মঞ্চে সিলেটের অনেক গুণী মানুষ ছিলেন, কিন্তু সকলেই ম্লান হয়ে গেলেন, পাদপ্রদীপের সবটুকু আলো এসে পড়ল কবি হেলাল হাফিজের উপর।
Published : 15 Dec 2024, 03:46 PM
বলা হয় একজন কবির একটিমাত্র পঙক্তি যদি মহাকালে টিকে যায় তবে সে কবিজীবন সার্থক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্রের সেই বিস্মরণঅযোগ্য পঙক্তি 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে'। কিংবা আবদুল হাকিমের বহুলশ্রুত পঙক্তি 'যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।' মহাকাল নির্দয়। সে মনে রাখে না অযুত নিযুত কবিকে, কালের গর্ভে হারিয়ে যায় অজস্র কবি ও তাদের বিপুল কাব্যপ্রচেষ্টা ও কাব্যসম্ভার। অনস্বীকার্য যে সেসব রচনার উৎকৃষ্ট অংশ জমা হয় সাহিত্যের ইতিহাসে, তৈরি করে সাহিত্যের ঐতিহ্য। তবে লোকমুখে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন একটি বা দুটি পঙক্তি।
ষাটের দশকের মিটিং, মিছিল, গণআন্দোলনের উত্তাল সময়ে সেই দশকেরই কবি হেলাল হাফিজ লিখলেন দুটি অবিস্মরণীয় পঙক্তি, “এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।" ছাত্রদের মিছিলে মিছিলে শ্লোগানে শ্লোগানে উচ্চারিত হলো, দেয়ালে দেয়ালে উৎকলিত হলো সেই দুটি বিদ্রোহ জাগানিয়া, সাহস জাগানিয়া দ্যুতিময় লাইন। তার রচয়িতা হেলাল হাফিজ হয়ে উঠলেন বিখ্যাত, ক্রমে ক্রমে মহীরুহ, জীবন্ত কিংবদন্তি। যে কবিতার সমাপ্তি ওই দুটি অসামান্য পঙক্তি সেই 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ হয়ে উঠল বাংলা ভাষায় সর্বাধিক পঠিত কবিতার একটি, ‘যে জলে আগুন জ্বলে' নামের কাব্যগ্রন্থ সর্বাধিক বিক্রিত কাব্যগ্রন্থ। বস্তুতঃ বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কোনো কবিতার বইয়ের এত সংস্করণ প্রকাশিত হয়নি, এত সহস্র কপি বিক্রি হয়নি। প্রতি বইমেলার সর্বাধিক বিক্রিত গ্রন্থতালিকায় বছরের পর বছর থেকেছে 'যে জলে আগুন জ্বলে'। কবিতার প্রতি পাঠকের আগ্রহ কমলেও, 'যে জলে আগুন জ্বলে'র প্রতি কমেনি।
'যে জলে আগুন জ্বলে'র অভাবনীয় সাফল্যের পর হেলাল হাফিজের অগুণিত ভক্তপাঠক প্রতি বইমেলায় অপেক্ষা করতেন তার নতুন কাব্যগ্রন্থের। বছরের পর বছর গড়িয়েছে, তিনি হতাশ করেছেন ভক্তদের, তাঁর নতুন কাব্য প্রকাশিত হয়নি। 'কেন তিনি আর লিখছেন না'— এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খেত ভক্তদের মাথায়। এ প্রশ্ন ছিল আমারও এবং সেটি জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেয়েছিলাম একবারই। লিটল ম্যাগাজিন 'ভাস্কর' এর রজতজয়ন্তী এবং এর সম্পাদক পুলিন রায়ের জন্মের সুবর্ণজয়ন্তীতে ‘পঞ্চাশে পুলিন, পঁচিশে ভাস্বর’ অনুষ্ঠানে কবি হেলাল হাফিজ ও আমি আমন্ত্রিত হয়ে সিলেটে গিয়েছিলাম। তিনি ছিলেন প্রধান অতিথি, আমি বিশেষ অতিথি। আয়োজকরা আমাদের একই হোটেলে রেখেছিলেন। হোটেল থেকে অনুষ্ঠানস্থলে যেতে যেতে তাঁর সাথে আলাপচারিতার একটি সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলাম। তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন তা আমার অনুমানের সাথে মিলে গিয়েছিল। প্রথম কাব্যগ্রন্থ পাঠকপ্রত্যাশার যে চূড়ায় গিয়ে চড়েছিল তাকে অতিক্রম করতে পারবেন কিনা— তা নিয়ে গভীর সংশয় ছিল কবির। প্রথম অভিযানেই এভারেস্ট জয় করার পর যা হয়, এরপরে অভিযাত্রী যা কিছু অতিক্রম করবেন তা এভারেস্ট থেকে নিচু শৃঙ্গ। ওই সংশয়ের সাথে মিশেছিল সুগভীর আলস্য।
তবে আরেকটি বিষয় সুস্পষ্ট। তিনি বাহুল্য নয় পরিমিতিতে; সংখ্যায় নয়, গুণগত মানে বিশ্বাস করতেন। সেই বিস্ফোরক কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। প্রথম কাব্য প্রকাশিত হয় এর ১৭ বছর পরে ১৯৮৬ সালে। স্বাধিকারের দাবীতে গণঅভ্যুত্থান থেকে স্বৈরাচারী শাসনের মধ্যকাল পর্যন্ত সময়টি তিনি নিয়েছিলেন প্রেম ও দ্রোহের মিলিত আগুনে কবিতাগুলোকে পুড়িয়ে খাটি করে তুলতে। এরও ২৬ বছর পরে ২০১২ সালে তিনি যে দ্বিতীয় কাব্য উপহার দিলেন সেই ’কবিতা ৭১’ 'যে জলে আগুন জ্বলে' গ্রন্থের ৫৬টি কবিতার সাথে নতুন কয়েকটি কবিতা সংযুক্ত করে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি নিজে একথা আমাকে বলেছিলেন। ২০১৬ সালে আমি যখন তাঁর সাথে আলাপ করছিলাম তখন পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত কাব্য বলতে ওই সবেধন নীলমনি ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ আর তার সাথে সংযোজিত কিছু নতুন কবিতা। তাঁর তৃতীয় ও সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ মুঠোফোনে লিখিত দুই পঙক্তির কবিতা নিয়ে গ্রথিত ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। সমগ্র কাব্যজীবনে কেবলমাত্র তিনটি কাব্য, মূখ্যত যা একটিই, প্রকাশ করে খ্যাতির অতখানি চূড়ায় ওঠাও এক বিরল ঘটনা।
সিলেটের সেই অনুষ্ঠানেই দেখেছিলাম কী বিপুল জনপ্রিয় তিনি। মঞ্চে সিলেটের অনেক গুণী মানুষ ছিলেন, কিন্তু সকলেই ম্লান হয়ে গেলেন, পাদপ্রদীপের সবটুকু আলো এসে পড়ল কবি হেলাল হাফিজের উপর। জীবদ্দশায় অমন কিংবদন্তি হয়ে ওঠা খুব কমজনের ভাগ্যেই ঘটে।
কবি হেলাল হাফিজের জন্ম দেশবিভাগের পরের বছর নেত্রকোণা জেলার আটপাড়া উপজেলার বড়তলি গ্রামে। তিনি নেত্রকোণা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই শুরু করেন সাংবাদিকতা এবং পরবর্তী কালে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রধানত সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। কবিতায় সাধনা ও কৃতির জন্য লাভ করেছেন আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ বেশ কিছু পুরস্কার। তিনি মূলত নিভৃতচারী ছিলেন। প্রচারণা থেকে ডামাডোল থেকে দূরে থাকতেন।
দুঃখ যে তাঁর সাথে আমার খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। পরিচয় রূপলাভ করেনি ঘনিষ্ঠতায়। কয়েকবছর আগে একবার প্রেসক্লাবে তার সাথে ক্ষণিক আড্ডা দেবার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে ছিলেন আরও দুই হাফিজ— হাসান হাফিজ ও মাহমুদ হাফিজ। তিন হাফিজকে লোকেরা তিন ভাই বলে মনে করতো তা কেবল নামের ওই মিলের জন্য নয় কিংবা তারা তিনজনই কবি বলে নয়, বরং হৃদয়ের অভূতপূর্ব মিলের জন্য। আপন তিন ভাইয়ের মতোই ছিলেন তিন হাফিজ। অগ্রজ হাফিজের অসুস্থতার সংবাদ পেলেই অনুজ দুজন ছুটতেন। তারা তিনজন ছিলেন ষাট, সত্তর ও আশি— তিন দশকের প্রতিনিধি।
দূরে থেকে তাঁর বহুবর্ণিল জীবনের গল্প শুনতাম। ধরাবাঁধা জীবনকে তিনি অগ্রাহ্য করেছিলেন। জীবন নিয়ে জুয়া খেলেছেন। কবিতার জন্যই কিনা নাকি অন্য কোনো বেদনায়- আজীবন বিয়ে করেননি। এক অর্থে তিনি নিঃসঙ্গ জীবনই কাটিয়ে গেলেন। সুদর্শন কবির জীবনে প্রেম এসেছে বারংবার, কিন্তু রূপবতীদের কাউকেই তিনি বিবাহের বন্ধনে জড়াননি। এই নিঃসঙ্গতা নিশ্চয়ই কখনো কখনো তীব্র ছিল। পা পিছলে বা মাথা ঘুরে তিনি যে বাথরুমের মেঝেতে অচেতন পড়ে রইলেন আর মারা গেলেন রক্তক্ষরণে, এটা হয়তো ঘটতো না যদি তার সঙ্গে কেউ থাকতেন। কী এক অন্তর্গত বেদনা নিয়ে প্রেম ও দ্রোহের কবি চলে গেলেন, তাঁর বেদনায় ভক্তকূল এখন কাঁদছে।
যতদিন মিছিলে শ্লোগান উচ্চারিত হবে, যৌবনের মতো একটি আশ্চর্য টগবগে বয়সে এসে পৌঁছাবে মানুষ ততদিন উচ্চারিত হবে সেই অবিস্মরণীয় পঙক্তিদ্বয় ”এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।" উনসত্তরে যিনি যুদ্ধে যাবার আগাম আভাস জাগিয়েছিলেন তিনি নিশ্চয়ই ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা। স্বাধীনতার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধের ইঙ্গিতবাহী পঙক্তিদ্বয় তাকে তুলে নিবে ইতিহাসে। নিয়েছেও। অমরত্বের সন্ধান বেশিরভাগ মানুষই পায় না, এ কবি পেয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন, স্মৃতি ও কবিকৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।