Published : 19 May 2024, 08:45 PM
আজ ১৯শে মে, আমি কানাডায় আসার ২৪ বছর দুইদিন পরে কোন বাঙালি শিল্পীর গান শুনতে যাচ্ছি।
তিনি তপন চৌধুরী। মন্ট্রিয়লে আজ তপন চৌধুরীকে নিয়ে বসবে এক অন্যরকম আয়োজন। নর্থ আমেরিকার বিভিন্ন কোন্ থেকে অসংখ্য শিল্পী আসছেন তার সামনে তার গান গেয়ে তাকে সম্মান জানাতে। আসছেন বাংলা ছড়ার দিকপাল লুৎফর রহমান রিটন, আসছেন বাংলা গানের আর এক কিংবদন্তী আমাদের বাউল-মনের শিল্পী মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমাম।
গান শোনা আমার একমাত্র নেশা, যার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আমাকে ছবি আঁকতে সাহায্য করে। আমি মদ খেয়ে ছবি আঁকতে পারি না, আমি গাজা খেলে ঘুমিয়ে পড়ি! তাই নেশার একমাত্র নস্যি গানকে আমি নাকে নয়, হৃদয়ের নিঃশ্বাসে টেনে নেশা করি।
ছবি আঁকতে আঁকতে গানের নেশায় আমি এ্যাডিক্টেড, আমার মাথার ভিতরে গানের সংগ্রহও বিশাল। আমি আজ রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনলে আগামীকাল আফ্রিকান কোরা মিউজিক শুনি। কোরা প্রথম শুনেছিলাম সোনা জেবার্থের কন্ঠে লন্ডনে। গাম্বিয়ার এই শিল্পী কোরা ক্লাসিকালের পারিবারিক আবহ থেকে বেড়ে ওঠা, তার অপূর্ব গায়কী আমাকে গভীর আন্দোলিত করে।
গান শোনায় আমি অকৃপণ, পঞ্চ কবির গানের সম্ভারে কতো ছবি এঁকেছি, গান ছবিতে এসে কীভাবে যেন বসে যায়, এই অনুভূতি আমার ছবি আঁকতে পারার এক আনন্দসঙ্গী।
আমি যখন ছবি আঁকি, হঠাৎ যদি মনে হয় পাথরঘাটা থেকে চিলমারী বন্দরে পৌঁছাতে হবে এবং এখনই, ব্যাপারটা আসলে মাথার ভিতরে আচমকা একটা জার্নি সৃষ্টি করা! ছবি আঁকতে আঁকতে মাথার ভিতরে এই যে মুহূর্তে ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চিলমাড়ি পৌঁছাই, এ কেবল গানের যানেই সম্ভব। আমার নিজস্ব গানের ডালা আছে, ইংলিশ গান শুনে জিপসি শুনি, জিপসি ছেড়ে বাউল গান, এমন করে আমি গান শুনে নিজের বিশাল এক জগৎ সৃষ্টি করে রেখেছি।
গান আমার ছবি আঁকার নিত্য সঙ্গী। রঙের প্যালেট এবং ক্যানভাসে ব্রাশের সম্পর্ক, গান এসে এই সম্পর্কে হৃদয় ঢেলে দেয়, আমি গানের ভেলায় ফ্রেম করে ফেলি একটা নতুন কম্পোজিশন। আমার গানের শ্রবণ বড়ই অদ্ভুত, পৃথিবীর সকল গানে আমার মনের পাগলপনা জেগে ওঠে। আমার প্রতিটি ছবিতে সঙ্গিতের এফেক্ট আছে। শৈশবে প্রথম গান শুনেছিলাম রবীন্দ্র সঙ্গীত, আমার মেজ বোনের বান্ধবীর কন্ঠে। ‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ’ সম্ভবত রবীন্দনাথই আমাকে কান ধরে বাংলা গানের একটা মন তৈরি করে দিয়েছিলেন। কেননা, গানে আমি দেহে নাচতে পারি না, কিন্তু মন আমার নাচে, মন আমার গানের পাগল।
প্রতিটি জীবনে গান শোনার স্মৃতি আছে, প্রথম কবে কোথায় কোন গানটি শুনেছিলাম, আমাদের সবারই জীবনে তা উজ্জ্বল হয়ে আছে। মান্না দে, হেমন্ত, সন্ধ্যা-লতা, সতীনাথ-তালাত, আর জগন্ময় মিত্র – এদের গান শুনে জেনেছি প্রেম কী গভীর এবং হৃদয়ের টানে ছবি হয়! বাংলা গান আমার মায়ের মুখ, বাবার নিঃস্বার্থ জীবনের ঘামের মন-বিসর্জন, বাংলা গান আমার আদরের ছোটবোন! রানার, রানার ছুটেছে চিঠি নিয়ে, বাংলা গান চিঠিতে আসা বুকের গোপন ভাষা, বাংলা গান এক বৈশাখে দু’জনের দেখা হওয়ার নারী-পুরুষের আদিম প্রেম।
গান শোনা আমার থামে না, আজ শাহ আব্দুল করিম তো কাল হাসন রাজা, আজ লালন তো কাল প্রতুল-ভুপেন হাজারিকা! গান কি শুধু কন্ঠ! সেতার– বাঁশি, তবলা-বেহালা, মন ডুবে যাওয়া এই সুরের যে স্রোতধারা, আমরা সঙ্গীতে কেমন ডুবে যাই। আজ যদি সত্তুর-আশি দশকের বাংলা ছায়াছবির মন মাতানো গান শুনি, পরক্ষণেই আমাদের কানে বেজে ওঠে আশি দশকের বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের যাদুর গিটার। ব্যান্ড সঙ্গীত যখন আমাদের গানের নতুন জোয়ার নিয়ে এলো, তপন চৌধুরী ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয়দের একজন, আদতে তাকে বলতে হবে বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীত জনপ্রিয় করার প্রধান পথিকৃত। জনপ্রিয় ব্যান্ড সোলসের সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন তিনি। তার কোন গানটি আমার সবচেয়ে প্রিয় এই কঠিন জিজ্ঞাসায় নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তর ঠিক করতে পারি না। তার গাওয়া অসংখ্য গান বাংলাদেশের স্রোতাদের পাগল করেছে, আমিও তার গান শুনি।
তার গান নিয়ে আমার একটি চমৎকার স্মৃতি আছে। একদিন নিস্তব্ধ দুপুরে ছবি আঁকছি, ইউটিউবে তার একটি এ্যালবাম বাজিয়ে দিলাম, বেজে উঠলো ‘শত বরষার জল’, দু’দিন ধরে যে ছবি আঁকছিলাম গান শুনতে শুনতে ফিগারের রঙ বদলে যাচ্ছিলো, লাল-হলুদের উষ্ণ তাপমাত্রা হারিয়ে গেল, নেমে এলো মন খারাপের প্রগাঢ় কালচে-নীলের জীবনের জল! তপন চৌধুরী মনের রঙ বদলে দেয়ার শিল্পী। গান এবং ছবির রঙ বদলের এই শিল্পধারা আমি উপভোগ করি। এই রঙ নিয়েই আজ সারা সন্ধ্যাটি তপন চৌধুরীর গানের ভেলায় ভাসবো।
এমন একজন শিল্পীকে সম্মান জানাতে পারা স্রোতাদের জন্য সৌভাগ্যের, শিল্পী গান গেয়ে নিজের জীবন পরিপূর্ণ করে তুলতে চেষ্টা করেন, তার গায়কীর আনন্দ তিনি উপভোগ করেন, স্রোতারাও যে উপভোগ করেন তা তাকে সম্মান জানিয়েই প্রমাণ করতে হয়।
দীর্ঘ সময় বাংলা গানের যে ধারায় শিল্পী তপন চৌধুরী নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, আমাদের আবহমান বাংলার হৃদয়ে চিরদিন পলাশ ফুটবে শিমুল ফুটবে এবং বুকের ভিতরে তার গানও সবার স্মৃতিতে নড়ে উঠবে।