বিনয় সরকারের চোখে `যুগ-প্রবর্তক’ নজরুল

চিন্তানায়ক ও ভাবুক বিনয় সরকারের মূল্যায়নকে অনুসরণ করে বা তার মূল্যায়নকে চ্যালেঞ্জ করে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কবি লেখকদেরকে খুব একটা মন্তব্য করতে দেখা যায়নি কখনো। তারা নজরুলকে যেমন উপেক্ষা করেছেন, তেমনি বিনয় সরকারের নজরুল-মূল্যায়নকেও উপেক্ষা করেছেন।

রাজু আলাউদ্দিনরাজু আলাউদ্দিন
Published : 25 May 2023, 07:08 AM
Updated : 25 May 2023, 07:08 AM

বাংলার অসামান্য প্রতিভা, বহুভাষাবিদ, বহু শাস্ত্রে যার পাণ্ডিত্য মুগ্ধ করার মতো, সেই বিনয় সরকার কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশের পরের বছরই ‘চরম তারিফ’ করেছিলেন তার রচিত এবং ১৯২২ সালে বার্লিন থেকে প্রকাশিত ফিউচারিজম অব ইয়ং এশিয়া নামক বইটিতে। সম্ভবত এটিই ছিল অন্য ভাষায় বিদ্রোহী কবিতার প্রথম স্বীকৃতি। বিনয় সরকারের মতে “ নজরুল আধুনিক বাংলা কাব্যের যুগ-প্রবর্তক।” ( পৃ--৩৯২) শুধু কবিতাই নয়, বিনয় সরকারের কাছে নজরুলের গানেরও মূল্য ছিল অসীম। তিনি মনে করতেন, “ সুর-শিল্পী নজরুল বাঙালী-সমাজে অমর। ... সকল দিক থেকে নজরুল-গীতাবলী বঙ্গ-সাহিত্যের অপূর্ব সৃষ্টি।” (পৃ-৩৯৩-৯৪)

বিনয় সরকারের কাছে নজরুল ইসলামের গুরুত্ব এতটাই ছিল যে বিনয় সরকারে বৈঠকে ( প্রথম খন্ডে) নামক বইটিতে নজরুলের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রায় ৫০ পৃষ্ঠাব্যাপী আলোচনা করেছেন। এছাড়াও বইটির উভয় খন্ডে বিভিন্ন প্রসঙ্গে বহুবার উল্লেখিত হয়েছেন নজরুল।

নজরুল ইসলাম লেখক হিসেবে আবির্ভাবের পর থেকে আজ পর্যন্ত ব্যাপকভাবে আলোচিত যেমন, তেমনি উপেক্ষিতও তিনি। একদিকে পশ্চিমবঙ্গের লেখক বুদ্ধিজীবীদের প্রচ্ছন্ন সাম্পদায়িকতার কারণে যেমন উপেক্ষিত, তেমনি বাংলাদেশে মুসলিমপ্রীতির আতিশয্যের কারণে অতিমূল্যায়িত। কিন্তু এসব অতিমূল্যায়নে সত্যিকারের নজরুল উন্মোচিত হয়েছেন খুব কমই। বিনয় সরকারের মতো বহুভাষী ও বহুবিদ্যায় পণ্ডিত মানুষটি সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বাইরে গিয়ে নজরুলের সত্যিকারের অবদানকে তুলে ধরেছেন তার বৈঠকে বইটিতে। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নিয়ে সমসাময়িক কবি গোলাম মোস্তফা কিংবা সজনীকান্ত দাস ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করছেন, এমনকি হুইটম্যানের অনুকরণকারী বলে তার গুরুত্বকে হীন করার চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু বিনয় সরকার হুইটম্যানের চেয়ে কোথায় এবং কিভাবে নজরুল আলাদা তার এক যথার্থ মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন। ‘বিদ্রোহী’তে বিদ্রোহটা কোথায়? এই কৌতূহলের জবাবে তিনি বলেছেন, “ বিদ্রোহ প্রথমতঃ মালে, দ্বিতীয়তঃ ভাষায়, তৃতীয়তঃ ছন্দে।” (পৃ- ৩৯৮) এই কবিতার মাধ্যমে নজরুল যে এক বিস্ময়কর অর্জনকে তুলে ধরেছেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “ “ বিদ্রোহী” দেখবামাত্র নজরুলের ভেতরে আমি হুইটম্যান আর রবীন্দ্রনাথ দুজনকে এক সঙ্গেই পাকড়াও করেছিলাম। তবুও বুঝে নিলাম লেখক বাপকা বেটা। বিংশ শতাব্দীর প্রথম কুরুক্ষেত্রের পরবর্তী অন্যতম যুগ-প্রবর্তক বাঙালীর বাচ্চা নজরুল।” ( পৃ- ৩৯৯) ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ছন্দের অভিনবত্বটা কোথায়? তারও ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন প্রাঞ্জল ভাষায়: “ “বিদ্রোহী”র সমান লম্বা কবিতায় রাবীন্দ্রিক “সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ে”র কিম্বা “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গে”র ছন্দ সত্যেনও দেখাতে পারে নি। এইখানেই নজরুলের বিশেষত্ব। আগেই বলেছি, রাবীন্দ্রিক ছন্দটাও বেশ চড়া হারে চেঁড়ে তোলা হয়েছে “বিদ্রোহী”তে। (পৃ-৪০০) ‘বিদ্রোহী’ কবিতার বিশেষত্ব নিয়ে আরও বহু কথা বলেছেন। কিন্তু বিনয় সরকারের চূড়ান্ত মূল্যায়ন হচ্ছে, “ “বিদ্রোহী” হচ্ছে ব্যক্তির উপনিষদ। ব্যক্তিত্ব এই কবিতার বেদান্ত।”(পৃ-৪০০)

শুধু তাই নয়, বিনয় সরকারের আলোচনায় আমরা নজরুলের এক সামগ্রিক মূল্যায়নই দেখতে পাই। তিনি বলেছেন, “নজরুলের মতো ষোল আনা বাঙালীর বাচ্চা বাঙলা সাহিত্যের গৌরব।” (পৃ-৩৯৭)

কেন তিনি গৌরব, তার ব্যাখ্যা কেবল নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাতেই সীমাবদ্ধ নয়। ভালোবাসার কবি হিসেবেও যে নজরুলের এক বিশেষ অবস্থান আছে, বিনয় সরকার সেই দিকে আমাদের মনোযোগ ফিরিয়ে দিয়ে বলেছেন: “ বাঙালী জাতের আবহাওয়ায় নজরুলের পক্ষে ভালোবাসার কবি হওয়া খুবই বাহাদুরির কাজ। অতিমাত্রায় বেহায়া আর ঠোঁট-কাটা না হলে নজরুলের পক্ষে অনেক কবিতাই প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। এই হিসাবে নজরুল বিপ্লবী। নজরুলকে দেখে হয়তো অনেক বাঙালীর ভয় ভেঙেছে বা ভাঙছে। নজরুলের প্রেম-সাহিত্যকে বঙ্গ-কাব্যে মানবিকতা বা মানব-নিষ্ঠার পথ-প্রদর্শক বলতে পারি।” (পৃ- ৪২৫) চিন্তানায়ক ও ভাবুক বিনয় সরকারের মূল্যায়নকে অনুসরণ করে বা তার মূল্যায়নকে চ্যালেঞ্জ করে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কবি লেখকদেরকে খুব একটা মন্তব্য করতে দেখা যায়নি কখনো। তারা নজরুলকে যেমন উপেক্ষা করেছেন, তেমনি বিনয় সরকারের নজরুল-মূল্যায়নকেও উপেক্ষা করেছেন। আজকের ভারত ও বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও রাজনীতি যে-সাম্প্রদায়িক ঘুর্ণাবর্তের মধ্যে পরেছে তার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ আমাদের অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদেরকে উপেক্ষা। আমরা যদি তাদেরকে চর্চায় ও আমলে রাখতে পারতাম তাহলে আজকে এই পরিণতি হতো না। তৎকালীন ভারতের সংস্কৃতির প্রধান আধি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নজরুল ইসলাম যে-লড়াইটি করেছিলেন তার গুরুত্ব এখন আমাদের কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নজরুল এসবের উর্ধে উঠে অবিভক্ত ভারতবাসীকে বিশ্ববোধে উজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন। নজরুলের এই ভূমিকার কথা বিবেচনা করেই বোধহয বিনয় সরকার বলেছিলেন: “ আজ নজরুলকেও বিশ্বশক্তির বেপারীরূপে হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সম্বর্ধনা করা উচিত। তা হলে বুঝবো,--বাঙালীর বাচ্চারা লিখিয়ে-পড়িয়ে লোক।” (পৃ-৪২৬) নজরুলের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে সবশেষে তিনি যা বলেছিলেন-- আমি মনে করি--তা আমাদের জন্য আজও প্রাসঙ্গিক: “ চৌদ্দ-আঠার বছর বয়সের ছেলেমেয়েরা নজরুলের অ-ধর্মে দীক্ষিত হতে থাকুক। বাঙলা দেশে মানুষ গড়ে উঠবে। (পৃ-৪৩৭)