাইল কাদারে: সাহিত্য সম্বন্ধে সুপরিচিত একটি অভিমত হচ্ছে, এই গ্রহের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর আধ্যাত্মিক সম্পদ হিসেবে এর দু’টি বৈশিষ্ট্য আছে: এটি সর্বজনীন এবং চিরন্তন। ফলে যে কেউ যে কোনোসময় সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে পারেন। হয়তো এ কারণেই সাহিত্য নিয়ে আলাপ করা এত সহজ মনে হয়। তবে একথাও বলে রাখা দরকার, সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে গেলে ভুল করাও সহজ। কোনো লেখকই নিজের জন্য সাহিত্য সৃষ্টি করেন না। কেউই না। সেই আদি থেকেই, এটি সৃষ্টি করা হচ্ছে সব মানুষের জন্য। ইংল্যান্ড চাইলেও শেক্সপিয়ারকে নিজের করে রাখতে পারবে না। তিনি আমাদের সবার। কেবল নিজেদের জন্য সাহিত্য সৃজন করা যায়, পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষের মানচিত্র নেই। এটা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: আলবেনিয়া একটি ছোট ও বিচ্ছিন্ন দেশ। এ দেশটি বাকি বিশ্বের মানুষ জানতেন না। বিদেশিদের কাছে আলবেনিয়া ও আলবেনিয়ার মানুষকে আপনি কীভাবে পরিচয় করিয়ে দেবেন?
কাদারে: মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য সাহিত্য সৃষ্টি করা হয় না। মানচিত্রের বই, ইতিহাস এসবই এজন্য যথেষ্ট। সাহিত্যের শিল্পগুণ এতটাই স্বাধীন যখনই কোনো ভাষায় এটি অনূদিত হয় তখনই নতুন করে এর জন্ম হয়। সাহিত্যের জাদুও এখানেই। স্বভাবতই, সাহিত্য যেখানে সৃষ্টি হয়েছে সেই দেশ বা দেশের মানুষকে চেনার ব্যাপারটা সহজাতভাবেই ঘটে। তবে এটি কখনোই সাহিত্যের লক্ষ্য নয়। এর জ্বাজ্জ্বল্যমান দৃষ্টান্ত প্রাচীন ট্রয় নগরী। নগরটিকে ধ্বংস করার সময় গ্রিকদের লক্ষ্য ছিল, এর সমস্ত স্মৃতি, এমনকি নামটি পর্যন্ত মুছে দেওয়া। অথচ ঠিক উল্টোটা ঘটেছে। সাহিত্যের কারণে তিন হাজার বছর পরও ট্রয় টিকে আছে এবং গোটা মানবজাতির স্মৃতিকে সতেজ রেখেছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ট্রয়ের ঘটনাটিকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম কূটাভাষ বলা যেতে পারে।
প্রশ্ন: আপনি বহুবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। আপনার ভক্তদের ব্যাপক প্রত্যাশা সত্ত্বেও পুরস্কারটি এখনও পাননি। এর কারণ কী বলে মনে করেন?
কাদারে: সত্যি বলছি, এ প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই। যদিও এ ধরনের প্রশ্ন করাটা প্রথার মধ্যেই পড়ে। আমার অনেক সহকর্মীও এ নিয়ে বিরক্ত। মনে হয় না এ বিরক্তির কোনো কারণ আছে। বরং বড়দিন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে যেমন অনেকে জিজ্ঞেস করে, এবারের বড়দিন কোথায় কাটাতে চান, তেমনি এ ধরনের প্রশ্ন করার প্রথাকেও আমার ভালোই লাগে। আমি মনে করি সাধারণ মানুষের এমন মনোযোগের জন্য সাহিত্যের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।
প্রশ্ন: মন্দ লোকেরা বলে আপনার নোবেল না পাওয়ার কারণ, তাদের মতে, একদলীয় মতবাদের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক কণ্ঠস্বর হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও তৎকালীন কমিউনিস্ট সরকারের সঙ্গে মিলেজুলে চলতেন। আপনার অবস্থানের সঙ্গে এমন অভিমত কি সাংঘর্ষিক নয়? এ ধরনের কথাবার্তা থেকে চিরকালের জন্য মুক্ত হওয়ার জন্য এখনই কি সঠিক সময় নয়?
কাদারে: শেষ থেকে শুরু করি। ঠিকই বলেছেন, এ ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়ার কাজ লেখকের নয়। স্বৈরাচারী শাসকের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক সবসময়ই জটিল। ইতিহাসে এমন কোনো শাসক নেই, সাহিত্য নিয়ে যিনি বিরক্ত ছিলেন না। শাসক, বিশেষত স্বৈরাচারী শাসক এই বিরক্তি লুকানোর চেষ্টা করে। সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ, গতিরোধ, জেল বা এমনকি মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেওয়ার সময়ও, এর স্তাবকতা করার চেষ্টা করে শাসক। উভয়ের প্রকৃতির কারণেই স্বৈরাচার আর সাহিত্যের সম্পর্ক এত বিষময়। আমরা জানি, সাহিত্যের মর্মমূলে আছে স্বাধীনতা, মুক্তি, গণতন্ত্র। অন্যদিকে স্বৈরাচার হচ্ছে এর পুরো উল্টো। সুপরিচিত লেখকদের ক্ষেত্রে, স্বীকৃতি যত বেশি, তাঁর সমস্যাও তত নাটকীয়। সমান্তরাল কোনো কর্তৃপক্ষকে সহ্য করে না একনায়ক, তার মর্যাদাকে তো নয়ই। একটা বড় ধরনের কূটাভাষের জন্ম হয় এ থেকে। নির্মম শাসকের অধীনেও উচ্চমানের সাহিত্য তৈরি হতে পারে। শাসক চায় একে ব্যবহার করতে। সাহিত্য সম্বন্ধে এমন ক্লিশের কথা শোনা যায় যেখানে দেশ এবং অন্তর্নিহিতভাবে শাসককেও সে সম্মান জানায়। অথচ সাহিত্য এটি করে না। সম্মানের কথা যদি বলি, সাহিত্য নিজেকেই সম্মানিত করে। কেবল নির্মমতার জন্যই নয়, একনায়কেরা চতুরতার জন্যও বিখ্যাত। বছরের পর বছর ধরে লেখকদের সম্বন্ধে গোপন ফাইল তৈরি করে তারা, বিশেষ করে তাদের নামে কলঙ্ক ছড়ানোর জন্য। আলবেনিয়ায় কমিউনিজমের পতনের পর সবার আগে যারা গোপন রাষ্ট্রীয় নথি অবমুক্ত করার দাবি তুলেছিল আমি তাদের একজন। সেই ঘটনার ২৭ বছর কেটে গেলেও আজও সেটি ঘটেনি। ঘটনাক্রমে দু চারটে নথি প্রকাশিত হলেও অধিক গবেষণার পরিবর্তে সেগুলোকে নীরবতার চাদরে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। বছরকয়েক আগে দৈবক্রমেই ১৯৮২ সালে করা গোপন এক তদন্তের প্রতিবেদন আমার হাতে আসে। যেহেতু পত্রপত্রিকায়ও এটি প্রকাশিত হয়েছে, সেটা দেখাচ্ছি আপনাকে। স্রেফ এসব নথিতে কী থাকে সেটি জানানোর জন্য। সবাই এগুলোর কথা বলে কিন্তু কেউ এগুলো দেখেনি।
প্রশ্ন: ঐ প্রতিবেদনে কোন ব্যাপারে কথা বলেছিলেন আপনি?
কাদারে: প্রতিবেদনে অনুরোধ করা হয়েছিল, ইসমাইল কাদারে নামে যে লেখকের সঙ্গে আজ আপনি কথা বলছেন, সেই লেখক যে সরকারকে উৎখাতের কাজে নিয়োজিত ষড়যন্ত্রকারী একটি দলের সদস্য সেটি প্রমাণ করার জন্য। বুঝতেই পারছেন, ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে কথা বলছি না আমরা, বলছি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে, যার পরিণতিতে গুলি করে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। চাইলে সহজেই প্রতিবেদনটি দেখতে পারেন। আলবেনীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. জিকিস্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের ফিরিস্তি আছে ওতে। জেরার সময় নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেছিলেন তিনি। সেই প্রতিবেদনে ‘ষড়যন্ত্রের’ বিস্তারিত বিবরণ আছে, আছে তদন্তকারীর নামও, যে এখনও আলবেনিয়ায় সুখেশান্তিতেই বাস করছে। এক তরুণ আলবেনীয় সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ঐ তদন্তকারী প্রতিবেদনের সত্যতাও স্বীকার করেছে।
প্রশ্ন: তারপর কী ঘটল?
কাদারে: ঘটনার ওখানেই শেষ। আপনি যে মন্দ লোকগুলোর কথা বললেন, তারাও এ প্রতিবেদন নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখাননি। এ থেকেই একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাথে লেখকের সম্পর্কের ব্যাপারটি বোঝা যায়। কমিউনিজমের পতনের পর ঐ ষড়যন্ত্র নিয়ে বড়াই করার ইচ্ছে আমার হয়নি, কারণ এটি সত্য ছিল না। তবে গোপন ফাইলটি সত্যিই ছিল। এটি সরাসরি বলে যে, লেখকের জন্য কফিন প্রস্তুত ছিল, কেবল নির্দেশের অপেক্ষা। অন্য অনেকের ক্ষেত্রেই তা ঘটেছে।
প্রশ্ন: এ ব্যাপারে আরেকটু সবিস্তারে বলবেন কী?
কাদারে: দেখুন লেখক কোনো জাদুকর নন। কমিউনিস্ট আলবেনিয়ার মতো একদিকে মোড় নেওয়া রাষ্ট্রের খামতিগুলো তিনি পূরণ করতে পারবেন না। তবে সব অবস্থায়, এমনকি অসম্ভব পরিস্থিতিতেও, নিজের সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি দায়ী। বিশেষ করে খ্যাতিমান লেখক। যাঁর স্বীকৃতি যত বেশি, দায়িত্বের সংবেদনশীলতাও তাঁর বেশি। আমার কথা বলি। কমিউনিজমের পতনের পর আমি বিখ্যাত হইনি, যখন কোনো ঝুঁকি ছাড়াই খারাপ দিনগুলোর কথা বলা যেত। সুইজারল্যান্ডের কোনো হ্রদের পাশে বসে, অর্থাৎ স্বৈরাচারী শাসনাধীন আলবেনিয়ার বাইরে বসে লেখিনি আমি, লিখেছি ভেতরে থেকেই। ১৯৬০ সালে স্টালিনিস্ট আলবেনিয়ার খুবই জনপ্রিয় লেখক ছিলাম আমি। এদিকে ’৭০ সালে দুর্লভ একটা ঘটনা ঘটল। প্যারিসে বসে একটি বই অনুবাদের পর বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেলাম। সে সময় এর মানে বোঝাত পশ্চিমা স্বীকৃতি। লেখকের জন্য, তাঁর পাঠকদের জন্য, যে কমিউনিস্ট দেশে তিনি বাস করেন সেটির জন্য, এটি ছিল বড় একটি ধাক্কা। আপাতদৃষ্টিতে আনন্দময় মনে হলেও, এমন ঘটনা দারুণ বিপজ্জনক হয়ে পড়তে পারে। এক্ষেত্রেও তাই ঘটল। লেখক নিজেকে আবিষ্কার করলেন বিরামহীন এক সংশয়ের মধ্যে। সেই সংশয়ের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই প্রশ্ন-আমাদের চিরশত্রু পশ্চিমা বুর্জোয়ারা, যারা বলশেভিক আলবেনিয়ার বীরত্বকে ঘৃণা করে, তারা কেন তোমার এতো পছন্দের? মানসিক বৈকল্যগ্রস্ত আলবেনীয় রাষ্ট্র রীতিমতো অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ল। চারদিকে নিস্তব্ধতা। তৈরি হলো গোপন ফাইল, যেগুলোর কথা আপনাকে বলেছি। খোলাখুলিভাবে অবশ্য কিছুই বলা হলো না। তারা চাচ্ছিল আমি নিজেই পশ্চিমাদের বলি: তোমাদের পছন্দ করি, তবে আমি তোমাদের শত্রু। এ ধরনের কিছু অবশ্য ঘটেনি। পশ্চিমা চাপের মুখে আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো বুর্জোয়া সাংবাদিকদের। এরকম কয়েক ডজন সাক্ষাৎকার পাবেন খুঁজলে, কিন্তু পূর্ণ নৈতিক দায় নিয়ে বলতে পারি, এসব সাক্ষাৎকারের কোথাও একটা অনুচ্ছেদও খুঁজে পাবেন না যেখানে আমি যা বলব বলে আলবেনীয় স্টালিনিস্টরা আশা করেছিল সেটি আমি বলেছি। এটি ছিল প্রথম পরীক্ষা যাতে আমি উত্তীর্ণ হয়েছিলাম এবং বলতে লজ্জা নেই, আলবেনীয় সরকার মাথা নুইয়েছিল।
প্রশ্ন: কাজটা কি কঠিন ছিল?
কাদারে: অবশ্যই। আমার কাজ ছিল মনকে সংহত করা যাতে মূল সত্যের বিকৃতি না ঘটে। পশ্চিমা সাংবাদিকরাও আমার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে আমার জীবনকে আরও দুঃসহ করার চেষ্টা করেননি তাঁরা। তারপরও, বিপজ্জনক মুহূর্ত হঠাৎই এসে যেত। বিশেষ করে টেলিভিশনে সরাসরি সাক্ষাৎকারের সময়।
প্রশ্ন: এমন একটি মুহূর্তের কথা শুনতে চাই।
কাদারে: জার্মানিতে, বার্লিন টিভিতে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় ঘটেছিল ওটা। সাংবাদিক হঠাৎ এমন একটা প্রশ্ন করলেন, পূর্ব ইউরোপ থেকে আসা যেকোনো লেখকের জন্য যা ভয়ংকর হতে পারে। তিনি বললেন, ‘মি. কাদারে, আপনি কি দেশের শাসকদের বিরুদ্ধে লিখতে পারেন?’ যদিও উস্কানি দেওয়ার ইচ্ছে থেকে ওটা করেননি তিনি, তবে এর চেয়ে বিরক্তিকর প্রশ্ন আসলে হয় না। তিনি প্রশ্নটি করে ফেলার পর যে নীরবতা নেমে এলো তখনই নিয়তি আমার মাথাকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করল। আমি বললাম, ‘না।’ তারপর ব্যাখ্যা করলাম যে আমার দেশে এ ধরনের কাজ করা আইনত নিষিদ্ধ। যতটা শোনাচ্ছে আদতে উত্তরটা তার চেয়ে সাহসী ছিল। বিমানে আলবেনিয়ায় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, উত্তরটাকে দেশে ‘খারাপ’ বলে ধরে নেওয়া হলে কীভাবে নিজেকে বাঁচাব। মনে পড়ল দেশের আনাচে কানাচে হাজারও প্ল্যাকার্ডে যে কথাগুলো দেখি সেগুলোর কথা: ‘সর্বহারার একনায়কত্ব দীর্ঘজীবী হোক’। তার মানে আমার দেশে যে একনায়কতন্ত্র চলছে দেশও সেকথা লুকায় না।
প্রশ্ন: লেখালেখির ক্ষেত্রে কি কাজটা আরেকটু সহজ ছিল?
কাদারে: পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে সেটি। ১৯৭০ থেকে কমিউনিজমের পতন পর্যন্ত পশ্চিমা দুনিয়ায় আমার স্বীকৃতি যেমনই থাকুক, আমাকে বলা হতো সমাজতন্ত্রী বাস্তবতার লেখক। এই তকমা যেহেতু নিজের ইচ্ছেমতো লেখার ব্যাপারে কোনো বাধার সৃষ্টি করেনি সেহেতু এর ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা ছিল না আমার। বরং এতটা স্বাভাবিকভাবে এটিকে ব্যবহার করতাম যে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু মজা করে বলেছিল, নিজের লেখালেখিকেও নাকি এ নামেই অভিহিত করতে শুরু করেছি আমি। সে বলেছিল, এখন আমার কাজ শুধু অন্য ধারা, অর্থাৎ স্তালিনীয় মতাদর্শ-আশ্রিত লেখালেখিকে অবক্ষয়ী (decadent) নামে আখ্যায়িত করা।
একনায়কতান্ত্রিক শাসনাধীনে রচিত সাহিত্যকে নিয়ে সবসময়, এমনকি আজও, ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ আছে। ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা’ নামটিও এই বিশৃঙ্খলার পালে হাওয়া দেয়। কারও কারও কাছে এ নামটি অভিশপ্ত এবং এর সঙ্গে সৃজনশীলতার কোনো সম্পর্কের কথা তারা স্বীকার করেন না। অন্যরা মনে করেন নামটিকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। আমার সবসময়ই মনে হয়েছে, সাহিত্যের ভিত্তিই হচ্ছে সংস্কারাচ্ছন্নতা, বিশেষ করে যখন তকমার প্রশ্ন এসে যায়। এ কারণে অস্বাভাবিক জায়গায় বসে স্বাভাবিক সাহিত্য রচনা করেছি, এই ফর্মুলাটা আমার কাছে একঘেয়ে লাগে। অথচ বরাবর এ ফর্মুলাকেই আঁকড়ে ধরে আছি। তিনটি আলাদা আলাদা সময়ে লিখেছি আমি। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ ছিল সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার আদর্শ সময়। পাঠক আর রাষ্ট্র ছিল একসুরে বাঁধা। পরবর্তী বিশ বছরও সমাজ ছিল সমাজতান্ত্রিক, তবে পাঠক ছিল দু’ রকম। আলবেনীয় আর আন্তর্জাতিক। কমিউনিস্ট শাসনোত্তর তৃতীয় পর্বটি ছিল পুরোপুরি মুক্ত ও স্বাধীন। নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, এই তিনটি ভিন্ন কালপর্বে আলবেনিয়ায় ও আলবেনিয়ার বাইরে বসে লেখা আমার খানচল্লিশ বইয়ের প্রতিটির আধেয়, কাঠামো ও বার্তা একই। এর কোনোটিকে আমি অস্বীকার করি না। ভিন্নমতাবলম্বী বা প্রথা অনুসারী, কারো পতাকা নিয়েই হাঁটিনি কখনও। ছিলাম স্রেফ একজন লেখক। ঐ তিনটি সময়েই। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে? একটা মজার ব্যাপার বলি। আজ আমরা যখন কথা বলছি, লন্ডনে মান বুকার পুরস্কার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ব্রিটেনে প্রকাশিত সেরা বিদেশি বইয়ের জন্য এই পুরস্কার। ২০১৭-র প্রতিযোগিতায় ১২টি দেশ নির্বাচিত হয়েছিল, যার মধ্যে একটি ছিল আমার দেশ আলবেনিয়া। কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, আলেবেনিয়ার প্রতিনিধিত্বকারী আমার বই ‘কামারিয়া ই টারপিট’ লেখা হয়েছিল আলবেনিয়ায় বসে, ৪০ বছর আগে। স্টালিনিস্ট, বলশেভিক আলবেনিয়া, যেটি ছিল ব্রিটেনসহ পশ্চিমা দেশগুলোর এক নম্বর শত্রু।
প্রশ্ন: সে বইয়ের কোনোকিছুই বদলায়নি। তার মানে কি বইটি তার মূল রূপেই প্রকাশিত হয়েছে?
কাদারে: একটা পৃষ্ঠাও বদলানো হয়নি বইটির। সেই সঙ্গে এটাও যোগ করি যে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ওপর লেখা হয়েছে বইটি।
প্রশ্ন: ১৯৯০ সালে ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় চান আপনি। কেন? ফ্রান্সকেই বা বেছে নিলেন কেন?
কাদারে: বিশেষত নেপোলিয়নের সময়কালে, অটোমান শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আলবেনীয়সহ বলকান অঞ্চলের সব দেশের কাছেই ফ্রান্স প্রিয় হয়ে ওঠে। বলকানে, বিশেষ করে আলবেনিয়ার কোনো কোনো অঞ্চলে একসময় ‘মার্সেয়া’কে দেশপ্রেমমূলক সঙ্গীত হিসেবেও গাওয়া হতো। প্রেসিডেন্ট আলিয়ার (আলবেনিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট রমিজ আলিয়া) সঙ্গে তিক্ত কয়েকটা চিঠি আদানপ্রদানের পর ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় চাই আমি। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আলিয়াকে অনেকে আলবেনিয়ার গর্বাচেভ বলে মনে করলেও আসলে তার শাসনাধীনে আলবেনিয়ার ভালো কিছু হওয়ার আশা নেই।
প্রশ্ন: এখন মাতৃভূমি আলবেনিয়ার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন? অতীতের কথা চিন্তা করলে সে সম্পর্ক কতোটা বদলেছে?
কাদারে: সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়েছে বলে শুনিনি। বরং সব ক্ষেত্রেই বোঝাপড়া খুব ভালো। ইউরোপীয়দের চোখে বলকানের মানুষ সাধারণত বেশ কর্কশ আর ঝগড়াটে। একথায় কিছুটা সত্যতা আছে বটে, তবে একথাও মানতে হবে, বলকানের মানুষ, বিশেষ করে আলবেনীয়রা সাহিত্য খুব ভালোবাসে, এমনকি সাহিত্যকে জীবনে ধারণ করারও চেষ্টা করে। এটি আসলে নারীদের বা ভালোবাসার প্রতি মনোভাবের মতো অন্যান্য কূটাভাষের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি বিস্ময়ও বটে। সেই সঙ্গে এ-ও বলি, বাস্তব জীবনে নারীদের প্রতি আলবেনীয়দের মনোভাব অতটা ঈর্ষণীয় না হলেও শিল্প-সাহিত্যে কিন্তু যথেষ্ট ইতিবাচক। আলবেনিয়ার মতো আর কোনো দেশের সাহিত্যে নারীরা এতোটা দেবীর মতো পূজিত হন না। আমার মনে হয় সাহিত্যও এ থেকে উপকৃত হয়েছে।
প্রশ্ন: নারীদের কথা যখন উঠলই, আপনার স্ত্রী হেলেনা, যিনি নিজেও একজন লেখক, আপনার জীবনে কেমন ভূমিকা পালন করেছেন?
কাদারে: তার সাহায্য ছাড়া লেখক হিসেবে দৈনন্দিনের কাজ কীভাবে চালাতে পারতাম জানি না। সে হচ্ছে আামর প্রথম পাঠক, আমার যেকোনো লেখা সম্বন্ধে প্রথম অভিমতটি তার। আমিসহ অনেক লেখকের কাছেই এ ব্যাপারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার সাহিত্যরুচিও অসাধারণ। এছাড়া আমার পাণ্ডুলিপি আগাগোড়া প্রস্তুত করা, কম্পিউটারে টাইপ করা, প্রথম প্রুফ দেখা, সম্পাদনা করাসহ বাকিসব কারিগরি কাজের কথা না-ইবা বললাম।
প্রশ্ন: গতবছর একজন মহান আলবেনীয় নারী, মাদার তেরেসাকে ভ্যাটিকানে সেইন্টহুড দেওয়া হয়েছে। আপনার মন্তব্য?
কাদারে: আমার উত্তর কী হবে নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারেন? স্বভাবতই আমি গর্বিত। সেইসঙ্গে এ-ও বলি, কমিউনিজমের দিনগুলোতে এ ব্যাপারটার নাটকীয় একটি মাত্রা ছিল। সারা দুনিয়া যেখানে তাঁকে শ্রদ্ধা করত, সেসময় দুটো কারণে আলবেনিয়ায় তাঁর কথা কেউ বলত না। প্রথমত, তিনি ছিলেন ধার্মিক, দ্বিতীয়ত, তাঁকে পশ্চিমা দুনিয়ার অংশ বলে মনে করা হতো। চাপটা এতো বেশি ছিল যে, বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও পরিবারের সাথে দেখা করতে বা আপনজনের কবরে ফুলের একটা তোড়া রাখতেও আলবেনিয়ায় আসার অনুমতি দেওয়া হয়নি তাঁকে।
প্রশ্ন: কমিউনিজমের সময়গুলোর কথা বাদ দিলে, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার জন্য আলবেনিয়া বিশ্বের অনন্য দেশগুলোর একটি। ধর্মের প্রতি তাদের মনোভাব আলাদা এবং নির্দিষ্ট কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে নিজেদের চিহ্নিত করে না তারা। এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
কাদারে: এটি সত্যি। এবং এটি আমাকে গর্বিত করে। সেই সঙ্গে এ-ও বলি, আমরা বলকানের মানুষেরা এ নিয়ে খুব সহজে বড়াইও করি। খুব ঈর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য বলব না এটাকে, তবে আলবেনীয়দের এ নিয়ে গর্ব করার অধিকার আছে। ব্যাখ্যাটা একটু জটিল। বিভিন্ন জাতির ইতিহাসে সর্বধর্ম-সমন্বয় খুব দুষ্প্রাপ্য বস্তু। ইতিহাসের নানা পর্বে আলবেনীয়রা এটি করে দেখিয়েছে। অটোমান দখলদারিত্ব, দখলদারিত্বের অবসান, আলবেনীয় রাজতন্ত্র, ফ্যাসিজম এবং এমনকি বিস্ময়করভাবে, কমিউনিজমের সময়ও, যখন সহনশীলতা জিনিসটা চিরকালের জন্য আলবেনিয়াকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল বলে মনে হয়েছিল। অন্য যে বৈধ অহংকারটি আমরা করতে পারি সেটি হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ নানা সময়ে ইহুদিদের সুরক্ষা দেওয়া।
প্রশ্ন: আপনি কি জানেন যে বার্লিনে ২০১৪ থেকে আলবেনীয় আলোকচিত্রী রফিক ভাসেলির নামে একটি স্কুল আছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যিনি দু’টি ইহুদি পরিবারকে রক্ষা করেছিলেন?
কাদারে: জানতাম না। আপনার কাছ থেকে জানলাম। অবশ্যই এটি আনন্দের বিষয়।
প্রশ্ন: জার্মানি কখন ভ্রমণ করেছিলেন? জার্মান রাষ্ট্র সম্বন্ধে আপনার অভিমত?
কাদারে: আলবেনিয়ার ইউরোপে ফেরত আসার পর থেকে সেখানে জার্মানির উপস্থিতি আছে। প্রথম ইউরোপীয়-আলবেনীয় রাজবংশটি জার্মান। দুঃখজনকভাবে, ইউরোপে আলবেনিয়ার অন্তর্ভুক্তির প্রথম ধাপটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে বিঘ্নিত হয়। নাটকীয়ভাবে আলবেনীয় রাজতন্ত্রের পতন ঘটলে আলবেনিয়া জার্মান-ইতালী অক্ষশক্তির অন্তর্ভুক্ত ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপরতো কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার সুপরিচিত গল্পের শুরু, যে পর্বে কমিউনিস্ট শিবিরের সঙ্গে গভীর প্রেম ও চরম শত্রুতা দুটোই আমরা দেখেছি। এরপর এলো চিনাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব আর শত্রুতা এবং আলবেনিয়ার দুঃখজনক বিচ্ছিন্নতা এবং অবশেষে কমিউনিজমের পতন। পুরোটা সময় জুড়ে পশ্চিম জার্মানি ছিল একমাত্র পশ্চিমা দেশ যেটি কমিউনিজমের প্রতি আলবেনীয়দের বৈরিতাকে কাজে লাগিয়ে একে ইউরাপের দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে। স্ট্রস (ফ্রাঞ্জ জোসেফ স্ট্রস, জার্মান রাজনীতিবিদ) যে মিশন নিয়ে নেমেছিলেন সেটি আসলে অসম্ভবই ছিল। কারণ আলবেনিয়া তার সাবেক কমিউনিস্ট বন্ধুদের শত্রু হয়ে গেলেও আদতে ছিল তাদের চেয়েও বেশি স্টালিনিস্ট। এ ব্যাপারটা বোঝা সহজ ছিল না। এদিকে ‘জার্মান সুযোগ’ নিয়ে এক ধরনের আশা ছিল আলবেনীয়দের মধ্যে। সব সময়ই পশ্চিম জার্মানিই ছিল এ আশার কেন্দ্রবিন্দু। সেদেশে বই প্রকাশের সূত্রে দুই বা তিনবার ভ্রমণ করেছি ‘পুঁজিবাদী জার্মানি’তে। অথচ প্রথমবার বার্লিনে ঢুকেছিলাম কিছুটা গোপনেই। একথা নিশ্চিত বিশ্বাস নিয়েই বলতে পারি, আলবেনিয়ায় জার্মান ও জার্মানিকে নিয়ে মনোভাব সবসময়ই ইতিবাচক। এটি হয়তো অংশত জার্মান বিজ্ঞানীদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধের কারণে, যেহেতু তারা আলবেনীয় ভাষা নিয়ে আলবেনীয়দের চেয়েও গভীর ও আন্তরিকভাবে ভেবেছেন। আলবেনীয়রা তাদের ভাষাকে কতটা ভালোবাসে এবং রীতিমতো পবিত্র জ্ঞান করে সে ব্যাপারটি না বুঝলে কৃতজ্ঞতার এ ব্যাপারটিও বুঝবেন না।
প্রশ্ন: আপনার অসাধারণ কৌতুহলী মানসিকতার জন্য ধন্যবাদ। একটা প্রশ্ন দিয়ে শেষ করি। বছরতিনেক আগে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান কসোভো গিয়ে সেই দেশকে ‘কসোভো তুরস্ক’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত?
কাদারে: তাঁর মন্তব্যটি শুনেছিলাম। কেবল এটাই বলতে পারি, খবরটি যখন প্রথম পড়েছিলাম, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি।